এক.
আমি বাস করি একা। একা সংসার। সঙ্গীহীন একলা সময়ই আমার প্রিয় ছিল। কিন্তু নির্লজ্জ ছায়া -আমার ছায়া, আমার একাকিত্বে ছায়া ফেললো !!
এটাই ছায়া সংক্রান্ত আমার আধুনিক জটিলতা। যদিও পদার্থবিজ্ঞানের 2-1টি সূত্র জানি। আলো -ছায়ার আবশ্যকতাও মোটামুটি বুঝি। তবুও ছায়া সত্ত্ব্া আমার মৌলিকত্ব খাবে - এই প্রস্তাবনা নিতান্তই বেমানানা, মার অযোগ্য।
মনে পড়ে প্রথম যেদিন ছায়া দেখে আৎকে উঠলাম- গল্প করছিলাম সবাই মিলে। হঠাৎ দেখি আমার ছায়া আলোর নিয়ম না মেনে অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গিমায়, নিজস্ব নিয়মে। প্রথমে অসহায়, পরে অত্যন্ত জেদী এবং তৎপর হলাম। আলো তার সূত্র অনুযায়ী ছায়া তৈরী করবে- এটাই নিয়ম। সেই থেকে শুরু; ছায়া প্রতিদ্বন্দিতা। মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত বোধ করি - কে কার ছায়া ? আমার বাস্তবতায় ছায়া নাকি ছায়ার
বাস্তবতা আমি ????
সেদিন আমার আর আমার নারীর সুদিন। স্বপ্ন, কল্পনা, হাসি, অভিমান; চা, হাসি, কল্পনা সব মিলিয়ে বিজ্ঞাপনের মডেলদের মতোন আলোকোজ্জ্বল মুহূর্ত। আর আলো মানেই ছায়া মানেই শত্রু । নারী জানে আমি অন্যরকম; তাই বলে আমার ছায়া!
অবশ্য আগে থেকেই আমি ছায়া সতর্কতা অবলম্বন করেছিলাম।আমি বসেছি যাতে আমার ছায়া আমার আড়ালে থাকে।হঠাৎই ছায়াটা ঘুুুুুুুুুুড়ে নিঃশব্দ বিড়ালের মতোন সামনের দিকে আসতে থাকে নিজের মতো। আমি যদিও কবিতা শোনাচ্ছিলাম নারীকে তথাপি সে আশ্চর্য হয়, বিস্মিত হয়, হতাশ হয়-
ঃ তোমার ছায়া ঠিক তোমার মতো নয়, কোন হিংস্র পশুর মতো .. .. অথবা অন্যরকম কিছু !!!!!
আচ্ছা তোমার কবিতাগুলো কালো কেন??
আমার মুহূর্তগুলো বিবর্ণ হতে হতে দেয়াল থেকে খসে পড়তে শুরু করে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি ভেঙ্গে পড়ি স্বশব্দে । বুঝতে পারি পুণরায় পরাজয়।
দুই.
দাঁড়াতে চেষ্টা করি, ছায়া লম্বা হয়। কতগুলো ভুল আজকাল প্রায়াই হয়। অস্থিরতায় গলে গলে পরে সময়। বুদ্ধিজীবীদের মতোন বিশ্লেষনে বসি। গোল্ডলিফ জালাই। নিশ্চই আশেপাশে সাহায্য করার মতোন কেউ আছে!
বাতাসে ধোঁয়া আর আমার চিন্তামুখ।
দূরত্ব ভেঙ্গে 'ক' জানতে চায়.. ..
"ক" স্বর্গের ঁিসড়ি ভাংতে জানে। স্বর্গের প্রহরী ওর বিশেষ পরিচিত কিনা !! বিনা বাধায় ঢুকতে দেয় যত্রতত্র। বিছানো রং, ঘনছায়া, বাতাসের সুর, শব্দ, জোসনা, ব্যতিক্রমী স্বপ্ন জাদুঘর। যেখানে খুশী যাওয়া যায়- যা খুশী চাওয়া যায়.. .. ..।
এমন সুন্দর স্বর্গে ঘুরে আসার ইচ্ছা ুধার মতোন তীব্রতর হতে থাকে। এক সময়ে আদীপর্বের বিস্ময় ঘোচাতে নতুন বিস্ময়ের খোজে; 'ক' এর সঙ্গী.. ..।
"ছায়া বাইরে রেখে ঢুকুন" স্বর্গ দ্বারে প্রহরীর ঠিক মাথার উপর লেখাটি সূর্যের মতোন জ্বলজ্বল করছে। আর আলো মানেই ছায়া মানেই শত্রু । যদিও "ক" ছায়াঘরে ছায়া রেখে জমা রেখে টোকেন হাতে ফোরোসেন্ট ঝলমলতা নিয়ে স্বর্গে মিলিয়ে যায়। হয়তো স্বর্গের মধ্যে আমার কথা সম্পূর্ণ ভুলে যায়; স্বাভাবিক। আমি ঘামতে থাকি আর ডুবতে থাকি এবং বুঝতে থাকি ছায়ার বিস্তার শুধু দেহের বাইরেই নয়, দেহের অভ্যন্তরে প্রতিটি কোষবদ্ধ সত্ত্বায়। অবিন্যস্ত , এলোমেলো; বুঝি বিরতিহীন প্রেতের মতোন পরজিবী। রঙ্গীন ফ্রেমে নিয়তই সাদাকালো দৃশ্য- আবর্জনাময়। তাড়া খাওয়া কুকুরের মতোন দৌড়ে আসি নিজ ডেরায়। ছায়াসহ নিজের ওজন বাড়তে থাকে।
তিন.
আমার অবস্থান আমাকে কোন পথে নিয়ে যাবে, বুঝতে চেষ্ঠা করি। চারদেয়ালে খসে পড়া কালচে, সঁ্যাতসঁ্যাতে সময়। আমরা একে অন্যকে সহ্য করতে পারি না সত্য; ছাড়তেও পারি না,ু অসুখের মতো একে অন্যের ধ্বংস কামনায়।
ঘর থেকে বেরিয়েই বুঝতে পারি "ভুল"। অসহায়ের মতো থমক্ দে;াঁড়াই। ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতেই অপমান বোধ করি। বেশ্যার ও অপমান বোধ থাকে। বোঝাতে চাই নিজেকে 'স্রোতের মতোন ছুটতে হবে। গভীর নীল জলের.. .. ..
জলের কথা মনে পড়তেই গলা শুকিয়ে আসে। নিজেকে আজন্ম তৃষ্ণার্ত মনে হয়। মনে পড়ে যেদিন প্রথম পুকুর সাঁতরে ওপাড়ে গিয়েছিলাম সেদিন জলের কাছে কৃতজ্ঞ হয়েছিলাম; জলের আলিঙ্গনে আত্নবিশ্বাসী হয়েছিলাম; জলের ভালোবাসায় প্লাবিত হয়েছিলাম। সে অনেক দিন পূর্বের। আশেপাশে কোথাও জলের সন্ধান পাবো সন্দেহে পা দুটো সচল করি। কোষবদ্ধ প্রতিটি সত্ত্বায় তৃষ্ণার তীব্র হাহাকার। একফোঁটা জল"স্বাধীনতার" থেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। এই মুহূর্তে পৃথিবীর কোন না কোন প্রান্তে নিশ্চই বৃষ্টি হচ্ছে!!! আহা, জল!! সবুজ সজিবতা, বেড়ে ওঠা উজ্জ্বলতা"- মগজে শুধু ভেসে বেড়ায় হালকা মেঘের মতোন।
বুঝতে পারি আমার ছায়া নিজের মতোন আমাকে চুষে চুষে পরিপুষ্ঠ আর আমি বিশুষ্ক রক্তমাংস টেনে হিচড়ে সামনে এগুতে চেষ্ঠা করতে থাকি।
চার.
হাঁটতে হাঁটতে কান্ত এগুতে থাকি। হঠাৎ বুঝতে পারি সূর্যের আলো পশ্চিম আকাশে রক্ত রাঙ্গিয়ে তার পরাজয়কে মেনে নিচ্ছে, হয়তোবা। আর বুকের মধ্যে, রক্তকোষে, স্টোর রুমে, খাটের নীচে, সিন্দুক আর নিন্দুকের গহীন ভেতরে সারাদিন যে অন্ধকার আটকে ছিল তা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। আমি বুঝতে পারছি না আমার ছায়া এই অন্ধকারকে সঙ্গী করে বাতাসের মতোন সর্বাঙ্গে জড়াবে নাকি অন্ধকারের ধাঁধায় পড়ে সে নিজেই হারিয়ে যাবে !!!
চারিদিকে এতো তীব্র অন্ধকার যে এখন আমার সামনে অথবা পেছনে, উপরে অথবা নীচে, দিকহীন; - আপাদমস্তক অন্ধকার। সবই একইরকম সম্ভাবনাময় অথবা ফ্রেমবন্দী রহস্যময়। এমনি করে কত সময় চলেছি অথবা আদৌ চলেছি কিনা বুঝতে পারছি না। স্থানু , নতজানু, অনতিক্রম্য, স্থির। হঠাৎ মনে হলো একটা গাছের নীচে বসে আছি যেমনি করে রৌদ্রকাতর কান্ত পথিক একটু জিরিয়ে নেয় পরবতর্ী দূরত্ব অতিক্রম করবে বলে। তবে আমার স্বল্পদৈর্ঘ্য জীবন আর এগুবে কিনা, নাকি অন্ধকারে স্থির ফ্রেমবন্দী হয়ে থাকবে বুঝতে পারছি না। কান্ত হতে হতে যখন পুরোপরি বিদ্ধস্থ, জরুরীভিত্তিতে মৃতু্যকে প্রায় মেনে নিচ্ছিলাম হঠাৎ একটি দৃশ্যপট চোখের সামনে ভেসে ওঠে .. ..
" একটি নবজাতকের জন্ম হচ্ছে। একজন মায়াবতী মা; মায়ের চিৎকার - যে চিৎকারের প্রতিটি শব্দ আলতো করে শিশুটিকে জড়িয়ে মায়ের পাশে শুয়িয়ে দেয়। আর শিশুটি মায়ের সঙ্গে নাভীর বন্ধন ছিন্ন্ হওয়ার শোকে নতুন কাঁদতে থাকে। মা হাসেন। হাসতে থাকেন আর হাসতে আর শিশুটিকে তার দুই স্তনের মধ্যে আগলে রাখেন যতদিন পর্যন্ত না শিশুটির ছেদন দাঁত বড় হয়।
অবশেষে সে যখন দীর্ঘদেহী হয় তার ছেদন দাঁতে সূর্যের আলো হাসে, সে কেঁপে কেঁপে ওঠে। সে তার চারিদিকে সবার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় আর হাতের মধ্য দিয়ে অনুভব করে স্যাঁতস্যাতে বোধ, হাড়-হাভাতে, ুদ্ধ শ্বাপদের অশ্লিল হাসি; ছায়ার আড়ালে। এমনি করেই সে ছায়াকে মালা পড়ায় শ্বাপদকে সাী রেখে। দেখতে পাই ছায়া এইবার গলে গলে ঢুকতে থাকে দেহের সবকটি কোষে। নিয়ত দখল করে নিউকিয়াস। নিয়ন্ত্রন করা শুরু করে দেহের সব কটি যন্ত্র শুধু পারছিলো না হৃদপিন্ডের সাথে। আর যেদিন হৃদপিন্ডকে সে জয় করলো সেদিনই তার পুরোপুরি বিজয় অর্জিত হলো।"
আমি গোঙ্গানীর মতোন শব্দ করতে শুরু করি। শৈশবের সেই কান্নার সুর আমার বিশুস্ক কন্ঠে আর গেয়ে ওঠে না অখচ সেই রকম একবার চিৎকার করে কাঁদতে পারলেই আমার মুক্তি .. ... ফ্রেমে বন্দী এই খন্ড দৃশ্যর পরিসমাপ্তি হতে পারে- মনে হতে থাকে তীব্রভাবে।
এমনি করে কত সময়, কদিন-বছর অথবা কতকাল স্থব্ধ, স্থাণু, অনড়, স্থিরচিত্র ছিলাম জানিনা। হঠাৎ শুনতে পেলাম খুবই অস্পষ্টভাবে জোসনা অংকুরিত সবুজের উল্লাস। এই উল্লাস আস্তে আস্তে সমুদ্রের মতো বিশাল হয়ে আছড়ে পড়তে থাকে মধুরতম শব্দে। আমি চোখ খুলে তাকালাম । পার্থিব চোখ এই দৃশ্য ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারছে না। আমি আমার অনুভূতির সবের্াচ্চ সুখ অনুভব করছি। আমার পায়ের কাছে থমকে আছে সমুদ্রের সাদা ঢেউ - ভেঙ্গে পড়ছে, কোলে জড়িয়ে ধরছে ভালোবাসার মতোন, আরতো আদরে । আমার আশেপাশে সবুজের সজিবতা মুছে দিচ্ছে মায়ের আঁচলের গন্ধে যাবতীয় বিলাপ, ঘুমহীন স্থব্দতা।
মাটির কোলে বসে আছি যেন মা আগলে রেখেছে ঘৃনার বিশ্ব সংসার হতে। জোসনার মায়াময় আলো দায়িত্বশীল পিতার মতো পরম যত্নে জোসনা আদ্রতায় ভিজিয়ে দেয় আর আমার মৃত কোষগুলোর আজন্ম তৃষ্ণা দূর হয়ে যেতে থাকে। আমি বুঝতে পারি সুন্দরের এই যাবতীয় প্রবাহে, ভালোবাসায় আমি এক নতুন প্রান। আর ঠিক তখনই শুনতে পেলাম আমার মাথার উপরের ডালে বসা সঙ্গমরত দুই পাখি যাদের ঠোঁট দুটি অসম্ভব লাল - বলছে সেই বাক্যটি যার উজ্জ্বলতায় চারপাশ সচল, প্রবাহমান, চঞ্চল, সি্নগ্ধ ও সুন্দর হয়ে উঠলো।
কেই না বললেও আমি বুঝতে পারলাম এই বাক্যটি মানুষের কাছে পৌছানোর দায়িত্ব আমার। আমি উঠে দাঁড়ালাম পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে মূল্যবান বাক্যটি বুকের মধ্যে ধারন করে। আমি হাঁটতে আরম্ভ করলাম.. .. .. ..।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



