আজকাল আর কোন কিছুই স্পর্শ করে না। অনুভূতিরা অনুগত থাকছে না অহর্নিশ। ভোতা হয়ে যাওয়া উপলব্ধি শৈশবের প্রতিবাদী মননটা খুন করছে অকপট। কেন এমন হচ্ছে? সাইকো এনালিস্টদের থিওরিতে নির্মোহ বিচার হাজির থাকছে আজ।
সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা এজন্য ট্রানজেশন টাইম থিওরি দিচ্ছেন। কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক ড. নেহাল করিম বলছিলেন, গত একদশক ধরে উত্তরণের যে ধাপ পেরোচ্ছি আমরা তাতে 'উন্নয়ন' শব্দটি গভীর রেখাপাত করেছে আমাদের জীবনে। একদিকে সূচকের খেল, অন্যদিকে বাস্তবতার চরম বৈপরিত্য! আমরা বস্তু আর ভোগের জন্য লুটপাটে ব্যাস্ত অথচ মানবিক গুনাবলি আর জ্ঞানভিত্তিক সমাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। তাই অজান্তেই সয়ে যাচ্ছে সব।
বাঁক বদলের যে দিকটা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানিরা অনাদী কথা বলছেন তা হলো, মনুষত্ব, কর্তব্যবোধ, ন্যায়পরায়নতা এবং সুবিচার। যদিও স্যাপিয়েন্সের তিন লক্ষ বছরের জার্নি কখনোই এ ধারায় ছিল না; তথাপি সমাজ চিন্তকরা সে দিকেই চোখ ফেরাতে বলছেন। কেননা অন্য সামাজিক জানোয়ারের ব্যতয়ে মানুষ ভালো-মন্দের তফাৎ করে থাকে। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, কেউ পাবলিক প্লেসে বা বাসে যে কোন অশোভন আচরণের তীব্র প্রতিবাদ করতো আশপাশের মানুষ। সামাজিক আর রাষ্ট্রীয় অবিচারে তো রীতিমত রাজপথে নেমে আসার উদাহরণও আছে, কিন্তু কী এমন ঘটলো আমাদের জীবনে যে মাত্র দুই দশকেই উত্তুঙ্গের বাঙালি তার যুক্তি তর্ক হারিয়ে অর্বাচীনে রূপান্তরিত হলো! এই বিবর্তন তো ডারউইন তত্ত্বকেও হার মানাচ্ছে।
সমাজ ও মনস্তত্ত্ববিদরা এই ভাবনাকে এবং গা সয়ে যাওয়ার এই প্রবনতাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলছেন না। এককথায় তারা একে অবক্ষয় হিসেবে প্রতীয়মান করছেন। অবক্ষয়ের বিষয়টি বলা হলে অনেকের কাছে তা গালভরা শোনায়, কারণ অবক্ষয় হচ্ছে সেটা কেউ অস্বীকার করছে না; কিন্তু কেন হচ্ছে সে প্রশ্নটা জোরেশোরে উঠছে না। দিন গুজরান আম আদমিকে সে ভাবনার দিকেই ঠেলে দিচ্ছেন চিন্তাশীল মানুষ।
সামাজিক নিগ্রহের দিকটি ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে এটি একদিনে গড়ে ওঠেনি। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ একসাথে কাজ না করলে নিগ্রহের যাতা ঘুরতে পারে না। কাজেই কারণগুলো জানা দরকার। তার আগে প্রয়োজন এই সাইলেন্ট কিলিং প্রসেস চিনতে পারা। এমন নানাবিধ সংকট থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা কয়েকটি পর্যায় চিহ্নিত করেছেন মানুষের চামড়া মোটা হয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে।
১। সংবেদনশীলতা হ্রাস- অন্যায় যখন হয় তখন আশপাশের মানুষ অজান্তে নিজেকে সেফজোনে নিয়ে যায়। কী করতে হবে সেটা যেমন বুঝে ওঠে না আবার বুঝে উঠলেও নানা পিছুটানে বিপদাপন্ন মানুষের দিকে এগিয়ে যায় না। ভয় এবং দ্বিমতচারতিা তার ডিফেন্স ম্যাকানিজম হয়ে দাড়ায়। ধীরে ধীরে সে তার সংবেদনশীলতা হারায়। বিজ্ঞানীরা এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে ভীতি দূর করার পরামর্শ দেন। যদি সাপ ভয় পায় কেউ তাহলে তাকে সাপের কাছে বারবার যেতে হবে। ভীতি কাটাতে এটাই কার্যকর ডিসেনসিটাইজ থিওরি।
২। মান নির্ণয়- কারও সাথে অন্যায় হলে আমরা আগে সামাজিক মূল্যায়নের দিকে যাই। দেখি সে হিন্দু, মুসলমান, নারী, পুরুষ বা নিদেনপক্ষে সমাজের কোন স্তরের মানুষ। তারপর যে নির্যাতন করেছে তার সামাজিক অবস্থান কী সেটা বোঝার চেষ্টা করি। এইসব বিবেচনায় আমরা ব্যক্তির কর্ম উপেক্ষা করি। যেখানে মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়নের অবকাশ হয় না। এতসবের পর সমাজের ব্যক্তিশ্রেণি তার সুবিধামত অবস্থান নির্ধারণ করে। এই যে আমরা ভেদাভেদ করছি, গণ্ডি কেটে চলেছি; আমরা মানুষকে শুধু মানুষ হিসেবে দেখতে পারছি না! এই প্রবনতা হন্তার সামিল।
৩। বৈধ্যতা- প্রেসক্লাবের সামনে গোটা পঞ্চাশ ‘মানুষ’ বসেছে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুতির প্রতিবাদ জানাতে বা সাঁওতালরা জমি থেকে উৎখাতের প্রতিবাদে অনশন করছে। কী মূল্য দিচ্ছি আমরা এই প্রতিবাদের? কেবলই নৈতিক সমর্থন। বলতে পারেন, এ ছাড়া ছাপোষা মধ্যবিত্তের আর কীইবা করার আছে? অথচ আজ সেখানে কোন একজন সেলিব্রেটি বা মিডিয়া ব্যক্তিত্ব গিয়ে দাড়াক, অমনি হৈচৈ পড়ে যাবে। আমরা অনেকেই চলে যাব একটি সেলফি তুলে পোস্ট করার আশায়। অর্থাৎ নিগ্রহের শিকার মানুষগুলোর আবেদনের ভ্যালিডেশন নাই। মিডিয়া বা সেলিব্রেটি কেউ না যতক্ষণ কোন বিষয়বস্তুর উপর আলো ফেলছে ততক্ষণ আমরা অন্যায় অবলোকনে ব্যর্থ! আবার এই মিডিয়া বা সেলিব্রেটিদের বানানো ঘটনাগুলো যখন আমাকে একের পর এক প্রতারিত করে (যেমনটা মা মারা যাওয়ার কথা বলে ভিক্ষুক মিথ্যা কথা বলে যখন দান হাতিয়ে নেয়, যার প্রেক্ষিতে অনেকেই প্রতারণার আশঙ্কায় দানই বন্ধ করে দেন) তখন আমি জেনে যাই কিছু মানুষের বানোয়াট আর মেকি আন্দোলন সম্ভব, হতে পারে জাগরণের কোন মঞ্চ এমনকি চোখে ঠুলি পড়ানো প্রবৃদ্ধির হরবাড়ন্ত। তখনই আসে চূড়ান্ত পর্ব- উপেক্ষা।
৪। উপেক্ষা- এই ডিনায়াল প্রসেসটা খুব মজার। সবাই জানে ঠিক না তারপরও একযোগে চর্চা করে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। অনেকটা সিগারেটের মত। জানি খুব খারাপ কিন্তু ছাড়তে পারছি না। এই যে দিনের পর দিন চোখ বন্ধ করে থাকা, আমরা মানি বা না মানি গা ঢাকা দেয়ার নিষ্ঠুর, বিধ্বংসী এই যুদ্ধে যতই চোখে পর্দা টেনে দিই, যতই বলি না কেন- এই বেশ ভালো আছি; আদতে আমরা ভালো নেই।
হ্যাঁ শব্দটা আমরা। অন্যের শিশু ধর্ষণের শিকার- এটা খবর মাত্র। প্রতিবাদহীন একটা রাষ্ট্রে যেন আমি ভাবতেই পারি না যে এটা আমার মেয়ের সাথে হতে পারে। এই না ভাবাটা কিংবা না ভাবতে চাওয়াটার পার্থক্যটাই রোমান্টিসিজমে বাঁচতে শেখায় মানুষকে। আপনাকে হাজার সত্য বলা হোক আপনি মানবেন না। কী ভাবছেন? ভাবছেন, আমি না মানলে তো এই প্রবলেমটা এগজিস্ট করে না! এই ধারণা থেকেই প্রমান হয় যে, সত্যের মুখোমুখি হওয়ার সাহস আমাদের নেই। এমন একটা সময় কোন এক রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে কেমন দম বন্ধ লাগে ঘরটা, গুমট হয়ে ওঠে চারপাশ। তখন কেবলই মনে হয়, হাসি হাসি মুখে এতদিন বাতাবিলেবু আর কাঠগোলাপের ছবি আপলোড দিয়ে যে হাসিমুখের ফেসবুকে ‘ভালো আছি’ রিপ্রেজেন্ট করে এসেছি তা মিথ্যা, বানোয়াট। আমরা ট্রুথ আর অলটারনেটিভ ট্রুথের পার্থক্য করি না। ফ্যাক্ট আর ট্রুথের জমা খরচ বুঝি না। তাতে কী আসে যায়, আপনি আমি না মানতে পারি সত্যটা তো বদলে যাচ্ছে না।
খেয়াল করলে দেখা যায়, এখন আমরা ভালো আর মন্দের ফারাক খুঁজি না বরং বেশি আর কম খারাপের তারতম্য মাপার চেষ্টা করি। প্রতিদিনই খুন হচ্ছে; সেখানে কন্সপিরেসি থিওরি চালান করে দিচ্ছি। নারী-শিশু ধর্ষণ হচ্ছে হামেশা; আহা... উহু... করে একদলা ঘৃণা উগড়ে দিয়ে হাতের ছয় ইঞ্চি পর্দায় ডুবে যাচ্ছি। বলা হচ্ছে, ওহ রেপ হয়েছে! যাক মেরে তো ফেলেনি! এ যেন বাজার-সদাই আর যৌনতার মতই আর পাঁচটা নিত্য ঘটনা; যা কেবলই সংবাদ আর সংখ্যায় দাড়িয়েছে!
হ্যাঁ এটা মেনে নেয়া সুবিধাজনক যে, অন্যায়ের প্রতিবাদ সর্বকালেই সীমিত বা গণ্ডিবদ্ধতায় শুরু। কিন্তু সে ধারাও যে ক্রমশ লুপ্ত! অন্যায় হচ্ছে প্রতিনিয়ত, এখন তার প্রতিবাদ হচ্ছে কই। বরং সে তুলনায় নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে আমি ভাবছি- যাক অন্যায় তো আর আমার সঙ্গে হয়নি অথবা আমি তো আর নেই সেখানে। এতো গেল একদল। যখন এই কথাগুলো উঠছে বা কেউ লিখছে আরেক দল ভাবছে, আমার হয়ে প্রতিবাদের কথাগুলো অন্য কেউ বলে দিক।হ্যাঁ এটা হাজারো মানুষের মনোভাব। কারণ, রাষ্ট্র ও সমাজে চলা নিগ্রহের বিরুদ্ধাচরণ না করাটা যে আরেকটা অন্যায় সেটা আমরা ভুলতে বসেছি।
মনোবিজ্ঞানীরা পোস্ট মিলেনিয়াম কনসেপ্ট নিয়ে এসেছেন আলোচনায়। তারা ২০০০-২০১০ এবং তার পরের দশকটিকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথম দশকে দ্রুত গতিতে অর্থনীতি ও সামাজিকভাবে বদলে যায় অনেক দেশ। পরের দশক অর্থাৎ বর্তমান সময়টায় যে রাষ্ট্রগুলো বদলে যাওয়া দেশগুলোর সাথে পাল্লায় নেমেছে তারা বাঁক বদলের ধারায় রয়েছে। একে সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন ট্রানজিশন পিরিয়ড। সামাজিক অস্থিরতা, বৈষম্য, বিভেদ আর চূড়ান্ত ভোগবাদীতার জন্য ট্রানজিশন টাইমকে কাঠগড়ায় তুলেছেন কেউ কেউ। উত্তরণের পথে এই প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক না মানলেও তারা একরকম প্রবোধের মধ্য দিয়ে মেনে নিচ্ছেন। এটা এক প্রকার ভেক।
এই ভেক ধরা পাশ কাটানো সময় বদলাতে হলে কী করতে হবে? না, আপনাকে বিরাট বা মহৎ কিছু করতে হবে না, বিপ্লব করতে হবে না। যা ভুল তাকে ভুল বলতে হবে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। সেটা করার জন্য স্বশরীরে না পারলেও আজকাল অনেক মাধ্যম আছে তাতে আওয়াজ তুলতে হবে। কেননা আজ আপনি আমার জন্য হাত বাড়ালে কাল আমি আপনার পাশে দাড়াতে বাধ্য।
শেষ করবো এনলাইটমেন্ট যুগের দার্শনিক ও সমাজচিন্তক জোসেফ দে মাইস্ত্রের জগদ্বিখ্যাত উক্তি দিয়ে- “Every nation gets the government it deserves”
আমরা যেমন পরিবার গড়ে তুলবো তার প্রভাব পড়বে সমাজে। সমাজ যেভাবে গড়ে উঠবে তার আদলে প্রতিষ্ঠা পাবে আগামীর রাষ্ট্র। তাই সমাজ যদি দুর্বল হয়, রাষ্ট্র যদি তাকে রিপ্লেস করার চেষ্টা করে তাহলে সেটা সোশ্যাল হেজিমনি। সুতরাং আসুন, রাজা উজির মারা বন্ধ করি। অন্যের বাড়ির কুকুরকে কে লাথি দিল বা বিড়ালকে মারলো কেন, তার প্রতিবাদ অবশ্যই হবে তবে তার আগে নিজের ঘরের উঠানে উলঙ্গ শিশুটার কান্না থামাতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৯ সকাল ৯:২৩