সেই ২০০৯ সাল থেকে এখানে যাতায়াত।তখন আমার থার্ড ইয়ার। কাটোয়ায় টুইশন পড়তে আসতাম সপ্তায় দুদিন। স্যারের ওখান থেকে বেরোতে প্রায় দেরি হয়ে যেত। শেষে দৌড়ে দৌড়ে কোনরকমে ট্রেন ধরতাম। ট্রেনে উঠে হাপাতে হাপাতে দেখতাম পাশে দাঁড়ানো আজিমগঞ্জ প্যাসেঞ্জার ট্রেনটা কেমন চুপচাপ দাড়িয়ে। ওদের টাইমে আসার টাইমে যাওয়ার কোনও বালাই নেই। ওর যাত্রীগুলোও অদ্ভুত। দেখতাম জানলার ধারে সীটে বসে ওরা দিব্যি ঘুমিয়ে পড়েছে। ট্রেন কখন ছাড়বে সে নিয়ে ওদের মাথা ব্যাথা নেই।
এইসব দেখতাম আর ভাবতাম একদিন আমাদেরও এই দৌড়ঝাঁপ শেষ হবে। সেদিন কোনও এক কাকভোরে একা একা বেরিয়ে পড়ব বাড়ি থেকে। চলে আসব এই কাটোয়ায়। ঢুকে পড়ব এই অলস ট্রেনগুলোর কোনও একটার পেটে। তারপর ওর ঘুম ভাঙ্গলেপরে আড়মোড়া ভেঙ্গে যেখানে নিয়ে যাবে চলে যাবো।
** ** **
আজ ২৮এ মে ২০১৪, মাঝে পেরিয়ে গেছে পাঁচ পাঁচটা বছর। জীবনের এই দৌড়ঝাঁপ আর থামেনি, কারণটা বদলে গেছে শুধু। কাজ ছাড়া, পরিকল্পনা বহির্ভূত ভাবে বেরিয়ে পড়া? নৈব নৈব চঃ । আজ কাটোয়া এসেছিলাম সেইরকমই একটা কাজে। প্রায় ১২ টার মধ্যে কাজ মিটিয়ে ষ্টেশনে এসে ফেরার ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।কিছুক্ষন এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে নীচে ওদিকের প্লাটফর্মে চোখ পড়ল। একটা ছোটো ট্রেন দাড়িয়ে আছে দেখে এগিয়ে গেলাম।
কাটোয়া-বর্ধমান লাইনের এই ন্যারো গেজের ট্রেন গুলো ঘুম-দার্জিলিঙের টয়ট্রেনের মতই তবে ওইরকম ছবির মত সুন্দর নয়। এগুলো এখানকার স্থানীয় মানুষজনের ছাগল, মুরগি, ধানচালের বস্তা বইবার আটপৌরে ট্রেন।
তবে সুপ্রাচীন এই ট্রেনগুলোর আয়ু আর বেশিদিন নয়। কাটোয়া স্টেশনের সামনেই এই ট্রেনগুলির ইঞ্জিনের একটা প্রমান সাইেজের রেপ্লিকা রাখা আছে। সেটা আবার আচ্ছাকরে ফুল-মালা-টুনি দিয়ে সাজানো। আসলে এটা একটা প্রতীক। মানে এই বেচারাগুলো খুব শীঘ্রই বলি হতে চলেছে।
বাবার কাছে ছোটবেলায় এই ট্রেনগুলোকে নিয়ে অনেক মজার মজার গল্প শুনেছি। বাবার কালের সেই ট্রেন গুলতে আর চাপতে পারব না? আমি বাবা হলে তখন ছেলে মেয়েদের কি কৈফিয়ত দেব? void(1);
চট করে হিসাব করে নিলাম আজ সময়ে বাড়ি ফিরতে না পারলে কি কি হতে পারে। মাহাভারতটা এমনকিছু অশুদ্ধ হবেনা বলেই মনে হল।ঠিক করলাম ছোটো ট্রেনে এখান থেকে বলগোনা, বলগোনা থেকে ট্রেন বাস যা পাই তাই ধরে বর্ধমান। তারপর বর্ধমান থাকে কালনা ফেরা যাবে। কিন্তু তার আগে পেটে কিছু দেওয়া দরকার। খলি পেটে রোমান্টিকতা হয় না।
** ** **
খেয়েদেয়ে ২০ মিনিট পর ফিরে এসে দেখি রেললাইন ফাঁকা। ট্রেন হাওয়া। তবে যে ড্রাইভার বলল ছাড়তে দেরি আছে! ধুস, কত কষ্ট করে মনকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে যাওয়ার জন্য রাজি করালাম, সব ভেস্তে গেল।কিন্তু তখন আমায় নেশায় পেয়ে বসেছে। কোথাও একটা যেতেই হবে।
কোথায় যাবো? এখন দুটো অপশন খোলা। ১. হাওড়ার দিকে, আমার বাড়ি, আগের স্কুল। এই রুটে যাতায়াত করতে করতে মন হেজে গেছে। অতয়েব বাদ। অথবা ২. আজিমগঞ্জের দিকে, তেমন কিছুই জানি না, ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরতে পারব তো? কাছেপিঠে কিছু নেই? গুগল ম্যাপে কর্ণসুবর্ণকে দেখতে পেলাম। কয়েক মাস আগে বন্ধুদের সাথে মুর্শিদাবাদ গিয়েছিলাম। তখন আসল দেখার জিনিসগুলো দেখেছি। কিন্তু কর্ণসুবর্ণে আসা হয়নি। সেখানে সেই কোন অন্ধকার বাংলা থেকে একা এক শশাঙ্ক বেরিয়ে পড়েছিল একদিন অজানা কনৌজ-কামরূপের দিকে। তার এলাকাটা একবার দেখে আসতে হবে না? অতঃপর কর্ণসুবর্ণ।
১২.৫০ এর ট্রেন ১.২০তে ছাড়ল। অবাক হয়ে লাভ নেই।এই লাইনে এটাই রেওয়াজ।মন্দের ভালো আমাদের ট্রেনটা একটা নতুন ডেমু। বেশ গড়গড়িয়ে চলল। মাঝেমধ্যে ক্রসিঙে একটু দাড়িয়ে থাকে।কাটোয়া লাইনে ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করে এই সব ক্রসিং আমার গা সয়ে গেছে।
যখন কর্ণসুবর্ণে নামলাম তখন ২.৪০। নেমেই ছুটলাম টিকিট কাউন্টারে।ফেরার টিকিটটা এখনি কেটে নিই। তখন দৌড়ে ট্রেন ধরতে হতে পারে। স্টেশনমাস্টারের ঘরেই কাউন্টার। একদম ফাঁকা। বাইরেও, ভিতরেও। এখানে টিকিট কাটার বিশেষ রেওয়াজ নেই নাকি? খানিক হাঁকডাকের পর , বোধায় স্টেশন মাস্টারমশাইই হবেন, উকি দিয়ে আমায় দেখে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন- 'গাড়ির খবর হলেপরে আসবেন'। আমি তর্কে কাঁচা। কথা না বাড়িয়ে স্টেশন থেকে নেমে সামনের ঝুপড়ির দিকে এগোলাম।কয়েকজন চাষি একটা বট গাছের ছায়ায় বসে জিরচ্ছিল। রাজবাড়ি ডাঙ্গার কথা বলতেই রাস্তা দেখিয়ে দিল।
** ** **
রাজবাড়ি ডাঙ্গা।এমন কিছু আহামরি দর্শনীয় নয়।দুটো ফুটবল খেলার মাঠের আয়তনের সমান একটা উঁচুনিচু জায়গা, নিচু গ্রিলের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ভিতরে এলাকার মেয়েবউরা ছাগল চড়াচ্ছে। আরকিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার একটা টিনের সাইনবোর্ড না থাকলে এটা ওই গরু বা ছাগল চড়ানোর জায়গা বলেই মনে হবে।
সভ্য ভাবে ঢোকার জন্য একটা গেট আছে। ভিতরে ঢুকে একটু খুজলে দেখা যাবে এখানে ওখানে মাটি খুড়ে বার করা পুরোনো ধ্বংসাবশেষ। নেটে দেখেছিলাম এখানে নাকি একটা বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষও আছে। সেটা কোনটা আলদা করে বুঝতে পারলাম না। আমার কাছে সবই মনে হচ্ছিল কোনো প্রাচীন নির্মীয়মাণ বাড়ির ভিত। কেউ যেন সেই সুদূর অতীতে বাড়ি বানাবে বলে ভীত তৈরি করে রেখে কয়েকদিনের জন্য কোথাও গেছে, কদিন পর ফিরে এসে সে তার অসমাপ্ত কাজ আবার শেষ করবে।
আমি ইতিহাসের ছাত্র নই। তাই পুরোনো এই পোড়া ইটের সারি গুলো দেউড়ী না অন্দরমহল, মন্দির না প্রাসাদ কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। শুধু মাঠের মাঝবরাবর একটা গোল স্তূপের মত দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম ওটা নিশ্চয় একসময় কুয়ো ছিল। এদিক ওদিক আর একটু ঘুরে দেখলাম তেমন কিছু আর চোখে পড়ল না।ধুর, শুধু এই দেখার জন্য এতো দূর এলাম? এর থেকে আমাদের কালনার রাজবাড়ি , একশো আট শিবমন্দির ঢের ভালো।তারপর নিজের মাথাতেই একটা গাট্টা মারলাম। ওহে, কালনায় যা দেখো তা খুব বেশি হলে তিনশ বছর আগের জিনিস। আর এগুলো আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর আগের। তখন দ্যাখগে বাংলা ক্যালেন্ডারই চালু হয়নি। মুখের কথা!
চোখের তৃপ্তি হল না বটে মনের খানিকটা হল।বুঝলাম আসলে আমি হয়ত শুধু এই শশাঙ্কের বাস্তুভিটে দেখতে আসিনি , আজকের কর্ণসুবর্ণ (কিম্বা আধীরের মুর্শিদাবাদ) দেখতেও নয়, আজিমগঞ্জের ট্রেনে চাপতেও নয়। আজ আমি এখানে এসেছি স্রেফ আমার খুবচেনা পৃথিবীটা থেকে একটু পালিয়ে আসতে।
এই সব আজেবাজে ভাবতে বসলে আমার আবার খুব খিদে পায়। আর খিদে পেলে আমার সব জারিজুরি শেষ। তখন দিব্যি শান্ত ছেলেটা হয়ে মায়ের আঁচলের তলায় ফিরে আসতে হয়।
** ** **
হন্তদন্ত হয়ে ষ্টেশনে ফিরে এলাম। আবার উকি দিলাম টিকিট কাউন্টারে। উনি এবারও পাত্তা দিলেন না।কিছু বললাম না। গট গট করে একদম সোজা উল্টোদিকের প্লাটফর্মে উঠে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম।পাশে বসা ভদ্রলোককে টিকিটের কথটা বলতেই এক গাল হেসে জানালেন- আসলে এখানে ট্রেন আসার টাইমের কোনো ঠিক ঠিকানা থাকে না। কোনোদিন একঘণ্টা লেট , কোনোদিন তারও বেশি। ট্রেন না পেয়ে অনেকেই ফিরে যায়। তাই যাত্রীদের গালিগালাজের হাত থেকে বাঁচতে উনি ট্রেন আসার খবর শুনিয়ে তবেই টিকিট ইস্যু করেন।
ব্যাপারটা এরপর অবশ্য হারে হারে টের পেলাম। ৩.৫০ এ একটা ডাউন ট্রেন আছে দেখে গিয়েছিলাম।ওটা ধরব বলে তড়িঘড়ি ৩.৪০ এ ষ্টেশনে ঢুকেছি। বসে থাকতে থাকতে ৩.৫০ পেরিয়ে ৪ টে হল। ৪ টে পেরিয়ে ৪.৩০।তারপর ৫ টা। ৫.৩০। কিন্তু ট্রেন কোথায়? এক ঘণ্টা পর পর আপ ট্রেন যদিও বা যাচ্ছে ডাউনের খবর নেই।শেষে ৫.৪৫ নাগাদ খবর হল ডাউন ট্রেন দুই নম্বর প্লাটফর্মে আসছে। গুটি গুটি যে ট্রেনটা ঢুকল সে আমার খুব চেনা- জঙ্গিপুর শেয়ালদা প্যাসেঞ্জার। এর রাইট টাইম এখানে দেখেছিলাম ২.৩৪। ভাবছিলাম কাঁদব, না হাসব? হাসির কারনটাই অবশ্য বেশি। কাটোয়াতে আর ট্রেন বদলাতে হবে না। যদিও অপাদমস্তক দেরি করে বাড়ি ঢুকতে হবে।নাহ, এখনি মাকে একটা ফোন করে দেওয়া দরকার, তাহলে বাড়ি ফিরে ঝাড়টা কিছুটা কম খেতে হতে পারে।
*** *** ***