somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: স্পর্শ লোভে

১২ ই জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। জানতাম সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ। তবু চাই ৫০ শতাংশ যেন ১০০ শতাংশে পরিণত হয়, লাবনী যেন তার হাতটাও বাড়িয়ে দেয়। চারপাশে তখন পিন-পতন নিরবতা। আমি লাবনীর চোখের দিকে তাকিয়ে। মনে আকুতি, একবার, কেবল একটা বার হাতটি ধরো। জানি, তোমাকে পাবো না কখনোই। তবু একটা বার হাতটা ধরলে মনের তীব্র একটা ইচ্ছে পূরণ হয়। কাঙালের মতো হাতটা বাড়িয়েছি লাবনী, প্লিজ, হাতটা ধরো।

লাবনী হাত বাড়াচ্ছে দেখে আমি চোখ বুজে ফেললাম। তার এই মুহুর্ত কালীন স্পর্শ সারা জীবনে জন্য মনে ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষ খুবই ভাগ্যবান। মানুষের স্মৃতি নামক একটা ব্যাপার আছে। স্মৃতি অতীত ঘটনাবলী ধরে রাখতে পারে খুব সহজেই। লাবনীর হাতের স্পর্শের স্মৃতিটুকু আমাকে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা দেবে, লাবনীকে না পাওয়ার যন্ত্রণা কিছুটা হলেও ভুলিয়ে দেবে।

লাবনীর বাবা এতোটাই উঁচু সমাজের লোক যে তিনি লাবনীকে কখনোই আমার হাতে তুলে দেবেন না। লাবনীও তার বাবাকে খুব ভালবাসে । সে কখনো তার বাবাকে কষ্ট দিতে পারবে না। কথাগুলো এই একটু আগেই সে বলছিল। আমি ভাবলাম যাকে পাওয়া যাবে না, তাকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখাটাও ঠিক না। তাই হাতের স্পর্শ পাওয়ার স্মৃতিটা কেবল চাওয়া। লাবনীর স্পর্শ পাচ্ছি না দেখে চোখ মেললাম। লাবনী নেই। সে চলে গেছে। আমাকে তোমার ছোঁয়া না দিয়েই চলে গেলে, লাবনী! এটা কী করলে! আমি তো কেবল তোমার হাতটা একবার ছুঁয়ে দিতে চেয়েছিলাম। তোমাকে কেবল তোমার স্পর্শেই পেতে চেয়েছিলাম। আর তো কিছু চাইনি। সেই চাওটাও আমাকে দিলে না, দিতে পারলে না!
সেদিন লাবনী চলে গিয়েছিল। আমিও আর তাকে আটকাতে চাইনি। বরং লাবনীকে মনে মনে একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। লাবনী, তোমার এ হাতটা আমি এক দিন না এক দিন স্পর্শ করবোই। যে করেই হোক।
আমার পড়াশোনার ধারা একবারেই পাল্টে ফেললাম। চলে গেলাম ভারত । সেখানে ২ বছর থেকে পামিস্ট্রি আর এস্ট্রোলজি নিয়ে বিশদ পড়াশুনা করলাম। কিরো, বেনহাম, নোয়েল জ্যাকুয়িনসহ সব বিখ্যাতদের বই পড়ে ফেললাম খুব মনোযোগ দিয়ে। জানলাম, হস্তরেখা বিদ্যা এক অনন্য বিদ্যা। এটা বিজ্ঞানের চাইতেও বড় কিছু। বিজ্ঞান ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না, হস্তরেখা বিদ্যা পায়। বিজ্ঞান ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, হস্তরেখা বিদ্যা পারে। পাথর দিয়ে সম্ভব সব কিছু পরিবর্তন করে দেয়া। আমি পুরোদস্তুর এক পামিস্ট হয়ে দেশে ফিরে এসে শুনি লাবনীর বিয়ে হয়ে গেছে। সে এখন অন্য শহরে চলে গেছে। যাক। কোন সমস্যা নাই। পামিস্ট্রিতে পুরোদস্তুর বুঁদ হয়ে যাওয়া একজন মানুষের কাছে কোন লাবনীই কোন ব্যাপার হতে পারে না। আধ্যাত্মিক জগতের এক মানুষ পার্থিব চাওয়া পাওয়ায় মত্ত হতে পারে না। দেরী না করে একটা চেম্বার খুলে বসলাম। সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লিখলাম, এখানে হস্তরেখা দিয়ে ভবিষ্যৎ জীবনের উপায় বলে দেয়া হয়। পসার বাড়তে সময় লাগল না তেমন। মোটামোটি বিখ্যাত একজন পামিস্ট হয়ে গেলাম বছর দুয়েকের মধ্যে।

একদিনের ঘটনা। মধ্য বয়েসী একটা লোক চেম্বারে ঢুকলেন। হাত দেখার জন্য হাতটা বড়িয়ে দিলে তিনি জানলেন তার সন্তান সম্ভবা স্ত্রী প্রায়ই নাকি বিদঘুটে ভয়ের স্বপ্ন দেখেন। ভয় পান সারাক্ষণ। উল্টা পাল্টা বকেন। তাই আমার কথা শুনে তিনি এসেছেন তার স্ত্রীর হাতটা একবার দেখাবেন বলে। তার মতে পাথরই নাকি জীবন। একজন পামিস্টের জন্য এমন ক্লায়েন্ট পাওয়া অত্যন্ত আনন্দের। দরজার দিকে তাকালাম। ভাবলাম, ভদ্রলোকের স্ত্রী হয়তো এখনই রুমে ঢুকবেন। আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে ভদ্রলোক জানালেন স্ত্রীর শরীর খারাপ থাকায় নিয়ে আসতে পারেননি। আমাকে অনুরোধ করলেন বাড়ি যাওয়ার। তার বড়ি নাকি পাশের শহরে। দূরবর্তী কলে কোথাও না গেলেও, পামিস্ট্রি সম্পর্কে ভদ্রলোকের শ্রদ্ধা আর বিশ্বাস দেখে না করতে পারলাম না। তিনি গাড়ি নিয়েই এসেছিলেন। অন্য ক্লায়েন্টদের হাত দেখা শেষে গাড়িতে চড়ে বসলাম।
লোকটার স্ত্রী হিসেবে লাবনীকে দেখে চমকে উঠলাম।
লাবনীও আমাকে দেখে ভ্রু উল্টালো! তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে ঘুমটা টেনে সামনে বসল।
বুঝলাম, লাবনী তার স্বামীকে আমার পরিচয় দিতে চাচ্ছে না।
কোথা থেকে জানি পুরনো ভালবাসা দুম করে জেগে উঠলো মনে। সেই পুরাতন উন্মাদনা এসে ভর করলো সারা শরীরে। লাবনীর হাতের উদ্দেশ্যে হাতটা বাড়িয়ে চোখ বুজলাম। মস্তিষ্কের স্মৃতি কোষগুলো তৈরী হল এক নিমিষে স্মৃতি ধরে রাখার জন্য।
লাবনী হাত বাড়াচ্ছে না দেখে তার স্বামী তাকে ধমক দিয়ে উঠলেন।
আহ! দাও তো হাতটা। আশরাফ সাহেবকে অনেক কষ্টে নিয়ে এসেছি। চেম্বারে নিশ্চয়ই এতোক্ষনে ভিড় লেগে গেছে।
অবশেষে আমি পেলাম। সেই হাতের পরশ এতোগুলো বছর পরে এসে ধরা দিল।
লাবনীর হাতটা ধরলাম শক্ত করে। আমার হাত কাঁপতে থাকলো। সেই পুরোনো মনের সেই অনুভ’তি আজো যে মনের ভেতর এভাবে লুকিয়ে ছিল টের পাই নি। থর থর হাতে লাবণীর হাতের ভাসমান রেখাগুলি পড়তে থাকলাম অনেক সময় নিয়ে।
হঠাৎ আঁতকে উঠলাম! জীবন রেখা খুব খারাপ একটা ইঙ্গিত দিচ্ছে! অন্যান্য রেখার অবস্থাও খুব একটা ভালো না। এমন রেখা দেখে যে কোন পামিস্ট খুব সহজে বুঝতে পারবে সেই হাতের অধিকারীর সামনে ভয়াবহ একটা ফাঁড়া! আমি ধরে নিতে বাধ্য হলাম বাচ্চা প্রসবের সময়টাই খুব ভয়াবহ হবে লাবনীর জন্য।
আমার চেহারা দেখে হয়তো বা ব্যাপারটা আঁচ করে ফেললেন লাবনীর স্বামী।
কি ব্যাপার আশরাফ ভাই। কঠিন কিছু?
নিজেকে সামলে নিলাম তাড়াতাড়ি। বললাম, ফাঁড়া একটা আছে কিন্তু এটা কাটানো যাবে। এটা কাটাতে হলে যে পাথরটা লাগবে তার নামটা জানিয়ে বললাম, পাথরটা আজকেই যে করে হোক সংগ্রহ করুন। আজকেই।
আমার জন্য চরম একটা রোমান্টিক মুহূর্ত এভাবে নিকষ কালো অন্ধকারে পরিণত হবে ভাবিনি কখনো। এ কেমন ভাগ্য আমার? ভালো লাগার মানুষটির মৃত্যুর পরোয়ানা আমাকেই পড়তে হলো কেন- পরের দু দিন মাথার মধ্যে প্রশ্নটা কেবল ঘুরপাক করতে থাকলো।
চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে একসময় লাবনীর স্বামীকে কল দিয়ে পাথরটি সংগ্রহ হয়েছে কি না জানতে চাইলাম।
জানলাম, পাথর সংগ্রহ হলেও বাবার নিষেধের কারনে লাবনী নাকি কিছুতেই সেটা পরতে চাইছে না। লাবনীর বাবা পাথরে মোটেও বিশ্বাস করেন না। প্রয়োজনে তিনি তাকে দেশের সবচে নামকরা ডাক্তার দেখাবেন। আমি তাকে বুঝানোর সবরকম চেষ্টা করলাম। বললাম, ওটা না পরলে সমূহ বিপদ। এমনকি লাবনীকে আপনি হারাতেও পারেন। তিনি তবু এ বিষয়ে তার অপারগতার কথা জানালেন। বললেন, লাবনী তার বাবাকে কষ্ট দিতে চায় না বলেই ওটা পড়বে না।
ফোন রেখে দিয়ে বিষন্ন মনে বসে থাকলাম। এতোদিন যে পামিস্ট্রিকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছি, সেটাকেই বললাম মিথ্যায় পরিণত হতে। লাবনীকে বাঁচাতে হলে এ ছাড়া আর কিইবা করার ছিল আমার। কেবল পামিস্ট্রি ভুল হলেই সেটা সম্ভব। এতোদিনকার সাজানো গোছানো চেম্বারটিতে তালা মেরে দিলাম। চেম্বারের সামনের সাইনবোর্ডটাও ভেঙে টুকরো টুকরো করলাম।

সেই লাবনীর মা-হারা ছেলে আজ এসেছিল পামিস্ট্রি শিখতে। ক্লাস নাইনে পড়া ছেলে হাত দেখায় উৎসাহী জেনে কৌতুহলী হলাম। সে জানালো, ইভানা নাকি তার হাত ধরেনি!
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৮:৫৭
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×