somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিউ এথিস্ট এর কাণ্ডারিরা

২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১০:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে লেখনীর মাধ্যমে নাস্তিক্যবাদী দর্শন প্রচার করে আলোচনায় উঠে আসা লেখকদের ‘নব-নাস্তিক্যবাদী’(New Atheists) বলে আখ্যায়িত করা হয়। এই লেখকদের মধ্যে রয়েছেন স্যাম হ্যারিস, রিচার্ড ডকিন্স, ড্যানিয়েল ড্যানেট এবং ক্রিস্টোফার হিচেন্স। এই লেখকেরা তাদের বইতে ধর্ম ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। সাংবাদিকতার ভাষায় এই লেখকদেরকে ‘নব-নাস্তিক্যবাদী’র তকমায় ভূষিত করা হয়। এরা নাস্তিক্যবাদের চার অশ্বারোহী (Four Horsemen) হিসেবেও অভিহিত হয়ে থাকেন। নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির উপরে অগাধ আস্থা ‘নব-নাস্তিক্যবাদী’ লেখকদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। পর্যবেক্ষকদের মতে, বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রভাবের প্রতিক্রিয়ায় এই লেখকরা নৈতিক দায়বোধ এমনকি কখনোবা ব্যক্তিগত ক্ষোভ এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকেন। দার্শনিকভাবে তাদের অবস্থান এবং প্রস্তাবিত যুক্তিসমূহ নতুন নয়। তা সত্ত্বেও, ‘এই চার’ লেখক তাদের কাজের ধরণ ও বক্তব্যের মাধ্যমে নানাবিধ বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন।

পেশা ও পদ্ধতিগত দিক থেকে এই লেখকদের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। পেশার দিক দিয়ে এদের মধ্যে কেবল ড্যানিয়েল ডেনেটই একজন দার্শনিক। নব-নাস্তিক্যবাদীরা একই সাধারণ পূর্বানুমান এবং দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে থাকেন। তাদের এই অবস্থান এবং এর পটভূমির তাত্ত্বিক গঠনকাঠামোকে ‘ ‘নব-নাস্তিক্যবাদ’’ নামে অভিহিত করা হয়। এই গঠনকাঠামোর একটি অধিবিদ্যাগত, একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক এবং একটি নৈতিক অংশ রয়েছে। অধিবিদ্যাগত অংশে অলৌকিক বা স্বর্গীয় কোন সত্তার অস্তিত্বহীনতা সম্পর্কে এই লেখকেরা সবাই একমত। জ্ঞানতাত্ত্বিক অংশে তাদের দাবি যে, ধর্মীয় বিশ্বাস মূলত অযৌক্তিক। নৈতিক অংশের প্রস্তাবনায় তারা একটি বৈশ্বিক এবং সার্বজনীন নৈতিক মানদন্ডের অস্তিত্ব রয়েছে বলে দাবি করেন। এই নৈতিক অংশ তাদেরকে ইতিহাসের বিখ্যাত নাস্তিক নিৎসে এবং সাত্রে থেকে আলাদা করেছে। নব-নাস্তিক্যবাদীদের দাবি মতে, বিভিন্ন দিক দিয়ে বিচার করলে ধর্ম অশুভ বৈ অন্য কিছু নয়। যদিও এক্ষেত্রে ড্যানেটের অবস্থান অন্য তিনজনের চেয়ে অনেক বেশি রক্ষণাত্মক।

ধর্মীয় বিশ্বাসের সমালোচনা এবং এর বুৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ব্যাখ্যায় নব-নাস্তিক্যবাদীরা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে থাকেন। ধর্মের গ্রহণযোগ্য বিকল্পের তালিকায় তারা বিজ্ঞানকে অগ্রাধিকার দেন। নব-নাস্তিক্যবাদীদের মতে, বিশ্বজগত ব্যাখ্যায় জ্ঞানলব্ধ বিজ্ঞানই একমাত্র(কিংবা সর্বোত্তম) পন্থা। কোনো বিশ্বাসকে তখনই জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে গ্রহণ করা সম্ভব, যখন এর সপক্ষে যথেষ্ট পরিমাণ প্রমাণ উপস্থিত থাকে। নব-নাস্তিক্যবাদীরা এই বলে উপসংহার টানেন যে, বিজ্ঞান ঈশ্বরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার বদলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব না থাকার দাবির প্রতি সমর্থন জানায়। তাদের দাবি অনুযায়ী, বিজ্ঞান ধর্মকে জৈবিক বিবর্তনের একটি পণ্য হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারে। উপরন্তু, ইহজাতিক নৈতিকতাবোধ এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করে ধর্মবিশ্বাসের গন্ডীর বাইরেও উপভোগ্য জীবনযাপন করা সম্ভব।

বিশ্বাস এবং যুক্তিবাদ

নব-নাস্তিক্যবাদীদের লেখনীতে ‘বিশ্বাস’ এর একটি সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা খুঁজে পাওয়াটা দুরুহ একটি কাজ। তাদের বিভিন্ন বক্তব্য থেকে বিশ্বাসের প্রতি তাদের বৌদ্ধিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি সাধারণ চরিত্র রূপায়িত হয়। রিচার্ড ডকিন্স তার ‘দ্য সেলফিশ জিন’ বইয়ে বলেন, ধর্মবিশ্বাস হল সাক্ষ্য-প্রমাণবিহীন অন্ধ-বিশ্বাস। এমনকি বিবদমান সাক্ষ্য-প্রমাণসমূহ ধর্মবিশ্বাসের বিপক্ষে সাক্ষ্য দেয়। একই ধারাবাহিকতায় ‘দ্য গড ডিলুশন’ বইয়ে ডকিন্স দাবি করেছেন, ধর্মবিশ্বাস আদতে অশুভ। কেননা এর বিশ্বাসীরা এর যথার্থতা নিরুপনের প্রয়োজন বোধ করে না। একইসাথে ধর্মবিশ্বাস এর বিপক্ষ মতকে সহ্য করতে পারে না। প্রথম ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, ডকিন্স মনে করেন, বিশ্বাস বুৎপত্তিগতভাবেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়, এমনকি তা অযৌক্তিক। ডকিন্সের পরবর্তী ব্যাখ্যা অনুযায়ী, যুক্তিবাদের জগতে বিশ্বাসের কোনো স্থান নেই। বিশ্বাসের স্বরূপ সম্পর্কে স্যাম হ্যারিসের দৃষ্টিভঙ্গি ডকিন্সের প্রথমদিককার বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। হ্যারিস বলেন, ধর্মীয় বিশ্বাস হল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি সম্পর্কে যথার্থতা-বিহীন বিশ্বাস। তার মতে, প্রমাণবিহীন কোনো বিষয়ে সুদৃঢ় আস্থা জ্ঞাপনে বিশ্বাস এক ধরণের অনুমোদন। এই অনুমোদন ধার্মিকরা একে অন্যকে দিয়ে থাকেন।

হিচেন্সের মতে, ধর্মীয় বিশ্বাসের শিকড় প্রোথিত রয়েছে ঐচ্ছিক চিন্তাধারার মধ্যে। ড্যানিয়েল ডেনেট এর মতে, ঈশ্বরের পক্ষে যুক্তিপরায়ণ হওয়া সম্ভব নয়। কেননা ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কিত ধারণার কোনো সুনির্দিষ্ট রূপরেখা নেই। ফলে ‘ঈশ্বরের অস্তিত্ব রয়েছে’ এমন বক্তব্যের কোনো যুক্তিগ্রাহ্য অর্থোদ্ধার করা সম্ভব নয়। এই অবস্থানকে সামনে রেখে ডেনেট প্রশ্ন ছুঁড়েছেন, ঈশ্বরের অস্তিত্ব দাবিকারীরা কি আদতেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন? ডেনেটের মতে, তারা হয়তো ‘ঈশ্বরবিশ্বাস’ প্রচার করেন, কিংবা ‘ঈশ্বর বিশ্বাস’ কে বিশ্বাস করেন(তারা মনে করেন ঈশ্বর বিশ্বাস একটি কল্যাণকর ধারণা যাকে বিশ্বাস করা যায়)। ড্যানেটের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, ধর্মবিশ্বাস কখনো যুক্তিগ্রাহ্য বা যৌক্তিক হতে পারে না। নব-নাস্তিক্যবাদীদের সমালোচকরা এক্ষেত্রে তাদেরকে বিশ্বাসকে যুক্তিগ্রাহ্য হিসেবে গ্রহণ করে বিকশিত হওয়া পাশ্চাত্যের দীর্ঘ দার্শনিক ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেন । সেন্ট অগাস্টিনের হাত ধরে পাশ্চাত্যের দার্শনিক ধারার সূত্রপাত যা বর্তমান যুগে এসেও অব্যাহত রয়েছে।

নব-নাস্তিক্যবাদীরা তাদের যৌক্তিক বিশ্বাসের মানদন্ড হিসেবে বিজ্ঞানবাদের ( scientific ) কিছু ধারাকে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বিজ্ঞানবাদের মতে, জ্ঞানভিত্তিক বিজ্ঞানই বিশ্বজগৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের একমাত্র মাধ্যম (কঠোর বিজ্ঞানবাদ)। কিংবা আরও উদার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করলে, যাবতীয় যৌক্তিক বিশ্বাসের একমাত্র উৎস(উদার বিজ্ঞানবাদ)। হ্যারিস এবং ডকিন্স এক্ষেত্রে খুবই উচ্চকণ্ঠ। হ্যারিস এক্ষেত্রে যাবতীয় অ্যাধাত্মিক ও নৈতিক প্রশ্নের সমাধানের যৌক্তিক পথ হিসেবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন। অন্যদিকে ডকিন্স জোর দিয়ে বলেন, একজন সৃজনশীল সত্তার অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্বের প্রশ্নটি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসুতার আওতাভুক্ত একটি প্রশ্ন। আলামত-সাপেক্ষতার উপস্থিতির উপরও নব-নাস্তিকবাদীরা সমান জোর দেন। তাদের মতে, একটি বিশ্বাস তখনই সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয় যখন এর সপক্ষে যথেষ্ট পরিমাণ সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকে। বিশ্বাসের সপক্ষে যথেষ্ট পরিমাণে বৈজ্ঞানিকভাবে যাচাইযোগ্য আলামত উপস্থিত থাকলেই কেবল তা জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে সত্য। এমন দাবি উপস্থাপনের মাধ্যমে বিজ্ঞানবাদ ও আলামত-সাপেক্ষতার মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নব-নাস্তিক্যবাদীরা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস অযৌক্তিক বলেই উপসংহার টানেননি। তারা আরও একধাপ এগিয়ে দাবি করেছেন, ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। বরং বিবদমান সাক্ষ্য-প্রমাণ ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষেই সাক্ষ্য দেয়। “ঈশ্বর-অনুকল্প” দাবি করে, অতিমানবীয় ক্ষমতা এবং অতিপ্রাকৃত বুদ্ধিমত্তার অধিকারী একজন ব্যক্তি স্বীয় ইচ্ছা এবং সৃজনীশক্তি দিয়ে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন । ডকিন্সের যুক্তি অনুযায়ী এই অনুকল্পটি মূলত “প্রমাণবিহীন। বরং তা স্থানীয় প্রথানির্ভর ব্যক্তিগত পর্যায়ের প্রচারণার একটি বিকশিত রূপ”(২০০৬, পৃ ৩১-৩২)। জ্ঞান-ভিত্তিক পূর্বানুমানের উপর নব-নাস্তিক্যবাদীদের অতি নির্ভরতা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে। বিজ্ঞানবাদের সপক্ষে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক সমর্থন আছে কিনা কিংবা আলামত-নির্ভরতার সপক্ষে যথেষ্ট আলামত রয়েছে কিনা, তা নিয়ে সমালোচকেরা সন্দিহান। স্বাভাবিকভাবেই তারা নবনাস্তিক্যবাদীদের আলামত-সাপেক্ষ অনুমানসমূহকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।

ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তিসমূহ

নাস্তিক্যবাদ বর্তমান যুগে এসেও একটি বহুল বিতর্কিত দার্শনিক অবস্থান। সুতরাং, নব-নাস্তিক্যবাদীরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষকার যুক্তিগুলোকে সময় নিয়ে বিবেচনা করবেন, এমনটা আশা করাই যায়। তারা ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষেও বলিষ্ট যুক্তির অবতারণা করবেন, এমনটাও প্রত্যাশিত। কিন্তু এদের কেউও এক্ষেত্রে মনোযোগী নন। ডকিন্স এ বিষয়ে এক অধ্যায় খরচ করলেও, ঈশ্বরবিশ্বাসীদের যুক্তিসমূহকে অতিমাত্রায় অভিসম্পাত এবং প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্বের দার্শনিক অংশকে এড়িয়ে যাবার কারণে সমালোচিত হয়েছেন। ডকিন্স দাবি করেছেন, ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। কিন্তু ডকিন্সের এড়িয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্বের দার্শনিক অংশে ডকিন্সের এই দাবির জবাব রয়েছে। নাস্তিক্যবাদকে আবশ্যিকভাবে সত্য ধরে নিয়ে স্যাম হ্যারিস ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষ-বিপক্ষকার যুক্তিতর্কের ব্যাপারে খুব বেশি বাক্যব্যয় করেননি। ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষকার বিশ্বতাত্ত্বিক দাবির( cosmological argument) ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেই হ্যারিস উপসংহার টেনেছেন। হ্যারিসের মতে, এই দাবি মহাবিশ্ব সৃষ্টির বিকল্প সম্ভাব্যতার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে, যা ঈশ্বর মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন বলে প্রণীত মূল দাবির সাথে সাংঘর্ষিক। ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতা প্রমাণ করতে হ্যারিস অশুভের অস্তিত্ব এবং পরিকল্পনাহীন নকশার (Unintelligent Design) দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। একই প্রেক্ষাপটে হিচেন্স “ধর্মগুলোর অধিবিদ্যাগত দাবিগুলো মিথ্যা”, “পরিকল্পিত নকশার দাবিসমূহ” শিরোনামে কয়েকটি প্রবন্ধ রচনা করেছেন। কিন্তু তার সাম্প্রতিককালের নিবন্ধসমূহতে তিনি নতুন কিছু বিষয় দাবি করেছেন। হিচেন্স বলেন, আজকের যুগে বিজ্ঞান ধর্মীয় পরিমণ্ডলের আওতাভুক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে সক্ষম। ফলে অতীতের ন্যায় ধর্মের মুখাপেক্ষী হবার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। হিচেন্সের মতে তাই, ঈশ্বর অনুকল্পটি আদতেই অপ্রয়োজনীয় । এরকমই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, মহাবিশ্বের আপাতদৃশ্য সুনিপুণ গঠনকাঠামোর নকশাকারক কে? ড্যানিয়েল ড্যানেট ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষকার যুক্তিগুলো পর্যালোচনা শেষে সেগুলোর দূর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ড্যানেট যুক্তি দেখান যে, ঈশ্বর নামক ধারণাটির কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশাত্মক বৈশিষ্ট্য নেই। ফলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কিত তর্ক-বিতর্কের প্রেক্ষাপট নিরূপণ করা যায় না।

নব-নাস্তিক্যবাদী চার বক্তার মধ্যে ঈশ্বরের সম্ভাব্য অস্তিত্বহীনতা নিয়ে ডকিন্সের উত্থাপিত যুক্তিটির কলেবর বিস্তারিত। যদিও ডকিন্সের দাবির কোনো অবরোহগত কাঠামো নেই। একারণে তার বক্তব্যের সুস্পষ্টতা নির্ণয় করা দুরূহ। ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতা প্রমাণে ডকিন্স “বোয়িং ৭৪৭ বিমান” নামক রূপক উদাহরণটি উপস্থাপন করেছেন। ডকিন্সের মতে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব একটি হ্যারিকেনের প্রভাবে লোহা-লক্কড়ের জঞ্জাল থেকে আপনাআপনি বোয়িং ৭৪৭ বিমান গঠিত হবার মতো অসম্ভব একটি ব্যাপার ( ডকিন্সের যুক্তিটি ফ্রেডরিক হয়েলের কাছ থেকে ধার করা, যদিও হয়েল তা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ব্যবহার করেছেন)। এই যুক্তির কেন্দ্রীয় প্রস্তাবনা হল, মহাবিশ্বের গঠন নকশাকারী ঈশ্বর স্বয়ং অবিশ্বাস্যভাবে জটিল এবং সম্ভাব্যতার উর্ধ্বে বিরাজমান এক সত্তা। ফলশ্রুতিতে ঈশ্বরকে ব্যাখ্যায় ঈশ্বরের থেকেও জটিল এবং আরও অসম্ভাব্য একটি ব্যাখ্যার প্রয়োজন হবে। ডকিন্সের মতে,একজন সুনিপুণ নকশাকারক মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন এমন দাবি স্ববিরোধী। কেননা, বিবদমান সকল জটিলতাকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম প্রস্তাবনা নিজেকেই ব্যাখ্যা করতে অসমর্থ। ডকিন্সের মতে, ঈশ্বর-অনুকল্পটি কার্যকরণের একটি অন্তহীন চক্রের সূচনা ঘটিয়েছে, যার আদৌ কোনো অন্ত নেই। হ্যারিসও এক্ষেত্রে ডকিন্সকে সমর্থন জানিয়েছেন। হ্যারিসের মতে, ঈশ্বরের অস্তিত্বের ধারণাটি একটি অন্তহীন পশ্চাতগামী চক্রের সূত্রপাত ঘটায়। ফলে ঈশ্বর নিজেও কারো দ্বারা বা কোনোভাবে সৃষ্ট হয়েছেন। উইলিয়াম লেন ক্রেগের মতো সমালোচকদের মতে, ডকিন্সের যুক্তি কেবল মহাবিশ্বের গঠন-নকশায় ঈশ্বর অনুকল্পের ব্যর্থতা দেখাতে পারে ( যদিও উইলিয়াম লেন নিজে তা মানতে নারাজ)। কিন্তু এ থেকে প্রমাণিত হয় না যে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই। ক্রেগের মতে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে একটি আবহমান ধর্মতাত্ত্বিক পূর্বানুমান রয়েছে। এই পূর্বানুমান মতে, ঈশ্বর স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে চির-বিরাজমান এবং তার অস্তিত্বের পেছনে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণের প্রয়োজন নেই। লেনের মতে, ঈশ্বরের উপর জটিলতা আরোপ এবং সেই জটিলতা কেন ঈশ্বরের অস্তিত্বের যুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক তা ডকিন্সের ব্যাখ্যা করা উচিত ছিল। ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসীদের তা জানার অধিকার রয়েছে। ক্রেগ যুক্তি দেখান যে, মানসিক কর্মপ্রক্রিয়া জটিল হলেও ঈশ্বরের মানসকাঠামো সরল হতে বাধা নেই।

null
নব-নাস্তিক্যবাদের চার অশ্বারোহী
বিবর্তন এবং ধর্মীয় বিশ্বাস

নব-নাস্তিক্যবাদীদের পর্যবেক্ষণে অলৌকিকতার কোন অস্তিত্ব নেই। সুতরাং, ধর্ম এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের পেছনে একটি প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা রয়েছে। জীববিজ্ঞানের মধ্যেই এই সামাজিক এবং মনস্তাত্বিক প্রপঞ্চগুলোর শিকড় রয়েছে বলে নব-নাস্তিক্যবাদীরা সবাই একমত। হ্যারিসের মতে, ধর্ম একটি জৈবিক প্রপঞ্চ। ধর্মবিশ্বাস আমাদের বৌদ্ধিক চিন্তাধারার ফসল। এই চিন্তাধারার উৎস পাওয়া যাবে আমাদের জৈবিক বিবর্তনের ইতিহাসে। ডকিন্স এক্ষেত্রে একটি সাধারণ ‘অনুকল্প’ কে সমর্থন করেন। এই অনুকল্প মতে, ধর্মীয় বিশ্বাস মানুষকে একটি অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করে। এর ফলে শিশুরা কোন প্রশ্ন ছাড়াই বড়দের কথা মেনে চলে। ডকিন্সের মতে, নির্দেশ মেনে চলার এই বৌদ্ধিক বিন্যাস অনভ্যস্ত শিশুদেরকে বিপদের হাত থেকে সুরক্ষা দেয়। একই সাথে তা আবার শিশুদেরকে প্রাপ্তবয়স্কদের বিভিন্ন অযৌক্তিক এবং ক্ষতিকর বিশ্বাসেরও মুখাপেক্ষী করে তুলে। ডকিন্স এক্ষেত্রে তার প্রণীত বিশেষ অনুকল্পের প্রতি বিশেষ জোর দেননি। তিনি এ সম্পর্কিত অন্যান্য প্রস্তাবনা শুনতেও আগ্রহী। ‘মোহ কাটানোর’(Break the spell) প্রচেষ্টায় ড্যানেট ধর্ম বিশ্বাসের উৎস অনুসন্ধান সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রস্তাবনা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন। ধর্মবিশ্বাসের উৎস অনুসন্ধানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণে যে বাধা রয়েছে, তা অতিক্রমণেই ড্যানেটের এই প্রচেষ্টা।

মানবসমাজে ধর্মবিশ্বাস উদ্ভবের কারণ ব্যাখ্যায় ড্যানেট এর প্রস্তাবিত ‘আদি-তত্ত্বের’ (Proto-theory) এর কেন্দ্রীয় অংশে রয়েছে একটি ‘অতিসংবেদনশীল ঘটক সনাক্তকারী যন্ত্র’ (hyperactive agent detection device) এর উপস্থিতি। এই যন্ত্র বিশ্বাস ও আকাঙ্খার প্রতিক্রিয়ার ভিন্ন ভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্য প্রদর্শন করে। ড্যানেটের যুক্তি অনুযায়ী, মানুষ হতবিহবল কোন ঘটনার সম্মুখীন হলে এই যন্ত্রের মাধ্যমে মনোজগতে কল্পকাহিনী তৈরির প্রবৃত্তি দেখা যায়। ফলশ্রুতিতে অদৃশ্য কিংবা অলৌকিক সত্তায় বিশ্বাসের জন্ম হয়( ২০০৬, পৃ ১১৯-১২০)। ড্যানেটের বিস্তারিত ব্যাখ্যায় ধর্ম এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের উদ্ভবের প্রাকৃতিক উৎসের বিশদ আলোচনা রয়েছে। হিচেন্স তার “ধর্মের অশুভ সূত্রপাত” অধ্যায়ে ধর্মের উৎস সন্ধানে ড্যানেটের প্রাকৃতিক কর্মকৌশল নিয়ে আলোচনা করেছেন। যদিও হিচেন্স তার লেখায় মানুষের সহজাত বিশ্বাসের প্রবণতা ও এই প্রবণতার সুযোগ নেওয়া ধর্মীয় নেতা ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে বিশদ জোর দিয়েছেন। ধর্মের উৎস সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জন্য ড্যানেট যে পথ বাতলে দিয়েছেন , তা ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই বিতর্কে অংশকারীদের মধ্যে রয়েছেন আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে বিজ্ঞানী, দার্শনিক এবং ধর্মতত্ত্ববিশারদেরা।( বিস্তারিত জানতে দেখুন Schloss, Jeffrey and Michael Murray, eds. The Believing Primate: Scientific, Philosophical, and Theological Reflections on the Origin of Religion (New York: Oxford University Press, 2009)।


ধর্মের নৈতিক পর্যালোচনা

নব-নাস্তিক্যবাদীদের মতে, পরিবেশে টিকে থাকার জন্য ধর্ম একসময় আলাদা সুবিধা দিয়েছিল। বর্তমানে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোতে ধর্ম নিজের উপযোগিতা হারিয়েছে। এই চার লেখকের তিনজনই(হ্যারিস, ডকিন্স এবং হিচেন্স) এ ব্যাপারে খুবই উচ্চকণ্ঠ। তারা তিনজনেই ধর্মকে নৈতিকতার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। তাদের মতে, অনেক সামাজিক সমস্যা সূত্রপাতের পেছনে ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিজেদের দাবির সপক্ষে তারা অনেকগুলো উদাহরণ উপস্থাপন করেছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বিতর্কের অবকাশ নেই এমন সব উদাহরণ যেমন আত্মঘাতী বোমাহামলা, ক্যাথলিক চার্চের চালানো ইনকুইসিশন, ধর্মীয় যুদ্ধ, ডাইনি হত্যা, সমকামীদের প্রতি ঘৃণা ইত্যাদি। অন্যদিকে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে এমন উদাহরণও রয়েছে। যেমন, মাদকসেবন এবং পতিতাবৃত্তি, গর্ভপাত এবং স্বেচ্ছামৃত্যুকে আইনগতভাবে অবৈধ ঘোষণা, ধর্মীয় বিশ্বাস চাপিয়ে দেবার মাধ্যমে শিশুদের উপর মানসিক নির্যাতন ইত্যাদি। হ্যারিস এসব অশুভ কর্মকাণ্ডের পেছনে অযৌক্তিক ধর্মবিশ্বাসকে দায়ী করেছেন। তিনি যুক্তি দেখান যে, বিশ্বাসীরা ধর্মবিশ্বাসকে ধর্মগ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী ঈশ্বরের ইচ্ছা হিসেবে ধরে নেন। এ থেকেই যাবতীয় অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে। এর মাধ্যমে নব-নাস্তিক্যবাদীরা ধর্মের জ্ঞানতাত্ত্বিক সমালোচনার সাথে নৈতিক সমালোচনার সম্পর্ক স্থাপন করেছেন।

নব-নাস্তিক্যবাদীরা ‘ধর্ম মানুষকে নীতিবান করে’- এমন দাবির তীব্র বিরোধিতা করেছেন। বরং তারা নিজেদের ভাষ্য অনুযায়ী ধর্মের দ্বারা মানুষের ভুল পথে চালিত হবার অসংখ্য উদাহরণ উপস্থাপন করেছেন। নাস্তিকতের ক্ষেত্রে নৈতিক স্খলন বেশি ঘটে এমন দাবিরও প্রত্যুত্তর তাদের কাছে রয়েছে। নাস্তিকদের নৈতিক স্খলনের উদাহরণ দিতে গিয়ে অনেকেই হিটলার ও স্তালিনের চালানো বর্বরতার প্রসঙ্গ টেনে আনেন। এর জবাবে নব-নাস্তিক্যবাদীরা বলেন, হিটলার আদৌ নাস্তিক ছিলেন না। হিটলার বরং নিজেকে খ্রিস্টান হিসেবে দাবি করেছেন। অন্যদিকে স্তালিনের মতো নেতারা নিজেরা নাস্তিক হলেও তাদের মতাদর্শ ধর্মের মতোই প্রচার করেছেন। মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত এই অপরাধগুলো নাস্তিকতা প্রচারে সংঘটিত হয়নি। নব-নাস্তিক্যবাদীদের মতে বরং ধর্মবিশ্বাসের কারণেই নৈতিক স্খলন বেশি ঘটে। স্বভাবগত কারণে আরও পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া না অবধি এ ধরণের উপসংহারে পৌঁছতে ড্যানেটের মনে দ্বিধা রয়েছে।

ইহজাগতিক নৈতিকতা

ধর্মের বিরুদ্ধে উত্থাপিত নৈতিক অভিযোগগুলোর একটি নৈতিক মানদন্ড রয়েছে। নব-নাস্তিক্যবাদীরা প্রথম থেকেই কোনোধরণের অলৌকিক বাস্তবতার অস্তিত্ব অস্বীকার করে আসছেন। সুতরাং, তাদের প্রস্তাবিত এই নৈতিক মানদণ্ডের অবশ্যই একটি প্রাকৃতিক ও ইহজাগতিক ভিত্তি থাকতে হবে। নাস্তিকদের অনেকেই মানুষের ঐক্যমত্যকে নৈতিকতার প্রাকৃতিক উৎস হিসবে চিহ্নিত করেছেন। যা মূলত আপেক্ষিক নৈতিকতার প্রতি দিক-নির্দেশ করে। কিন্তু নব-নাস্তিক্যবাদীরা দ্ব্যর্থহীনভাবে আপেক্ষিক নৈতিকতাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। নব-নাস্তিক্যবাদীরা হয়তো ন্যায়পরায়ণতার একটি “স্থান-কাল নিরপেক্ষ” রূপ রয়েছে বলে মনে করেন। কিংবা তাদের মতে ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে মানুষের মধ্যে একটি সাধারণ ঐক্যমত্য রয়েছে। অথবা তারা নৈতিকতার একটি বৈশ্বিক মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে ধর্মের সমালোচনা করে থাকেন।

নব-নাস্তিক্যবাদীরা নৈতিকতার একটি বৈশ্বিক মানদণ্ডের প্রস্তাবনা করেছেন, যা কিছু দার্শনিক কৌতুহলের জন্ম দিয়েছে। প্রথমত, নৈতিকতার উপাদানগুলো কি কি? হ্যারিস এই প্রশ্নের একটি বিশদ উত্তর দিতে চেষ্টা করেছেন। তার মতে, ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন মূলত চেতনাশক্তিসম্পন্ন প্রাণীদের সুখ-দুঃখের সাথে সম্পর্কিত। দ্বিতীয়ত, নৈতিকতার উপাদানগুলো যদি ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ থেকে না আসে, তবে নৈতিকতার মানদণ্ড সম্পর্কে মানুষ কিভাবে ওয়াকিবহাল হবে? নব-নাস্তিক্যবাদীরা একমত যে, প্রতিটি মানুষের মধ্যে প্রাথমিক একটি নৈতিক জ্ঞানের উপস্থিতি রয়েছে। হ্যারিস এই জ্ঞানকে ‘নৈতিক স্বজ্ঞা’(Moral intuition) বলে অভিহিত করেছেন। অন্যান্য নব-নাস্তিক্যবাদীদের যেহেতু এ বিষয়ে ভিন্ন কোনো অবস্থান নেই, সুতরাং ধরে নেওয়া যায় যে এ বিষয়ে তারা হ্যারিসের সাথে একমত। তৃতীয়ত, বৈশ্বিক নৈতিক মানদণ্ডের উদ্দেশ্যগত ভিত্তি কি? যদি আপেক্ষিক নৈতিকতাকে ভুল হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, তবে নতুন একটি প্রশ্নের জন্ম হয়। ব্যক্তিনিরপেক্ষ কোন প্রাকৃতিক ভিত্তিমূলের উপর দাঁড়িয়ে কোনও ব্যক্তিকে বা কোনো আচরণকে ভাল-মন্দ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়? হ্যারিসের প্রদত্ত নৈতিকার জৈবিক উৎস সম্পর্কিত প্রস্তাবনা এর উত্তর হতে পারে। মানুষসহ আরও কিছু প্রাণীদের নৈতিক আচরণের পেছনে ডকিন্স চারটি ডারউইনীয় যুক্তি প্রস্তাব করেছেন। অন্যদিকে ড্যানেটের আগ্রহ মূলত ধর্মের ক্রমবিকাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, নৈতিকতার উৎপত্তি নিয়ে ডকিন্সের প্রদত্ত ব্যাখ্যার সাথে তার একমত হওয়ার কথা। এই দার্শনিক প্রশ্নের জীববৈজ্ঞানিক উত্তরের সমস্যা হলো, তা শুধুমাত্র নৈতিক আচরণের উদ্ভব ব্যাখ্যা করতে পারে, কিন্তু নৈতিক আচরণগুলো কেন সত্য তা ব্যাখ্যা করতে পারে না। নব-নাস্তিক্যবাদীরা চতুর্থ একটি নৈতিক প্রশ্নের অবতারণা করেছেন, যার স্রষ্টা তারা নিজেই, “আমরা কেন নীতিবান হবো?” হ্যারিসের মতে, নৈতিক আচরণের মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি অর্জিত হয়। “যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব নাই থাকে, তবে নীতিবান হবার ফায়দা কি?” প্রশ্নের জবাবে ডকিন্স কিছু নীতিবান নাস্তিকের উদাহরণ দিয়েছেন। কিন্তু এই উত্তরের সমস্যা হল, তা শুধুমাত্র মানুষের নৈতিকতা চর্চার ক্ষেত্রে ঈশ্বরের অপ্রয়োজনীয়তা দেখাতে পারে। কিন্তু নাস্তিকদের কেন নৈতিকতা চর্চা করা উচিত, সে ব্যাখ্যা দিতে পারে না। (উল্লেখ্য, সর্বক্ষেত্রে নৈতিকতা চর্চার বাধ্যবাধকতার আদতেই কোনো যুক্তিগ্রাহ্যতা নেই; বিস্তারিত জানতে দেখুন Peter Singer, Practical ethics 1979)।

তথাকথিত স্বর্গীয় প্রত্যাদেশসমূহ

যদি স্বর্গীয় কোনো সত্তার অস্তিত্ব না থাকে, তবে ঐশ্বরিক কোনো প্রত্যাদেশও নেই। এর মানে এই দাঁড়াল যে, তথাকথিত পবিত্র গ্রন্থগুলো আদতে মানুষের লেখা। হ্যারিস, ডকিন্স এবং হিচেন্স তিনজনেই ধর্মগ্রন্থগুলোর লৌকিক উৎসের সপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। তাদের প্রধান অভিযোগ হচ্ছে ধর্মগ্রন্থগুলোতে নৈতিকতার অভাব রয়েছে এবং এগুলো বাস্তবতার সাথে সম্পর্কহীন তথ্যে ভরপুর। হ্যারিস ওল্ড টেস্টামেন্টের আইন সম্পর্কিত কিছু অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করে সেগুলোকে বর্বর বলে রায় দিয়েছেন। হ্যারিসের মতে, ওল্ড টেস্টামেন্টের এই আইনসমূহের প্রতি যীশুখ্রিস্টের সমর্থন রয়েছে এবং নিউ টেস্টামেন্টেও কোনো উত্তরণ ঘটেনি। হ্যারিস মনে করেন, ধর্মগ্রন্থগুলোতে বর্ণিত প্রত্যাদেশসমূহকে আক্ষরিক অর্থে বিবেচনা করা থেকে বিরত হবার মাধ্যমে খ্রিস্টানদের নৈতিক উত্তরণ ঘটেছে এবং সহিষ্ণুতার চর্চা বেড়েছে। ডকিন্স এক্ষেত্রে হ্যারিসের সাথে একমত যে, বাইবেল এবং কোরানে বর্ণিত ঈশ্বরেরা সহিষ্ণু নন। উপরন্তু ডকিন্সের মতে,

“ কল্প-সাহিত্যের ইতিহাসে ওল্ড টেস্টামেন্টের ঈশ্বর নিঃসন্দেহে সবচাইতে অনাকর্ষণীয় চরিত্র”(ডকিন্স ২০০৬, পৃ ৩১)।

ইহজাগতিক বিকল্প
মানসিক পরিতৃপ্তি অর্জনের ক্ষেত্রে ধর্মের বিকল্প হিসেবে এই চার লেখকের প্রত্যেকেই ইহজাগতিক কিছু উপায় বাতলে দিয়েছেন। হ্যারিসের প্রস্তাবিত ‘আধ্যাত্মিকতা’র মডেলে স্বীয়চেতনার বোধ হারিয়ে পরিতুষ্টি অর্জন করা সম্ভব। হ্যারিসের মতে মানব চেতনা্র( consciousness) ক্রিয়াপ্রকৃতি সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে ক্রমশ আমরা এর উপযোগিতা দেখতে পারব। ঈশ্বরের বিকল্প হিসেবে ডকিন্স মানসিক প্রক্রিয়ার ক্রিয়াকৌশল উন্মোচন ও মনের পরিতুষ্ঠি অর্জনে বিজ্ঞানের সক্ষমতার কথা বলেছেন। অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মানুষের মুক্তিতে ডকিন্স আনন্দিত এবং মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানের অসীম ক্ষমতার উপর তার অবিচল আস্থা রয়েছে। ড্যানেটের মতে, মানবমনের পরিতৃপ্তি অর্জনে অসাধারণ এই প্রকৃতিজগৎ একাই যথেষ্ট। ড্যানেট মনে করেন,

বিশ্বজগতের জটিলতা সম্পর্কে অপার কৌতুহল আমাদেরকে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ থেকে মুক্তি দেবে।

সমালোচনা ও সাম্প্রতিক বিতর্ক

ডকিন্স ও হ্যারিসের আদর্শগত অনমনীয়তা ও আক্রমণাত্মক অবস্থান নাস্তিকদের মধ্যেই অনেক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। অনেক তরুণ নাস্তিক যারা সংকীর্ণ মানসিকতার বিরোধী এবং অন্য সংস্কৃতি ও ব্যক্তিপরিচয়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাদের অনেকেই নব-নাস্তিক্যবাদীদের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছেন।
নারীবাদের উপর ডকিন্সের আক্রমণ এবং মুসলিমদের পরিবর্তনে অসক্ষম একটি উন্মত্ত ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসেবে বর্ণনা করে দেয়া বক্তব্য তাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
কোরান সম্পর্কে হ্যারিসের মত হল,

“আপনাকে যদি চোখ বেঁধে বানর্স এন্ড নোবেল(প্রকাশনা সংস্থা) এর কোনো বিক্রয়কেন্দ্রে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে চোখ বন্ধ অবস্থায় আপনার বেছে নেওয়া সর্বপ্রথম বইটি কোরানের চেয়ে বেশি জ্ঞান-সমৃদ্ধ হবে”।

হ্যারিসের এই যুক্তিটি অনেকে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কেননা, হ্যারিস তার এই যুক্তিটি ধার করেছেন থমাস ম্যাকাউলি’র কাছ থেকে যিনি তার ১৮৩৫ সালে প্রকাশিত ‘মিনিট অন এডুকেশন’ বইতে দাবি করেছিলেন,

“আমি এমন কারো সাক্ষাৎ পাইনি যিনি অস্বীকার করতে পারবেন যে, যেকোনো ইউরোপিয় লাইব্রেরির একটি মাত্র শেলফে থাকা বইগুলোর উপযোগিতা সমগ্র ভারত ও আরবের সাহিত্যের সমকক্ষ”।

২০০৬ সালে এলএ টাইমসে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে হ্যারিস দাবি করেন,

ইউরোপে একমাত্র ফ্যাসিস্টরা আসন্ন ইসলামী বিপদ অনুধাবন করতে পেরেছে।

হ্যারিস একাধারে ধৃত জঙ্গিদের কাছ থেকে নির্যাতনের মাধ্যমে তথ্য আদায়, ড্রোন হামলা, প্রয়োজনবোধে পারমাণবিক হামলা ও মুসলিমদেরকে আলাদাভাবে তল্লাশির পক্ষে মত দিয়েছে।
হ্যারিসের সমালোচকরা তাকে বর্ণবাদী ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী ভাবাপন্ন বলে অভিযুক্ত করেছেন।

নাস্তিক্যবাদের এই অধুনা শাখার সপক্ষে ও বিপক্ষে অনেক প্রবন্ধ ও গ্রন্থ রচিত হয়েছে। নব-নাস্তিক্যবাদীদের উত্থাপিত দার্শনিক প্রশ্নগুলোর ব্যাপ্তি অনেক বিস্তৃত। বিজ্ঞান ও ধর্মের আন্তঃসম্পর্ক, বিজ্ঞানের দর্শন, ধর্মীয় দর্শন, ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যায় এই প্রশ্নগুলো ভবিষ্যতে অনেক আলোচনা ও বিতর্কের খোরাক জোগাবে।

*ইন্টারনেট এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ফিলোসফি অবলম্বনে লিখিত; *সংক্ষিপ্ত ও পরিবর্তিত।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১০:৫৩
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×