আমাদের দেশে সাবানের উপকরণাদি প্যাকেটের উপর মুদ্রণের সরকারি বাধ্যবাধকতা নেই ফ উন্নত দেশে সাবানে ফসফেটের ব্যবহার নিষিদ্ধ ফ সরকারি আইন প্রণয়ন করে সাবান ও ডিটারজেন্টের প্যাকেটে কতটা সালফেট, ফসফেট ও আর্সেনেট আছে, তা সাবান প্রস্তুতকারী কোম্পানীগুলোকে জানাতে বাধ্য করা উচিত ফ আর্সেনিক দূষণ রোধে আমাদের তরল সাবান ও ডিটারজেন্ট ব্যবহার করতে হবে ফ কলতলায় কাপড় কাঁচা, বাসন মাজা কমাতে হবে ফ খাবার পানির টিউবওয়েলের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ও উন্নত নিষ্কাশণ ব্যবস্থা আর্সেনিকের ঝুঁকি কমায়।
।। সব্যসাচী সরকার ।।
অ্যালকেমিস্ট গ্যেবর (ঐণঠণর) নবম শতকে লাল ইটের মতো দেখতে এক রকম খনিজ দ্রব্য 'রিয়েলগার'কে পোড়ান। রিয়েলগার হল আর্সেনিক সালফাইড। এই দহন প্রক্রিয়ায় স্বাদহীন, সাদা পাউডারের মতো একরকম পদার্থ পাওয়া যায়, যার বিজ্ঞানভিত্তিক নাম আর্সেনিক অক্সাইড। তারপর থেকে বারোশো বছর ধরে লোকের মুখে মুখে এই পদার্থটিই 'আর্সেনিক' বলে অভিহিত হয়ে আসছে। মৌলিক আর্সেনিক ই্র) কিন্তু সম্পূর্ণ পৃথক বসত্দ এবং আজ পর্যনত্দ আর্সেনিকের যত বিষাক্ত ব্যবহার তা এই তথাকথিত 'আর্সেনিক' (অক্সাইড)কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। এই অক্সাইড যৌগটি সহজেই পানিতে গুলে যায়। কার্বন ডাইঅক্সাইড যেমন পানিতে দ্রবীভূত হয়ে কার্বনিক অ্যাসিড (সোডা ওয়াটার) তৈরি করে, ঠিক তেমনই এই অক্সাইডটিও পানিতে দ্রবীভূত হয়ে অ্যাসিড তৈরি করে। কী অ্যাসিড তৈরি হবে তা নির্ভর করে আর্সেনিকের জারণ অবস্থার (মসধঢর্টধমভ র্্রর্টণ) উপর আর্সেনাস অক্সাইড পানিতে গুলে দিয়ে তৈরি করে আর্সেনাস অ্যাসিড, আর্সেনিক অক্সাইড পানিতে দ্রবীভূত হলে তৈরি হয় আর্সেনিক অ্যাসিড। এই দুটিই বিষাক্ত, তবে আর্সেনাসের বিষক্রিয়া খুব সহজেই আরম্ভ হয়। আর্সেনিক অ্যাসিডি মানুষের শরীরে সহজেই আর্সেনাস অ্যাসিডে রূপানত্দরিত হতে পারে। আর্সেনিক বিষয়ক্রিয়াতে রোগীর প্রতিক্রিয়া অনেকটা কলেরা রোগীর মতো-বমি, পায়খানা, পেটে ব্যথা; ক্রমে স্নায়ুতন্ত্র বিকল হয়ে গিয়ে রোগী কোমায় চলে যায় এবং পরে কিডনি, লিভার ইত্যাদি প্রায় সবই অকেজো হয়ে শেষ পর্যনত্দ মৃতু্য নিয়ে আসে। বিগত হাজার বছর ধরে এই আর্সেনিক পানীয় বা খাদ্যসামগ্রীতে বিষ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। মহিলাদের খুব প্রিয় ছিল এই পদার্থটা। ভিক্টোরিয়ান যুগে মহিলারা গায়ের রং ফার্স করার জন্য এটি ব্যবহার করতেন। সেই সময় তাঁরা অবশ্য জানতেন না যে ওই ফর্সা ব্যাপারটির মানে আরসিনোসিস রোগ। সেই সঙ্গে 'ফ্যাশনেবল মার্ডার উইপন' হিসেবেও এর খ্যাতি জুটেছিল প্রচুর। পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে চাইলে সেই যুগে পিসত্দল বা ম্যাকবেথের ছুরি প্রয়োগের চেয়ে নিঃশব্দ আর রক্তপাতবিহীন আর্সেনিকের প্রয়োগ বেশি পছন্দের ছিল। সেই যুগে রাজা, ব্যারনদের ঘরে ঘরে 'ইনহেরিটেন্স পাউডার হিসাবে এই আর্সেনিকের বেশ কদর ছিল। এমনকী 'কাউন্সিল অফ টেন' নামে এক সংস্থা উপযুক্ত পারিশ্রমিকের বিনময়ে অপছন্দের মানুষকে আর্সেনিক প্রয়োগে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার বায়না নিত। ইউরোপে রেনেসাঁস যুগে ব্যক্তিদ্বন্দ্বেও ব্যবহৃত হত এই বিষ। উনিশ শতকের আগে পর্যনত্দ বিষ হিসাবে এর যথেচ্ছ ব্যবহারের পিছনে একটি প্রধান সুবিধা ছিল এই যে, ডাক্তারি শাস্ত্রে এই বিষক্রিয়া ধরার কোনও উপযুক্ত বিধি জানা ছিল না। তাই সম্রাট নেপোলিয়ানের মৃতু্যর কারণ পেটের আলসার হিসাবেই মেডিক্যাল রিপোর্টে লিপিবদ্ধ হয়। 1836 সালে মার্শ নামে এক রসায়নবিদ আর্সেনিকের উপস্থিতি প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় বিধিসম্মত রাসায়নিক পরীৰার ব্যাখ্যা দেন। 1840 সালে আদালতের অনুমতিসাপেৰে কবরস্থিত মৃত ব্যক্তির শরীরে এই পরীৰার প্রয়োগ সাফল্য নিয়ে আসে। এই ঘটনাটি এতই চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে যে স্যার আর্থার কোনান ডয়েলও শার্লক হোমসের 'আর্সেনিক ডিনারের কেস' নামক রহস্য গল্প লিখে আর্সেনিক বিষক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অপরাধের বিজ্ঞানসম্মত তথ্যগুলি জনসাধারণের সামনে তুলে ধরেন। এই সময়ই ফরেনসিক সায়েন্সের গোড়াপত্তন। আজ আমরা জানি যে, সম্রাট নেপোলিয়নের মৃতু্য আর্সেনিক জনিত, কারণ তাঁর চুলে প্রচুর পরিমাণে আর্সেনিক পাওয়া যায়। সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসনকালে যে বাড়িতে তিনি থাকতেন তার দেওয়াল সবুজ রঙে রং করা ছিল এবং প্রকৃতপৰে এই সবুজ রঙের বস্তুটি ছিল কপার আর্সেনেট সমুদ্রের ভিজে বাতাসে এই দেওয়ালে ছত্রাকের আবির্ভাব হয়। এই ছত্রাক জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়ায় আর্সেনিকের অ্যালকিল ঘটিত যৌগ তৈরি করে। পদার্থটি বায়বীয়,কাজেই সহজেই নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। সম্রাট নেপোলিয়নের ৰেত্রেও তাই ঘটেছিল। 1851 সালে ব্রিটেনের সরকার 'আর্সেনিক অ্যাক্ট' প্রণয়নের মাধ্যমে এই আর্সেনিক অক্সাইডের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন যাতে ইঁদুর আর পোকামাকড় মারা এবং কিছু ওষুধের মধ্যে এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ থাকে। আর্সেনিক বহুদিন ধরেই কীটনাশক, আগাছানাশক, ছত্রাকনাশক, কাষ্ঠ সংরৰক, সিরামিক্সের এনামেল এবং রং হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। আবার পেনিসিলিন আবিস্কারের আগে সিফিলিস জাতীয় রোগের চিকিৎসাতেও এটি ব্যবহৃত হত। আজকের উন্নত প্রযুক্তির যুগে উজ্জ্বল আলো যুক্ত মোবাইল ফোন ও অন্যান্য সেমিকন্ডাক্টর যুক্ত ইলেকট্রিক জিনিসপত্র প্রস্তুতিতে গ্যালিয়াম আর্সেনাইড একটি পরিচিত নাম। ব্যবহৃত হওয়ার পর বর্জিত এই আর্সেনিক যুক্ত বস্তুগুলির যথেষ্ট অসুবিধা সৃষ্টি করার কথা। বড় বড় শহরের বাতাসে তাই এই জাতীয় দূষণ অত্যনত্দ স্বাভাবিক। অনেকে হিমালয়, গঙ্গা, ব্রহ্মণপুত্র বা গঙ্গার বদ্বীপকে এই আর্সেনিকের উৎস বলে দাবি করেন। এতে একটা প্রশ্ন থেকে যায়-আর্সেনিক কি অন্য জায়গায় নেই? ভূগর্ভে আর্সেনিক তার সালফাইড যৌগ হিসাবে সুপ্ত অবস্থায় থাকে বলা যায়, কারণ এই ধরনের আকরিকগুলি সাধারণত পানিতে দ্রবীভূত হয় না। আবার পৃথিবীতে প্রতি 1 কিলোগ্রাম মাটির মধ্যে 2-5 মিলিগ্রাম আর্সেনিক সাধারণত থেকেই থাকে। তাই স্বভাবতই কিছু প্রশ্ন মনে আসে। প্রথমত, যদি হিমালয় ও গঙ্গা ব্রহ্মপুত্রকে এর উৎস বলে দাবি করা হয় তবে হিমালয়, যমুনা ও পঞ্চনদ থেকে এটি বেরিয়ে আসে না কেন? দ্বিতীয়ত, যদি রাসায়নিক ও কীটনাশকের বহুল ব্যবহারের ফলে কৃষিকার্যে ও প্রচুর পরিমাণে সেচের পানি নিষ্কাশনে এই দুরবস্থা ঘটে থাকে, তবে সেটি উত্তরপূর্ব ভারতের এক কোণেই সীমাবদ্ধ কেন? আবার হিমালয়, গঙ্গা ও যমুনার স্থিতি বহুকাল আগে থেকে, তবে হঠাৎই গত 30-35 বছর ধরে এর উৎপাত শরম্ন হল কেন? এই সমসত্দ প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতে গেলে সাধারণ জ্ঞান ছাড়াও বিষয়ের একটু গভীরে যাওয়া প্রয়োজন। আর্সেনিক যখন মাটির উপরের দিকের সত্দরে থাকে তখন অক্সিজেনের প্রভাবে তা আর্সেনিক অক্সাইড হয়েই থাকে। মাটিতে লোহার পরিমাণ যথেষ্ট বেশি। অক্সিজেনের প্রভাবে আদর্্র পরিবেশে লোহায় মরিচা পড়ে, যা রাসায়নিক ভাষায় ফেরিক অক্সাইড। ফেরিক অক্সাইড এই বিষাক্ত আর্সেনিক অক্সাইডের সাথে মিশে এক ধরনের জোড়-লবণ তৈরি করে, যাকে সাধারণত আর্সেনিক ফেরিঅক্সাইড-হাইড্রক্সাইড বলা হয়। এই জোড়-লবণ থেকে আর্সেনিককে পানিতে দ্রবীভূত করা অত্যনত্দ দুরূহ কাজ। এ যেন লোহার মরিচার থলিতে বন্দি এক দৈত্য। এভাবেই প্রকৃতি তার নিজস্ব প্রযুক্তির সাহায্যে আর্সেনিকের প্রভাব থেকে আমাদের বাঁচতে সাহায্য করে এসেছে। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা তার দান হিসেবে নতুন প্রযুক্তির অমৃত গ্রহণ করলাম কিন্তু তারই ফলে যে বিষের উৎপত্তি তার জন্য কোনও নীলকণ্ঠের ব্যবস্থা করলাম না। বরং প্রকৃতির থলের বাঁধন থেকে দৈত্যকে দিলাম মুক্তি। গাঙ্গেয় অববাহিকায় পানীয় জলের সমস্যা বহুদিনের। বছরের মধ্যে মাটিতে থাকা প্রায় সব পানিই কলেরা, আন্ত্রিক জাতীয় রোগের মূল। এর থেকে মুক্তি পেতে বসানো হল টিউবওয়েল। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যাপক হারে সাবান ও ডিটারজেন্ট পাউডারের প্রচলন শুরম্ন হয়ে গেল। 1970 দশক পর্যনত্দ গায়ে মাখা সাবানের প্রচলন কমই ছিল এবং কাপড় কাচার উপকরণ হিসাবে সোডা বহল পরিমাণে ব্যবহৃত হত। সাধারণত খাওয়ার পানির জন্য নির্দিষ্ট কুয়ো বা পুকুর চিহ্নিত ছিল যেখানে কাপড় কাচা বা স্নান জাতীয় কাজ নিষিদ্ধ ছিল। সেই সময় দুটি ঘটনা ঘটতে শুরম্ন করল। হাতের কাছে টিউবওয়েল এসে গেল এবং বাজার সাবান ও ডিটারজেন্ট পাউডারে ভরে গেল। সভ্যতা এল, আমরা জীবাণু রহিত পরিস্কার জল খেলাম, তাতে ভালভাবে স্নান করলাম, ভাল ডিটারজেন্ট যুক্ত সাবান দিয়ে কাপড় কেচে পরতে অভ্যসত্দ হলাম। আমাদের কেউ বোঝাল না যে, শুধু পানীয় জলের জন্যই এই টিউবওয়েল। তাই অবারিতভাবে টিউবওয়েলে স্নান, কাপড় কাচা, বাসনপত্র ধোওয়া শুরম্ন হয়ে গেল। অধিকাংশ ৰেত্রেই এই টিউবওয়েলগুলি সরকারি হওয়ায় সকলেই সমভাবে ব্যবহারের অধিকার পেল। যে পরিমাণ পানি এই কাজে প্রতিদিন ব্যবহৃত হল তা নিকাশের জন্য উপযুক্ত পাকা নালার ব্যবস্থা হল না। এবং এটাই হয়ে গেল একটা খুব বড় ভুল। সাধারণত সাবান ও ডিটারজেন্টগুলি 10-18টা কার্বন পরমাণুযুক্ত হাইড্রোকার্বনের কার্বক্সিলেট বা সালফেটের সোডিয়াম লবণ। আবার এই রাসায়নিকগুলিকে ভালভাবে সাবানের আকার দিতে তাতে কিছু পরিমাণ ফসফেট ও সালফেট মেশাতে হয়। খর জলের খরত্ব দূর করতে কিছু পলিফসফেটও ব্যবহার হয়। প্রচুর পরিমাণে সাবান/ডিটারজেন্ট ব্যবহার শুরম্ন হতেই এই 10-18 কার্বন যুক্ত হাইড্রোকার্বনের কার্বক্সিলেট বা সালফেটের সোডিয়াম লবণগুলি তা থেকে মুক্ত হয়ে কাঁচা নর্দমাতে জমতে শুরম্ন করল। এতে ফসফেট ও সালফেটও মিশে রইল। এই ফসফেট শৈবাল জাতীয় উদ্ভিদের খাদ্য। পানিও এর মাত্রা বাড়তেই মৈবাল দ্রম্নত বাড়তে থাকে এবং তার ফলে জমা পানির উপরে সবুজ শৈবালের একটা আসত্দরণ তৈরি হয়। এই আসত্দরণ বাতাসের অক্সিজেনকে জমা পানিতে মিশতে বাধা দেয়। নর্দমার জমা পানি অক্সিজেন শূন্য হয়ে এলে সালফেট রিডিউসিং ব্যাকটেরিয়া নামের একদল জীবাণু মহাভোজের নিয়ন্ত্রণ রৰা করতে মাটি ফুঁড়ে চলে আসে। এদের লোভনীয় খাদ্য হল ওই 10-18 কার্বন যুক্ত লবণগুলি। অক্সিজেনে নিশ্বাস নিতে পারে না বলে এরা সালফেটের অ্যানেয়ারোবিক শ্বাস প্রক্রিয়া ব্যবহার করে এবং এই প্রক্রিয়ায় সালফেট পরিণত হয় সালফাইডে। প্রচুর সালফেট থাকায় এরা বহাল তবিয়তে সেখানে ঘরসংসার করে। সূর্য উঠলে উপরের আসত্দরণের শৈবাল কিছু অক্সিজেন উৎপন্ন করে। তবে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে তারা আবার কার্বন ডাইঅক্সাইডের আসত্দরণে জায়গাটি ঢেকে দেয়। ফলে দিনে সূর্যালোকের জন্য ওই জীবাণুগুলি কাদার মধ্যে লুকিয়ে থাকে, আর সন্ধ্যা থেকে পুনরায় সূর্য ওঠা পর্যনত্দ নিজেদের বংশবৃদ্ধি করে চলে। তাই লৰ করলে দেখা যাবে যে, সন্ধ্যা বা রাত্রিতে এইসব বদ্ধ নর্দমা থেকে পচা ডিমের গন্ধ যুক্ত হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস বের হয়। এমনকী এইসব নর্দমার মাটিগুলিও কালো হয়ে যায়। কারণ, বাদামি রঙের ফেরিক অক্সাইড যুক্ত মাটি এই হাইড্রোজেন সালফাইডের উপস্থিতিতে বিজারিত হয়ে ফেরাস সালফাইডে পরিণত হয়, যার রং কালো। ফেরিক অক্সাইড ফেরাস হওয়া মাত্র বন্দি হয়ে থাকা আর্সেনিককে ছেড়ে দেয়, যা এখন সহজেই পানিতে দ্রবীভূত হতে পারে। অতিরিক্ত সালফাইডের উপস্থিতিতে এই আর্সেনিক অক্সাইড আর্সেনিক সালফাইডে পরিনত হতে পারে, কিন্তু সেটিও হাইড্রোলিসিস প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে পানিতে মিশে যায়। বদ্ধ কাঁচা নর্দমায় আর্সেনিকের আধিক্য সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এই আর্সেনিক সহজেই চুঁইয়ে চুঁইয়ে মাটির নীচে গিয়ে কলের পানিতে মিশে যায়। আবার টিউবওয়েলের নীচে যে জলভান্ডার আছে তাতে যদি মিশে যেতে পারে তাহলে পুরো জলভান্ডারই কলুষিত হওয়া সম্ভব। এই ঘটনা একদিনে ঘটা সম্ভব নয়, তাই 15-20 বছর পর পুরোমাত্রায় এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কাজেই আমি যদি আমার ব্যবহারের টিউবওয়েল ও তার নিষ্কাশন ব্যবস্থা খুব ভাল রাখি, তবুও আমাকে কিছুদিনের মধেই আর্সেনিক যুক্ত পানিই পান করতে হবে। কারণ অন্যান্য জায়গার টিউবওয়েলগুলির মাধ্যমে মাটির তলার জলভান্ডারে রোজই আর্সেনিক মিশে যাচ্ছে। এরকম কাঁচা নিষ্কাশন ব্যবস্থাযুক্ত কত টিউবওয়েল তার সঙ্গে যুক্ত এবং কত বছর ধরে সেগুলি ব্যবহৃত হচ্ছে, তা দিয়েই এই আর্সেনিক মিশে যাওয়ার একটা পরিসংখ্যান পাওয়া যেতে পারে। ভারতের যেসব প্রদেশে পানীয় জলে আর্সেনিকের উৎপাত নেই, সেখানে একটা জিনিস লৰ করা যায় এবং তা হল উন্নত নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং পানীয় জলের জন্য টিউবওয়েলের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার। আর একটি বড় সুবিধা হল এখানে সূর্যের প্রখর তাপে বছরের বেশির ভাগ সময়েই জলের নিকাশি নালাগুলি প্রায় শুকিয়েই থাকে। জলশূন্য স্থানে সালফেট রিডিউসিং ব্যাকটেরিয়াগুলি অন্যান্য জীবাণুর মতোই বাঁচতে পারে না। কিছু দিন বেঁচে যদিও বা কিছু আর্সেনিক মুক্ত করে, তা বিনা জলে মাটির বুকে আটকেই থেকে যায় এবং হাওয়া ও মরিচার সংস্পর্শে এসে ধীরে ধীরে আবার বন্দি হয়ে যায়। এ পর্যসত্দ যা বলা হল তা বদ্ধ আর্সেনিকের জলে মুক্তি পাবার কাহিনী। এছাড়াও অন্য উৎস থেকে আর্সেনিক জলে আসে এবং তা হল আমাদের নিত্য ব্যবহার্য সাবান ও ডিটারজেন্ট আউডার। সাম্প্রতিক এক গবেষণা নিবন্ধে দেখানো হয়েছে যে, বহুল প্রচলিত 26টি সাবান ও ডিটারজেন্টে বেশ ভাল পরিমাণ (গড়ে প্রতি কিলোগ্রামে 4 মিলিগ্রাম) আর্সেনিক জলে মিশছে। 2003 সালের সাবান ও ডিটারজেন্ট উৎপাদনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, 60 হাজার টন সাবানও ডিটারজেন্টের মাধ্যমে 4 মিলিগ্রাম প্রতি কিলোগ্রাম হিসাবে প্রায় 250 কিলোগ্রাম আর্সেনিক শুধু 2003 সালের সাবান ও ডিটারজেন্টের জন্য পানিতে যুক্ত হয়েছে। 10 বছরে এই পরিমাণটা কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। আগে সাবানের ব্যবহার কম ছিল, কিন্তু মোট পরিমাণটা ভীতিপ্রদ। সাবানে বাইন্ডার হিসাবে যে সালফেট ও ফসফেট ব্যবহার করা হয় তাতেই এই আর্সেনিক (আর্সেনেট যৌগ রূপে) অপদ্রব্য হিসাবে থেকে যায়। আমাদের দেশে সাবানের উপকরণাদি প্যাকেটের উপরে মুদ্রিত রাখার কোনও সরকারি বাধ্যবাধকতা নেই। সাবানে ফসফেটের ব্যবহার পৃথিবীর অনেক দেশে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যাতে শৈবালের অত্যধিক বাড়বাড়নত্দের ফলে লেকের পানির উপরিভাগ ঢাকা পড়ে জলবাসী প্রাণীর প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অভাব না ঘটায়। ইউরোপ ও আমেরিকায় চালু সাবানে আর্সেনিক প্রায় নেই বললেই চলে। সাবান ও ডিটারজেন্ট থেকে আর্সেনিক দূষণ রোধ করতে গেলে আমাদের তরল সাবান ও ডিটারজেন্ট ব্যবহার করা উচিত। তরল অবস্থার জন্য এগুলিতে বাইন্ডারের ব্যবহার নেই, তাই বাইন্ডারযুক্ত অপদ্রব্য থেকে আর্সেনিকের মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। তাছাড়া সালফেট ও ফসফেটের কম ব্যবহারে অবাত শ্বসন ও শৈবালের বৃদ্ধি থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়। এর সঙ্গে কলতলাতে কাপড় কাচা, গোসল করা, বাসন মাজা কমাতে হবে এবং বিশেষ করে দেখতে হবে, এই সাবান যুক্ত ব্যবহৃত জল যেন কাঁচা নিষ্কাশন নালায় জমে না থাকে। মনে রাখা দরকার, মাটির তলার জলাধারে যদি দু-একটি টিউবওয়েল থেকেও এইভাবে আর্সেনিক পেঁৗছায় তবে ক্রমে বাকিগুলিতেও তা পেঁৗছে যেতে বাধ্য। সরকারি আইন প্রণয়ন করে সাবান ও ডিটারজেন্টের প্যাকেটে কতটা সালফেট, ফসফেট এবং আর্সেনেট আছে তা সাবান ও ডিটারজেন্ট কোম্পানিগুলিকে জানাতে বাধ্য করা উচিত। যে জলভাণ্ডার আমরা বিষিয়ে দিয়েছি তা বিষহীন হতে বহু সময় লেগে যাবে, তবে আর নতুন করে যেন আমরা জলে আর্সেনিক বৃদ্ধিতে সাহায্য না করি। আমাদের শরীরে বেশ কিছু এনজাইমের মধ্যে আছে একাধিক সালফাহাইড্রিল গ্রম্নপ একটি সালফার পরমাণু ও একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর জোট। এনজাইমগুলিকে স্বাভাবিক কার্যক্রম রাখতে এই গ্রম্নপগুলি অত্যনত্দ প্রয়োজনীয়। আর্সেনাস অ্যাসিড এগুলির সঙ্গে বিক্রিয়া করে আর্সেনিক সালফার বন্ধন তৈরি করে এই এনজাইমগুলির কার্যৰমতা নষ্ট করে দেয়। দ্বিতীয়ত, আমাদের শরীরে একানত্দ অপরিহার্য একটি বিক্রিয়া -পরস্পরা ঘটে, যার নাম অক্সিডেটিভ ফসফোরাইলেশন। এই পুরস্পরার এক স্থলে 'এটিপি' তৈরির সময় ফসফেটের জায়গাটি আর্সেনেট এসে দখল করে এবং এই অতি প্রয়োজনীয় জৈবরাসায়নিক ক্রিয়াটিকে ব্যাহত করে। শরীরে আর্সেনিক প্রবেশ করলে সালফাহাইড্রিল গ্রম্নপগুলির সঙ্গে এর বিক্রিয়াকে বন্ধ করার জন্য পেনিসিলঅ্যামিনও অন্যান্য 'চিলেটিং এজেন্ট' (যা দুষ্কৃতী আর্সেনিকটিকে নানা দিক থেকে ঘিরে বন্দি করে রাখে, যাতে তা বিক্রিয়ায় লিপ্ত হতে না পারে) ব্যবহার করা যায়। তবে এই ধরনের নতুন ও আরও উপযোগী 'চিলেটিং এজেন্ট'-এর খোঁজে গবেষণা কোথাও হচ্ছে বলে এখনও জানা নেই। পরিশেষে বলা প্রয়োজন যে, আর্সেনিকের সবটুকুই খারাপ নয়। সম্প্রতি এক বিশেষ ধরনের বস্নাড ক্যান্সারের সর্বোত্তম ওষুধ হিসাবে আর্সেনিক অক্সাইড ব্যবহৃত হচ্ছে। নির্ধারক জিনিসটি হল পরিমাণ। বহু রাসায়নিক পদার্থই অল্প মাত্রায় জীবনদায়ী, কিন্তু বেশি মাত্রায় বিষ। পশ্চিমবঙ্গে, বাংলাদেশে এবং এইসব জলীয় আবহাওয়া যুক্ত অঞ্চলে আর্সেনিক দায়ী নয়, দায়ী আমাদের নির্বোধ ভাব। ইউনেস্কো বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাহেবরা জানেন না, বা বোঝেন না যে, কীভাবে আমরা এই টিউবওয়েল ব্যবহার করি কারণ তাদের দেশে উন্নত নিষ্কাশন ব্যবস্থার জন্য ব্যবহৃত পানির ছিটেফোঁটাও কেউ দেখতে পায় না। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার দাম অনেক, এবং পারিপাশ্বর্িক অপরিচ্ছন্ন রেখে বিষের জন্য জীবন দেওয়া নেহাতই বোকামি। (কলকাতার পাৰিক দেশ পত্রিকার সৌজন্যে)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০০৬ ভোর ৫:১৪