somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গন্তব্য ......

২৭ শে জুন, ২০১২ রাত ১১:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ট্রেনটা ছুটতে ছুটতে জিরিয়ে নেবার সাথে সাথে কয়েকটা লোকের ওঠানামায় সুবিধা করে দিতেই আমার গন্তব্যপথের ঠিক মাঝামাঝি স্টেশনটায় এসে থামল।

ফাল্গুন-চৈত্রের এই কড়কড়ে সকাল , তাতানো মধ্যদুপুরগুলোর কথা বোধহয় কোন কবি বলেননি অথবা কম বলেছেন । তাঁরা শুধু বলেছেন গাছে গাছে নতুন কুঁড়ি আর ফুলের বেড়ে ওঠার কথা, দখিনা বাতাসের বাঁশি বাজিয়ে গান শোনাবার কথা ।
সাধারণ কর্মজীবী মানুষ আর ছাত্রছাত্রীদের কাছে বসন্তের রূপ এতো মাধুর্যময় হয়ে ওঠে না । রাস্তার পাশের ধুলো এমনিতেই ছটফটে ; তার ওপর ট্রেনের আগমনীবার্তা পেলেই নাচানাচি আরও বেড়ে যায় । আর ধুলোদের এই উদ্দামনৃত্যের হতভাগ্য দর্শক এবং ভোজক ( ধুলো খাবার কথা মনে হয় সবাই জানে) আমাদেরকেই হতে হয় !!

যারা এইমাত্র নেমে গেল তাদের বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হবার দৃশ্য কল্পনা করে আমার কষ্ট আরেকটু বাড়ল। আমাকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে বাসায় পৌছাতে ।

বিরক্তি নিয়ে প্যান্টের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে চোখ গেল প্ল্যাটফর্মের দিকে। দেখি ট্রেনে ওঠার জন্য পা বাড়িয়েছে দুই ভাই বোধহয় । একজনের বয়স আন্দাজ ১০-১২। আরেকজনকে দেখে মনে হল ৪ কিংবা ৫ এর বেশী না।
আমার গল্পের নায়ক এই ছোটজন।

বাইরের রোদ আরও স্পষ্ট করে দিলো ছেলেটার চেহারা । আমি এমনিতেই ধুলো বেশ ভয় পাই, তার উপর ছেলেটার চেহারা দেখে আমি রীতিমতো আঁতকে উঠলাম । নিজচোখে না দেখলে আসলে ঠিক বলে বোঝানো যাবেনা । একটা জীর্ণ হাফপ্যান্ট পরা, খালিগা। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা । সেই মাথায় এতো পরিমাণে ধুলো জমে আছে যে দেখলে মনে হবে কেউ হয়তো ওকে ধুলোস্নান করিয়েছে এইমাত্র । মাথাটা চিকচিক করছে বালিতে। আমি এই ভেবে অবাক যে বড় ভাইটা কি মাথাটা ঝেড়েও দিতে পারেনা ! এইতো গেল মাথার কথা । ছেলেটার মুখ তখনও ভালভাবে দেখিনি । তবে যতটুকু দেখলাম , মুখেও ধুলোর ছড়াছড়ি ।

ট্রেনে উঠলো ওরা । আমি দরজার পরেই প্রথম সিটে জানালার পাশে বসা। ছেলেটা বিনা সংকোচে , ধাই করে আমার হাঁটু ঘেঁষে জানালায় থুতনি ঠেকিয়ে দাড়িয়ে পড়লো । আমি সংস্কারবশত (! ) পা টা সরিয়ে নিলাম। ওর গায়ে আমার পা লেগেছে এই জন্য নয়; আমার কাপড়ে ধুলো লাগার ভয়ে । বলতে অস্বস্তি হচ্ছে তবুও নিজের দোষ ঢেকে নিজের কাছে ছোট হতে চাইনা। আমি একটু সংকুচিত হয়ে বসলাম । তাই বলে ওকে সরে যেতে বলব এমন নির্লজ্জ হয়ে যাইনি । কয়েকমিনিট পর সংকুচিত ভাবটাও কেটে গেল । আমি মনে মনে স্বস্তি পেলাম নিজের ব্যবহারে ।

- জুয়েল , যেইহানে দাড়াইসস ঐহান থিকা লড়বিনা , ঠিকাছে ?
- ঠিকাছে ।

বড় ভাইয়ের আদেশ শুনে সায় দিলো জুয়েল নামের ধুলোমাখা ছেলেটা।
স্পষ্ট কথা বলা শুনে একটু ধাক্কা খেলাম । বয়স আমার অনুমানের চেয়ে একটু বেশীই হবে বোধহয় । ভেবেছিলাম ভিক্ষা করতে উঠেছে । কিন্তু না। ভিক্ষা চাইবার কোন লক্ষণ দেখলাম না ।

জুয়েল এখনো আমার পা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে । হাতটা জানালা দিয়ে বাইরে বের করে দিয়েছে । বাতাস ছোঁয়ার খেলা খেলছে ।

আমি সেই সুযোগে আরেকটু ভাল করে দেখে নিতে লাগলাম ওকে । মুখটা দেখতে পেলাম। কপাল, নাক , গাল বালুতে মাখা। যেন আঠা দিয়ে ধুলোগুলো জুড়ে দিয়েছে কেউ। কানের দিকে চোখ গেল । ধুলোর একটা মিনি পাহাড় তৈরি হয়েছে ওখানে। ঠোঁটদুটোয় কিসের লাল রং সেটা বুঝিনি । হয় রক্ত না হয় লাল রঙের সস্তা আইসক্রিমের দাগ।

মায়া , আবেগ জিনিসগুলো অদ্ভুত ! এরা যখন তখন , যেখানে সেখানে উঁকি মারতে পারে। এখন কি কারণে ওর উপর আমার মায়া জন্মালো সেটা রীতিমতো গবেষণার বিষয় । প্রথমে ভেবেছিলাম ভিক্ষা চাইলে ভিক্ষা দিয়ে দেব।
কিন্তু ভিক্ষা চাইল না কারো কাছ থেকেই। ভাবলাম নামার আগে ওকে দশটা টাকা দিয়ে যাব। একরকম মনস্থির করেই বসে আছি। পকেটে হাত ঢুকিয়ে টাকাটা বের করে হাতের মুঠোয় নিয়ে রাখলাম।

ট্রেনটা পরের স্টেশনে এসে গেছে প্রায়।

-“জুয়েল , আইয়া পরসি । চল যাইগা ।” বড় ভাইটার কণ্ঠ ।
আমি জুয়েলের হাত খুঁজতে লাগলাম। আলগোছে টাকাটা ওর হাতে দিয়েই নেমে যাব। ততক্ষণে নামার জন্য বাম দিকের দরজায় লোক জড়ো হয়ে গেছে। ডান দিকটা একটু অপরিষ্কার । ওদিকে কেউ নামবেনা।

কিন্তু যা ভাবিনি সেটাই হল। ওরা ডান দিকের দরজা দিয়ে চলে গেল আর আমি এদিকে পড়ে গেলাম লোকজনের ভিড়ের মাঝে । অবস্থা এমন যে ওদিকে দাঁড়িয়ে থাকা দায়। নামতেই হবে। টাকাটা হাতের মুঠোয় ধরা ।

তখনো পারতাম জুয়েলকে ডেকে টাকাটা দিতে । কিন্তু আমি দি গ্রেট মুখচোরা !! সবার সামনে কোন কারণ ছাড়া শুধু শুধু একটা ছেলেকে ডেকে টাকা দিতে যাচ্ছি আর সবাই সেটা হাঁ করে দেখছে – ইহাই আমার অস্বস্তির কারণ !

জুয়েল চলে গেল আমার লুকানো দয়া , মহত্ত্ব আর দানশীলতাকে হেয় করে। আর আমি নেমে গেলাম একটা চাপা কষ্ট নিয়ে।

ভাবলাম অন্য কাউকে দিয়ে দেই ।রাস্তায় তখন খুঁজলাম জুয়েলের মত বাচ্চাদের । কিন্তু ঐসময় সবাই যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে !

দশটা টাকা আমার জন্য কিছুইনা কিন্তু হয়ত জুয়েলের জন্য অনেক কিছু। দশটাকার জায়গায় একশো টাকা দিলেও আমার কমবেনা। অথচ দেখো , জুয়েল আমার সেই দান না পেয়েও কেমন সুখে ধুলোমেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে ।
আর আমাকে যেন মনে মনে বলে যাচ্ছে – “ তুমি থাকো তোমার দশটাকা আর একরাশ লজ্জা নিয়ে । আমি চাইনা তোমার দাক্ষিণ্য ; ওটা নিজের কাছেই রেখে দাও।”

জুয়েলের সেই অবচেতন মনের না বলা ধিক্কার আমার কানে বাজতে লাগলো ।

“জীবনটা একটা বিশাল পথ । সবাই পথিক। কেউ নিজ গন্তব্য আগে থেকেই বেছে নেয়। কেউ সঠিক গন্তব্যের খোঁজ না পেয়ে নিজেকে ছেড়ে দেয় কোন সুনসান আঁধারঘেরা পথে। আবার কেউ কখনোই ঠিক করতে পারেনা কোন পথে সে হাঁটবে ; চিরটাকাল বিভ্রান্তই থেকে যায় ............... গন্তব্যহীন ......... ।”

এদিকে দশ টাকার নোটের গন্তব্য হয়ে গেল আবার আমার পকেটে ,
জুয়েলের গন্তব্য সেই ধুলোমাখা চিরচেনা রাস্তা ,
আমার শরীরের গন্তব্য বাসা ,

আর

আমার মুখচোরা , বিভ্রান্ত মনের গন্তব্য ? ............ – সে আমি নিজেও জানি না।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১২ সকাল ১০:১৬
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×