মো আব্দুল কাইয়ুম : মৃত্যুদন্ডাদেশ একটি নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অধঃপতিত শাস্তি। বর্তমান বিশ্বের অর্ধশতকেরও বেশি রাষ্ট্রে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যতম একটি ধরন হলো রাষ্ট্র কর্তৃক সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান হিসেবে মৃত্যুদণ্ডাদেশের আইন। ১৯৪৮ সালে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত হওয়ার পর মাত্র ৮টি দেশ অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধানকে বাতিল করে। ১৯৭৭ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬তে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হিসেব অনুযায়ী, ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ১৪০টি দেশ সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের আদেশকে বাতিল করে যা বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দেশের সমপরিমাণ। তবে এ দেশগুলোর মধ্যে কেবল ১০২টি দেশ সকল প্রকার অপরাধের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের আইনকে বাতিল ঘোষণা করেছে।
মৃত্যুদন্ডের শাস্তি মানেই রাষ্ট্রকর্তৃক একজন নাগরিকের বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করা। এটি সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের দুটি বিধানকে সরাসরি লঙ্ঘন করে। প্রথমটি হল, জীবন ধারণের অধিকার এবং দ্বিতীয়টি, অত্যাচার থেকে মুক্ত হয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। মৃত্যুদণ্ডের বিধান একটি চূড়ান্ত ও অনড় শাস্তি। এর মাধ্যমে নিষ্পাপদের শাস্তি দেয়ার সম্ভাবনা সর্বদা রয়ে যায়। ১৯৭৩ পরবর্তী আমেরিকা-যুক্তরাষ্ট্রে ১৫০ জন বন্দিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় যারা পরবর্তীতে নির্দোষ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিলেন। আইনের মাধ্যমে যে সকল দেশ মৃত্যুদণ্ডের বিধান কার্যকর করে তাদের বিচার ব্যবস্থা নানা সময়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পরিসংখ্যান মোতাবেক, ২০১৫ সালে হওয়া মৃত্যুদণ্ডগুলোর মাঝে ৮৯% হয়েছে বিশ্বের মাত্র তিনটি দেশে (চীন, ইরাক ও ইরান)। অনেক মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রে স্বীকরোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রধান ভূমিকা পালন করে যা অত্যাচারের মাধ্যমে গ্রহণ করার অভিযোগে জর্জরিত। সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক শ্রেণী কিংবা জাতিগত, বর্ণভিত্তিক অথবা ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী অধিক মৃত্যুদণ্ডের শিকার হয় বিচারিক নিরপেক্ষতার অভাবে। মৃত্যুদণ্ডের বিধানকে ইরান ও সুদান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক্ষেত্রে তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে। এগুলো হলো বিশ্বের যে সকল দেশে মৃত্যুদণ্ডে যেসকল আন্তর্জাতিক আইন যুদ্ধাপরাধ ব্যতীত অন্য সকল ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধানের বিরোধিতা করে সেগুলো হলো- The Second Optional Protocol to The International Covenant on Civil and Political Rights, Protocol No: 6 to The European Convention on Human Rights, The Protocol to The American Convention on Human Rights to Abolish Death Penalty; তবে যুদ্ধাপরাধসহ সকল ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে “Protocol No : 13 to The European Convention on Human Rights” আইনটি। বিভিন্ন দেশের আইন হত্যার মত অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধানের প্রয়োজনীয়তার যুক্তি দেখালেও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে এটি কোন সমাধান নয়।
রাষ্ট্রে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার জন্য যে সকল পদ্ধতি গ্রহণ করা হয় তার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ফাঁসি, শিরচ্ছেদ, ইলেক্ট্রিক শক, রাসায়নিক ইনজেকশন, ফায়ারিং স্কোয়াডের দ্বারা মাথার পিছনের অংশে গুলিবর্ষণ ইত্যাদি। ২০১৫ সালে সমগ্র বিশ্বে (চীন ব্যতীত) ১৬০০ টিরও বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনা দেখা যায় যা ২০১৪ সালের চেয়ে ৫৪% বেশি। মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক প্রণীত সনদ ৬২/১৪৯ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০০৮ সালে এ সনদটি প্রয়োগ করা হয়। এর মাধ্যমে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তির ওপর স্থগিতাদেশ দিতে অনুরোধ করা হয় যা এ শাস্তির বিলুপ্তির লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়েছিল। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মৌলিক অধিকার সনদের ২(২) ধারা মোতাবেক সকল প্রকার মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে ইইউ রাষ্ট্রগুলো অবস্থান নেয়। : ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে কাউন্সিল অব ইইউ ‘European Day Against Death Penalty’ প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয় যা ২০০৮ সালের ১০ অক্টোবর থেকে পালিত হয়ে আসছে। ‘ World Coalition against Death Penalty’ কর্তৃক একই বছর থেকে একই দিনে ‘আন্তর্জাতিক মৃত্যুদণ্ডাদেশ বিরোধী দিবস’ পালন শুরু হয়। যে জীবন রাষ্ট্র দিতে পারে না সে জীবন কেড়ে নেয়ার অধিকারও রাষ্ট্রের নেই।
সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের প্রশ্নে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুক্তি হিসেবে নাগরিকদের অপরাধে নিরুৎসাহিত করার ক্ষেত্রে এ দন্ডটি ব্যবহারের কথা বলে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যে সকল দেশে মৃত্যুদণ্ডের আইন প্রচলিত আছে সেসকল দেশে অপরাধের মাত্রা নিম্নগামী না হয়ে বরং ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তবে মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিষিদ্ধ করার জন্য সাহসী রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম যা মানবাধিকারের পক্ষে লড়াই করতে সক্ষম। দেশে মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা ও মৃত্যুদণ্ডের আইন কার্যকর রাখা পরস্পরবিরোধী।
লেখক : মানবাধিকার কর্মী (মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’) : [email protected] দিনকালে প্রকাশিত লিংক মানবাধিকার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডাদেশ বেআইনী
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১১:৩৯