রাজধানীর তিন নাগরিকে- নগর জীবনের অভিজ্ঞতাঃ
ঢাকা মহানগরীতে নানা সমস্যার মুখে পড়তে হয় নগরবাসীদের। সেসব সমস্যা এবং নগর জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে তিন নাগরিকের সাথে কথোপথোনের মাধ্যমে তিন নাগরিকের অভিমতঃ
সাইফুদ্দীন আল মামুন, চাকরিজীবী
দেশের খ্যাতনামা একাটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। সিনিয়র মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ-এর চাকরি হওয়ায় সারাদিনই রাজধানী ঢাকা শহরের এ প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটোছুটি করে বেড়াতে হয়। জনবহুল রাজধানী শহরে এসে কর্মজীবন শুরু করেছেন ৬/৭ বছর হলো। বিয়ে করেছেন ৪ বছর হলো, একটি ছেলে সন্তানও আছে। একজন কর্মজীবীর বিচিত্র সমস্যাগুলোর আঁচ লাগছে প্রতিদিন। এ প্রসঙ্গে তিক্ত অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, এক এক করে কতো সমস্যার কথা বলবো বলুন, সমস্যা দিয়েই তো প্রতিদিন শুরু হয়। ঘর থেকে বেরিয়েই প্রতিদিন পরিবহন সমস্যার কারণে মনটা বিষিয়ে ওঠে। ধাক্কাধাক্কি করে কোনো গণপরিবহনে উঠলেই বাস কন্টাক্টরের সাথে শুরু হয় ভাড়া নিয়ে কাইজ্জা। তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যামে আটকা থেকে গরমে ঘেমে জবজব হয়ে লেট করে অফিসে পৌঁছে বসের ঝাড়ি খাওয়া। সব কিছুর দাম বেশী- বাজারে গেলে মাথা খারাপ হয়ে যায়।
আমাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষদের সমস্যা অনেক। তা মুখ ফুটে বলা যায় না সবসময়। প্রতিদিনই অফিসের কাজে শহরের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। আর বিচিত্র সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এর মধ্যে পরিবহন সমস্যা, যানজট, দুপুরে বাইরে খাওয়া-দাওয়া সমস্যা, পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি, জীবনযাত্রা ব্যয় বৃদ্ধি, রান্নার গ্যাস সমস্যা- আমার মতো আরও অনেককে বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে রেখেছে। আমাদের বেতনের অংকের সঙ্গে ব্যয় ক্রমেই ভারসাম্য হারাচ্ছে। আমরা যারা ভাড়া বাসায় থাকি বাড়ি ভাড়ার অস্বাভাবিক হার আমাদের জীবনে চরম অস্বস্তি সৃষ্টি করছে। বেতনের বড় একটা অংশ বাড়ি ভাড়া, গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল, টেলিফোন বিল, ডিশ বিল ইত্যাদিতেই চলে যাচ্ছে। বাকি যা থাকছে, তা দিয়ে সম্মানজনকভাবে বাঁচাটাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
জেসমিন শারমীন, চাকরিজীবী
কাজ করেন রাজধানী ঢাকার একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে। একজন কর্মজীবী নারী হিসেবে কি ধরনের সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়- জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুরুষদের চেয়ে কর্মজীবী নারীর সমস্যা অনেক বেশি। তাদের সমস্যা ঘরে-বাইরে সবখানে। রাজধানী ঢাকার জটিল নাগরিক জীবনে কর্মজীবী নারী হিসেবে আমার মতো আরও অনেকেই একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকি প্রতিদিন। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘরদোর সামলে নিজের অফিসের জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়। এখানেও হাজার ঝক্কি। সবসময়ে কাজের লোক থাকে না। একাই সব সামলাতে হয়। অফিসের জন্য বেরিয়ে ঠিকমতো রিক্সা কিংবা অন্য যানবাহন পাওয়া যায় না। পেলেও পথে পথে প্রচণ্ড জ্যামে পড়তে হয়। এ কারণে অফিসে পৌঁছতে লেট হয়ে যায়। প্রায় এজন্য বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। যানবাহন সমস্যাটা মহিলা কর্মজীবীদের জন্য সবচেয়ে বেশি বিব্রতকর। বৃষ্টির দিনে বিকেলে অফিস ছুটির পর ঝড় বৃষ্টি নামলে কিংবা সকালে অফিসে আসার সময় বৃষ্টি শুরু হলে ভীষণ খারাপ লাগে। একটু বৃষ্টি হলে ঢাকা শহরের অলিগলি রাজপথ ডুবে সয়লাব হয়ে যায়। এর মধ্যে মেয়েদের চলাচল করা বেশ কঠিন। বৃষ্টি কিংবা জলাবদ্ধতার কারণে অফিসে না গিয়েও পারা যায় না। আর বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কোনো অনুযোগ গ্রহণযোগ্য নয়। তাহলেই বুঝতেই পারছেন আমাদের সমস্যা। এছাড়া সপ্তাহের ছয়দিন অফিস করার কারণে আমাদের পরিবার পরিজনসহ কেবলমাত্র একদিন শুক্রবারে একসঙ্গে যৎসামান্য সময় কাটানোর ফুরসত পাওয়া যায়। সেদিন বেড়ানোর স্পটগুলোতেও বেশ ভীড় থাকে। যে কারণে বাইরে বেড়াতে যেতেও মন সায় দেয় না। ঢাকা শহরে কর্মজীবী নারীদের ঘরে বাচ্চাদের দেখাশোনা, ঘরদোর সামলানোর জন্য আজকাল কাজের লোকের ভয়ানক সংকটের মোকাবেলা করতে হয়। ঘরে ঘরে এ সংকটটি প্রবল। এভাবে ফিরিস্তি দিতে গেলে আরও অনেক দেয়া যাবে। তারপরেও সবকিছু সয়ে আমাদের জীবন যাপন করতে হচ্ছে রাজধানী ঢাকা শহরে।
রাফসান আমীন, চাকরিজীবী
একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে প্রিন্সিপাল অফিসার। মতিঝিল অফিস। রাজধানী ঢাকা শহরেই বড় হয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই নাগরিক জীবনের নানা সমস্যা সংকট দেখে আসছেন। একজন কর্মজীবী মানুষ হিসেবে রাজধানী ঢাকা শহরে কি ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, "সমস্যার কি শেষ আছে? প্রতিদিন সকাল থেকেই কতো ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, তার ইয়ত্তা নেই। বাসা থেকে অফিসের জন্য বেরোলেই টেনশন চেপে থাকে মনে। সময়মতো ঠিকভাবে অফিসে গিয়ে পৌঁছতে পারবো তো। অফিস টাইমে রিকশাসহ অন্যান্য গাড়ি পাওয়াটা রীতিমতো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অফিসগামী যাত্রী হিসেবে আমার মতো অন্য অনেকেই তেমন ভোগান্তির শিকার হন প্রতিদিন। অফিসে যাবার পর কাজের চাপেও অস্থির থাকতে হয়। তার উপর বাসায় রান্নার গ্যাসের চাপ থাকেনা, ওয়াসার পানি নাই। অফিস শেষে বাড়ি ফেরার সময়েও ঝক্কি কম হয় না। বিকেলে, সন্ধ্যেয় রাস্তার ট্র্যাফিক জ্যামে পড়ার বিড়ম্বনা আমার মতো সবাইকে চরমভাবে ভোগায়। অফিসে যাওয়া আসায় কর্মদিবসের চার ঘন্টা চলে যায়। এতো গেলো সমস্যার একটি ধাপ। তারপর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আমাদের মতো কর্মজীবী মানুষদের ক্রমেই অস্থির করে তুলছে। সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা নিয়েও এক ধরনের টেনশনের মধ্যে থাকতে হয়। বাসায় ঠিকমতো কাজের লোক না পাওয়াটাও বেশ পীড়া দেয়। এ নিয়ে বাসায় নিত্যদিন সমস্যার সৃষ্টি হয়। সব সমস্যার বড়ো সমস্যা দ্রব্য মূল্য! বাজারে গিয়ে নুন্যতম প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র না কিনেই বাড়ি ফিরে আসি...
রাজধানী ঢাকা শহরে আমাদের মতো কর্মজীবীদের সীমিত সুযোগের বিপরীতে সমস্যার পাহাড় প্রতিদিনই প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রাখছে। এগুলো থেকে পরিত্রাণ পেতে আমরা সবাই ব্যাকুল হলেও কোনও লাভ হচ্ছে না। দিনে দিনে সমস্যা কেবলই বাড়ছে। সমস্যা যেনো মেট্রোলাইফের অলংকার। এছাড়া নাগরিক জীবন যেনো সম্পূর্ণ হয় না।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:৫৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



