somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কানুনগোপাড়া: আলোকিত অতীতের উৎসারিত আলোতে

১৪ ই মে, ২০২১ রাত ১০:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কাল গিয়েছিলাম বোয়ালখালি পোপাদিয়া গ্রামে ভাস্কর জয়াশীষ আচার্যের বাড়িতে। কালচারাল পার্ক আসার পর এটি বেশ মজার ভ্রমণ ছিল। লম্বুরঘাট দিয়ে কর্ণফুলি পার হয়ে আমার প্রথম বোয়ালখালী যাওয়া। কৃষ্ণা অবশ্য এর আগেও জয়াশীষদার বাড়িতে গিয়েছে। তবে লম্বুরঘাট দিয়ে নয়।

সকাল ১০ টার মধ্যেই পৌঁছলাম জয়াশীষদার বাড়িতে। বেশ কিছুক্ষণ আলাপ-সালাপ আর পানাহার করে ১২ টার দিকে বউ, পুত্র, শাশুড়ি ও শ্যালিকাকে নিয়ে রওয়ানা দিলাম কানুনগোপাড়ার উদ্দেশ্যে।


টমটম থেকে নামলাম স্যার আশুতোষ কলেজের সামনে। রসিক চন্দ্র দত্তের জ্যেষ্ঠপুত্র রেবতী রমণ দত্ত ‘কানুনগোপাড়া এডুকেশন সোসাইটি’র সহযোগিতায় ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে এই কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁরই পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নামে। কোভিডের কারণে তালাবদ্ধ ঐতিহাসিক কলেজে আর ঢোকা সম্ভব হলো না, যদিও ক্যাম্পাসের কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম শিখর বরণডালা পেতে অপেক্ষায় ছিল আগন্তুক পরিব্রাজকদের জন্য।

কলেজের সামন ধরে এগুতেই দেখি কানুনগোপাড়া ড. বিভূতি ভূষণ উচ্চ বিদ্যালয়। ড. বিভূতি ভূষণের নাম প্রথম শুনেছিলাম প্রিয়মদার কাছে। রসিক-মুক্তকেশী দম্পত্তির তৃতীয় রত্ন বিভূতি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপক ছিলেন। একসময় অধ্যাপনা ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়ে যান। গবেষণা প্রবন্ধ The science of the sulba জন্য D.sc ডিগ্রি লাভ করেন। বিভূতি ভূষণ উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশেই একটা মন্দির। মন্দিরের মাঠে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম কোথায় যাওয়া যায়! ফোন করলাম প্রিয়মদাকে। ব্যাস! পেয়ে গেলাম তথ্য। সামান্য দূরেই শতবর্ষী বান্ধব পাঠাগার। শিল্পী শেফালী ঘোষের বাড়ি। আর বিখ্যাত দত্ত বাড়ি। আপডাউন টমটম নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম।


প্রথমে বান্ধব পাঠাগারে নামলাম। এরই মাঝে আমাদের সাথে সংযুক্ত হলো ভাস্কর তপন ঘোষ। পাঠাগারের চত্ত্বরে দাঁড়িয়ে অনুভব করছিলাম শতবর্ষ আগে সমাজ নির্মাণে ও স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর স্বাপ্নিক তরুণ বিপ্লবীদের পদধ্বনী। যুব সমাজের মধ্যে পাঠ্যাভ্যাস বৃদ্ধি ও শরীর চর্চায় উদ্বুদ্ধ লক্ষ্য নিয়ে ১৯০২ সালে কানুনগোপাড়া বান্ধব সমিতি নামে এক সংগঠন গড়ে উঠে। ত্রিপুরা চরণ চৌধুরী, রেবতি রমণ দত্ত, মোক্ষদা রঞ্জন কানুনগো, ড. বিভূতি ভূষণ দত্তসহ যুবকরা মিলে এই সংঘ গড়ে তোলেন। স্বদেশী আন্দোলনে যোগসূত্রের দায়ে ব্রিটিশ সরকার এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। পরে এর নাম পালটিয়ে রাখা হয় কানুনগোপাড়া বান্ধব পাঠাগার। পাঠাগারের অন্তরালে আশপাশের গ্রামে চলত বিপ্লবের প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি। এমন স্মৃতিধন্য পাঠাগারে প্রবেশ করতে পারিনি কোভিডের কারণে। পাঠাগার পুনর্নির্মিত হয়েছে বেশিদিন হয়নি। হলঘরও নির্মাণ হয়েছে। নতুন ভবনটির নাম করা হয়েছে দত্ত বাড়ির আরেক কৃতি সন্তান বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের প্রথম হাইকমিশনার সুবিমল দত্তের নামে। কিছুক্ষণ কাটানোর পর ছুটলাম কিংবদন্তী শিল্পী শেফালী ঘোষের বাড়ির দিকে।


কানুনগোপাড়ায় একটা বিষয় লক্ষ করলাম যে, বিশাল বিশাল পুকুর কাটা হচ্ছে যন্ত্র দিয়ে। এরকমই একটি পুকুরের পাড়ে শেফালী ঘোষ চিরনিদ্রায় শায়িত। তাঁর সমাধির উপর শিল্পীর আবক্ষ একটা ভাস্কর্য।

কৃষ্ণা বেশ আপ্লুত হয়ে উঠলো। এই ভাস্কর্যটির কাজ সে করেছিল। মূল ভাস্কর যদিও কোথাও তার নাম রাখেননি (নিদেনপক্ষে সহকারী ভাস্কর হিসেবে)। আমরা সবাই বেশ কয়েকটি ছবি তুললাম। তপন জিজ্ঞেস করে করে আমাদের নিয়ে গেল শেফালী ঘোষের ভিটায়। বিশাল মাটির দোতলা বাড়ি (শেফালী ঘোষের ভাই জানিয়েছিলেন এটি তিনতলা ছিল! ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এখন এই অবস্থা।) মাটির বাড়ির এক মাথায় পাকা একচালা ঘর।

বারান্দায় বসে ছিলেন শিল্পীর বড়ো ভাই। আমাদের দেখে তার স্ত্রীও বেড়িয়ে আসেন। বয়স্ক এই দম্পত্তি আমাদের পেয়ে গল্পের ঝুড়ি খুললেন, বললেন অনেক কথা। চা নাখেয়ে উঠতেই দেবেন না। এদিকে গাড়িওয়ালার তাড়া। তার অন্য ট্রিপের সময় হয়ে এসেছে। চা পান করে বিলম্ব না করে বেড়িয়ে পড়লাম।

কিছু দূর এগিয়েই পেলাম মুক্তকেশী বালিকা বিদ্যালয়। ১১ জন মেধাবী ও গুণী পুত্রের মা হিসেবে ব্রিটিশ সরকার মুক্তকেশী দত্তকে রত্নগর্ভা উপাধি দিয়েছিল। কিন্তু তারপরও মুক্তকেশীর মনে এক গভীর বেদনা ছিল। চার কন্যা মনোরমা দত্ত, চিন্ময় দত্ত, স্নেহলতা দত্ত ও সরোজ দত্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেননি। মায়ের মনের এই দুঃখ মেটাতে ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে রেবতী রমণ দত্ত মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মুক্তকেশী বালিকা বিদ্যালয়’। তিনি ছিলেন সে সময় ব্রিটিশ সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। কোভিডের জন্য যথারীতি এই স্মৃতিধন্য বিদ্যাপীঠও বন্ধ ছিল।

পাশেই রসিক-মুক্তকেশীর বাস্তুভিটায় ভগ্নপ্রায় মাটি আর কাঠের দ্বিতল বাড়ি। বিভিন্ন আশ্রিত মানুষ রয়েছে ঘরগুলোতে। ঘুরতে ঘুরতে আমাদের ফিরতে হলো তিনটার দিকে জয়াশীষদার ডেড়ায়। অন্নপ্রাশনের ভুড়িভোজ করে সন্ধ্যার আগেই ফিরলাম আপন-নীড়ে একরাশ তৃপ্তি নিয়ে।

তথ্যসূত্র :
১। Click This Link
২। Click This Link
৩। Click This Link.
৪। Click This Link.
৫। Click This Link.

সংযুক্তি:
রসিক-মুক্তকেশীর ১১ সন্তান:
রেবতী রমণ দত্ত, এমএ; বিসিএস (জন্ম ২২-৭-১৮৮৪ মৃত্যু ১২-৭-১৯৬৪)। ভূপতি মোহন দত্ত, এমএ, বিএল; জন্ম-১৮৮৬ মৃত্যু-১৯৭১ (বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামের সময়) । বিভূতিভূষণ দত্ত, ডিএসসি; পিআরএস (জন্ম-২৮-৬-১৮৮৮, মৃত্যু-৬-১০-১৯৫৮ )। নীরদ লাল দত্ত, এমবি; জন্ম-১৮৯০ মৃত্যু-১৯৬৮ইং (৬ মে)। বিনোদ বিহারী দত্ত, এমএ; বিএল; পিএইচডি; পিআরএস (জন্ম-২-৯-১৮৯২ , মৃত্যু- ২-৩-১৯৭৬)। হরিহর দত্ত, এমবি (জন্ম-২৭-৬-১৮৯৯ মৃত্যু-২১-৬-১৯৯০)। প্রমথ রঞ্জন দত্ত, এমএ; পিএইচডি (লন্ডন)জন্ম-১৯০১ মৃত্যু-৩০-১০-১৯৩৯ । সুবিমল দত্ত, বিএসসি; আইসিএস (জন্ম ৫-১২-১৯০৩ মৃত্যু ২-৩-১৯৯২)। সুকোমল দত্ত, বিএসসি (ইঞ্জিনিয়ার); এমআইই (জন্ম ১৯০৬ , মৃত্যু-...)। পরিমল দত্ত, এমবি (জন্ম ১৯১০, মৃত্যু ২২-৩-১৯৭২)। রণজিৎ কুমার দত্ত, বিই (জন্ম ২-৭-১৯১৩ মৃত্যু ৫-৫-১৯৯৭)।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০২১ রাত ১০:৫২
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস-পরীক্ষার হলে দেরিঃ পক্ষ বনাম বিপক্ষ

লিখেছেন BM Khalid Hasan, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



বর্তমানের হট টপিক হলো, “১ মিনিট দেরি করে বিসিএস পরীক্ষার হলে ঢুকতে না পেরে পরীক্ষার্থীর স্বপ্ন ভঙ্গ।” প্রচন্ড কান্নারত অবস্থায় তাদের ছবি ও ভিডিও দেখা যাচ্ছে। কারণ সারাজীবন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

×