somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুলতান : বামুনের দেশে এক অতিকায় স্বাপ্নিক।

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১০:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পাঠঘর থেকে-১
এস এম সুলতানকে নিয়ে বেশ কৌতূহল কাজ করছে আমার মধ্যে বেশ দীর্ঘদিন ধরে। আহমদ ছফার "যদ্যপি আমার গুরু" পড়ার পর থেকেই এ কৌতূহলের জন্ম। অনলাইনে তাঁর আঁকা ছবিগুলো দেখেছি, সাথে সাথে তাঁকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধগুলোর যা পেয়েছি তা পাঠ করেছি। আর দেখেছি তারেক মাসুদের "আদম সুরত"। নানা কারণে তাঁকে নিয়ে লেখা কোনও বইয়ের সাথে সংযোগ আমার ঘটেনি। আমার পরিচিত শিল্পী-বলয়ে সুলতান নিয়ে কিছু জানার আগ্রহ যেই প্রকাশ করেছি, দুয়েকজন বাদে প্রায় সকলেই নেশা-ভাঙ আর কিছু মিথই ঘুরেফিরে শুনিয়েছেন।

"আমি চাক্ষিক রূপকার মাত্র" পড়ার পর রামকিঙ্করকে নিয়ে যে কারণে আমার আগ্রহের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল, ঠিক একই কারণে আমি সুলতানকে নিয়েও ঠিক এমন ধাঁচের বইয়ের সন্ধান করছিলাম। গত এক বছরে খসরু পারভেজ সম্পাদিত "মুখোমুখি সুলতান", সৈয়দ নিজারের "ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা" এবং হাসনাত আবদুল হাইয়ের" সুলতান" সংগ্রহ করি। কিন্তু পাঠ করা হয়ে ওঠেনি। এক ধরনের অনিয়মিত রিডিং ব্লক (জানি না রাইটিং ব্লকের মতো করে রিডিং ব্লক আছে কি না!) কাজ করছিল। মন বসাতে পারছিলাম না।

করোনাকালীন সময়ে বুলবন ওসমানের "নন্দনতত্ত্বের গোড়ার পাঠ নাড়তে গিয়ে সুলতান নিয়ে দুটি লেখা পড়লাম। ফের অতৃপ্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। পড়ব পড়ব বলে গত সপ্তাহে এসে "মুখোমুখি সুলতান" পড়া শুরু করলাম, বেশ আনন্দ ও তৃপ্তির সাথেই গতকাল পাঠ শেষ করলাম। ১১২ পৃষ্ঠার এই বইটি শেষ করতে সাত-আটদিন লেগে গেল। খসরু পারভেজ, শাহাদুজ্জামান, শরীফ আতিক-উজ-জামান ও বাবলু ভট্টাচার্যের নেওয়া সাক্ষাৎকার দিয়ে বইটি সাজানো হয়েছে। সুলতান বিষয়ক প্রাথমিক-পাঠে বইটি আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। শিল্প, সমাজ, নগর, রাষ্ট্র, পৃথিবী, বাঙালি ও মানুষ নিয়ে তাঁর চিন্তা-ভাবনার দার্শনিক রূপ ছড়িয়ে রয়েছে বইটির পরতে পরতে। তাছাড়াও শিল্পীজীবনের পরিভ্রমণের একটা চিত্র পাওয়া যায়। কলকাতা আর্ট কলেজে পড়া, সেখানে বরাবরের মতো ভালো রেজাল্ট করা সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ না করেই পরিভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। ফলে এক ঈর্ষণীয় ভবঘুরে জীবনের স্বাদ নিয়েছিলেন। বিশ্বজনীন বোধের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে এই পরিভ্রমণের সমাপ্তি টেনেছেন তিনি। এভাবে শিকড়ের কাছে ফিরে আসা ও তাঁর স্বজাতির কাছে মূল্যায়িত হওয়ার বিন্দুমাত্র আশা-প্রত্যাশা না করে এক সন্ত-শিল্পীর জীবন ধারণ করে মাটি ও মানুষের ঘনিষ্টতর হয়ে এর বয়ান তিনি দিয়ে গেছেন বিস্ময়করভাবে। আর তা যেন একমাত্র সুলতানের পক্ষেই সম্ভব।



তিনি গ্রাম নিয়ে ভেবেছেন, ভেবেছেন কৃষকসমাজ নিয়ে, আর ভেবেছেন শিশুদের নিয়ে। ভাবনাকে বাস্তবায়নও করেছেন, তার মতো করে। রাষ্ট্র-সমাজ তাকে বুঝেনি। এক জায়গায় তিনি বলেছেন,

“আমি আলাপ করি বেগম এরশাদের সঙ্গে, তাকে অনেক বুঝালাম। তাকে বললাম, আমার গ্রামের ছেলেমেয়েরা ভোররাতে কাঁদে কেন? চিৎকার করে কাঁদে, এমনকি বিছানা থেকে মাকে উঠতেই দেয় না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কাঁদে কেন? তখন তিনি বলতে পারলেন না। বললেন, আপনি বলেন। আমি বললাম যে, ওদের খিদে লাগে। সারা রাত্রি ঘুমানোর পর ওদের যখন খিদে লাগে, তখন কাঁদে। গরিবের ঘরে এমন কিছু থাকে না, যা দিয়ে সকালে ওদের কান্না থামানো যায়।’

এ-থেকে বোঝা যায় তার মানবিক শিশুশিক্ষাভাবনার স্বরূপ। পেটে ক্ষুধা নিয়ে কীভাবে একজন শিশু ছবি আঁকা শিখবে! কীভাবে সে পড়াশোনায় মনোযোগী হবে! শিশুদের জন্য তিনি গড়ে তুলেন শিশুস্বর্গ। নির্মাণ করেন বজরা, যাতে করে নৌভ্রমণের মধ্য দিয়ে শিশুরা প্রকৃতিকে রঙ-তুলি দিয়ে চিত্রায়িত করতে পারে। তার শিশুভাবনা বা শিশুবিকাশ-ভাবনা সত্যিই মানবিক ও প্রকৃতিঘনিষ্ট। বেশ সুন্দরভাবেই শিশুভাবনার সার উঠে এসেছে। তা যেন ঠিক মহাকালের মগ্ন শিশুর মুখে শিশুস্বর্গের বয়ান।

ইতিহাসের সাথে তাঁর চিন্তার বোঝাপড়ায় তাঁর চিত্রকলার নির্মাণ তা তিনি বেশ সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন। বারবার বিষয়বস্তু হিসেবে কৃষকসমাজ ও তাদের দানবীয় শরীরের চিত্রায়ণ তিনি কেন করেছেন তাঁর ব্যখ্যাও পাওয়া গেছে বেশ চমৎকারভাবে। তিনি বলেন,
“সচরাচর আমরা যা দেখে থাকি তার দৃশ্যানুগ সরল উপস্থাপনা ছবি নয়। তেমন কাজ শিল্পীর তুলির দক্ষতা তুলে ধরে মাত্র। কিন্তু তার কোনো হিউম্যান ভ্যালু থাকে না। শুধু প্লাস্টিক ভ্যালু চিত্রকলার উদ্দেশ্য হতে পারে না, তবে শিল্পীর নৈপূণ্য কৌশল তার ছবির হিউম্যান ভ্যালু ফুটিয়ে তুলতে অবদান রাখে অবশ্যই। আবার ছবির স্বাভাবিক অঙ্গ-সৌষ্ঠবের হলে তোমাদের মনে এই প্রশ্ন জাগত না। এগুলো গ্রামীণ জীবনের Photographic Representation হোত মাত্র। বক্তব্যহীন ছবি নিশ্চয় ছবি নয়। ওদের স্বাস্থ্যবান করে চিত্রিত করার উদ্দেশ্য তিনটি বিষয়ের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। বিষয় তিনটি হলো _ নৃতত্ত্ব, ইতিহাস ও রাজনীতি। নৃতত্ত্ব বলছে, আমাদের পূর্ব-পুরুষরা খুবই স্বাস্থ্যবান ছিল, দানবীয় অঙ্গ-সৌষ্ঠবের ছিল। অনার্য জনগোষ্ঠীর মানুষ হওয়ায় তাদের রঙ, নাক, চোখ, চুল ইত্যাদি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের যা আমার ছবির মানুষের রয়েছে। ঐতিহাসিক সত্য হল, একদা তাদের প্রাচুর্য ছিল, কোনো কিছুরই অভাব ছিল না, কিন্তু রাজনৈতিক চক্রান্তে তাদের সে স্বাস্থ্য হারিয়ে গেল। যুগে যুগে তারা শোষিত হল নিরন্তর এবং এই প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত রয়েছে। আমি চাই ওদের হারানো স্বাস্থ্য ফিরে পাক । আমি স্বপ্ন দেখি ওদের সোনালী দিন। আমি তাকাই সামনে ও পেছনে, সময়কে অতিক্রম করে। তাই ওরা দানবীয়। তাছাড়া মানুষকে ভালোবাসলে তার প্রকাশ হওয়া চাই সুন্দর ও বলিষ্ট। আমার কাছে শক্তিই সৌন্দর্য। মাইকেল এঞ্জেলো যেমন মানুষকে Normal size থেকে Abnormal size এ নিয়ে গেছেন। তিনি মনে করেছেন, মানুষ এত বড় হলে ভালো হয়। Concept of Adam-ও কিন্তু এই রকম। তার যে বর্ণনা আছে তা এই রকম”।
বহু বিচিত্র বিষয়ে সুলতানের দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে এ বইয়ে। কাশ্মিরে প্রদর্শনীর কথা যেমন এসে তেমন এসেছে সেখানকার সৌন্দর্য ও কৃষকের কথা। এসেছে ইউরোপে ও আমেরিকায় প্রদর্শনী পরিভ্রমণের গল্প।

বিচিত্র ও বহুমাত্রিক আভায় উদ্ভাসিত শিল্পী সুলতানকে নিয়ে গুন্টার গ্রাস বলেছিলেন, ‘সুলতানকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ হয় না’। “মুখোমুখি সুলতান” পাঠ করে উপলব্ধি হলো গুন্টার গ্রাসের মূল্যায়নটুকু কতটা গভীর ও অন্তর্ভেদী। সুলতান বামুনের দেশে এক অতিকায় স্বাপ্নিক।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৮:০৭
৮টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস-পরীক্ষার হলে দেরিঃ পক্ষ বনাম বিপক্ষ

লিখেছেন BM Khalid Hasan, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



বর্তমানের হট টপিক হলো, “১ মিনিট দেরি করে বিসিএস পরীক্ষার হলে ঢুকতে না পেরে পরীক্ষার্থীর স্বপ্ন ভঙ্গ।” প্রচন্ড কান্নারত অবস্থায় তাদের ছবি ও ভিডিও দেখা যাচ্ছে। কারণ সারাজীবন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা-২০২৪

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭



ছবি সৌজন্য-https://www.tbsnews.net/bangla




ছবি- মঞ্চে তখন গান চলছে, মধু হই হই আরে বিষ খাওয়াইলা.......... চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী গান।

প্রতি বছরের মত এবার অনুষ্ঠিত হল জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা-২০২৪। গত ২৪/০৪/২৪... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

×