somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: অন্য বিভাস

২১ শে জুন, ২০১৩ রাত ২:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


(সতর্কতা: ২৪৮৩ শব্দের গল্প।)

তের নাম্বার রোডের দিকে বাঁক নিতেই নিচের দিকে খুট করে একটি শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হোঁচট খাওয়া কিংবা কিছুর সঙ্গে ঠুকে যাওয়ার ভঙ্গিতে মৃদু ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেল গাড়িটা। আর তখনই পেছন দিক থেকে আসা একটি মাইক্রো-বাসের ড্রাইভার জানালা দিয়ে মাথা বের করে খিস্তি করে উঠল হয়তো। কোনো শব্দ শুনতে না পেলেও সাইড মিররে লোকটির চেহারার বিকৃতি আর বিবিধ ভঙ্গিতে দু ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে অনুমান করে কায়েস। এ মুহূর্তে আরো কেউ সত্যি সত্যি মুখের ওপর গাল দিলেও কিছু করার নেই তার। দামি গাড়ি পথের ওপর বসে গেলে ছোটলোকের দল খুশি হয়। সময়ে যারা চোখ তুলে তাকানোর সাহস রাখে না, তেমন মানুষও গায়ে পড়ে দুটো জ্ঞান দেবার সুযোগ পেয়ে যায়।

কায়েস গাড়ি থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকায় কোনো সুবিধা-জনক জায়গা পাওয়া যায় কি না যাতে নিরাপদে গাড়িটা রাখা যায়। কিন্তু শহরবাসীর যাবতীয় স্বার্থপরতার চিহ্ন বহন করে বাড়ির সামনের রাস্তা আর সীমানা প্রাচীরগুলো। কোথাও কারো জন্যে এক সেন্টিমিটার জায়গারও ছাড় নেই। যে কারণে গাড়িটাকে ঠেলে ঠেলে সামনের দিকে নিয়ে যেতে পারলেও কোথাও যে দাঁড় করিয়ে মিস্ত্রি ডাকবে বা কোনো ওয়ার্কশপে যোগাযোগ করবে তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিল না সে। ঠিক তখনই পেছন দিকে একটি মিষ্টি বাচ্চা কণ্ঠে বলতে শোনা যায়, গাড়ি ঠেলা লাগব সার?

চমকে না উঠলেও বেশ খানিকটা অবাক দৃষ্টি নিয়ে পেছন দিকে তাকায় কায়েস। দেহের আকৃতি দেখে পাঁচ-ছ বছর বয়সের বেশি ভাবতে ইচ্ছে হয়না তার। কিন্তু ফুটপাতে, হাটে-ঘাটে বা স্টেশনে বড় হতে থাকা অপুষ্ট দেহের শিশুদের সঠিক বয়স অনুমান করা কঠিন। আর যতটা অনুমান করা হয় তার চেয়ে ঢের বেশিই থাকে তাদের বয়স। যে কারণে তাদের বেশির ভাগই মানসিক পরিপক্বতার দিক দিয়ে একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের সমান প্রায়। কিন্তু এ ছেলেটি তার গাড়ি ঠেলতে কী সহযোগিতাই আর করতে পারবে ভাবতেই মুখটা হাসি হাসি হয়ে ওঠে তার। অবয়বে তবু কিছুটা গাম্ভীর্য টেনে এনে বলে, তোকে নিয়ে আমরা মোটে দুজন। গাড়িটাকে ঠেলে বেশি দূর নিতে পারব না।

-হেই চিন্তা আমি কইরা ফালাইছি! বলতে বলতে পরিষ্কার আর ঝকঝকে দাঁত দেখায় সে। তারপর এক হাত নাড়িয়ে জানায়, ওয়ার্কশপের মানুষরে খবর দিয়া দিমু যা করনের তারাই করব।

কায়েস আর অবাক হয় না। কিন্তু মনে মনে ছেলেটির পরামর্শ বা সিদ্ধান্তটিকেই মেনে নিতে বাধ্য হয়। আর তাই হয়তো সে বলে ওঠে, ওয়ার্কশপ কতদূর?

-দূর আছে। ফোন কইরা দিলেই গাড়ি নিয়া মানুষ আইসা পড়ব। বলতে বলতে হঠাৎ কেমন একটি নির্দেশের সুরে বলে ওঠে সে, সার, আমি কই আপনের মুবিলে নম্বরটা লাগাইয়া আমারে দিয়েন, কথা কই আগে।

-নাম্বারটা জানিস?

-জানি। তয় সার একটা কথা ফাইনেল কইরা লইয়েন, গাড়ি ঠেইলা নিতে কত আর আরেক গাড়ির পিছে বাইন্ধা নিতে কত দিতে হইব? ওয়ার্কশপে গাড়ি না নিলেই ভালা হইব।

কয়েস একবার পেছনের রাস্তাটার দিকে তাকায়। খুব বেশি গাড়ি চলাচল করছে না। তবু কোন দিক থেকে কোন ঝামেলা এসে পড়বে নিশ্চিত বলা যায় না কিছু। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কোমরের বেল্টে আটকানো চামড়ার খাপ থেকে সেল ফোন বের করতে করতে বলে, কী নাম তোর?

-আমিরুল।

চটপট জবাব বের হয়ে আসে ছেলেটির মুখ থেকে।

-আচ্ছা আমিরুল, নাম্বারটা কি মনে আছে?

তখনই আমিরুল তোতা পাখির মতো নাম্বারটা বলতে আরম্ভ করলে কায়েস বলল, আর একটু ধীরে, মানে আস্তে আস্তে!

আমিরুল খানিকটা থমকে গেলেও নাম্বার বলতে কোনো অসুবিধা হয় না।
ওপাশে রিঙ হতে থাকলে সেল ফোনটি আমিরুলের হাতে দিতে দিতে সে আবার বলে, ফোন নিয়ে দৌড় দিবি না তো?

আমিরুল কায়েসের ছেলেমানুষি দেখে হাসি চাপতে পারে না যেন। হাসতে হাসতেই সে বলে, তাইলে আমার একটা হাত ধইরা রাখেন!
তারপরই সে বলতে আরম্ভ করে, মনু ভাই, একটা পাট্টি আছে। গাড়ি লইয়া আইয়া পড়! দামি গাড়ি। লেক্সাসের মতন। আমার কমিশন আগে দিবা। লগে যামু না। হ। তের লম্বরের মোড়ে!

কথা শেষ করে ফোন ফেরত দিতে দিতে হাসি মুখে আমিরুল জানায়, আইজগা আগেই ফাইনেল কইরা লইলাম। লগে ওয়ার্কশপে গেলে ঠিক মতন কমিশন দেয় না।

সেটা হাতে নিয়ে ফের কোমরের খাপে রাখতে রাখতে কায়েস জিজ্ঞেস করে, ওরা কত দেবে তোকে?

-খুব বেশি হইলে পঞ্চাশ। তাও একবারে না। পাঁচ-দশ ট্যাকা কইরা ভাইঙ্গা ভাইঙ্গা দিবো কয়েক দিনে।

-গাড়ি ঠিক হয়ে গেলে আমি তোকে আরো বেশি দেবো।

আমিরুলের মুখে এবার যেন খানিকটা তাচ্ছিল্যে হাসি ফুটে ওঠে। বলে, নাইলে একটা শতকিয়া লোট দিবেন, এর বেশি তো না!

-আরো বেশি। তুই ভাবতেও পারবি না।

-আমার তো আরো কাজ-কাম আছে, বেশি দেরি করতে পারমু না!

-লোকগুলো যতক্ষণ না আসে ততক্ষণ থেকে যা!

-তাইলে আমারে যাই দিবেন, তাগোরে দেখাইয়া দিয়েন না কইলাম।
-আচ্ছা। ওরা কাজ শেষ করে চলে গেলেই দেবো।

দেখতে দেখতে প্রায় ভাঙা-চোরা রঙ-ছাল উঠে যাওয়া একটি নীলচে গাড়ি এসে থামে। গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে দুজন লোক দুপাশের দরজা খুলে নেমে আসে। একজন কায়েসের পাশে এসে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অন্যজন গাড়ির সামনে গিয়ে বনেট খুলে ফেলে। একটু কাত হয়ে কায়েসের উদ্দেশ্যে বলে, পবলেন কি গাড়ির?

কায়েস সমস্যাটা বলতেই লোকটি বলল, গাড়ি অখনই চালু কইরা দেওন যাইবো। কিন্তু ট্যাকা দিবেন পাঁচ হাজার!

পাঁচ হাজার টাকা?

অবাক হয়ে পাশে দাঁড়ানো লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকে কায়েস।
পাশে দাঁড়ানো লোকটি এগিয়ে যায় তার সঙ্গীর দিকে। তখনই আগের লোকটি বলে ওঠে, আপনের ভালার লিগাই কইলাম। আইচ্ছা একা হাজার কম দিয়েন!

কায়েস মনে মনে হিসেব কষে, সঙ্গে টাকা ই আছে সাকুল্যে পাঁচ হাজার। তা ছাড়া তাদের কথা মতোই টাকা দিতে হবে এমন দিব্যি কেউ দেয়নি তাকে। তাই সে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বলে, দু হাজার পাবেন।

-তাইলে আর হইলো না। বলেই বনেট নামিয়ে দিয়ে লোকটি তার সঙ্গীকে বলল, ল রে, তেল খরচটাই ঘাটতি!

আমিরুল অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চাপা স্বরে বলে, দর বাড়াইয়েন না কইলাম। এক হাজার কইলেও হইত!

লোকটি তাদের গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে বলল, ভাইব্যা দেহেন সার!

একবার আমিরুলের দিকে তাকিয়ে কায়েস বলল, যা বলেছি একবারেই বলে দিয়েছি।

লোকটি মুখ কালো করে বলল আবার, তিন হাজার দিয়েন, গাড়ির কাজ কইরা দিতাছি।

-দু হাজারের বেশি হলে আমি কাজ করাবো না।

-আইচ্ছা দেখি। বলেই সে তাদের গাড়ির কাছে ফিরে যায়। ব্যাগের একটি বাক্স মতন কিছু আর একটি ছোটখাটো ফোমের ম্যাট হাতে করে ফিরে আসে। গাড়ির নিচের দিকে ম্যাটটি ঠেলে দিয়ে একজন চিত হয়ে সেটার ওপর শুয়ে পড়ে গাড়ির নিচে ঢুকে যায়। তারপর সঙ্গীকে এটা ওটা দিতে বলে ঠুকঠাক শব্দ করে কিছুক্ষণ।

কায়েস আমিরুলের দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়ে বলল, এরা মানুষ কেমন?

-বেশি খারাপ না।

-কতদিন ধরে চিনিস?

-অনেক দিন।

-আগে থেকেই চিনতি, নাকি নতুন পরিচয় হয়েছিল?

-ওয়ার্কশপের কাছে একটা চায়ের দোকানে কাজ করতাম। তখন থাইক্যা তাগোরে মুখ চিনা চিনি।

তাদের কথার মাঝে কায়েস শুনতে পায় একজন বলছে, গাড়িডা ইস্টাট লয় কিনা দেখেন দেখি!

কায়েস গাড়িতে উঠে বসতেই এবার দুজনে মিলে সামনে গিয়ে ফের গাড়ির বনেট খোলে। একজন হাত নেড়ে বলে গাড়ি স্টার্ট দিতে।

সেলফ চেপে ইগনিশন চাবি মোচড় দিতেই গাড়ি চালু হয়ে যায়। ইঞ্জিনের গতি বাড়িয়ে কমিয়ে দেখে নিয়ে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। মনে মনে ভাবে, দু হাজার টাকা কি খুব বেশি ঠকে গেল? একেবারে কাউকে না পাওয়ার চেয়ে দু হাজার টাকায় কাজ হয়ে যাওয়া এক অর্থে ঠকা হয়নি তেমন। লোকগুলো বেশি খারাপ হলে গাড়িটাকে তাদের ওয়ার্কশপে নিয়ে গিয়ে দু-চারদিন ঘুরিয়ে মোটা টাকার একটি বিল ধরিয়ে দিলেও তার কিছু করবার ছিল না। যেহেতু গাড়ির যন্ত্রাংশের কিছুই জানে না, সে তুলনায় লোকগুলোকে সৎ বলতেই হবে। দু হাজার টাকা দিয়ে দিলে তার কাছে থাকবে মাত্র তিন হাজার। এ টাকা নিয়ে লিজির সঙ্গে দেখা করাটা ঠিক হবে না হয়তো। বলা যায় না খরচের ধাক্কাটা কততে গিয়ে ঠেকে। অবশ্য সঙ্গে ক্রেডিট কার্ড আছে। সমস্যা তেমন হবে না। তবু সে লিজির সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনাটা বাদ দিয়ে দেয় মনে মনে। তার চেয়ে ভাল হবে এদিক ওদিক কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া।

বনেট নামিয়ে লোক দুটো জানালার দু পাশে দাঁড়িয়ে একজন হাত পাতে। আর তা দেখে ওয়ালেট বের করে দুটো হাজার টাকার নোট বের করে বাড়িয়ে ধরতেই, লোকটি টাকাটা হাতে নিতে নিতে বলল, আমরা থাকতে থাকতে একটা চক্কর লাগাইয়া আসেন, পবলেন থাকলে বুঝা যাইবো।

কায়েস তাই করে। তের নাম্বার রোডের ভেতর দিয়ে এগিয়ে একটা বাড়ির পাশ দিয়ে বাঁক নিয়ে ফিরে আসে। কিন্তু তেমন কোনো সমস্যা টের পায় না। তাদের দিকে চোখ তুলে বলল, ঠিকই তো আছে। প্রবলেম তো কিছু টের পেলাম না।

-তাইলে যাই আমরা। বলতে বলতে একজন হাত তুলল সালামের ভঙ্গিতে।

কায়েস মাথা কাত করতেই তারা তাদের গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।

আমিরুলকে দেখা যায় তাদের পেছন পেছন এগিয়ে যেতে। গাড়ির আড়াল হতেই উচ্চতার কারণে আমিরুলকে দেখতে পায় না কায়েস। সে চুপ চাপ গাড়িতেই বসে থাকে আমিরুলের ফিরে আসবার অপেক্ষায়। ঠিক তখনই ফোনটা বেজে ওঠে। একটানা বাজতেই থাকে। একটি অচেনা নাম্বার। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটি নারী কণ্ঠ বলে ওঠে, তুমি কই? আমি ওয়ান্ডারল্যান্ডের সামনে খাড়াইয়া আছি!

-আচ্ছা, আসতাছি এখনই। বলে লাইন কেটে দেয় কায়েস। ফোনটা ফের খাপে পুরতে পুরতে ঘাড় ফেরালেই দেখতে পায় আমিরুল হাসি হাসি মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর সঙ্গে সঙ্গেই সে জানতে চায়, তোর কাজ হলো?

আমিরুল হাতের মুঠি খুলে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট তুলে ধরে জানালা বরাবর।

-তাহলে আমাকে চা খাওয়াবি তো। আমার জন্যেই টাকাটা পেয়ে গেলি।
-আপনে খাইলে আমি খাওয়ামু। গরুর দুধের চা।

-তাহলে উঠে আয়। বলেই বাঁ দিকের দরজাটা খুলে দেয় কায়েস।

আমিরুল ইতস্তত করে বলে, এই ময়লা কাপড়ে এমন পরিষ্কার সিটে বসা ঠিক হইবো না।

-উঠে আয়। তুই নেমে গেলে সিটের কভার লন্ড্রিতে দিয়ে যাবো।

আমিরুল যেন নিঃসংকোচে উঠে পড়ে সিটে বসে দরজা টেনে বন্ধ করে দেয়। তারপর বলে, বনানী বাজার মার্কেটে চলেন।

-কোনদিক দিয়ে গেলে সহজ হবে?

-তাইলে আমি কইতে থাকি আপনে চালাইয়া যান।

কয়েকটা বাঁক ঘুরে তারা বনানী বাজারে এসে পার্কিঙে গাড়ি থামায়। নেমে পড়ে কায়েস গাড়ি লক করে দিয়ে আমিরুলকে বলে, তোর জামা-কাপড় কয়টারে?

-যা পিন্দা আছি তাই।

-ধুয়ে দেয় কে, মা-বাবা আছে?

-না। একজনরে আপা ডাকি। হ্যায় ধুইয়া দেয়।

-থাকিস কোথায়?

-আপার বাসায়।

-আপা করে কি?

কয়েসের এমন জিজ্ঞাসার জন্যে যেন প্রস্তুত ছিল না আমিরুল। যে কারণে তাকে হয়তো তাকে বিভ্রান্ত দেখায় কিছুটা। বলা উচিত হবে কি হবে না সে দোলাচলেই যেন দোলে সে কিছুক্ষণ। তা দেখে হয়তো প্রসঙ্গ পালটাতেই কায়েস ফের জিজ্ঞেস করে, তোর আপার বাচ্চা কয়টা, আর তোর দুলাভাই করে কি?

আমিরুল হেসে উঠে বলে, আপার তো বিয়াই হয় নাই!

কায়েসও হাসে। বলে, বিয়া না হইলে বাচ্চা হয় না?

আমিরুল লাজুক হেসে মাথা নাড়ায়।

-আচ্ছা তোর সেই চায়ের দোকান কোথায়?

কথাটা আমিরুলের উদ্দেশ্যে হলেও তার চোখ ঘোরাফেরা করে বিভিন্ন দোকানে। ঠিক তখনই তার চোখ পড়ে একটি বন্ধ দোকানের গেটের সামনে নানা মাপের সার্ট প্যান্ট ঝোলানো। মেঝেতেও বিছানো আছে বেশ কতগুলো। সে দিকে তাকিয়ে আমিরুলকে বলল, দেখ তো আমিরুল, লোকটা যে সার্ট-প্যান্ট ঝুলিয়ে রেখেছে, বিক্রি করে নাকি পুরানো?

-বিক্রি করে। সবই নতুন।

-আমার মাপে সার্ট-প্যান্ট পাওয়া যাবে না?

কেমন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে আমিরুল বলে ওঠে, আপনের মতন মাইনষ্যে ওই কাপড় পিন্দে নাকি?

-তাহলে কারা পিন্দে, কেনে কারা?

-গরিব মানুষে।

-তাহলে তুই কিনিস না কেন। টাকা তো আছেই সঙ্গে।

-আমি তো গরিবের থাইক্যা খারাপ। ফকিরা।

-ফকিররা তো ভিক্ষে করে। তুই কাজ করিস। কমিশনে।

-আমিও আগে ভিক্ষা করছি।

-এখন করিস না কেন?

-শরম করে।

-চল কাপড় দেখি।

আমিরুল যেন আঁতকে উঠে বলে, চা খাইবেন না?

তারপরই একটি খোলা চায়ের স্টলের দিকে হাত তুলে বলে, ওই যে রফিক চাচার দোকান। গরুর দুধের ঘন চা। অনেক সোয়াদ!

-এক কাপ চা কত?

বলতে বলতে সামনের দিকে হাঁটে কায়েস। সঙ্গে সঙ্গে চলে আমিরুলও। বলে, এক কাপ সাত ট্যাকা।

-খেয়েছিস?

-খাইছি, তয় কিন্যা খাই নাই।

-তাহলে কিভাবে খেতে পারলি?

-কেউ কেউ আধা কাপ রাইখ্যাই উইঠ্যা যায়, হেই চা।

ঝুলিয়ে রাখা কাপড়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কায়েস বলল, আমার মাপের সার্ট-প্যান্ট হবে?

লোকটি কেমন করে হেসে উঠে বলে, আপনে কি আমার লগে মজা করেন?

-না মজা করি না। তাহলে এর মাপের দেখান। বলে আমিরুলকে দেখিয়ে দেয় সে।

এবার লোকটি সহজ ভঙ্গিতে কাপড় নামায়। তারপর ফিতা দিয়ে আমিরুলের কোমর আর গায়ের মাপ নেয়। তা দেখে বিভ্রান্ত আমিরুল বলে, পঞ্চাশ ট্যাকা দিয়া কি কাপড় কিনন যায়? আর কাপড় কিনলে খামু কি?

লোকটি দু সেট সার্ট-প্যান্ট নামিয়ে দেয় মাপ মতো। তার মাঝে এক সেট হাফ হাতা আর হাফ প্যান্ট। অন্যটা ফুল হাতা সার্ট আর ফুল প্যান্ট।

বেশি দামাদামি করে না কায়েস। আমিরুলকে বলল, দেখ তো কোন সার্ট-প্যান্ট তোর মাপ মতো হয়? পরে দেখ।

দেয়ালের আড়ালে গিয়ে পরনের কাপড় পালটে আসে আমিরুল। আর তা দেখে কায়েস বলে ওঠে, স্যান্ডেল না জুতো পরবি দোকানে গিয়ে পছন্দ করে আয়। কিন্তু আমিরুল মাথা নেড়ে জানায়, লাগবো না। ঘরে আছে।

কায়েস বলে, ঠিক তো, নাকি রাতে পা না ধুয়েই ঘুমিয়ে পড়িস?

- না আছে। পেলাস্টিকের জুতা।

কাপড়ের দাম পরিশোধ করে কায়েস আবার তাকায় আমিরুলের দিকে। পুরনো গুলো ফেলে দে!

না। এইগুলাও অনেক দিন পিন্দন যাইবো। বলেই সে দোকানীর দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, একটা পলিথিন দেন দেখি।

লোকটি নীল রঙের একটি পলিথিনের শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিতেই আমিরুল তার পুরোনো সার্ট-প্যান্ট তাতে গুছিয়ে নিয়ে যেন আপন মনেই বলে ওঠে, আপারে কমু ধুইয়া দিতে। তারপরই সে মুখ তুলে হাসি মুখে কায়েসকে বলল, চলেন চা খাই!

-আচ্ছা চল!

কায়েস দোকানটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে দেখতে পায় আমিরুল সেখানে পৌঁছে গিয়ে বলছে, চাচা দুই কাপ চা দেন দেখি। একটা কাপ গরম পানি দিয়া ভালা মতন ধুইয়া দিবেন।

চা দোকানের রফিক নামের লোকটি কেমন তাচ্ছিল্য ভরে বলে, তুই নিজেরেই তো ভালা মতন ধুইয়া রাখস না।

-কাজে কামে থাকি। তাই বইল্যা তো ময়লা খাওন খাই না!

-মানষ্যের ঝুটা তো খাস!

-আইজগা খামু না। আমার গেস্ট আছে।

কায়েস দোকানের সামনে এসে দাঁড়াতেই রফিক তখন চোখ তুলে তাকায়। আর তখনই সুযোগ বুঝে একটি চোখ টিপে দেয় কায়েস। সে ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয় না রফিকের। হাসি মুখে দুটো কাপ ভাল মতো ধুয়ে চা বানিয়ে দুজনের দিকে এগিয়ে দেয়।

আমিরুল চা হাতে একটি বেঞ্চে গিয়ে বসে কায়েসকে বলল, আহেন সার। বইসা আরাম কইরা খান।

কিন্তু কায়েস জানায়, বেঞ্চটা নিচু বেশি, বসলে আমার হাঁটুতে সমস্যা হবে। বলেই সে চায়ে চুমুক দেয়। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমিরুলের দিকে তাকিয়ে বলে, ম্যানি থ্যাঙ্কস আমিরুল!

-কেন সার?

আমিরুলের মুখটা কেমন আহ্লাদী দেখায়।

-চা-টা সত্যিই ভাল।

কায়েসের কথা শুনে আমিরুলের মুখ যত না উজ্জ্বল হয় তার চেয়ে আরো বেশি ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে রফিকের চেহারায়।

চা খাওয়া শেষ করে কায়েস ওয়ালেট বের করে একটি পাঁচশত টাকার নোট আমিরুলের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, আমার কাছে কোনো একশ টাকার নোট নেই, পুরোটাই তুই রেখে দে। আর চায়ের দামটা তো তি দিবি তাই না? আমি তাহলে যাই।

-হ সার! বলেই সে পাশে বেঞ্চের ওপর চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে নতুন প্যান্টের পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার নোটটি বের করে বাড়িয়ে ধরে রফিকের দিকে। বলে, দুইটা চায়ের দাম রাখেন!

রফিক মাথা নেড়ে জানায় তার কাছে পঞ্চাশ টাকার খুচরা হবে না।
আমিরুল বিষণ্ণ মুখে জানায় তার কাছে আর টাকা নেই। কাল চায়ের দাম শোধ করে দেবে। কিন্তু তখনই কায়েস জানায়, আমার কাছে মনে হয় বিশ টাকার একটি নোট আছে। বলতে বলতে সে ওয়ালেট থেকে বিশটাকার একটি নোট বের করে রফিকের হাতে দিয়ে দেয়। তারপর বলে, বাকি টাকা আমিরুলের কাছে থাক। তার খুচরার দরকার হতে পারে।

চা খাওয়া শেষ হয়ে গেলে কায়েস গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে পাশাপাশি চলে আমিরুলও। এক সময় কায়েস বলল, আচ্ছা আমিরুল, তুই স্কুলে পড়েও তো তোর কমিশনের কাজটা করতে পারতি। সপ্তাহে চাল-ডাল পাবি যা দিয়ে তোর আর আপার খাওয়া হয়ে যাবে ভাল মতো।
কায়েসের কথা শুনেই আমিরুলের মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে যায়। ঠোঁট উলটিয়ে বলে, নাহ, ইশকুল মাদ্রাসায় আর যামু না কোনোদিন। সারা বছর বিরানী খাওয়াইলেও না!

কায়েস খানিকটা বিচলিত হয়ে পড়ে আমিরুলের কথায়। সঙ্গে সঙ্গেই বলে, সমস্যা কি?

-অনেক সমস্যা। মুখ দিয়া বাইর করন যাইবো না।

-আমি ছাড়া তো শুনবে না কেউ।

-আগে একটা মাদ্রাসায় পড়তাম। তারা খাইতেও দিতো। হেই মাদ্রাসার হুজুর দুইডা ভাল আছিল না। আমগো লগে জোর কইরা খারাপ কাজ করতো। অনেক পোলা কান্দাকাটি করলেও তারা ছাড়তো না।

-তাহলে স্কুলে গেলি না কেন? সেখানে তো অত হুজুর নেই!

-ইশকুলেও কয়দিন পড়ছি। ওইখানেই এক রকম কেইস হইসে।
কায়েসের মুখটাতে অদৃশ্য কেউ যেন কালো রঙের প্রলেপ বুলিয়ে দিয়ে যায় অথবা সমাজের অন্ধকার নর্দমার কালো ময়লা এসে ঢেকে দিয়ে যায় তার চেহারার ঔজ্জ্বল্য। আমিরুলের কথা প্রসঙ্গে কী বলতে পারে তাই যেন হাতড়ে ফিরে এদিক ওদিক তাকায় বার কয়েক। তারপর গাড়ির দরজার হাতলে হাত রেখে বলল, যাইরে তাহলে, ভাল থাকিস!

-আপনেও ভালা থাইক্যেন! বলে হাসে আমিরুল। আর তার হাসির সঙ্গে সঙ্গে সাদা দাঁতের উজ্জ্বলতা যেন দিনের আলোকে বাড়িয়ে দেয় আরো বহুগুণ।

(সমাপ্ত)

১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিনেতা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৫



বলতে, আমি নাকি পাক্কা অভিনেতা ,
অভিনয়ে সেরা,খুব ভালো করবো অভিনয় করলে।
আমিও বলতাম, যেদিন হবো সেদিন তুমি দেখবে তো ?
এক গাল হেসে দিয়ে বলতে, সে সময় হলে দেখা যাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×