'মন সায়র'
এবং
'বাসি বকুলের ঘ্রাণ'।
এবছর একুশে বই মেলা থেকে বই কিনেছি মাত্র ছয়টা। আর উপহার হিসেবে পেয়েছি ২২ টা। ৪ জন সম্মানীত ব্লগার বন্ধু মোট ৬ টা বই উপহার দিয়েছেন- তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আজ মনিরা সুলতানা আপুর কবিতার বই 'মন সায়র' এবং গল্পের বই 'বাসি বকুলের ঘ্রাণ' নিয়ে লিখছিঃ-
'মন সায়র'......

ছোট্ট একটি শব্দ কবিতা। অথচ এর বিশালতা আর গভীরতা সত্যিকার অর্থেই অকল্পনীয়। জীবনের প্রত্যেকটি উপাদান আর উপাত্ত নিয়েই কবিতা। একটি জীবনের আলোকে সামগ্রিক জীবন নিয়ে লেখা হয় কবিতা। কবিতা হাসায়, কবিতা কাদায়। কবিতা আনন্দ দেয়, কবিতা বেদনা শেখায়। তাই একজন কবির কাছে তার কবিতা নিজের সন্তানের মতো, যে তাকে ভালোবেসে পাশে থাকে দুঃখের সময়েও।
কবিতা বা পদ্য হচ্ছে শব্দের ছন্দোময় বিন্যাস; যা একজন কবির আবেগ, অনুভূতি, উপলব্ধি চিন্তাকে সংক্ষেপে উদ্ভাসিত করে আর তা শব্দের ছন্দায়িত ব্যবহারে সুমধুর শ্রুতিযোগ্যতা যুক্ত করে। কবিতা হচ্ছে ছন্দ, দোলা এবং স্পন্দন নিয়ে রচিত একগুচ্ছ শব্দমালা।
চলো দু'জন মিলে সুখের কিছু ফানুস উড়াই!
চলো এক টুকরো পূর্ণিমার বাদলে করি স্নান
........
........
ভোরের কুয়াশার মত সুখ ছুঁয়ে যাক মানুষের ধরণীতে।(পূর্ণতা)
কবিতা এমন একটা ব্যাপার যেটা আসলে পড়ে, অনুভব করে অন্যকে ভাষায় প্রকাশ করে বুঝানোর নয়। তবুও কিছু কথা জড়ো হয় যে কোন কাব্যগ্রন্থ পাঠ শেষেই। এই বইটি পাঠ শেষেও তেমন কিছু কথাই জড়ো হয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থে বত্রিশটি কবিতা স্থান পেয়েছে। সবগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করলে এই পর্যোলোচনা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। তাই যেসব কবিতা ভাবনার খোরাক যোগাতে সক্ষম হয়েছে সেগুলো নিয়েই বরং আলোচনা করা যাক।
কবিতা লিখেন কে? একজন কবি। পাঠকের মনের অজানা কথাগুলোই যেন ভেসে উঠে পঙক্তি হয়ে কবির কবিতার। পাঠক নিজের না বলা কথাগুলো গুচ্ছ আকারে লিপিবদ্ধ দেখে আনন্দে হয় আত্মহারা; কিন্তু কখনো কি ভাবে কবির কথা! সেই আক্ষেপটাই যেন কবিতায় তুলে ধরেছেন কবি। যেখানে তিনি বলেন-
প্রতিদিন ফুরিয়ে যাওয়া এক ছোট্ট জীবনে!
আমি জীবনানন্দের কবিতায় রয়ে যেতে চাই
পৃথিবীর সব চাইতে রূপবতী দীঘিতে
কলমির গন্ধ ভরা জলে আঁচল মেলে ধরা গল্প হয়ে...(নৈঃশব্দের নৈবেদ্য)
কবির আক্ষেপটাই যেন প্রতিবাদের ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে ক্ষোভে পরিণত হয়। সেই ক্ষোভটাই যেন কবিকে প্ররোচিত করে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান দেয়ার। তখন কবি বলেন –
সমবেত সুহৃদ!
অগ্নি ঝরা মার্চেরগল্প পড়ো
সে গল্প কবিতা তোমায় গর্বিত করুক
রক্তে আনুক উদ্যম;
তবে কেন এই মার্চে নিষ্পাপ শিশুর কেটে ফেলা আংগুল
তোমার রক্তে আগুন ঝরায় না!(শৃংখল বেঁধেছ পায়ে)
কবি মানেই রোমান্টিক আর কবিতা মানেই রোমান্টিকতা। হোক না তা দ্রোহের কবিতাগুচ্ছ সেখানেও চুপিসারে রয়ে যায় কবির অজানার প্রেমের কথা। কবির অজানায় হারিয়ে যাবার কথা। এমনই হারিয়ে যাবার উপাখ্যানে কবি বলেন –
স্বর্ণামতির স্রোতে পৌঁছে যাবে
অনাগত সময়ের আগমনী বসন্ত বার্তা;
আবছা আবডালে অবহেলায় আবেশিত প্রেমীর হৃদ মাঝারে; অশোক পারিজাতের রঙের ডালি ঢেলে প্রস্ফুটিত হোক
বিভোর দলছুট প্রেমের বৃন্দাবন।(কবিয়াল ফাল্গুণ)
হাজার মানুষের ভীড়ে ছুটে চলা মানুষটার একাকীত্ব আর ঝাঁকে উড়ে বেড়ানো পাখিটার শূন্যতায় কবি যেন এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন খুঁজে পান। সেই মানুষটা কিংবা সেই পাখিটার যে ভালোবাসার মানুষটাকে পাবার আকাঙ্ক্ষা তাই ফুটে উঠেছে তার কবিতায়।
তথাকথিত সমাজের ভালোবাসা মানেই যেন জৈবিক চাহিদার এক আঁতুড়ঘর। আসলেই কি তাই? ভালোবাসা তো মনের সঙ্গে মন বুনার এক কাজ। ভালোবাসা সে তো অশরীরী – না ধরা যায় না ছোঁয়া যায়। ভালোবাসার সেই অকথিত কোমলতার কথাই কবি বলেছেন –
অতখানি অবহেলায় অবগাহনের সুখ নিতে নেই
নিত্যকার চালডালে আটপৌরে করে
অযাচিত ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে, ওই চোখে অবহেলার চোখ রেখো না
ফেরানো দৃষ্টির শুণ্যতায় উন্মাদ হতে হবে!(দীর্ঘশ্বাসের দ্রাঘিমা)
স্বপ্ন আর মিছিল যেন একই সূত্রে গাঁথা দুটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। স্বপ্ন যেন কবিতার মতো। প্রতিবার পড়ার সময় তা নিজেকে আরো মেলে ধরে, নিজের আরো বিস্তৃতি বাড়ায়। আর মিছিল! স্বপ্ন হোক কিংবা মিছিল সে তো শুরু করে একজনই। কিন্তু তার কি কোনো শেষ আছে? স্বপ্ন আর মিছিলের স্ফুলিঙ্গ নিয়ে পৃথিবীর বুকে হেঁটে বেড়ায় কোনো না কোনো এক সুবোধ।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীর সৌন্দর্যের মুগ্ধ হয়ে কত শিল্পী আর মনীষী এই দেশের প্রেমে পড়েছেন তার ইয়াত্তা নাই। কিন্তু আধুনিকতার কবলে পড়ে ক্রমশ নদী হারাচ্ছে তার অস্তিত্ব। কিন্তু সেই নদীর এমন দগ্ধতা আর ক্ষতের কথা কতজনে মনে রাখে? কতজন সেই নদীর হাহাকার শোনে? কবি সেই হাহাকারের খানিকটা তুলে ধরেছেন তার কবিতায়।
প্রেম। প্রকৃতির অদ্ভুত এক সৃষ্টি। প্রেমের বন্ধন যে কতটা গাঢ় তা তো যুগে যুগে ইতিহাসই প্রচার করে এসেছে। কিন্তু সেই গাঢ়তা কি খানিকটা ম্লান হয়নি? হয়েছে বটে আর তাই তো বেড়েছে প্রেমের ব্যর্থতা আর বিচ্ছিন্নতা। সেই বিচ্ছিন্নতার জ্বালা সইতে পারে এমন কজনাই বা আছেন?
কথার কোনো ক্ষয় আছে কিংবা শেষ আছে? কথা স্রোতস্বিনী নদীর মতো; প্রজন্ম থেকে প্রজন্মাতরে, যুগ থেকে যুগান্তরে। কথার কোনো ক্ষয় নেই কিংবা শেষ নেই তবে কথা থাকে অপেক্ষায়। সেই অপেক্ষায় পালা শেষ হয় কিন্তু কথা তবু ফুরোয় না। গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে কথাগুলো জমতে জমতে একদা হারিয়ে যায় কোনো অতলে, কোনো এক অজানার দেশে। যা কবির কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন পরম মমতায়।
কবিতার বই পড়ার সবচেয়ে ভালো সুবিধা হলো একরাশ মুগ্ধতায় ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যাওয়া যায়। অবাধ্য শৈশবকে যেমন অনুভব করা যায় তেমনি সমাজের রূঢ় বাস্তবতাকে চোখের সামনে স্পষ্ট দেখা যায়। এভাবেই কবি নিজের গান গেয়ে অন্যকে করে প্রভাবিত। আর কবিতার বই একরাশ মুগ্ধতায় রয়ে যায় পাঠকের মনে হয়তোবা ক্ষণিকের জন্যে কিংবা হয়তো আজীবনের জন্যে। যেমনটা কবিও যেতে যেতে বলে যান–
খেয়ালী দুপুরকে
খুঁজে নেয় গাংচিল
ফাগুন বাতাসে
হাওয়াই মিঠাই কলরোল!
চিরকুটে
নীলাভ আলোর মায়া
এ বসন্ত কথা না রাখার ফাঁদ বুনেছে।(শহুরে ফাল্গুন)
আমি নিজেকে কবিতা বোদ্ধা মনে করি না। তবে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির অংগনে কবিতা আমার অন্যতম পছন্দের। সেই হিসেবে বলতে চাই, মনিরা সুলতানা একজন পরিপূর্ণ কবি। কবি মনিরা সুলতানার জন্য শুভ কামনা।
*********************************************
বাসি বকুলের ঘ্রাণ.....

আমাদের জীবন অনেক সংক্ষিপ্ত। এই সংক্ষিপ্ত জীবনে যেকোনো সময় যেকোনো ঘটনা ঘটতে পারে। সময়ের সাথে সাথে যেকোনো মুহূর্তে বদলে যেতে পারে অবস্থা কিংবা অবস্থান। যেকোনো মুহূর্তে ঘুরে যেতে পারে জীবন নদীর বাঁক। প্রত্যাহিক জীবনে এমনি সব মোড় ঘোরানো ঘটনার সমাহারে জীবনঘনিষ্ঠ কিছু বাস্তবতার সমন্বয়ে লেখক মনিরা সুলতানার গল্প সংকলন 'বাসি বকুলের ঘ্রাণ'। ছোট ছোট ঘটনার সমাহারে চিত্রিত হয়েছে সমাজ জীবনের নানা ধরনের গল্প। ৫০ পৃষ্ঠার গল্পের বইয়ে বিশটা গল্প! বুঝতেই পারছেন কতটা ছোট এক একটা গল্পের প্লট! খুব ছোট ছোট এই গল্প গুলো অনেকটাই দিনপঞ্জি(ডায়েরী) স্টাইলে লেখা।
জীবন প্রবাহের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষের সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে। কেউ হয়ে আসে আলোর দিশারী আবার কারোর সংস্পর্শ আমাদের পিছিয়ে দেয় অনেকটা। জীবনের জটিলতা, জীবনের সমস্যা কত যে অন্যমনস্ক করে দেয় মানুষকে। কত অসহায় বোধ করে মানুষ। কত ঘুম বিনষ্ট হয় রাতের দিনের, সমাধান না মিললেও বুক বাঁধতে হয় আশায়। অটল থাকতে হয় পর্বতের মতো। যা এই গল্প গ্রন্থের উপজীব্য বিষয়।
হয়তো লেখকের জীবন বোধের উপলব্ধির চমৎকার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে গল্পের বইতে। সব মিলিয়ে বইটি যেন সময়ের সাথেসাথে মুহূর্তেই বদলে যাওয়া জীবনের চমৎকার আখ্যান।
'মন সায়র'
এবং 'বাসি বকুলের ঘ্রাণ' -মন্দ দিক......
দুটো বই-ই খুবই সাদামাটা প্রচ্ছদ। অর্থবোধক এবং আকর্ষণীয় নয়। বই দুটির কাগজে হাত কেটে যায়! বাইন্ডিং মানসম্মত নয়। সব চাইতে অস্বস্তিকর হচ্ছে বইয়ের সাইজ। টেবলয়েট/ফিকশান সাইজের বই সংরক্ষণের জন্য মোটেই উপযোগী নয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:৫৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



