----------
নস্টালজিক ক্যাফের তিন তালার টেরেসে পুবের সবচেয়ে করনারের দুজন বসার টেবিলটা খালি নেই, তাই ধারে একটা খালি টেবিল পেয়ে চেয়ার টেনে বসলো রূম্পা, অভিক থাকলে নিশ্চিত ম্যানেজ করে ফেলতো ঐ করনারটা, রূম্পা আর অভিকের সবচেয়ে পছন্দের বসার জায়গা, এখানকার ওয়েটাররাও তা জানে, সাত মসজিদ রোডের নুতন এই ক্যাফেটা রুম্পার খুব ভালো লাগে, কি সুন্দর ছিমছাম পরিবেশ, ইন্টেরিওর ডিজাইন্টাও এতো মোহনিয়,কেমন যেনো ছায়া ঘেরা কোনো গ্রামের বাড়ীর উটহোন. অভিক যেদিন প্রথম ওকে নিয়ে এলো এই ক্যাফেতে প্রথম দিনই রূম্পা বলেছিলো অভিক কে এখন থেকে বাইরে কোথাও খেলে এখানেই আসবো সবসময়, শুনে সায় দিয়ে মাথা ঝাকিয়ে বলেছিলো অভিক আমিও তাই ভাবছিলাম, মাঝে মাঝে রূম্পা ভাবে সত্যি কি অভিকের সাথে অর এতো মিল নাকি অভিক মিত্থ্যে মিল করে নেয় রুম্পাকে খুশি করবার জন্য,ভাবনায় ছেদ পরলো, অনেক দেরী করে ফেলছে অভিক, রুম্পাকে অফিস থেকে হঠাত ছুটি নিয়ে বের হতে হয়েছে, এম বি এর ফাইনাল ইয়ার ইনটারনশিপ, আগে বের হওয়াটা ভালো দেখায় না, অভিকের সময় গ্যান খুব টনটনে ওরতো এমন হওয়ার কথা না, অবশ্য ওরও নুতন চাকরি, ছটায় ছুটি, অফিস কামিয়ে লাঞ্চ করার জন্য আজই কেনো আসতে বলল রুম্পাকে, কে জানে, ফোনে এত কথা বলার সুযোগ ছিলো না, দুজনেই মহা ব্যাস্ত থাকে, স্টূডেণ্ট লাইফের মত আর দেখা আড্ডা হয়না, কিন্তু দুজনেই দুজনের কাছে কমিটেড, ঘর বাধবে একসাথে একটূ থিতু হয়ে। আধঘন্টা ধরে বসে আছে, এরই মদ্ধে অয়েটার দুবার খোজ নিয়ে গ্যাছে অর্ডার দেবে কিনা, ওরাও জানে অভিকের জন্য অপেক্ষায় রূম্পা। আর এভাবে বসে থাকতে ভালো লাগছেনা, মনের ভিতর একটা অভিমান দানা বাধতে চাইছে, আর দশ মিনিট দেখে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় রূম্পা।
অভিক অফিস থেকে বের হয়েছে রুম্পাকে ফোন দেয়ার ঠিক আধ ঘন্টা পর। বস তানভীর ভাইকে ম্যানেজ করে বেরোতে দেরী হয়ে গেলো, নিশ্চয় এতোক্ষনে রূম্পা এসে অপেক্ষা করছে। বসুন্ধরা থেকে ধান্মন্ডি অনেক দূর, যাঞ্জট পেড়িয়ে বাইকে একঘন্টা লেগে যাবে। অস্থির লাগছে অভিকের, ভাবলো বের হয়ে ফোন দিলেই হোতো, প্যান্টের পকেটে আলতো করে ছুয়ে দেখলো ছোট আংটির বক্সটা ঠিক আছে নাকি, সকালে অভিক কে অবাক করে মা আংটিটা হাতে দিয়ে বললেন এটা রুম্পাকে দিবি,আমার ছেলের বউএর জন্য উপহার। কিছুটা লজ্জা পেয়েছিলো অভিক, সামলে নিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরেছিলো, আংটিটা রুম্পাকে না পরানো পরযন্ত সস্তি নেই অভিকের। বাইকের গতি বাড়িয়ে দেয়, নস্টালজিক ক্যাফের সামনে দাঁড়িয়ে রুম্পা, দূর থেকেও চিনতে পারে অভিক, কিন্তু ওতো ভিতরেও বসতে পারতো, বাইরে দাঁড়িয়ে কি করছে,একা একা বসে থাকতে অসস্তি হয়, তাই বাইরেই শেডের নিচে দাঁড়িয়ে আছে বোধহয়। আর মাত্র কয়েক মুহরত তারপরেই সামনাসামনি হবে দুজন, রাস্তার উলটো সাইড দিয়ে একটু এগিয়ে ইউ টার্ন নিয়ে সামান্য এগিয়েই ক্যাফেটা। দ্রুত ছুটে রুম্পার সামনে হারড ব্রেক করে চমকে দেয়ার প্ল্যান করে অভিক, সেই জন্য স্পিড ধরে রেখে ইউ টার্ন নিতে হবে,
ক্যাফের ভেতোরে চল্লিশ আর বাইরে এসে পনেরো মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে রূম্পা এখোনো অভিক এসে পৌছেনি, প্রায় পাঁচ বার কল দিয়েছে, রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ না করে কেটে দিচ্ছে, বারবার,এমন অভ্যেস নেই অভিকের, অথচ জরুরী ভাবে অভিক ডেকে এনেছে রুম্পাকে, সকালে ফোন দিয়ে বলল নস্টালজিকে লাঞ্চ করবো চলে এসো, এই ক্যাফেটা ওদের দুজনের খুব প্রিয় জায়গা, এখানেই দুজন দুজনকে কথা দিয়ছিলো ঘর বাধবে একসংগে. এক ব্যচ সিনিওর অভিক কথা দিয়েছিলো রূম্পা পাশ করে বেরোলেই সিদ্ধান্ত নেবে, অভিভাবকদের জানাবে. গত মাসেই বিশববিদ্যালয়ের কনভোকেশন হয়ে গেলো সেখানে দুজনেই নিজেদের অভিভাবকদের মধ্যে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো, অনারাও বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন দুজনের ইচ্ছে, নাহ! বেশ গরম লাগছে, চিন্তার রেশ কেটে যায় রুম্পার, এখানে দাড়াতে ভালো লাগছেনা আর। কিছুখন আগেই বড় রাস্তার উল্টো পাশটায় কিছু এক্টা হয়েছে, প্রচুর লোকজন একটা জায়গায় ভীড় করে হইচই করছে ক্রমেই ভীড় বাড়ছে মনে হয় কোনো দুরঘটনা, উত্তেজিত ভাবে হইচই করছে সবাই একটূ পরই হয়তো গাড়ী ভাংগা শুরু হবে, কিছু হলেই লোকে এখন সবার আগে ভাংচুর আর আগুন লাগানো শুরু করে। ভয় আর অভিমানে কান্না ডুক্রে ওঠে রুম্পার মনে, প্রচন্ড অনিচ্ছা নিয়ে একপা দুপা এগিয়ে যায়, একটা খালি অটোরিক্সা দেখে থামতে বলে, কই যাইবেন তাড়াতাড়ি ওঠেন আপা, অহনি গ্যাঞ্জাম শুরু হইবো, মটর সাইকেল আর বাস এক্সিডেন্ট হইসে একটা জোয়ান পোলা মারা গেসে রাস্তার অই পাড়ে। কি সব বলছে লোক্টা ঠিকমত শুনতে পায়না রূম্পা, শেষ বারের মত অভিক আসার রাস্তাটার দিকে তাকায় ছলছল দ্রিস্টিতে, ধীর পায়ে অটোতে উঠে বসে সে।
মাটিতে পড়ে আছে ছেলেটা বয়স পচিশ থেকে তিরিশ কম বই বেশী হবেনা রাজপুত্রের মত চেহারা মাথার বা পাশটা মাটির সাথে বাড়ি খেয়ে থেঁতলে গেছে,আহারে ক্যান যে পোলাগুলি হেল্মেট পরেনা, হেল্মেট পরা থাকলে বাইচ্চা যাইতো কে যেনো ভিড়ের মদ্ধ্যে বলে উঠলো, কিছু লোক ছেলেটার পাশেই পরে থাকা দুম্রে যাওয়া বাইক্টা দাড় করানোর চেষ্টা করছে,এরই মদ্ধ্যে কালো বিশাল দেহী এক লোক ভীর ঠেলে এগিয়ে এলো, বাজখাই আওয়াজে চেচিয়ে ডাক্লো অই কালু,মন্তাজ,ইদ্রিস এইদিকে আয়,আর রাস্তা বন কইরা দে, একটা গাড়িও যেন চলবার না পারে, আর কাম্রুল লাশটারে সাইড কইরা রাখ একটা কাপড় দিয়া ঢাক। বেচে আছে নাকি ভালো কইরা দেখেন ভাই, ম্রদু গুঞ্জন উঠলো ভীড় করা লোকগুলোর ভেতোর, বোঝা গেলো পুরো পরিস্থিতি এখন বিশালদেহীর নিয়ন্ত্রনে। লোক্টা আক্কাস, স্থানিয় মাস্তান, তার এখন অনেক কাজ, কিছু গাড়ী ভাংচুর করাতে হবে, আশেপাশে আতংক তৈরী করতে না পারলে তার ব্যাবসা হবেনা, দুই একটা গাড়িতে আগুন দিতে পারলে খুব সহজেই ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরী হয়, তখন সুযোগ মত দোকান লুট, ভাঙা গাড়ীর আতংকিত যাত্রির কাছ থেকে ছিনতাই, সব কিছুই সহজ হয়ে যায়, এই কাজগুলি করার জন্য তার বিশেষ বাহিনী আছে, রোজ রোজ তো আর তার সীমানায় মানুষ দুর্ঘটনায় মরবে না। সে চকিতে কালুকে চোখের ইশারায় কিছু নির্দেশ দিলো,রোগা পটকা একটা ছেলে খানিক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত পরিচয়হীন বাইক চালকের পাশে বসে ভাবলেশহীন চেহারায় নিহতের শরীরে থাকা প্যান্ট শার্ট পকেট হাতরাতে শুরু করলো। ভাবখানা এমন যে এখনই হাস্পাতালে নিবে। অস্ফুট সরে ককিয়ে উঠে ছেলেটা, বাইচ্চা আছে বাইচ্চা আছে শোরগোল উঠে ভীড়ের মদ্ধে। কালু কি খুজস? হাস্পাতাল লইয়া যা, বিরক্ত সরে খকিয়ে উঠে আক্কাস শেখ, জিবিত মানুশের চেয়ে ম্রিত মানুশ তার প্রয়োজন ছিলো বেশী। হাস পাতালে দিয়া তাড়াতাড়ি চইলা আইবি, পুলিশে ঝামেলা করবার পারে, অই মিয়ারা খারাইয়া দেহেন কি? হাত লাগান আমার লগে, জনতার দিকে তাকিয়ে খেকিয়ে ওঠে কালু, এরই মদ্ধ্যে সে যা পেরেছে চালান করে দিয়েছে নিজের পকেটে,।
একটা বড় ধরনের ঝামেলার পর যেমন একটু একটু করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে সময়টা এখন তেমনি, ঘটনাস্থল থেকে বেশ দূরে একটা চায়ের দোকানে কালু বসে চা খাচ্ছে, পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে নিয়েছে,তবে তার আগেই যা ঘটানোর ঘটিয়েছে আক্কাসের দল,কালুও তাদের সহযোগি, এখন সবাই ছড়িয়ে পরেছে নিরাপদ দুরত্তে। কালু নিজের কাধের ছোট ব্যাগটা চেপে ধরে স্মিত হাসি দিলো,ভালো আমদানি হয়েছে আজ,আক্কাস শেখ খুশি হবে,কালুকে ভালো ভাগ দেবে,কিন্তু সমস্যা হয়েছে পকেটে থাকা মোবাইল ফোন্টা নিয়ে,দামী ফোন্টা কালু হাত্রে নিয়েছে ছেলেটার পকেট থেকে সাথে একটা ছোট চকমকা কাগজ দিয়ে মুড়ানো প্যাকেট আর একটা মানিব্যাগ, এখন ভাবতে অবাক লাগে ঠিকমত গ্যান না থাকলে ও প্যাকেট টা ঠিকই চাইপ্পা ধইরা রাখছিলো পোলাডা, মোবাইল্টা খালি কিসুক্ষন পর পর একটা সুন্দর মেয়ের ছবি নিয়ে বাইজ্জা ওঠে, আর কালু কাটাকাটি ছবি আলা বোতাম টিপে বন্ধ করেদেয়। পুরো মোবাইল্টা বন্ধ করতে পারলে ভালো হোতো কিন্তু তা পারছেনা কালু কাউকে জিজ্ঞেসো করতে পারছেনা। ভাবছে একটু আড়ালে গিয়ে দেখতে হবে বাক্সটার ভেতর কি আছে আর মানিব্যাগে কত টাকা আছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় কালু আক্কাস শেখ কে মোবাইল,মানিব্যাগ আর ছোট প্যাকেট টার কথা বলা যাবেনা এগুলো সে নিজেই রেখে দেবে,
একটু আড়াল খুজে কালু,হেটে হেটে ধান্মন্ডি পার্ক এর ভেতোর একটা নির্জন জায়গায় ঝোপের আড়ালে গিয়ে বসে, প্রথমেই মানিব্যাগ খুলে খুশিতে মন ভরে যায় ছোট বড় নোট মিলিয়ে প্রায় চার হাজার টাকা,কয়েকটা ডেবিট আর ক্রেডিট কারড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, কিছু ভিজিটিং কারড, ক্লাস সেভেন পরযন্ত পড়াশোনা করেছে কালু বাংলাটা ভালোই পড়তে পারে। ম্রিত ছেলেটির পকেট থেকে হাত্রে নেয়া মোবাইল্টি যে বেশ দামী সেটাও সহজেই বোঝে, এবার প্যাকেট টার গায়ে মুড়ানো কাগজটা ছিড়ে ফেলে সে বেরিয়ে আসে একটি আংটির ছোট বক্স।
লোভে আর উত্তেজনায় ছোট ছোট সাস নিতে থাকে কালু, অপুরব সুন্দর আংটিটা দেখে কয়েক সেকেন্ড বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে সে, ছোট ছোট দুটি সাদা ঝকমকে পাথর দিয়ে কারুকাজ করা আংটি টা, সাথে একটা গোলাপী কাগজ ভাজ করা, খুলে গোটা গোটা হাতের পরিস্কার বাংলা লেখাটা পড়ে কালু, মুহুরতে তার মন চলে যায় গ্রামে, সেখানে ব্রিদ্ধা মা আর তার বউ এর মুখটা চকিতে ভেসে ওঠে। মার একটুও যত্ন নেয়না বউটা সারাক্ষন খিটমিটি। দীর্ঘ শাস ফেলে, কাগজের লেখাটা আবার পড়ে কালু,
তোমাকে অনেক ভালোবাসি রূম্পা, তোমার জন্য আমার মায়ের উপহার।
©হাসান কাবীর