এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার!
জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল মূলত শেখ হাসিনার ফ্যাশিষ্ট শাসন এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনগণের জাগরণ। তখন মানুষের আশা ছিল একটি প্রকৃত স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। যা কিনা বিদেশি আধিপত্য থেকে মুক্ত হবে।
যেখানে বৈষম্য থাকবে না। বিদেশী দাসত্বের শৃঙ্খল থাকবে না। অর্থনীতি, বাণিজ্যনীতি ও শাসন কাঠামো হবে স্বতন্ত্র। সমুদ্র, নদী, জ্বালানি- সব কৌশলগত সম্পদের মালিকানা থাকবে জনগণের হাতে। সামরিক বাহিনী হবে শক্তিশালী ও আধুনিক। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা পৌঁছাবে প্রতিটি ঘরে। নৈতিকতার ভিত্তিতে গড়ে উঠবে এক সুন্দর শান্তিপূর্ণ সমাজ।
কিন্তু, এখন কী হচ্ছে?
গত এক বছর ধরে আমরা দেখেছি, তথাকথিত “সংস্কার” নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার দৌড়ঝাঁপ। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন চলমান সংস্কার উদ্যোগ ও সেগুলোর অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে একাধিকবার জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রিয়াজের সাথে বৈঠক করেন। জ্যাকবসন ও তার ডেপুটিরা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সাথেও ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করছে।
বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্রের উন্নয়নে’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততার নামে বাংলাদেশে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস ও যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে ঘনঘন বৈঠক ও বিবৃতি লক্ষ্য করছি, যেখানে আমাদের শাসনব্যবস্থায় সংস্কারের আহ্বান জানানো হচ্ছে।
আমাদের সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে, সংস্কার ও তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা’ নিশ্চিতের নামে আমেরিকার এই চাপ কোনক্রমেই আমাদের জনগণের জন্য মঙ্গলজনক নয়। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, আমেরিকা একদিকে যখন ‘গণতন্ত্র’ ও ‘মানবাধিকারের’ কথা বলেছে, তখন অন্যদিকে সবসময় নিজ স্বার্থে স্বৈরশাসকদের সমর্থন দিয়েছে।
মার্কিনীরা এই অঞ্চলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বা মানবাধিকার প্রচারের চেয়ে তাদের কৌশলগত ও প্রতিযোগিতামূলক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। যেমনঃ ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল’, যা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির একটি স্তম্ভ।
আমরা মার্কিন নীতিতে তাদের দ্বিচারিতা প্রত্যক্ষ করেছি, যেমনঃ তারা একদিকে তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের সাথে কূটনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রেখেছিলো, অন্যদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত কিছু বাংলাদেশী নিরাপত্তা কর্মকর্তার উপর ‘প্রতীকী’ ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।
পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এই ধরনের প্রতারণামূলক কৌশল গভীরভাবে প্রোথিত। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মুখোশের আড়ালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বদা তার প্রতারণা লুকিয়ে রাখে এবং তার নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করার জন্য অন্যান্য দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে।
তাই, ‘সংস্কার’ নামক এই রাজনৈতিক ‘পুতুলনাচ’ নিয়ে আমেরিকার পক্ষ থেকে ঘন ঘন ফলো-আপের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশের উপর তার আধিপত্য বিস্তার করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম এবং সেটা হাসিনা যেমনটি ইন্ডিয়াকে দিয়েছিল তার চেয়ে অধিক সহযোগিতা প্রদানের মনোভাবসম্পন্ন একটি সরকার এই অঞ্চলে আমেরিকার কৌশলগত স্বার্থকে আরও ভালোভাবে নিশ্চিত করতে পারবে- তা হোক চুম্মা পীর কিম্বা গরু পীর।
তাই, আমেরিকা বাংলাদেশের সংস্কারকে ‘সমর্থন’ করার নামে মূলত চীনকে মোকাবেলা এবং উত্থান ঠেকাতে মার্কিন নিরাপত্তা কাঠামোর সাথে একত্রিত হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে।
যে কারণে জনগণ হাসিনার অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল, রক্ত দিয়েছিল এবং প্রকৃত পরিবর্তনের আশা করেছিল, তার সবই বৃথা যাবে। কারণ এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী জনগণকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
দুর্ভাগ্যবশত, তারা এখনও স্বীকার করতে রাজি নয় যে, এই নিপীড়নের ‘প্রকৃত কারণ’ শুধু স্বৈরাচারী হাসিনা নয়, বরং যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন এবং যে ‘নতুন রাজনৈতিক সমাধানই’ প্রণয়ন করা হোক না কেন, আমরা মুক্ত হতে পারবো না, যদি না আমরা এই পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার কবল থেকে মুক্ত হতে পারি, যা আমাদের দুর্দশার আসল কারণ।
তাই, হাসিনা উৎখাত হলেও আমাদের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি, বরং আমেরিকার এজেন্ডাই এখানে সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হবে।
জনগণের আন্দোলন ইতিমধ্যেই ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং পুরোনো ব্যবস্থা ধীরে ধীরে ফিরে আসছে। আপনারা কোন ভুল ভাবনা ভাববেন না যে পুরনো ব্যবস্থার মানে হচ্ছে হাসিনার ব্যবস্থা।
বরং আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা রাজনৈতিক সমাধানই হচ্ছে সেই মূল ব্যবস্থা, যা তাদের স্বার্থে স্বৈরাচারী কিংবা গণতান্ত্রিক সব ধরনের রাজনীতিবিদদের লালন করে। এই বিশ্বব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা।
কিন্তু এরপরও মার্কিনীদের প্রতি নতজানু এই দেশের রাজনৈতিক চিন্তাবিদগণ আমাদেরকে ‘বাস্তববাদী’ হতে বলছেন। তাদের দৃষ্টিতে, ভারত আমাদের সার্বভৌমত্বের জন্য প্রত্যক্ষ হুমকি। এর ‘বাস্তবসম্মত’ সমাধান হলো আমেরিকার কোলে আশ্রয় নেয়া! আজকের শাসক আর তথাকথিত মোল্লা রাজনীতিকরা নিজেদের স্বার্থের জন্য জনগণকে বেচে দিচ্ছে। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে ক্ষমতা পাওয়ার আশায়।
জনগণ হতাশ, কারণ যালিম হাসিনার পতনের পরও একই রাজনীতি, একই আনুগত্য আর একই দাসত্বের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এবার শুধু পাশা বদল করে ধর্মান্ধদের পুনর্বাসন করে আফগানিস্তান- সিরিয়া -লিবিয়া -ইয়ামেনের স্থায়ী অরাজক ধারায় বাংলাদেশ দেখতে চাচ্ছে। ডক্টর ইউনুসও মার্কিন-বৃটেন-ভারতের আধিপত্য মোকাবেলা না করে বরং জামায়াতের ক্ষমতার বন্দোবস্তে ব্যস্ত হয়েছেন।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



