সত্যি বলতে আমার উদ্ভট কাজ করতে একটু বেশিই ভাল লাগে।হয়ত আমি সবার থেকে আলাদা,নয়ত সবার থেকে আলাদা হতেই কাজ গুলো করে বেরাই।অনেক ফালতু কাজই করে বেড়াই,তার মধ্যে একটা হল শীতের রাতে বাইরে হাটতে যাওয়া।গভীর রাতে হাটাহাটি আমার অনেক পুরনো অভ্যাস(হুমায়ন আহমেদ স্যারের প্রভাব বোধহয়),শীতের রাত এ হাটা তার একটা বাড়তি মাত্রা।অনেক বকা খেয়েও ছাড়তে পারিনি।তবে গত বছর HSC পরীক্ষা আমাকে বিরত রেখেছিল(আমি এক মহাফাকিবাজ)।ভর্তি শেষে যখন অবসর সময় কাটাচ্ছি তখন পুরানো ভূতটা আবার ফিরে আসল।আজ রাতে হাটতে বের হয়েছি,যথারীতি হাতে একটা আইসক্রিম।উদ্দেশ্য হীন ভাবে হেটে চলেছি।রাতে শীতের সঙ্গী হয়ে ঝাকিয়ে বসেছে নীরবতা।হাটতে হাটতে কত গুলো দোকানের সামনে এসেছি,হঠাত কথাবার্তার আওয়াজে একটু অবাকই হলাম।বিস্মিত হয়ে দেখলাম,আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি(জায়গাটা পাকা করা) তার থেকে একটু দুরেই এক মা তার শিশু সন্তানকে নিয়ে শুয়ে আছে অথচ আমি যা দেখে ভাবেছিলাম ময়লার স্তুপ।শখ করে বাইরে ঘুরতে বের হয়েছি,তার উপর হাটছি,শরীর গরম হয়ে আছে,তারপর ও শীত হাড়ে চুমো খেয়ে যাচ্ছে।আর খেয়াল করে দেখলাম ঐ মহিলা তার শাড়ি দিয়ে লড়ছে,তাও নিজের জন্য না,তার সন্তানকে উষ্ণ রাখতে,বুকের কাছ থাকা বেঢপ আকৃতি যার অস্তিত্বের সাক্ষ্য দিচ্ছে।কিছুক্ষনের জন্য সমগ্র সত্তা যেন নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেল্ল।হাতে ধরে থাকা কোন আইস্ক্রিম,যা কিনা কয়েক মুহুর্ত আগেই আমার কাছে অনেক উপভোগ্য ছিল তাই আমার কাছে অসহ্য লাগল।সেখান থেকে পালিয়ে এলাম বাসায়।নিজের ভিতর লুকিয়ে থাকা পুরানো একটা জিনিস ফিরে আসল।নিঃসন্দেহে জিনিসটা মায়ের সন্তানের প্রতি গভীর মমতাকে নির্দেশ করে,সেই সাথে কি এও নির্দেশ করে না ব্যক্তি হিসেবে আমার ব্যর্থতা?জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতা?আমি যখন ফিরে এসে বাসায় আমার উষ্ণ বিছানায় শুয়ে পড়লাম,অই ভাগ্যহত মা হয়ত তখনও নিজের শরীর এর উষ্ণতা দিয়ে একটু আরাম দেয়ার চেষ্টা করছে এদেশের ভাগ্যহত আরেক নবীন সদস্যের।মনে অপরাধ বোধে ভুগতেছি,ইশ! যদি টাকা টা দিয়ে তাকে সাহায্য করতে পারতাম,৩৫ টা টাকা এভাবে বাজে খরচ না করলেও পারতাম।মনে পড়ল সমাজ বইয়ের কথা,যেখানে পড়েছিলাম,জ়ীবনের এক সুবিধার কথা যার নাম,”জন্মগত সুবিধা”।যার ব্যাখ্যায় লিখা ছিল যারা স্বচ্ছল পরবারে জন্ম গ্রহণ করে তারা অধিক সুবিধা পায়।এটি একটি নির্মম বাস্তব সত্য।আমি আজ কম্বল গায়ে শুয়ে আছি তাতে আমার কৃতিত্ব কই?জন্ম নিয়েছি এটাই?আজ আমার বাবা ভাল পজিশনে আছেন বলে আমি বাজে খরচ করে ফুর্তি করে বেড়াব?অথচ এই টুকু টাকার অভাবে মানুষ না খেয়ে থাকে।মনে আস্তেই পারে,”এহ আমার কি ঠেকা পড়ছে???”।সত্যি বলছি কেউ যদি আমাকে এই প্রশ্ন করে আমি সরাসরি কোন উত্তর দতে পারবনা।শুধু একজন বুয়েট প্রফেসরের কথা বলতে পারি,আমার বুয়েট নিয়ে,পড়াশোনা নিয়ে আমার কথাবার্তা শুনে যিনি আমাকে বলেছিলেন,”এভাবে ভাবছ কেন?এমন ও তো হতে পারত,তুমি হয়ত অন্য কার ঘরে,অন্য কোন দেশে জন্ম গ্রহণ করেছ।তখন কি আর তুমি এভাবে ভাবতে পারতে?তুমি এই দেশে জন্মাইছ,আজ এখানে আসছ তার পিছনে নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা আছে,বিশেষ উদ্দেশ্য আছে।খালি নিজেকে নিয়ে ভাববা কেন?”আমি জানি না আমার উদ্দেশ্য কি,জানতে পারিনি এখনও।তবে সমাজের যে অসংগতি চোখে পড়ে তা দূর করার চেষ্টা টা কি আমার দায়িত্বের মাঝে পরে না?আমি কি তা করি?আমাদের এলাকায় এক মহিলা আছে যিনি কানে কম শোনেন।অনেক দেরীতে হলেও তার বিয়ে হয়।কিন্তু কিছুদিন পর মহিলাকে ছেড়ে চলেও যায়।কিন্তু ইতোমধ্যে মহিলার গর্ভে সন্তান চলে আসে।সে ঝুকিপূর্ণ অবস্থায়ও তাকে মআনুষের বাড়িতে কামলা খাটতে হয়েছে।আমার মাকে দেখেছি যতটুকু সম্ভব সাহায্য করেছে।কিন্তু তার পর যা ঘটল তা আর কষ্টকর,বাচ্চাটা জন্ম নিল বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী হয়ে।একে তো বাবা নাই,তার উপর মা নিজেও কানে কম শুনে,আমি নিজে দেখেছি এই মহিলার কষ্ট।টাকার অভাবে চিকিতসা করাতে পারে নাই।একবার বাচ্চাটার চোখ উঠছে তিন দিন পর্যন্ত টাকার জন্য বাচ্চাটার কোন চিকিতসা করাতে পারেনি।পড়ে আম্মু তার চোখের ড্রপ কিনে দিয়েছিল।বাচ্চাটা এখন হাটতে পারে একটু একটু।অনেক আগে একবার ঠিক করেছিলাম বাচ্চাটাকে শিশু হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে দেখানর জন্য কিছু টাকা দিব।এরপর কত টাকা হাতে আসল আর গেল,কত বাজে খরচ করলাম,কিন্তু ঐ বাচ্চাটাকে দেয়া হল না।আমি বলতেই পারি তাতে কি?সেদিন শুয়ে ল্যাপটপ এ Simpsons দেখছি,হঠাত খেয়াল করে দেখালাম ওই পিচ্চিটা পিছনে বিছানার পাশে দাড়িয়ে অপার বিস্ময়ে স্ক্রিন এর দিকে তাকিয়ে আছে।আমি জানি না তার সেই শব্দহীন জগতটা কেমন।নিজের ভিতর একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল,আমি তো নিজ থেকেই চাইছিলাম তাকে সাহায্য করতে,আমার ধর্ম আমাকে শিখিয়েছে যদি কোন ভাল কাজের জন্য নিয়ত করি তবে তা পালন করা ওয়াজিব হয়ে যায়।মানবতা না হোক আমার ধর্ম পালনে আমার দায়িত্ব এই শিশুটিকে সাহায্য করা।আজ যদি আমি কাউকে না বলতাম এই কথা টা কেউই জানত না,তখন পালন করি আর না করি তাতে কারো কথা বলার কিছু থাকবে না।আর যদি কেউ কিছু বলেও আমি নাহয় যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম।আটকে দিলাম নিজের ঘরের দরজা,মোবাইলটাও নাহয় সুইচ অফ করে পুরো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম,কিন্তু তারপর ও কি পারব নিজেকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিতে?এটি আমার নৈতিক দায়িত্ব ছিল যা পালনে আমাকে কেউ বাধ্য করতে পারবে না,এমন কি যা পালন না করলেও কোন জায়গায় আমার কোন বিচার হবে না।কিন্তু আমার বিবেকের কাছে আমি কি জবাব দিব?আমি কি করে তাকে এড়িয়ে যাব।আমার প্রচন্ড একাকী মুহুর্ত গুলো তেও আমি তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারবনা।যদি কোন দিন শুনি একটু চিকিতসা পেলে অথবা আরও আগে চিকিতসা পেলে ছেলেটা ভাল হয়ত ভাল হয়ে যেত,আমি কি জবাব দিব আমাকে?আমার মা যখন আমাকে আদর করে “বাবা” বলে ডাকে তখনকার আমার যে আনন্দ,সে আনন্দ থেকে ওই শিশু টিকে বঞ্চিত করার দায় আমি কি করে এড়াব?সারা জীবন হয়ত এভাবেই কাতিয়ে দিব বিবেকের কাছে ধুকে ধুকে।হয়ত দেখা যাবে ফ্রেন্ডরা এসে বলবে,চান্স পেয়েছিস,এবার খাওয়া,আমিও তাদের নিয়ে চলে যাব boomers,kfc,bfc,thirty3,movenpic এ।যাওয়ার পথে মাড়িয়ে যাব অসংখ্য পথশিশুর একবেলা পেট ভরে খাওয়ার আকুতি।অথচ যদি সবাই যদি একবার ইচ্ছা করতাম চাইলেই অনেক অভুক্তের মুখে অন্তত একবেলা খাবার তুলে দিতে পারতাম।তাতে নিজের উদরপূর্তি হয়ত হত না,কিন্তু অনেক গুলো চোখের তারার ঝিলিক দেখতে পেতাম যার কাছে ঐ মহাশুন্যের তারার ঝিলিক কিছুই না।কিন্তু কই করছি নাতো।নিজেকে নিয়েই মেতে আছি।মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় আমি মানুষ কিনা।সন্দেহ টা বেশি দূর স্থায়ী হয় না।যদি জিজ্ঞেস করা হয়,মানুষ সৃষ্টির সেরা কেন?অনেকেই হয়ত বলবেন মানুষের বিবেক আছে যা অন্য প্রাণির নাই।আমিও তাই বলব,তবে সাথে যুক্ত করব মানুষের আছে প্রচন্ড ইচ্ছা শক্তি।মানুষ চাইলেই পারে অসম্ভব কে সম্ভব করতে,আবার চাইলেই পারে নিজের বিবেক কে গলা টিপে মেরে পশুর মত জীবন কাটাতে,নিজ স্বার্থে পাখির মত এক পাশের চোখ দিয়ে শুধু নিজের প্রয়োজন টুকুই দেখে যেতে।উদাহরন চান?এইত আমাকেই দেখুন না,আমার আর পাখির মধ্যে পার্থক্য এটাই সে গাছে বানানো বাসায় ঘুমায় আর আমি সেই গাছ কেটে বানানো খাটে তোষক পেতে ঘুমাই,আর তোষকের নিচে চাপা দিতে চাই বিবেক।ঐ আসল পাখিটাই বোধহয় ভাল থাকে,তাকে এই বাড়তি কষ্টটা করতে হয়না।মানুষের আকৃতি নিয়ে বেচে আছি পশুর মত আত্মকেন্দ্রিক হয়ে আমি,আপনি হয়ত আমরা আরো অনেকেই।আসুন না সবাই একটা বার চেষ্টা করেই দেখি…………………………হয়ত পারব না,অন্তত একবার হোচত খেয়েই দেখি…………………এগিয়ে যেতে তো শিখব………………
“যদি একটি বার ভাবতে পারি আমাদের সব স্বপ্নের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এ পৃথিবী,
যেখানে শীতার্ত রাতের শেষে ক্ষুধার্ত শিশু একা পড়ে রয় শুধু বেচে থাকার স্বপ্নে,
অসীম বুকে যার বুকে আশ্রয় কেবল নির্দয় ভূমিতে,
অর্থহীন জন্মটাই যার অভিশাপ,
আগুন্তক সমাপ্তির অপক্ষায় কাটে সবটুকু দু;সময়,
নিঃশব্দ কান্নায় বহুক্ষন,
আমার ঘুমন্ত বোধ যেন তাতে অনুতপ্ত হয়
যেন ক্লান্ত হয় আমার অনিঃশেষ চাওয়া,
সীমাহীন পাওয়ার অভিলাষ,
তৃপ্ত হয় অবাধ্য শুন্যতা,
জীবন্ত হয় নিষ্প্রাণ,
যেন বিশুদ্ধ রোদে আবার উষ্ণ হয় পৃথিবী
শুধু একটি বার সত্য হোক চিরন্তন সত্যের বাইরে
অন্য রকম এক পৃথিবী,
শ্বাশত মুক্তির আলোয় উদ্ভাসিত হোক আধার,
অবরুদ্ধ হোক সব রুদ্ধ শৃঙ্খল,
সব মিথ্যা শ্রেষ্ঠত্ব হোক অবনত,
শান্ত হোক সব যন্ত্রনা বিধাতা,
অবারিত হোক নির্মল,
সবুজের ওপারে হোক এক অন্য সূর্যদোয়,
পৃথিবী হোক নির্ভয় আশ্রয়
পূর্ণ হোক সব নির্মোহ হৃদয়,
শুদ্ধ হোক আমার পৃথিবী,
সমাপ্ত হোক সব অসমাপ্ত কান্না,
সত্য হোক আমার এই প্রার্থনা”
-ট্র্যাক(সত্য হোক),ব্যান্ড(রোড ৩১),এলবাম(রক ২০২)
সত্য হোক এ স্বপ্ন