somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের সাহিত্যের দুর্দিন ও কয়েকটি জিজ্ঞাসা

১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ সকাল ১১:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(ফোটো: গুগুল)
(সতর্কতা: অনেক বড় লেখা)

পত্র-পত্রিকা ও ফেসবুকের মাধ্যমে আমরা এরই মধ্যে জেনে গেছি যে, বাংলাদেশের অনেক কবি-গল্পকার-ঔপন্যাসিক বিশ্বের নানা দেশের সাহিত্যসভা অলংকৃত করছেন; যা আমাদের জন্যে মর্যাদা ও গর্বের। সেই সঙ্গে বিদেশি সাহিত্য সভায় উপস্থাপিত বিভিন্ন ধরনের বাংলা সৃষ্টি-সম্ভার নানা দেশের ভাষায় অনুদিত হয়ে বিশ্বময় আলো ছড়াচ্ছে। সেসব অনুদিত সাহিত্য আবার বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার সংবাদও চোখে পড়ে। তারপরও আমাদের শুনতে হয় যে, বাংলাদেশের সাহিত্যের তেমন কোনো উন্নতি নেই। তেমন চোখে পড়ার মতো শক্তিমান কোনো সাহিত্যিকের জন্ম হচ্ছে না।
এই যে অনুর্ধ চল্লিশ, অনুর্ধ ত্রিশ বয়সের ঘোষণা দিয়ে যেসব সাহিত্য পুরস্কার আমাদের দেশে প্রচলিত আছে, সেসব পুরস্কারের প্রতিটিই তো অনুর্ধ চল্লিশ বা অনুর্ধ ত্রিশের কেউ না কেউ গ্রহণ করছেন প্রতি বছরই। আর পুরস্কারগুলো যারা অর্জন করছেন তা তাদের মেধা ও যোগ্যতার বলেই অর্জন করছেন। তারপরও কেন আমাদের শুনতে হবে যে, বাংলাদেশের সাহিত্যের তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি? হাসনাত আবদুল হাই যখন বলেন, ...পশ্চিমবঙ্গে অনেক লেখক যেমন পেশা হিসেবে বাংলায় সাহিত্যচর্চা গ্রহণ করতে পেরেছেন, বাংলাদেশে এখনো সেই বাস্তবতা তৈরি হয়নি। এই পার্থক্য দূর করতে না পারলে সাহিত্যচর্চায় বাংলাদেশ পেছনে পড়ে থাকবে...
(বাংলা সাহিত্য কতটা আন্তর্জাতিক? প্রথম আলো, ১৯ জানু ২০১৮)।

প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে যে, বাংলাদেশের সাহিত্য পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য থেকে পিছিয়ে আছে। প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় আমাদের সাহিত্য কোনো অংশেই বিকশিত হয়নি? তাহলে কি যোগ্য মানুষদের মূল্যায়ন হচ্ছে না? যদি যোগ্যদের মূল্যায়ন নাই হয়ে থাকে তাহলে পুরস্কার প্রাপ্ত বিপুল সংখ্যক লেখক কী করছেন? নাকি পুরস্কার পেয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অংশ হয়েই হাত গুটিয়ে নিচ্ছেন? কিন্তু লেখকরা যে হাত গুটিয়ে নিচ্ছেন সে কথাই বা জোর দিয়ে বলি কি করে? দেখছি তো ফি বছর অমর একুশে বই মেলায় পাঁচ-ছ হাজার বই ছাপা হচ্ছে। এই পাঁচ-ছ হাজার বইয়ের ভেতর গল্প-উপন্যাস-কবিতা-প্রবন্ধতো কম করে হলেও হাজার খানেক হবে। তার ভেতর পঞ্চাশ-ষাট-সত্তুরটা বইও কি মানোত্তীর্ণ নয়? আর এসব বই যে মানোত্তীর্ণ বা মানসম্পন্ন নয়, সেটাই বা নির্ধারণ করেন কারা? আর কোন মনদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে এটি নির্ধারিত হয়?
বাংলাদেশে নানা পদের সাহিত্য পত্রিকা ছাড়াও অনেক দৈনিক পত্রিকা নিয়মিত সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করছে। তার মানে সাহিত্য সম্পাদকদের সংখ্যাও অপ্রতুল নয়। সে সঙ্গে সাময়িকীর পাতাগুলোও খালি থাকছে না কোনো বারই। লেখার অভাবে সাময়িকী প্রকাশ হয়নি এমন ঘটনাও তেমন একটা ঘটে না (অন্তত আমার জানা নেই)। তারপরও কেন আমাদের বর্তমান সাহিত্যের এমন দৈন্য দশা?
আর একটু আগ বাড়িয়ে যদি বলি যে, বাংলাদেশের বাইরে বা সার্কভুক্ত রাষ্ট্রসমূহে যে সব সাহিত্যসভা ও সাহিত্য বিষয়ক অনুষ্ঠান হচ্ছে এবং যে সব বাংলাদেশী সাহিত্যিক সে সব অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে যান তারাও কি সেখানে মানহীন সাহিত্য উপস্থাপন করে আসেন? তাহলে অত ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রতি বছর কারা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন?
সম্প্রতি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদারের দেহাবসানের পরপরই তাঁকে নিয়ে ফেসবুকে নানা রকম মন্তব্য পড়তে পড়তে বুঝলাম যে, জনপ্রিয়তা কখনো কখনো অন্য কারো মনোকষ্টেরও কারণ হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে মনে করি, প্রাসঙ্গিক ভাবেই উঠে এসেছে ”দেশ” ও ”আনন্দবাজার”এর কথা। যারা নতুন লেখক তৈরিতে বেশ ভালো ভূমিকা রেখে চলেছে। সে তুলনায় বাংলাদেশে এমন মানদণ্ডে কোনো পত্রিকা নতুন করে জন্ম নেয়নি। আর যে সব পত্রিকা আছে সেখানেও ঘুরেফিরে সেই একই মুখ। লেখার মানও তথৈবচ। কিন্তু সে সব লেখারই কোনো একটি আলোচনা পড়লে মনে হবে বর্তমান বাংলা সাহিত্যের সেরা এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বি লেখক তিনিই।
আসলে পত্রিকার দোষ দিয়ে লাভ নেই। লাভ নেই স্বজন প্রীতির দোহাই দিয়েও। দোষ হচ্ছে সাহিত্য সম্পাদকের। যোগ্য সাহিত্য সম্পাদকের অভাব। একজন ভালো কবি-গল্পকার-ঔপন্যাসিক-প্রাবন্ধিক যে ভালো সম্পাদক হবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সম্পাদনা আলাদা একটি যোগ্যতা। মুকুটের অনেকগুলো মূল্যবান পালকের একটি। আমাদের দেশে আরেকজন আহসান হাবিব জন্ম নেবেন না বলে কি সম্পাদনা থেমে থাকবে? নাকি থেমে আছে?

বাংলাদেশের যে কোনো কর্মকাণ্ডেই স্বজনপ্রিতীর অভিযোগ থাকে। এমন কি বাংলা একাডেমীর পুরস্কারও অযোগ্য মানুষকে প্রদানের পর প্রতিবাদের মুখে প্রত্যাহারের একাধিক ঘটনাও আছে। এসব নয়-ছয়, উনিশ-বিশ কারা করে? এ জিজ্ঞাসারও কোনো সদুত্তর নেই।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কথা যদি বলি- এতে গুটিকয়েক লোভী মানুষের উদর পূর্তি হচ্ছে কেবল। দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ। তাই সিন্ডিকেটের প্রভাব ভালো কিছু বয়ে আনে না। কাজেই যোগ্য মানুষ নেই এ কথা যেমন অসার, মানসম্পন্ন সাহিত্য তৈরি হচ্ছে না- এ কথারও কোনো সারবত্তা নেই। আসল কথা হচ্ছে যে, যোগ্যরা পেছনে পড়ে থাকছে আর অযোগ্যরা হাত ধরাধরি করে, ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি করে মিছিলের অগ্রভাগ অন্ধকার করে রেখেছে। যে অন্ধকারে তারা দেখতে পাচ্ছে না নিজেদের অপকীর্তিগুলো।
বাংলা একাডেমী প্রকল্পের মাধ্যমে কয়েক বছর লেখক উৎপাদন করলো। ফলে, সনদধারী প্রশিক্ষিত লেখকে সমৃদ্ধ হলো বাংলাদেশ। যাদের লেখা পত্রিকায় ম্যাগাজিনে নানা জাতীয় ঈদসংখ্যায় অগ্রগণ্য বিবেচিত হয়। কিন্তু সেখানেও নাকি ধানের চেয়ে চিটা বেশি, ফসলের তুলনায় আগাছা বেশি। লেখক তৈরিতে যে বাংলা একাডেমী নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছিল সে কথাও তেমন জোর দিয়ে বলা যায় না।
বীজ পরিমাণে ফসল। এ কথা আমরা সবাই জানি। জমিতে যে ধরনের বীজ বপন করা হবে ফসলও তেমনই হবে। সে সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, কাঙ্ক্ষিত ফসল অর্জনে জমির ভূমিকাও কিন্তু কম নয়।
সাহিত্যিক যদি সাহিত্যের বীজ হয়, তাহলে সাহিত্য হচ্ছে ফসল আর পাঠক হচ্ছে সেই ফসলের ক্ষেত্র। তদ্রূপ, সাহিত্য নামক ফসলের পরিচর্যাকারী অর্থাৎ চাষী হচ্ছেন গিয়ে প্রকাশক, সম্পাদক। তাহলে দেখা যাচ্ছে চাষী যেমন ভালো বীজ নির্বাচনে অক্ষম, তেমনই ক্ষেত্র প্রস্তুতের দিক দিয়েও ব্যর্থ। তাই মনে করি, আমাদের দেশের দশ কোটি বা পাঁচ কোটি পাঠক থাকলেও আমাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকের বই সর্বোচ্চ একলক্ষ পাঠকের কাছেও পৌঁছুতে পারছে না। এর জন্যে দায়ী করবো কাকে- মানহীন সাহিত্য নাকি পাঠকের রুচির নিম্নগামীতা নাকি বইয়ের উচ্চমূল্য?
আমি মনে করি যে, পাঠক তৈরিতে পেপারব্যাকেরও একটা বড়সড় ভূমিকা রয়েছে। হার্ডকভারের তুলনায় পেপারব্যাকের খরচ অনেকটা কম। সাশ্রয়ী বলে সব ধরনের পাঠকের ক্রয় ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে যায় না। তা ছাড়া বই-পুস্তকের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে আমাদের দেশের নীতিহীন ব্যবসা পদ্ধতিও অনেকটা দায়ী। কেন না কাগজের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রিন্ট মিডিয়ার অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদানের মূল্য বৃদ্ধিও অনেকটা ভুমিকা রাখে। ফলে উচ্চমূল্যে বই কেনার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে তা আশা করাটাই হয়তো বোকামী। ছোটবেলা দেখেছি ববা তাঁর বন্ধুদের কাছ থেকে বই ধার করে এনে পড়তেন। সেসব বই ছিল নীহার রঞ্জন গুপ্ত, ফাল্গুণী মুখার্জি, বিমল মিত্র, জরাসন্ধ। সেসব বই পেপারব্যাক যেমন ছিল, ছিল নিউজপ্রিন্টে ছাপানো। আজকাল এমন কোনো বই দেখা যায় না। সবই হার্ডকভার আর অফসেট কাগজে ছাপা।
সম্প্রতি একটি সংবাদে দেখলাম যে, মুদ্রাস্ফিতির কারণে সব কিছুর চড়া মূল্যের ফলে মিশরে কিস্তিতে বই বিক্রির কথা ভাবা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে আমরা দিনকে দিন যেমন পাঠ বিমুখ হয়ে পড়ছি, বইয়ের দোকানগুলো যেভাবে তাদের ব্যবসা পাল্টে ফেলছে, সেখানে উচ্চমূল্যের পুস্তক নির্ভর সাহিত্য কতটুকু মূল্যায়িত হবে আর মান বৃদ্ধি বা উৎকর্ষের দিকে এগিয়ে যাবে তা নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না।
আমাদের কোটি জনতা পাঠ বিমুখ, অনুর্বর, পতিত জমির মতো। আগে যেমন ছোটবেলা থেকেই আমাদের পাঠাভ্যাস গড়ে উঠতো, এখনকার ছেলেমেয়েরা পরিচিত হচ্ছে নিত্য নতুন ডিভাইসের সঙ্গে। সেই সঙ্গে তাদের দিতে পারছি না তেমন একটি সুষ্ঠু পরিবেশ।
এ প্রসঙ্গে আরো একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষিত শিক্ষক থাকলেও পরিচালনা পরিষদের অধিকাংশই আলু-পটল-পাট বা ভাঙারি ব্যবসায়ী। যাদের অনেকেই শিক্ষা জীবনে প্রাথমিকের গণ্ডি পার হতে পারেনি। পরিচালক যদি অশিক্ষিত হয় শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে সে কতটুকু মাথা ঘামাবে তা কিন্তু ভাবনার বিষয়। স্কুল কলেজের পরিচালনা পরিষদের সদস্যপদ অর্জনে সামাজিকভাবে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ছাত্রছাত্রীর শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে সহায়ক কোনো ভুমিকা রাখতে পারবে বলে ভরসা হয় না। মোটকথা যে নিজেই অশিক্ষিত, ভাবনা-চিন্তায় অনগ্রসর, চলমান শিক্ষা ব্যবস্থায় উন্নত পরামর্শ সে কীভাবে দেবে?
স্কুল-কলেজের পরিচালনা পর্ষদ অশিক্ষিত বলেই আজকাল স্কুল-কলেজ ও গ্রামীন পর্যায়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে বইয়ের বদলে দেওয়া হয় গ্লাস-জগ-থালা-বাটি। যেহেতু বই সংসার বা পরিবারের কোনো কাজে আসে না সে ক্ষেত্রে ঘটি-বাটিই উত্তম অর্জন। ভবিষ্যতে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি পুরস্কার হিসেবে তসবিহ- জায়নামাজ, চাদর, কম্বল নির্বাচন করে তাহলে মোটেও অবাক হবো না। কারণ বইয়ের তুলনায় এসবই মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কাজে আসে বেশি।
এ কথা মানতেই হবে যে, আমাদের পাঠাভ্যাস না বাড়লে আমাদের সাহিত্যের উন্নতি হবে না। নিরপেক্ষ সমালোচনার ক্ষেত্র তৈরি না হলে গৎবাঁধা আর নিচু মানের সাহিত্য থেকে আমাদের উত্তোরণ ঘটবে না এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়। কাজেই শুরু থেকেই যাতে আমাদের পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠে সে উদ্দেশ্যে শিশুকাল থেকেই সবার হাতে বই তুলে দিতে হবে। স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় সব ক্ষেত্রেই পুরস্কার হিসেবে নির্বাচন করতে হবে বই। জন্মদিনে জামা-জুতো কেক, খেলনার পাশাপাশি উপহার হিসেবে নির্বাচন করতে হবে বই। উপহার হিসেবে বই পেলে শিশুটি কৌতুহল থেকেও একদিন বইটি পড়ে দেখতে পারে। হয়তো সেদিন থেকেই সে বইয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। আর এভাবেই দূর হতে পারে শিশুদের পাঠবিমুখতা।
তা ছাড়া অনেকেরই অভিমত যে, স্টেশনে, বাসে, ট্রেনে, লঞ্চ-স্টিমারে, মেট্রোতে বই পড়ার সুবিধা সৃষ্টি করা যেতে পারে। তৃণমূল পর্যায়ে পাঠাগার আন্দোলন আরো জোরদার করা যেতে পারে। স্কুল-কলেজে বই পড়া কর্মসূচি বাড়ানো যেতে পারে এবং এ প্রকল্পটিকে আরো আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করা যেতে পারে। বছরের বিশেষ দিনগুলোতে, বিয়ে-বার্ষিকীতেও বই হতে পারে আদর্শ উপহার। বাদ যাবে না ভ্যালেন্টাইন দিবসটিও।
সাহিত্যের মানোন্নয়নে আরেকটি বিষয় বেশ গুরুত্বপুর্ণ বলে মনে করি। আর তা হলো বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা বা লিটলম্যাগ তাদের ঘোষণায় উল্লেখ করে দিচ্ছে যে, লেখাটি অবশ্যই সুনির্দিষ্ট শব্দ সংখ্যার হতে হবে। কিন্তু লেখালেখির ব্যাপার তো ক্ষেত-খামারে বা কলে-কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের মতো নয় যে, গ্রাহকের চাহিদা মতো যোগান দেওয়া সম্ভব। লেখালেখি অনেকটা ভালোবাসা, নেশা আর প্রাণের তাগিদের ব্যাপার। যা একজন লেখকের স্বাধীন মনের স্বতঃস্ফুর্ত ভাবনার প্রকাশ। বাঁধ দিয়ে একটি নদীর স্রোত পরিবর্তন করা গেলেও একজন লেখকের ভাবনা-চিন্তার বিচরণ ক্ষেত্রকে সীমাবদ্ধ করে সৃজনশীলতার বিকাশ কতটুকু সম্ভব? এমন অবস্থায় তো আমার ভাবনার দুয়ারে অর্গল লেগে যায়। সুনির্দিষ্ট শব্দ সংখ্যার সীমাবদ্ধতা মেনে লিখতে গেলে তেমন কিছুই ভাবতে পারি না। সৃজনশীলতার কোনো চৌহদ্দী বা বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত নয়। এতে করে লেখকের স্বতঃ্ফুুর্ত ভাবের প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। যার ফলে সৃষ্টিশীল কাজের মান পড়ে যেতে পারে। সাহিত্য সম্পাদকদের স্বজনপ্রীতি বা অনুগতদের বলয় ভেঙে বেরিয়ে আসতে হবে। ভালোমন্দ সব লেখাই ছাপানো যেতে পারে। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত সাহিত্য বিষয়ে উন্মুক্ত আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ রাখা যেতে পারে।
চিত্রশিল্পী যখন রঙের যথেচ্ছ ব্যবহার করতে না পারেন তখন তিনি তার মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি করা শ্রেষ্ঠ কর্মটি উপহার দিতে পারেন না। একজন প্রকৃত সাহিত্যিকের বেলায়ও তেমনই মনে করি। আর তাই হয়তো আমরা মানোত্তীর্ণ সাহিত্যকর্ম পাচ্ছি না। খেলারাম খেলে যা, কীর্তিহাটের কড়চা, বিপ্রদাশ, দেবদাস, কড়ি দিয়ে কিনলাম, মানব জমিন, পার্থিব, জোছনা ও জননীর গল্প এমন ধরনের আরো যত বিশালাকৃতির গ্রন্থ আছে সেগুলো কিন্তু সুনির্দিষ্ট শব্দ সংখ্যার ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি। আর যার বিচরণ ক্ষেত্রের পরিধি যতটা বিস্তৃত তার ভাবনা আর দেখার পরিমিতিও তেমন। আজকাল অমন বিশাল ক্যানভাসের গ্রন্থ রচনার সাহস বা ক্ষমতা খুব কম লেখকেরই আছে। আর কেউ যদি লিখেও থাকেন তাহলে তা প্রকাশে কোনো প্রকাশক আগ্রহ প্রকাশ করবেন বলে মনে হয় না। তবে সে ক্ষেত্রে লেখক যদি ঘোষণা দেন যে তিনি তার নিজ খরচে গ্রন্থটি প্রকাশ করতে চান, তাহলে দেখা যাবে যে, তার দরজায় প্রকাশকদের লম্বা লাইন লেগে গেছে হয়তো।
প্রকাশনার ক্ষেত্রে টাকা হলেই যা-তা ছাপানোর সুযোগ বন্ধ করতে হবে। নিরপেক্ষ সম্পাদনা, সৎনির্বাচক এবং মান বিচারে অনুত্তীর্ণ বই যেন বাজারে আসতে না পারে। আর কোনোভাবে নির্বাচকদের ম্যানেজ করে কোনো মানহীন বই যদি চলেও আসে তদারকির মাধ্যমে তা যেন বাজার থেকে সরানোর ব্যবস্থা থাকে।
লেখাটি শেষ করার আগে একটি ঘটনার কথা জানিয়ে যাই, যা আমাদের সাহিত্যের দুরবস্থার আরেকটি বড় কারণ বলা যেতে পারে।
একবার কোনো এক লেখিকা বাংলা একাডেমীর লেখক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন (পুরো ব্যাপারটি আমার মনে নাই)। তো তিনি একটি অনলাইন পত্রিকায়(পত্রিকার নাম মনে পড়ছে না।) লিখেছিলেন যে, একবার বাংলা একাডেমীর কোনো একটি সংকলনের সম্পাদক হওযার সুযোগ পান। আগের বছর সংকলনটির সম্পাদক ছিলেন অন্য কেউ। যিনি সংকলনটি করার সময় লেখিকা ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের পুছেন নাই। এবং তাদের দলের কারো লেখা সেই সংকলনটিতে স্থানও দেন নাই। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি পূর্বতন সম্পাদকের ওপর ক্ষুণ্ন ছিলেন। তো এই লেখিকা যখন সম্পাদক হওয়ার সুযোগটা পেয়ে গেলেন তিনি আগের সম্পাদক ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের কারো লেখাই নিজের সম্পাদিত সংকলনে স্থান দেন নাই। এবং লেখাটিতে তিনি এও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, বাপু, আগেরবার তুমি আমারে গোণায় ধর নাই, এবার আমিও তোমারে হিসাবের বাইরে রেখে দিলাম।
ব্যাপক বিনোদন ও আত্মশ্লাঘার কথাই বটে! কিন্তু আমার কথা হলো একজন সম্পাদক যদি ব্যক্তিগত স্বার্থ, ক্রোধ বা প্রতিশোধস্পৃহার ঊর্ধে উঠে নিজের দায়িত্বটুকু পালন করতে না পারলেন তাহলে তিনি নিজেই বা পাঠককে কী দিলেন আর সাহিত্যের মালায় কোন ধরনের ফুলই বা সংযোজন করলেন তা হয়তো আলাদা করে বিশ্লেষণ না করলেও চলবে।
আমার হীন মানসিকতাকে যদি আমার নির্বিরোধ কর্ম দিয়ে আড়াল করতে না পারলাম তাহলে মাঝখান থেকে আমার শ্রেণিটাকেই তুলে ধরলাম মাত্র, সাহিত্যের কোনো উপকার হলো না। কাজেই আমদের সাহিত্যের অনুর্বরতা বা দুরবস্থা অথবা উৎকর্ষের দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকার মূলে আমাদের অনুদার মানসিকতাও একটি বড় কারণ।
আমাদের হাতে ক্ষমতা থাকলেই আমার শ্যালকের গরুর রাখালকেও ক্ষমতার আসনে বসিয়ে দিলে যোগ্য লোকের অপমান করা হয়। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না একথাও আমরা নিজেদের বেলা মনে করতে চাই না।
পরিশেষে এইই বলবো যে, বাংলাদেশের সাহিত্যের ক্ষেত্রে উৎকর্ষ লাভের একমাত্র উপায় তার বিকাশের পথকে নিষ্কণ্টক ও বাধাহীন করা। যা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আকাশ-কুসুম বলা যায়।

৬/৬/২০২৩ইং।

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৪৮
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×