somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেখা...

১০ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১.
মেয়েটা খুব হাসিমুখে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। মা এসে পেছনে দাঁড়ালেন, ‘কীরে? আজ তুই এতো খুশি খুশি?’
- ‘আমি খুশি থাকি না কবে?’
- ‘আজকে মনে হয় একটু বেশিই হাসিখুশি।’
- ‘তাই? কে জানে।’
মা ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, মেয়েটা আয়নার দিকে তাকিয়ে পেছনে মায়ের বেরিয়ে যাওয়া দেখলো, ‘মাকে হয়তো আর কোনোদিন দেখতে পাবো না। আমার মা’টা কত্ত সুন্দর...’ চোখে পানি চলে এলো তার। চোখ মুছে আয়নার দিকে তাকিয়ে জোর করে একটা হাসি ফুটিয়ে তুললো। হাসির আড়ালে পৃথিবী লুকাতে অভ্যস্ত সে।
তৈরি হয়ে বাসা থেকে বের হচ্ছে সে, ‘মা, আমি গেলাম।’
মা বললেন, ‘আজকে জলদি বাসায় আসিস।’
মেয়েটা দাঁত বের করে হেসে বললো, ‘আসবো না!’ তারপর মাকে ভেঙচি কেটে হাসতে হাসতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো; যাক, মাকে ফাঁকি দেওয়া গেছে। মা কিছু বুঝতেই পারেনি।
মা মেয়ের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তার মনটা যেন কেমন করছে, ‘ও এভাবে হাসলো কেনো? হাসিটা ভালো না।’ অজানা একটা দুশ্চিন্তা বুকে পাথরের মতো চেপে বসলো তার। কী যেন ভাবতে ভাবতে দরজা লাগিয়ে ঘরে ঢুকলেন। অনেক কাজ পড়ে আছে।
হাসিমুখেই অফিসে ঢুকলো মেয়েটা। অফিসে ঢুকেই কিছুক্ষণের জন্য মনটা অনেক হালকা হয়ে গেলো। কাজের মধ্যে ডুবে থাকলে তার মাথায় আর কিছু খুব একটা কাজ করে না। তাই এতোদিন সেই চেষ্টাই করে এসেছে সে। কিন্তু আর পারছে না। সবাই ভালো। যারা ভালো না তাদেরকে কেয়ার করে না সে। এভাবেই চলছিলো। কিন্তু এখন আর পারছে না এভাবে চালাতে। পারছে না একজনকে এড়িয়ে চলতে। খুব কষ্ট হয়, খুব। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয় না সে। ওই যে, হাসির আড়ালে সে পৃথিবী লুকাতে অভ্যস্ত। তাই কেউ কিছু বোঝে না। এমনকি যার জন্য কষ্ট, সেও না। নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করে?
জানে না মেয়েটা। জানতে চায়ও না। জানলেও তার কষ্টের বিশালতায় একবিন্দুও ফারাক আসবে না।
অফিস ছুটি। কাজ গুছিয়ে রওনা দিতে যাবে মেয়েটা। এমন সময় সে সামনে পড়লো। ছেলেটা ভদ্রতার হাসি হাসলো, মেয়েটাও। জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন আছেন?’
- ‘ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?’
- ‘আমিও ভালো আছি।’
- ‘ছুটি?’
- ‘হ্যাঁ। যাই।’
- ‘ঠিক আছে।’
- ‘ভালো থাকবেন,’ বলে মেয়েটা মুচকি হেসে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলো।
মেয়েটার কণ্ঠে কিছু একটা ছিলো; ছেলেটার গায়ে কেমন যেন কাঁটা দিয়ে উঠলো। ‘ আমার মনের ভুল’ ভাবতে ভাবতে নিজের কাজে চলে গেলো সে। কিন্তু কিছুতেই চিন্তাটা মাথা থেকে তাড়াতে পারলো না। সারাটা দিন শত কাজের মাঝেও মেয়েটার ‘ভালো থাকবেন’ কথাটা তার কানে বাজতে থাকলো।

২.
অনেক রাত হয়ে গেলো, মেয়েটা বাসায় ফিরলো না। ফোন করতে করতে পাগল হয়ে যাচ্ছে বাসার সবাই। ফোন বন্ধ। চিন্তায় অস্থির মা মেয়েটার বাবা আর ভাইয়াকে পাঠালেন খোঁজ করতে। পরিচিত সবার কাছে ফোন করা হলো। আশপাশের সব জায়গায়, যেখানে যেখানে সে যেতে পারে, যাওয়া হলো। নাহ্, নেই কোথাও। ভাইয়া অফিসে গিয়ে জেনে এলেন তার বোন ঠিক সময়েই অফিস থেকে বেরিয়েছেন।
ভয় দুশ্চিন্তায় অস্থির বাবা-ভাই গেলেন থানায় ডায়েরি করতে। গেলো কোথায় মেয়েটা?
পরদিন সে অফিসে এলো না। কাছের কলিগরা সবাই অবাক। ব্যাপার কী? ও তো পারতপক্ষে কখনো মিস দেয় না। অসুস্থ নাকি? না কোনো সমস্যায় পড়লো?
অফিস শুরুর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে অফিসে চাউড় হয়ে গেলো কাল রাতে মেয়েটার ভাই এসেছিলো তার খোঁজ নিতে। তার মানে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়েছে, মেয়েটা বাড়ি ফেরেনি। বস শুনে চেঁচামেচি করতে লাগলেন, রাত-বিরাতে ভাইটা খোঁজ নিতে এসেছিলো। অফিসের কি কোনো দায়িত্ব নেই? রাতে কি একবারও বাসায় খোঁজ নেওয়া উচিত ছিলো না সে বাসায় ফিরেছে কিনা?? ‘আমাকে একবারও জানানো হলো না কেনো?’ বলে চিৎকার করে তিনি অফিস মাথায় তুলতে লাগলেন। মেয়ের বাবার ফোন নাম্বার জোগাড় করে তিনি নিজেই ফোন করলেন। এখনো তার কোনো খবর পাওয়া যায়নি শুনে প্রয়োজনে সবরকম সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে ফোন রাখলেন। ফোন রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি, ‘এতো হাসিখুশি কর্মঠ একটা মেয়ে, কই গেলো কাউকে না জানিয়ে? কোনো বিপদ হলো না তো?’
অফিসে অনেক কথাই হতে লাগলো। কেউ কেউ বলছে, নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলায় পড়েছে। কেউ ভাবছে, কেউ কিডন্যাপ করলো নাকি? অনেকে আবার মুখ বাঁকিয়ে বলছে, কিসের বিপদ আর কিসের কী? নিশ্চিত দেখো কোনো ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গেছে!
ছেলেটার কানেও এসব কথা গেলো। সব শুনে কেমন থম মেরে বসে থাকলো অনেকক্ষণ। মেয়েটার কিছু একটা হয়েছে। সত্যিই কোনো বিপদ হয়েছে ওর। কিন্তু এতে সে কী করতে পারে?
- ‘আসবো?’
ছেলেটা তাকিয়ে দেখলো তার বন্ধু। একই সাথে অফিসে জয়েন করেছিলো দু’জন।
- ‘আয়। তুই আবার অনুমতি নিয়ে আমার রুমে ঢুকিস কবে থেকে?’
বন্ধুটা খোশগল্পের ধার দিয়েও গেলো না। ঢুকে সরাসরি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কাজটা তুই ঠিক করলি না।’
- ‘আমি আবার কী করলাম?’
- ‘তুই খুব ভালো করেই জানিস তুই কী করেছিস। পুরো দুনিয়া তোকে ক্ষমা করলেও আমি তোকে ক্ষমা করবো না,’ বলেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
ছেলেটা মাথা নিচু করে চুপচাপ দীর্ঘক্ষণ বসে রইলো। তারপর মনে মনে বললো, ‘দোস্ত, শুধু তুই না, আমি নিজেও হয়তো নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না।’

৩.
পরদিন সকাল। ছেলেটা অফিসে ঢুকে নিজের রুমে বসেছে মাত্র। তার বন্ধু এসে ঘরে ঢুকলো, ‘খবর শুনেছিস?’
- ‘কী খবর?’
- ‘ওকে পাওয়া গেছে।’
ছেলেটার মুখ নিজের অজান্তেই উজ্জ্বল হলো, ‘সত্যি? কোথায় পাওয়া গেছে? কই ছিলো ও দু’দিন?’
- ‘হাতিরঝিলে।’
- ‘হাতিরঝিলের ওখানে কী করেছে দু’দিন ধরে?’
- ‘পানিতে ডুবে ছিলো।’
- ‘মানে???’ দম যেন বন্ধ হয়ে এলো ছেলেটার।
- ‘হ্যাঁ। আজ ভোরে ওর লাশ পাওয়া গেছে। পানির ওপর ভেসে উঠেছিলো।’
ছেলেটা দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বসে থাকে। কিন্তু সেদিকে বন্ধুর ভ্রূক্ষেপ নেই। সে বলে চললো, ‘পুলিশ মনে করছে দুর্ঘটনা। বৃষ্টির রাত ছিলো। রেলিংয়ের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলো। হয়তো পিছলে পড়ে গেছে। কী কী নাকি আলামত পেয়েছে। সেগুলো দেখে তাদের এটাই মনে হচ্ছে,’ এবার সে আড়চোখে বন্ধুর দিকে তাকালো, ‘কিন্তু তুই নিশ্চয়ই জানিস এটা দুর্ঘটনা না, তাই না?’
- ‘কী বলতে চাস?’
- ‘তুই খুব ভালো করেই জানিস আমি কী বলতে চাই। কাজটা তুই ঠিক করিসনি। একটা মেয়ের সরল মন নিয়ে তুই খেলেছিস। মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়েছিস, যেখানে তুই জানতি সেগুলো সত্যি করা তোর পক্ষে সম্ভব না।’
- ‘কিন্তু আমি তো সত্যি করতে চেয়েছিলাম!’
- ‘মশকরা করো তুমি আমার সাথে?! চাইলে তুমি ঠিকই পারতে। না পারলে অন্তত ওকে থামাতে পারতে। কিন্তু না। তুমি না ও কূল ছাড়তে পারো, না এ কূল।’
- ‘কিন্তু আমি তো ইচ্ছা থাকলেও ওকে গ্রহণ করতে পারছিলাম না।’
- ‘তাহলে ওকে স্বপ্ন দেখালি কেনো? সত্যি জানার পর ও সরে যেতে চেয়েছিলো। কেনো যেতে দিলি না?’
- ‘কীভাবে দিতাম? আমি তো ওকে...’
- ‘কী? ভালোবেসে ফেলেছিলি? আর কতো ভণ্ডামি করবি? এক সাথে কয়জনকে ভালোবাসা যায়? মনে রাখিস, অন্যের মনে এতো বড় কষ্ট দিয়ে কখনো নিজে সুখে থাকা যায় না। মৃত্যুর আগে বের হওয়া ওর দীর্ঘশ্বাস তোর সব সুখ উড়িয়ে নিয়ে যাবে। মনে রাখিস আমার কথাটা,’ রাগে কাঁপতে কাঁপতে বন্ধুর রুম থেকে সে বেরিয়ে গেলো।
ছেলেটা কিছু ভাবতে পারছে না। কী হয়ে গেলো এটা? তাহলে কি সত্যিই এটা দুর্ঘটনা নয়? তাহলে কি...তাহলে কি.....নাহ্, মাথা কাজ করছে না ঠিকমতো। ছেলেটা বেল বাজিয়ে পিয়নকে এক কাপ কফি দিতে বলে। মাথাটা খুব ধরেছে।
মিনিট পাঁচেক পর পিয়ন কফি নিয়ে রুমে ঢোকে। হাতে একটা সাদা খাম। কফিটা এগিয়ে দিয়ে খামটা দেখিয়ে বলে, ‘স্যার, আপনার জন্য একটা চিঠি আসছে।’
- ‘কোত্থেকে এসেছে?’
- ‘জানি না স্যার। ঠিকানা নাই। শুধু...প্রেরকের জায়গায়....’ পিয়ন বলতে যেন একটু লজ্জা পাচ্ছে দেখে খামটা সে হাতে নিয়ে দেখলো প্রেরকের ঘরে লেখা ‘তোমার পাগলি’। ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড চমকে গেলেও পিয়নকে বুঝতে না দিয়ে বিদেয় করে দিলো।
পিয়ন চলে যাওয়া পর্যপন্ত অপেক্ষা করলো সে। তারপর রুদ্ধশ্বাসে একটানে খামটা ছিঁড়ে চিঠিটা বের করলো। ভেতরে শুধু ছোট ছোট দু’টো বাক্য লেখা –
‘ভালো থেকো। আবার দেখা হবে।’
‘মানে কী এই চিঠির?’ সে শুধু ওই মেয়েটাকেই আদর করে ‘পাগলি’ ডাকতো। সুতরাং বুঝতে বাকি নেই চিঠিটা তারই লেখা। তারিখটাও দু’দিন আগের, মানে যেদিন সে উধাও হয়েছিলো সেদিনের। তাহলে নিশ্চয়ই ওর মৃত্যুটা দুর্ঘটনা। এজন্যই লিখেছে ‘আবার দেখা হবে’...... কিন্তু তাই যদি হয় তবে চিঠি লেখার কী দরকার ছিলো?! নাহ্, হিসেব মিলছে না। সব কেমন গোলমেলে লাগছে। মাথাটাও গরম হয়ে আছে, তাই ভাবতেও পারছে না ঠিকমতো।
ওলটপালট ভাবতে ভাবতেই কফির কাপে চুমুক দিতে গেলো সে। এমন সময় পাশে রাখা মোবাইলটা বেজে উঠলো। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে পরিচিত একটা কণ্ঠ বললো, ‘তোমার জন্য একটা গুড নিউজ আছে......’
গুড নিউজটা শুনে আর অফিসে বসে থাকতে পারলো না ছেলেটা। মনের সব দুশ্চিন্তা, কষ্ট আর আশঙ্কা কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেলো। ফোনটা হাতে নিয়ে একবার বসকে জানিয়ে এক ছুটে বেরিয়ে গেলো বাসায় যাওয়ার জন্য। বাবা হতে যাচ্ছে সে, তাও আবার প্রথমবারের মতো; এটা কি চাট্টিখানি কথা???

৪.
তদন্তে আত্মহত্যার কোনো আলামত পাওয়া গেলো না। তাই বেশি ঝামেলায় না গিয়ে মৃত্যুটাকে ‘দুর্ঘটনা’র সিল দিয়েই কেস ক্লোজ করলো পুলিশ। অফিসে একদিন কালো ব্যাজ ধারণ, ‘আমরা শোকাহত’ ব্যানার লিখে এক সপ্তাহ টাঙ্গিয়ে রেখে শোক প্রকাশ, প্রথম প্রথম কিছুদিন অফিস থেকে বস আর কলিগদের পক্ষ থেকে মেয়েটার বাসায় খোঁজ নেওয়া, এই চললো। এক সময় এসবও বন্ধ। ধীরে ধীরে সবাই ভুলে গেলো তাকে। শুধু ভুললো না মেয়েটার পরিবার; তার বাবা, মা আর ভাই। কেনো যেন তারা কিছুতেই মানতে পারছিলো না তাদের মেয়ের মৃত্যু স্রেফ একটা দুর্ঘটনা।
ভুলতে পারলো না আরো একজন। না চাইতেও কেনো যেন তার হঠাৎ হঠাৎই মেয়েটার কথা মনে পড়ে যায়।

৫.
ফুটফুটে একটা মেয়ে এসেছে ছেলেটার ঘর আলো করে। পুতুলের মতো সুন্দর, মায়াবতী। ভীষণ খুশি সবাই। সবচেয়ে খুশি যেন বাচ্চাটার বাবা। সারাক্ষণ মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে থাকে। অন্য কারো কোলে দিতেই চায় না। বোঝে সবাই, প্রথম সন্তান বলেই এতো বেশি আহ্লাদ, এতো বেশি উৎসাহ।
ছেলেটা পরম সুখে নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘোরে, কথা বলে মেয়ের সাথে। ‘ও কি আমার কথা বোঝে? নিশ্চয়ই বোঝে। নইলে হাসে কেনো?’ নিজের সন্তান হওয়ার যে এতো সুখ, আগে তো জানতো না সে!
সবকিছুই ঠিক আছে। শুধু একটাই সমস্যা। বাচ্চাটার গায়ে কেমন যেন একটা গন্ধ। গন্ধটা খারাপ না। মিষ্টি মিষ্টি। কিন্তু কেমন যেন। বাচ্চাটার গায়ের ওই গন্ধ নাকে এলে তার কী যেন মনে পড়তে গিয়েও পড়ে না। কোথায় যেন হারিয়ে যায় সে। কোন ভাবনার জগতে ডুবে যায়। সবাই বলে সব নতুন বাচ্চার গায়েই এমন গন্ধ থাকে। কিন্তু ছেলেটা মানতে পারে না। আরো কতো ছোট ছোট বাচ্চাই তো কোলে নিয়েছে সে। কই, তাদের গায়ে তো এমন গন্ধ ছিলো না!
কিন্তু নিজেকেই আবার বোঝায় সে, ‘নিশ্চয়ই এটা আমার মনের ভুল। নইলে বাকিদের কাছেও তো গন্ধটা অন্যরকম লাগতো।’

৬.
দেখতে দেখতেই বাচ্চাটার বয়স ১১ বছর হয়ে গেলো। বাচ্চাটা নিজের সঙ্গে অনেক সৌভাগ্য বয়ে এনেছে। ওর জন্ম হওয়ার পর থেকেই একটার পর একটা প্রমোশন আর ইনক্রিমেন্ট পেয়ে আসছে ছেলেটা। সংসার ভেসে যাচ্ছে খুশির জোয়ারে। এই যেমন আজ মেয়ের একাদশ জন্মদিনে অফিস থেকে নিউ ইয়র্ক ব্রাঞ্চে কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে জয়েন করার অফার পেয়েছে সে। আট বছরের কন্ট্রাক্ট। বিশাল সুযোগ। কষ্ট শুধু একটাই, ওই আট বছর পরিবারের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। কারণ ওই সময়ের মধ্যে নিউ ইয়র্ক ছাড়াও কাজের খাতিরে আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া-আসা করতে হবে। তবে একটাই আশা, আট বছর পর দেশে এসে বউ-বাচ্চাকে নিয়ে সেখানে গিয়েই সেটেলড হওয়ার সুযোগ পাবে। তখন বাকি জীবনটা নিয়ে আর ভাবতে হবে না।
অফিস থেকে খবরটা পেয়ে বাসায় এসেই সবাইকে জানালো সে। খুশিতে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েও ধরলো না। মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসলেও তার থেকে বেশ একটা দূরত্ব বজায় রাখে সে। মেয়েটা এতো বড় হওয়ার পরও তার গা থেকে ছোটবেলার সেই গন্ধটা যায়নি, বরং আগের চেয়ে তীব্র হয়েছে। মেয়ের কাছে যেতেও তার কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। অন্য কেউ গন্ধটা পায় না। শুধু সে-ই টের পায়। এই গন্ধটা মেয়ের ধারে কাছে গেলেই তার নাকে লাগে। তখনই কী যেন তার মনে হতে চায়। অজানা এক দুশ্চিন্তা আর ভয় তাকে ঘিরে ধরে।
কিন্তু মেয়ে তো আর সেটা বুঝতে চায় না। বাচ্চা মানুষ। বাবার আরো কাছে আসতে চায়। আর বাবা পালায় মেয়ের কাছ থেকে। এই অস্বস্তি, ভয় আর দুশ্চিন্তায় অল্প বয়সেই হার্ট দুর্বল হয়ে গেছে বেচারার। প্রেশারটাও আজকাল আর নিয়ন্ত্রণে থাকতে চায় না। তাই মনে মনে একটু খুশিও হলো বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে; মেয়েটা থেকে দূরেও থাকা হবে, আবার তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎটাও নিশ্চিত হবে। কে জানে, সেই ফাঁকে হয়তো অজানা ভয়টা কেটেও যেতে পারে।
অফিসের প্ল্যানমতো ঠিক তেতাল্লিশ দিন পর এক ভোরে ঢাকা ছেড়ে নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো ছেলেটা।

৭.
আট বছর পর।
ছেলেটা আর ‘ছেলে’ নেই। তিনি এখন একটি প্রতিষ্ঠিত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির নিউ ইয়র্ক শাখার কান্ট্রি ম্যানেজার শাহীনুর রহমান। আট বছরের কন্ট্রাক্ট শেষ করলেও ভালো পারফরম্যান্সের সুবাদে কন্ট্রাক্ট বাড়ানো হয়েছে আরো তিন বছরের জন্য। বেতনও বেড়েছে অনেক। দেশের ফেরার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো দেশে কিছুদিন সময় কাটিয়ে ফ্যামিলিকে নিয়ে একবারে আমেরিকায় পাড়ি জমানো। ওখানে মোটামুটি সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। বাকিটা এখানে ছুটি কাটাতে কাটাতেই হয়ে যাবে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চেকিং শেষে লাগেজ নিয়ে ফুরফুরে মনে বেরিয়ে এলেন শাহীনুর। কতোদিন পর সবাইকে দেখবেন। স্ত্রীকে ছবি আর ভিডিও চ্যাটে দেখলেও মেয়েটাকে একটি বারের জন্যও দেখতে পাননি তিনি। কেনো যেন মেয়েটা বাবার কাছে একটা ছবিও পাঠাতে দিতো না। ভিডিও চ্যাটে তো সামনেও আসতো না। ফোন করলে মাঝে মাঝে কথা বলতো, কিন্তু তাতেও কেমন যেন জড়তা। শাহীনুর মনে করতেন মেয়েকে দূরে দূরে রাখার ফল হয়তো এটাই, মেয়ে আর তাকে সেভাবে আপন ভাবতে পারে না। দোষ তো তার নিজেরই।
তবে শেষবার নিউ ইয়র্ক থেকে কথা বলার সময় মেয়েকে খুব উৎসাহী মনে হয়েছে। খুব খুশি হয়ে বলেছে, ‘বাবা জলদি আসো, কতোদিন পর দেখা হবে।’ সেই খুশিটা মনে করতে করতেই ওয়েইটিং এরিয়ায় বেরিয়ে এলেন তিনি। বাসার সবাই অপেক্ষা করছে সেখানে, তার আদরের একমাত্র মেয়েটাসহ।
দূর থেকেই দেখছেন সবাই দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। ওই তো... বাবা, মা, স্ত্রী আর......
হঠাৎ করেই বুকের বামপাশটায় চিনচিনে ব্যথা শুরু হলো তার। ব্যথাটা বাড়ছেই। সমানে ঘামছেন শাহীনুর রহমান। নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। যতো কাছে যাচ্ছেন ততোই মাথার ভেতর সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। ‘না, এটা অসম্ভব! এটা হতে পারে না!’ কিন্তু এটা তো চোখের ভুল নয়।
‘ও এগিয়ে আসছে, আমার দিকেই এগিয়ে আসছে! বাকিরা কি ওকে দেখতে পাচ্ছে না? তাহলে থামাচ্ছে না কেনো?? অবশ্য ওরা তো আর ওকে চেনে না। কিন্তু সাথে নিয়ে এলো কোত্থেকে? বয়স মনে হচ্ছে আরো কমেছে ওর....’
কী ভাবছেন এসব শাহীনুর? বয়স কমা তো পরের কথা, সে তো এখানে থাকারই কথা না!
ও কাছে চলে এসেছে একেবারে। হাসিমুখে শাহীনুরের দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বললো, ‘ভালো আছো?’
পায়ে যেন কোনো জোর নেই। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না শাহীনুর। পড়ে গেলেন সেখানেই। বুকে প্রচণ্ড ব্যথা। দেখছেন সবাই ছুটে আসছে তাকে ধরতে। ওর কোলেই শুয়ে আছেন তিনি। শুনছেন তার স্ত্রী বলছে, ‘পদ্ম, বাবাকে ধরে রাখ।’ এটা তাহলে তার মেয়ে? তার নিজের মেয়ে পদ্ম?? গায়ে সেই গন্ধ। হঠাৎ তার মনে পড়লো এই গন্ধ কেনো তার এতো পরিচিত। কেনো এই গন্ধে এতোটা অস্বস্তি আর ভয় পেতেন তিনি। ‘এটা তো ওর গায়ের গন্ধ ছিলো। রোজ দুষ্টুমি করে যে গন্ধ শুঁকতাম। ও বিরক্ত হয়ে তাড়িয়ে দিতো। তাও বার বার জ্বালাতাম...আমার মেয়ের গায়ে এই গন্ধ?? আর চেহারাটা....হ্যাঁ.....সেই নাক, সেই চোখ, সেই মাখন মাখন গায়ের রঙ......’
সবার মাঝে কান্নার রোল পড়ে গেছে। কেউ একজন চিৎকার করে শাহীনুরের জন্য একটা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে বলছে, তার নাকি হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।
বুকে অসহনীয় যন্ত্রণায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শাহীনুর রহমানের। দেখলেন সবাই কাঁদছে, শুধু একজন ছাড়া। তার মুখে হাসি, প্রাপ্তির হাসি, প্রশান্তির হাসি। তার কোলেই শুয়ে আছেন তিনি।
চোখ বন্ধ হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে শুনলেন কানের কাছে ফিসফিসে একটা কথা, ‘বলেছিলাম না, আবার দেখা হবে?’
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:১৫
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিনেতা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৫



বলতে, আমি নাকি পাক্কা অভিনেতা ,
অভিনয়ে সেরা,খুব ভালো করবো অভিনয় করলে।
আমিও বলতাম, যেদিন হবো সেদিন তুমি দেখবে তো ?
এক গাল হেসে দিয়ে বলতে, সে সময় হলে দেখা যাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×