আমাদের সমাজে কেউ গরীব কিংবা কালো হলে অথবা যে কোন দিক দিয়ে নীচু স্থরের হলে তাকে অহংকার বশতঃ তাচ্ছিলোর চোখে দেখা হয় এবং তাকে নিয়ে ঠাট্রা বিদ্রুপও করা হয়। আর এই ঠাট্রা বিদ্রুপ এর পরিণাম যে অত্যন্ত ভয়াবহ।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তাঞ্চয়ালা বলেন, হে বিশ্ববাসী বান্দাগণ! তোমাদের কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপো উত্তম হতে পারে। এবং কোন নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা সে উপহাসকারিণী অপো উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাকে মন্দ নামে ডাকা গোনাহ্। যারা এহেন কাজ থেকে তওবা না করে তারাই যালেম।
যা হোক, ঠাট্রা বিদ্রুপের করুণ পরিণতি সম্পর্কীয় একটি সত্য ঘটনা নিম্নরূপঃ
সুন্দর-সুশ্রী সুঠাম দেহের অধিকারী ফুটফুটে এক ছেলে। নাম তার ইরফান। পড়াশুনায় মোটামুটি ভাল। তার পিতা ইনকাম ট্যাক্সের একজন উকিল। সেই সুবাদে অভাব কি জিনিস তা কোনদিন সে টের পায়নি। কিন্তু তার একটি মারাত্মক দোষ এই ছিল যে, সে সর্বদা অহংকারবোধ নিয়ে চলাফেরা করতো এবং গরীব ও মধ্যবিত্ত ছাত্রদের নিয়ে অহর্নিশ উপহাস ও ঠাট্রা বিদ্রুব করে বেড়াত।
তার সাথে যোগ দিত আরো কয়েকজন ধনীর দুলাল। তারা সকলেই ছিল ইরফানের মতই অহংকারী। তবে ইরফান ছিল সেই দলের নেতা।
একদিন তাদের স্কুলে রশিদ নামের একটি ছেলে নতুন ছেলে ভর্র্তি হল। তার গায়ের রং ছিল অত্যন্ত কালো। ইরফানের কয়েকজন সাথী ছেলেটিকে দেখে দৌড়ে এসে তাকে বলল, "আমাদের স্কুলে একজন নতুন ছেলে ভর্তি হয়েছে। তাকে দেখে কেউ কেউ বলছে, সে নাকি আফ্রিকার জঙ্গল থেকে পলায়ন করে এসেছে।"
ইরফান তো সর্বদা এ জাতীয় সংবাদের অপোয় থাকে। সুতরাং সংবাদ পেয়ে আর দেরি নেই। সাথে সাথে সাথীদের নিয়ে সে ছুটল ছেলেটিকে দেখার জন্য। ছেলেটিকে দেখেই মনে হল, সে যেন বড় এক শিকার পেয়ে গেল। তাই সে প্রথমেই ছেলেটিকে "মিস্টার নিগ্রো" বলে সম্বোধন করল। (আফ্রিকার কালবর্ণের লোকদের নিগ্রো বলা হয়)।
ইরফানের এই প্রাথমিক সম্বোধনে নবাগত ছাত্র রশীদের হৃদয়কে মারাত্মকভাবে আঘাত করেছে। ব্যথায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল তার হৃদয়-মন। শেষ পর্যন্ত এই ব্যথা তার দু'চোখকে অশ্রু-সজল করে তুললো। টপ টপ করে দু'ফোট অশ্রু ইরফানদের সামনেই গড়িয়ে পড়লো। কিন্তু এতে তাদের মনে একটু দয়া-মায়া সৃষ্টি হয়নি। তারা একের পর এক বিভিন্ন বাক্যবানে রশিদের অন্তরকে চৌচির করতে লাগলো। কিন্তু তারা একটি বারের জন্যও চিন্তা করলো না যে, কালো কিংবা ফর্সা হওয়া মানুষের এখতিয়ার ভূক্ত কোন জিনিস নয়। এটা সম্পূণ আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি যাকে যেমন চান তেমনই বানান।
যা হোক রশিদ এক পর্যায়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, ভাই আমার নামতো রশিদ। আমাকে মিঃ নিগ্রো বলে সম্বোধন করছ কেন? তার কথায় ইরফানসহ উপস্থিত সবাই অট্রহাসিতে ফেটে পড়লো। ইতিমধ্যে তাদের শ্রেণী শিক্ষক আফজাল সাহেব ক্লাশে প্রবেশ করে হাসির কারণ জিজ্ঞাসা করলে ইরফান একথা ওকথা বলে পাশ কাটানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু পাশের একটি ছোট ছেলে বলল, স্যার সে মিথ্যা বলছে। রশিদ ভাই কালো হওয়ার কারণে তাকে নিয়ে ওরা হাসছিল। একথা শুনতেই আফজাল সাহেব বেত নিয়ে ইরফানকে মারার জন্য উদ্যত হলেন। কিন্তু রশিদ সংগে সংগে দাঁড়িয়ে দরদ কন্ঠে বললো, "স্যার! অনুগ্রহ করে ইরফান ভাইকে মা করে দিন।" একথায় স্যারের রাগ থেমে গেল তিনি ইরফানকে মা করে দিলেন।
এ আচরণের পর যেখানে রশিদের প্রতি ইরফানের ভালবাসা ও মমতা বৃদ্ধির কথা ছিল কিন্তু সেখানে শত্রুতা ও বিরোধীতা এসে ভীড় জমাল। কেননা সে যে এক চরম অহংকারী। তার কথা হল যার কারণে স্যার আমাকে মারতে আসলেন তার আর রা নেই। সুতরাং সে রশিদের চরম শত্রুতে পরিণত হল এবং সেদিন থেকে নিয়মিত তাকে "মিঃ নিগ্রো" বলে সম্বোধন করতে লাগলো।
রশিদ সীমাহীন ধৈর্যশীল ছেলে বিধায় ইরফানের এই আচরণে মনে দারুণ কষ্ট পেলেও কোনদিন সে এ ব্যাপারে স্যারের নিকট নালিশ করেনি। ফলে ইরফান দিন দিন আরো বেশী বেপরোয়া হয়ে গেল।
আল্লাহ তা'য়ালা তো বান্দার সব আমলই সর্বদা প্রত্যক্ষ করছেন। তাইতো ইরফানের দেয়া সকল উপহাস ও বিদ্রুপকে রশিদ অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে মেনে নিলেও তিনি হয়তো তা সইতে পারেননি। ফলে ইরফানকে এমন এক মারাত্মক দূর্ঘটনার শিকার হতে হল যার কারণে মৃত্যু পর্যন্ত কোন দিন সে সমাজে মাথা উচুঁ করে হাটতে পারেনি।
সেদিন ছিল রসায়ন বিজ্ঞানের ব্যবহারিক কাসের দিন। ইরফান তার অন্যান্য সাথীদের নিয়ে বিজ্ঞানাগারে প্রবেশ করে রাসায়নিক দ্রব্য ও এসিড নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষ নিরীক্ষা করছিল। এমন সময় হঠাৎ সে টেবিলে উপর রাখা গরম পানির পাত্রের সাথে ধাক্কা খেল। এতে পাত্রটি নিচে পড়ে গেল এবং ফুটন্ত পানি ছিটকে এসে তার চেহারায় পড়লো। সাথে সাথে দু'হাত দিয়ে ইরফান তার চেহারা ঢেকে ফেলল।
ইরফানকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হল। দেখা গেলো, প্রচন্ড গরম পানি ফুটফুটে সুন্দর চেহারাটিকে সীমাহীন কুৎসিত কালো চেহারায় পরিণত করে দিল। ইরফানের আব্বা চেহারার স্বাভাবিক সৌর্ন্দয ফিরিয়ে আনার জন্য বিপুল অর্থ খরচ করলেন। কিন্তু কিছুতেই কাজ হলো না।
একদিন ইরফান তার পিতাকে বললো তাকে স্কুলে ভর্তি করে দিতে। তার কথা মত পিতা তাকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ইরফান এবার কারো সাথে কথা বলে না। এমনকি বিরতির সময়েও কাসের বাইরে যায় না।একদিন কাস শেষে বইপত্র নিয়ে সে কাসরুম থেকে বের হচ্ছিল। হঠাৎ তার কানে ভেসে এল ঞ্ছকে যেন বলছে, ভাই! এমন বিশ্রী চেহারা তো আর কোন দিন দেখিনি। আরেকজন বলছে, "আমি তো এই কুৎসিত চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।" এ কথাণ্ডলো শুনে ইরফানের মনে হল, কে যেন তার হৃদয়ে একের পর এক বর্শার আঘাত করে চলছে।
ইরফান আজ বুঝতে পারলো, কাউকে উপহাস কিংবা বিদ্রুপ করলে হৃদয়ে কি পরিমাণ ব্যথা অনুভূত হয়। সাথে সাথে সে এ-ও বুঝলো যে, আমার এই করুণ পরিণতি নিশ্চয়ই ঐ নবাগত কালো ছাত্রটিকে উপহাস ও ঠাট্রা বিদ্রুপেরই ফল। যাকে দেখে সে মিঃ নিগ্রো বলে সম্বোধন করতো।
উপরোক্ত ঘটনার আলোকে বলা যায় যে, ইরফানের মত এমন অনেকেই আছে যারা তাদের উচিত ঠাট্রা বিদ্রুপ উপহাস এর মত খারাপ দিক ত্যাগ করা নচেৎ তাদের পরিণতি ইরফানের মত হতে পারে অথবা এর চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




