বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ওরফে সাকা চৌধুরী বিএনপির প্রতি কখনো ক্ষুব্ধ আবার কখনো হতাশা প্রকাশ করেছেন। গ্রেফতার হওয়ার পর বিএনপির নেতাকর্মীরা তার জন্য জোরালো আন্দোলন ও স্লোগান দিতে অস্বীকার করার কথা জানতে পেরে তিনি ক্ষুব্ধ। বিজয় দিবসে বিএনপির মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একাংশ চট্টগ্রামে ও ঢাকায় তাকে নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল ও সেস্নাগান দিতে অস্বীকার করার খবর গোয়েন্দা সদস্যদের থেকে জেনে এ ক্ষোভ প্রকাশ করেন সাকা চৌধুরী। দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদে সাকা গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) এমন তথ্য জানিয়েছেন। এদিকে সাকাকে ডিবির হাজতখানায় স্বাভাবিক নিয়মে এবং স্থান স্বল্পতার কারণে সাধারণ হাজতিদের সঙ্গে রাখা হয়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানায়।
গোয়েন্দা পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, সাকা চৌধুরীকে ডিবি অফিসে সাধারণ হাজতখানায় চোর-ডাকাত, সন্ত্রাসী ও অস্ত্রধারীদের সঙ্গে ফ্লোরে রাখা হয়েছে। ফ্লোরের নির্জন সেলে সাকা চৌধুরী ধূমপান করছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, সাকাকে স্বাভাবিক অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি ডিবির কর্মকর্তাদের ওপর ক্ষেপে যান। আবার কড়াভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলে নরম হয়ে যান। জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া সাকা বেশিরভাগ সময় ঘুমান। স্বজনদের সঙ্গে খুব বেশি দেখা করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে না তাকে।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, মিন্টো রোডের গোয়েন্দা পুলিশের (দক্ষিণ) মাত্র একটি হাজতখানা। ওই হাজতখানায় আগে চারজন আসামি ছিল। বৃহস্পতিবার রাতে তাদের সঙ্গে সাকাকে থাকতে দেয়া হয়। শীত নিবারণের জন্য দুটি কম্বল দেয়া হয়েছে। এর একটি দিয়ে সাকা বালিশ বানিয়েছেন। শুক্রবার সকালে ৬ জন দুর্ধর্ষ গাড়িচোর ধরা হলে তাদের কক্ষে রাখা হয়েছে। তাদের সঙ্গে স্বভাবসূলভ ভঙ্গিতে হাসিঠাট্টা করে সাকার দিন কাটছে। বর্তমানে তিনি সুস্থ রয়েছেন বলে জানা যায়।
এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, গতকাল শনিবার সকালে সাকা তিন চোর দিয়ে শরীর ম্যাসেজ করছিলেন। পরে এটা ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় সিসি টিভিতে ধরা পড়লে তাদের এ কাজ থেকে বিরত রাখা হয়। শুক্রবার রাতে চোরদের প্রভাবিত করে সাকা এ কাজ করান। গতকাল সকালে সাকাকে যথারীতি হাজতখানার নিয়ম অনুযায়ী সকালের খাবার দেয়া হয়। খাবারের মেন্যুতে তেল ছাড়া পরাটা, ভাজি ও ডিম ছিল। শনিবার রাতে ডিবির ক্যান্টিনের মাছ, সবজি দিয়ে ভাত দেয়া হয়েছে। সাকা রাতে যথারীতি ঘুমাচ্ছেন। শুক্রবার রাতে ১০টার পর খাবার খেয়ে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। তবে হাজতখানার ভেতরে সাকাকে স্বাভাবিকভাবে রাখা হলেও কক্ষের বাইরে কঠোর পুলিশ পাহারা রয়েছে। হাজতখানায় একসঙ্গে একাধিক অপরাধী রাখায় বাথরুম থেকে নোংরা গন্ধ বের হয়। এতে সাকা বিব্রত হন।
এদিকে গতকাল সকাল ৯টার দিকে সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী, মেয়ে ফারজিনা কাদের চৌধুরী ও ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ের সামনে যান। কিন্তু তাদের কাউকে সাকা চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেয়া হয়নি। এ সময় পরিবারের পক্ষ থেকে শীত নিবরণের জন্য গরম জ্যাকেট, মাফলার, চাদরসহ কিছু শীতবস্ত্র সাকা চৌধুরীর কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সাকাকেব জানান, বিজয় দিবসে আপনার মুক্তির জন্য বা আপনার পক্ষে এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীরা মিছিল করতে অস্বীকার করেন। তাদের বক্তব্য সাকা যুদ্ধাপরাধী। এমন কথা শুনে সাকা ক্ষুব্ধ ও বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তখন মন চাঙ্গা করতে শৈশব ও কৈশোরের দাপটশালী জীবনের কথা বললে আবার ঘুরে দাঁড়ান সাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সাকা হাজতিদের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটান। আবার মাঝে মধ্যে ক্ষেপে যান।
এদিকে পুলিশ হেফাজতে সাকাকে নির্যাতন করা হয়েছে কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ডিসি মনিরুল ইসলাম জানান, গ্রেফতারের পর সাকা চৌধুরীকে নির্যাতন করা হয়নি। বরং সাকা চৌধুরী পুলিশের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছেন। পোশাকধারী পুলিশের ওপর হাত ওঠাতে দ্বিধাবোধ করেননি। ডিবি অফিসে আসার পর আইন, মানবাধিকার ও তার সামাজিক অবস্থান রক্ষা করেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ডিবিতে হাজতখানা কম থাকায় একই হাজতখানায় তাকে অন্যদের সঙ্গে রাখা হলেও তার সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় আনা হচ্ছে। তার নিরাপত্তায় ডিবি অফিসে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার সাকাকে আদালত থেকে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে ডিবি অফিসের হাজতখানায় রেখে কড়া নিরাপত্তায় অপরাধ বিশেষজ্ঞরা জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।
চট্টগ্রামে সাকার প্রতিকৃতিতে জুতা মেরে ও আগুন দিয়ে ঘৃণা প্রকাশ
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে অবিলম্বে বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি ও আজ রোববার চট্টগ্রামে আহূত হরতাল প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়ে চট্টগ্রামে বিভিন্ন সংগঠন সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে। এ সময় সমাবেশ শেষে সাকা চৌধুরীর প্রতিকৃতিতে জুতা মেরে ও আগুন দিয়ে সচেতন নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ঘৃণা প্রদর্শন করা হয়।
গতকাল শনিবার বিকেলে চট্টগ্রামের বিভিন্ন পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ নাগরিক সমাজের উদ্যোগে চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ সমাবেশে বক্তারা অবিলম্বে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ অন্য রাজাকার- আলবদরসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার দাবি জানান। পাশাপাশি তারা বলেন, সাকা চৌধুরীর মতো একজন ঘৃণিত রাজাকারের জন্য হরতাল আহ্বান করে বিএনপি তার রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বই প্রমাণ করল। তারা আজকে বিএনপির ডাকা হরতাল ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে নগর জীবনকে স্বাভাবিক রাখার জন্য নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। এ ব্যাপারে তারা প্রশাসনের প্রতি যে কোন নৈরাজ্য দমন করারও আহ্বান জানান।
সাবেক সংসদ সদস্য কফিল উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে প্রবীণ রাজনীতিবিদ পংকজ ভট্টাচার্য, পেশাজীবী নেতা ডা. প্রফেসর এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম, নারীনেত্রী নূরজাহান খান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
এর আগে সকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নগরীর দারুল ফজল মার্কেটের সামনে থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিল থেকে রাজাকার সাকা চৌধুরীর ফাঁসি দাবি করে আজকের হরতাল প্রত্যাখ্যান করার জন্য নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়।