somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এইতো জীবন

২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুর। এইমাত্র মোল্লা বাড়ির জামে মসজীদে জোহরের নামাজের আযান হয়েছে। বাবা এসেছেন ভাত খেতে। কিন্তু মা'র রান্না এখনো শেষ হয়নি। অন্তত আরো আধা ঘন্টা দেরি হবে। কিন্তু বাবার তা সইবে না। তিনি রেগে গেলেন। রাগের চোটে চিল্লাতে লাগলেন, 'অহানো ভাত হইনাই, তয় বাইত বইয়া করো কি জিগাই? ঘোরার গাস কাডো নাহি? আমার আর ভাত খাওন নাগবো না, তোরাই জম্মের মতন খা গিয়া। আর কোনোদিন আমার সামনে ভাত আনোসতো তোর মরা বাহের মাথা খাস।'
মা একটি কথাও বললেন না। অন্তত এটুকুও না যে, বেলাতো এখন একটার বেশি বাজে না। দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় তো এখনো শেষ হয়ে যায়নি। অথচ মা'র মনে হলো বাবা যা বলেছেন তাই ঠিক। তিনি মুখ দিয়ে যা বলবেন, যা উচ্চারণ করবেন তাই যেন ঠিক। মা কোনো কথা না বলে তরকারি রাধতে লাগলেন। বাবা দাত কটমট করতে করতে আর বিশ্রী ভাষায় গালাগাল দিতে দিতে চলে গেলেন। ইতি,বিথি এবং আমি ঘরের ভেতর বসে আছি। বাবার ভয়ে অস্থির। দশ কী পনের মিনিট পরে মা আমায় ডাকলেন। কাছে গেলাম। মা টিফিন বাটিতে ভাত বাড়ছেন। 'যা তোর বাপেরে ভাত দিয়া আয়।'
একবার ইচ্ছা হলো বলি আমি পারবো না। বাবার কাছে যেতে ইচ্ছা করছে না। তার কাছে এখন গেলে যে কী হবে তা আমার জানা। কিন্তু মা'র চোখের দিকে তাকিয়ে আর না করতে পারলাম না। টিফিন বাটিটি নিয়ে রওনা হলাম। বাবার কাছে গেলে কী হবে সে দৃশ্য কল্পনা করতে করতে এগুচ্ছি। দৃশ্যটি কল্পনা করে আমার চোখে জল চলে এলো। জল ভরা চোখ দুটোকে জামার হাতায় মুছলাম। অত্যন্ত দূর্বল চিত্তের মানুষ আমি। কেউ সামান্য কটু কথা বলেছে, অমনি আমার চোখে জল চলে এসেছে, এমন অবস্থা। এই যে এখন আমাকে কেউ কিছু বলে নাই অথচ আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কেন পড়ছে? জানিনা!

রহমালি মোল্লার টি স্টলে বসেছিলেন বাবা। আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম তার কাছে। আমার গলার স্বর বোধ হয় গলার ভেতরেই রয়ে গেলো, এমন গলায় বললাম, 'বাবা ভাত আনছি।'
'ভাত নিয়া যা, আমি খাইছি।'
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। বাবা আবার বললেন, 'কইছি না নিয়া যা, আমি খাইছি। তোর মায়রে যাইয়া খাইতে কগা। খাইয়া শরিলে বাতাস নাগাইয়া ঘুরতে কগা।'
বাবার কথায় বিদ্রুপের গন্ধ। আমি প্রাণপণে বলতে চাইলাম বাবা আপনি মা'কে ক্ষমা করে দিন। মা আর কোনদিন আপনার ভাত দিতে দেরি করবে না। মাকে ক্ষমা করেন। আপনি এখন ভাত খান। কিন্তু আমি কিছু বলতে পারলাম না। আমার কণ্ঠনালী দিয়ে সহসা কোন কথাই বেরুলো না। আমি শুধু প্রাণপণে বাধ ভাঙা প্লাবনের মত অশ্রুরাশি গোপন করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলাম।
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে হুংকার ছুড়লেন। 'অহানো খারাইয়া রইছোস শুয়োরের বাচ্চা, তোরে যাইতে কইছি না এইহানতোনে। এট্টা নাত্তি দিয়া ফুটবলের মতন উরাইয়া হালামু।'
পষুর গর্জন আর রক্তাভ চোখের দিকে তাকিয়ে বাবার সামনে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব হলো না। জামার হাতায় চোখ মুছতে মুছতে হাটা ধরলাম।
আমি অনেক চেষ্টা করেছি আমার চোখের জলের গোপনীয়তা রক্ষা করতে। মা বলেছেন, আমার কাকাও বলেছেন, আমার চোখের জলকে উদ্দেশ্য করে—'পুরুষ মানুষের কখনো কাঁদতে নেই। পুরুষ মানুষের চোখে জল শোভা পায় না।' আমি কথাটিকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছি। কিন্তু আমার আমি, আমার অন্তর, আমার চোখ যে, কথাটা কখনো মেনে চলতে পারে না। কেউ আমার সাথে চুল পরিমান রূঢ় ব্যবহার করলে অমনি আমার চোখে জল চলে আসে। এই যেমন এখন আমার চোখে জল চলে এসেছে। প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলাম আমার চোখের জল ঠেকাতে। শেষবারের মত জামার হাতায় চোখ মুছে মনেমনে ঠিক করলাম, মায়ের সামনে এমন দূর্বল মুখ নিয়ে যাবো না। মা'র কাছে যাবো এমন একটি কঠিন মুখ নিয়ে যে মুখে ভয়ের কোন চিহ্ন থাকবে না, যে মুখে কান্না থাকবে না। যে মুখে থাকবে অত্যাচারি বাবার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার মত কঠিনতা। আজ এখানে মা'র তো কোন দোষ ছিলো না। তাহলে বাবা কেন শুধু শুধু মা'র সাথে এমন করবেন? রাগ করবেন? ভাত খাবেন না? এসবের অর্থ কি? মনেমনে ঠিক করি মা'কে প্রতিবাদি হতে শেখাবো। অত্যাচারির অত্যাচার মেনে নিলে সে আরো প্রশ্রয় পায়।

মা'র সামনে ভাতের বাটিটি টুপ করে রেখে দিলাম। বললাম, 'ভাত রাহে নাই। আমি আগেই জানতাম এমুন করবো হেইরনিজ্ঞাই যাইতে চাই নাই।'
'কি কইলো তুই কইয়া খাওয়াইতে পারলি না।'
আমি বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বললাম, 'না পারমু না তোমাগো এত্ত কাহিনী আমার ভাল্লাগে না। খাইলে খাইক না খাইলে না খাইক। আমার কিচ্ছু যায় আহেনা। আমার খিদা নাগছে আমারে ভাত দেও।'
মা আমার গালটা আচ্ছা মত টিপে দিলেন। 'জন্নার খালি নিজের উদরের কতাই জানো। ভাত যে কোতায়তোন আইবো হেইডা জানো।? হেই কথাকি একবারো মনে কইরা দ্যাহো? যা বাইরা বাইত্তেতোন আইজকা এট্টারো ভাত নাই। মানুষটা কত কষ্ট কইরা হারাদিন কাম করে, রাগতো একটু করতেই পারে।'
মা'কে দেখে মা'র ব্যবহার দেখে আমার বিষ্ময়ের সীমা নাই। আমার মা'র মত পতিভক্ত নারী আমি দ্বিতীয়টি চোখে দেখিনি।
আমার গাল থেকে মা'র হাতটা ঝামটা মেরে সরিয়ে দিলাম। 'আমারে মারো ক্যা? আমারে মারো ক্যা? আমার কি দোষ?'
'আরে না, না তোগো দোষ হইবো ক্যা? তুই আর তোর বাজি মিল্লাতো খালি আমার দোষ পাইছোস। ক্যা যে আল্লায় আমারে অহানো মউয়ত দেয় না?'
মা হুহু করে কাঁদতে লাগলেন। এমন কান্না যে, একেবারে বুকের ভেতরে গিয়ে আঘাত হানে। অসহ্য লাগছে। আমি আর কোন কথা না বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম। ইদানিং আমার কী জানি একটা হয়েছে। সব কিছুতেই কেমন একটা অস্বস্তি ভাব চলে এসেছে। কোন কি ছুই সহ্য হতে চায় না এমন।

খুব ছোটবেলা হতেই আমি নিঃসঙ্গ ধরণের মানুষ। আমার সুখ, দুখ যা কিছু আছে তা শুধু আমাতেই সীমাবদ্ধ। আমি কাউকে বলতে পারি না আমার মনের কথা। সারাটিক্ষণ আমি তীব্র এক মানসিক কষ্টে ভুগি। বুঝ হবার পর থেকে বাবার কাছ থেকে একটা জিনিশ পেয়ে আসছি তাহলো- শাসন, শাসন আর শাসন। শাসনের বাইরে আরো যে কিছু আছে বাবা সেটা জানেন না। আর আমার এমন স্বভাব, আমি কারো সঙ্গে রাগ করতে পারি না। আর কেউ আমার সাথে রাগ করলে, সে যদি প্রথমে এসে আমাকে আদরের স্বরে একটা ডাক না দেয়, তাহলে আমি তার সঙ্গে মিশতে পারি না। আর বাবা কখনো সে কাজ করেন না। কাজেই বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভদ্রতার।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বড় রাস্তা পার হয়ে মাঠের মধ্যে নেমে পড়েছি। জৈষ্ঠের মাঝামাঝি সময়। সূর্য খাড়াখাড়ি ভাবে কিরণ দিচ্ছে। প্রচণ্ড তাপদাহে জ্বলছে পৃথিবী। আমাদের এ অঞ্চলে প্রচুর পাটের চাষ হয়। এইতো সেদিন দেখলাম চাষীদের পাটের বীজ বপন করতে। দেখতে, দেখতে ক'দিনেই একমাজা পরিমান হয়েছে। মাঠের পর মাঠ শুধু সবুজ আর সবুজ। বাতাসে পাটের কচি মাথাগুলো দুলেদলে উঠে। সেই মাঠের মধ্যে দিয়ে চলছি আমি। বড় রাস্তা থেকে প্রায় দুই কিলো মিটার উত্তরে বিশার পুকুর নামে একটা স্থান আছে। একই স্থানে সারধরা বড় বড় চারটা পুকুর। এত বড় যে এর একেকটা পুকুরের অর্ধেক সমানও কোন পুকুর আমাদের গ্রামে নাই। বর্ষাকালে পাড়গুলো যায়। শুকনো মওসুমে আটকা পড়ে পানি। পানির সাথে মাছও। প্রচুর মাছ পাওয়া যায় শুকনোর দিনে। আশে পাশের গ্রাম থেকে ঝাক ধরে আসে মানুষ। ষোল, শিং, গজার মাছে পাতিল বোঝাই করে নিয়ে যায়। এই পুকুর নিয়ে একটা জনশ্রুতি আছে, অনেক অনেক দিন আগের কথা---"তখন এখানে আশেপাশে দশ—বিশ কিলোমিটারের মধ্যে কোন কোন মানুষের বসতি ছিলো না। তখন বিশু নামের এক চোর নাকি এখানে বসবাস করতো। রাতের বেলা চুরি করে দিনে এসে এখানে লুকিয়ে থাকতো। কিভাবে যেন মানুষজন জেনে গেলো বিষু চোর রাতে চুরি করে দিনে এসে এখানে লুকিয়ে থাকে। একদিন গ্রামবাসীরা লাঠিসোঠা সহকারে বিশুকে আক্রমন করতে এলো। সমূহ বিপদের সম্ভাবনা দেখে বিষু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পায়ের গোড়ালি দিয়ে চার যাগায় চারটা গুতো মারে। আর অমনি অলৌকিক ভাবে তৈরী হয়ে যায়। ইয়া বড় বড় চারটি পুকুর। তার একটাতে লাফিয়ে পড়ে বিষু। আক্রমণ করতে আসা লোকজন তাকে আর খুঁজে পেলো না।"
এসব গাঁজাখুরি গল্পের অবশ্য কোন ভিত্তি নেই। কিন্তু এ যায়গাটা আমাকে বড় টানে। এ যাগাটা পাশ দিয়ে আমাদের প্রাইমারি স্কুলে যাবার পথ। এ যাগাটা আমি প্রথম আবিষ্কার করি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময়। আমার যখন খুব মন খারাপ হয় তখন এখানে এসে বসে থাকি। নিরব, নিথরে পড়ে থাকা টলমল করা পুকুরের জল, শত বছরের পুরনো রেইন্ট্রি কড়ুই গাছ, সেই গাছে শালিক, দোয়েল, ঘুঘু, ময়না, টুনটুনি পাখির গান আমাকে মোহিত করে। এমনও মাঝেমাঝে হয়েছে, সকালবেলা আমি এখানে এসেছি, আর মাগরিবে আযান পড়ে গেছে আর আমি রওনা দিয়েছি বাড়ি পথে। এখান থেকে ফিরে যাবার পরে বেশ ফুরফুরে এক ভালোলাগা অনুভব করি আমি।

আজকের এই তপ্ত দুপুরে, পুকুরের টলমলে পানির দিকে তাকিয়ে আছি আমি। টুস করে একটি ঢিল ছুড়ে দিলাম। সারা পুকুরের পানিতে ঢেউ খেলে গেলো। আমার কেবলি মা'কে মনে হতে লাগলো—
*
হেরিকেনের মৃদু আলোয় আমাদের ছোট্ট কূটীরের মেঝেতে মায়ের সামনে আদর্শলিপি বই নিয়ে পড়তে বসি। মা আমায় আপ্রাণ চেষ্টা করছেন পড়াতে। আমার ভাল্লাগে না, এদিক তাকাই, ওদিক তাকাই, অকারণে পিঠ চুলকাই। এই যখন অবস্থা, ঠিক তখন অবাক হয়ে লক্ষ্য করি—উপর থেকে আমার সামনে, বইয়ের উপর, টুপ করে একটি বিস্কুট পড়ে। উপর দিকে, চারপাশে তাকিয়ে বিস্কুট কোথা থেকে এলো অনুমান করতে পারি না। উৎসুক হয়ে মা'কে জিজ্ঞাসা করি, 'মা বিস্কুট দিলো কেডা?'
'আল্লায় দিছে বাজান, আল্লায় দিছে। তুমি পড়তেছো দেইখ্যা খুশি অইয়া আল্লায় তোমারে বিস্কুট দিছে। আরো বেশি পড়লে, আরো বেশি বিস্কুট দিবো।'
'হাচাইনি মা?'
'হ, হাচা আমার লক্ষি বাজান। পরো, কয় আকারে কা। খয় আকারে খা।'
আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেতাম। আরো বেশি বিস্কুট পাওয়ার লোভে গলার ভলিউম বাড়িয়ে দিয়ে পড়তাম, 'কা, খা...'

আমার মা অত্যন্ত দুঃভাগ্য নিয়ে এ পৃথিবীতে এসেছেন। মা'র জন্মের আগেই নানার মৃত্যু হয়েছিলো। এজন্য মা তার বাবার আদর সোহাগ বঞ্চিত একজন মানুষ। তার আর কোন ভাই, বোন ও ছিলো না। আমার নানা এবং নানি আমার কাছে কল্পিত চরিত্র ছাড়া কিছুনা। তাদের নিয়ে আমার কোনো স্মৃতি নেই। নানি যখন মারা গেলেন তখন আমার বয়স কত হবে? বয়স ঠিক মনে নেই। তবে আবছা আবছা মনে আছে। তার চেহারা স্পষ্ট মনে করতে পারছি না। তবে আমার প্রতি তার যে অন্তহীন স্নেহ ভালোবাসা ছিলো তা বুঝতে পারি। ছোট বেলায় আমি একটু ছোয়াচে ধরণের ছিলাম। কারো খাবার থালায় খেতাম না, কারো পান করা গ্লাসে পানি পান করতাম না, চেহারা দেখতে পছন্দ না হলে তার হাতের খাবার খেতাম না, এমন। মা'র কাছে শোনা আমি নাকি এসব ব্যাপারে বাচবিচার করলেও নানি খাইয়ে না দিলে খেতাম না, তিনি খাইয়ে দিলে আমার পেট ভরতো না। আমার এরকম যখন অবস্থা তখন নানি মারা গেলেন। মা বেচারী আরো একা হয়ে পড়লেন। মা নাই, বাবা নাই, বন্ধু-বান্ধব নাই, ভাই-বোন নাই, স্বামীর সংসারে সুখ নাই।

তখন বর্ষাকাল। পানিতে টইটম্বুর চারদিক। নৌকার করে নানিকে তার পৈতৃক ভিটায় নিয়ে গিয়ে দাফন করা হলো। তখন থেকেই আমার মা'য়ের কান্নার প্রত্যক্ষ্য সাক্ষী আমি। মা নানির কবরের পাশে বসে কাঁদেন। মা যখনই নানির কবর দেখতে যান আমকে নিয়ে যান। তাঁর কান্না দেখলে আমারও কান্না পায়। কিন্তু আমি কাঁদি না। নিঃশব্দে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। আরো ভালো করে তাঁর কান্না দেখতে ইচ্ছা হয় আমার। মাথার কাপড় সরিয়ে, মুখাবয়ব উম্মুক্ত করে তার চোখের দিকে তাকাই আমি। গভীর আবেগে মা আমায় জড়িয়ে ধরে পুরো পৃথিবীটাকেই সমুদ্র করে দিতে চান। আমি তাঁকে স্বান্তনা দিতেই চাই। প্রাণপণে বলতে চাই মা, "মা'গো তুমি আর কেঁদোনা। মনেমনে বিধাতাকে বলি, হে আল্লাহ, হে পরম করুণাময় রব্বুল আলামিন তুমিতো সবই পারো। তুমি আমার মায়ের কষ্টটা ভুলিয়ে দাও।" আমি প্রাণপণে মা'কে স্বান্তনা দিতে চাই, তার কষ্ট ভুলিয়ে দিতে চাই, তাকে সাহয্য করতে চাই, তাকে বলতে চাই মা'গো আমি তোমার ছেলে, আমি তোমাকে ভালোবাসি মা, আমি বড় হয়ে তোমার সব চাওয়া পূরণ করবো। কিন্তু আমি কিছুই পারি না। আমি তাঁর কষ্ট ভোলাতে পারি না, তাঁকে সাহয্য করতে পারিনা, তাঁকে স্বান্তনা দিতে পারি না। আমি জানি তবুও স্বান্তনা হিসেবে শুধু আমাকেই ভাবেন। তাঁর বেচে থাকার প্রেরণা শুধুই আমি।

আমার বাবা, মা এবং আমরা তিন ভাই, বোন এই পাঁচ জনের একটি অসুখি সংসার আমাদের। বাবা একজন দিন মজুর। আমাদের পরিবারে তিনিই একমাত্র আয়ের উৎস। সমাজের নিন্মবিত্ত শ্রেণীর মানুষ আমরা। আমদের পরিবারটিক অসুখি বলার কারণ শুধু মাত্র অর্থনৈতিক কারণ না। পৃথিবীতে কিছু সংখ্যক মানুষ আছে যারা একে অপরের প্রতি, আপনজনের প্রতি মায়া, প্রীতি, ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারে না, যথাযথ ভাবের প্রকাশ ঘটাতে পারে না। প্রচণ্ড ভালোবাসে অথচ বলতে পারে না। যার,যার প্রত্যেকের আছে একটা করে নিজস্ব জগত। একজনের জগতে আরেকজন যেতে পারে না। তা সত্বেও অর্থনৈতিক কারণটাকে একেবারে ফিকে করে দেয়া আমার উদ্দেশ্য না। কারণ যতক্ষণ না মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসে ততক্ষণ অন্যান্য স্বাধীনতার দ্বারগুলোও বন্ধ থাকে। সে যাহোক, সুখ-দুঃখ নিয়েইতো মানুষের জীবন। আমাদের পরিবারটা হলো বিরুদ্ধস্রোতে দাড় বেয়ে চলা নৌকার মত। অনেক কষ্ট করে সামনে এগানো যাকে বলে।
*
বিকেল হয়ে এসেছে। চারদিকে ফুরফুরে বাতাস। পশ্চিমাকাশে সূর্যটাকে রক্তপিণ্ডের মত দেখাচ্ছে। বিদায়ি সূর্যের রক্তিম আভা গাছের পাতায় পড়াতে কী এক অদ্ভুত বর্ণ ধারণ করেছে। মেঘশিরীষের মগডালে বাসা বেঁধেছে কাণিবক। সারাদিন খাবার সন্ধানে ঘুরে ফিরে এইমাত্র বাসায় ফিরেছে, পাকস্থলি বোঝাই করে। ফিরে আসতে বাচ্চাগুলো আধ হাত লম্বা গলাওলা মাথা বের করে খাবার গ্রহনের জন্য চিচি করছে। বাবা কিংবা মা বক পাখিটা নিজের উদর থেকে খাবার উগরে সবগুলো বাচ্চার মুখেই পুরে দিচ্ছে। কী দৃশ্য! সৃষ্টিকর্তার এক রহস্যময় খেলা। বাচ্চাগুলোর জন্যে সীমাহীন ভালোবাস সৃষ্টি করে বাবা এবং মা বক পাখিটার মনে।
নিজের অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো আমার মুখ থেকে। উঠে দাড়াতেই ক্ষূধার তীব্রতা অনুভব করলাম। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। দুপুরে খাওয়া হয় নাই। এতক্ষণ একদম টের পাইনি। বাড়ি ফেরার জন্য ঘুরে দাড়াতেই আমি ভয়ানক ভাবে চমকে গেলাম। পিছনে রাজা ভাই দাঁড়িয়ে কিছুটা ভয় ও পেলাম। থতমত খাওয়া গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, 'আরে রাজা ভাই আফনে এইখানে, কি জন্য?'
'আব্বার নগে পাট খ্যাতে সার বুনতে আইছি।'
'ও।'
'কি ভাবতেছিলা এইখানে বইয়া?'
'কই কিছু নাতো!'
'তোমার ডর করে না?'
'ক্যান,ডর করবো ক্যান?'
'আরে এইখানে মানুষ একলা, একলা এইভাবে আসেনাকি?'
'ক্যান ক্ষতি কি?'
'যদি ভুতে ধরে!'
'ভাই, আমি ভুত বিশ্বাস করি না।'
পাট ক্ষেতের মধ্যে খেকে রাজা ভাই'র বাবা ডাকলেন, 'কৈরে, রাজা কোথায় গেলি?'
রাজা বলল, 'এই যে আব্বা এইহানে।' আমার দিকে তাকিয়ে রাজা আবার বলল, 'তোমারে আরও দুই দিন দেখছি এইখানে এমুন বইয়া থাকতে। ঘটনা কি কওতো?'
'ঘটনা কিছু না। আমর ভালোলাগে তাই আহি আপনার অসুবিধা আছে।'
'অসুবিধা কিছুনা, তয় তোমার লগে আমার কথা আছে।'
'কি কথা?'
'অনেক কথা।'
'কন?'
রাজার বাবা একটা বেতের ঝুড়ি হাতে করে এদিক পানে আসতে, আসতে বললেন,' কার লগে কথা কসরে রাজা? আরে এইডা কেডা? আরে ও পোলা তুমি কেডা? কি করো এইহানে?'
অনেকগুলি প্রশ্ন একবারে করাতে কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিলাম না। চুপ করে রইলাম।
' আরে ও পোলা তুমি কেডা? কতা কওনা কেন? কি নাম তোমার?'
'জে, রাজা।'
'কও কী! আমার পোলার নাম ও তো রাজা।বাড়ি কোথায়?'
'জে, দক্ষিণ পাড়া।'
'অ। বাহের নাম কি তোমার?'
'জে, ধনু মোল্লা।'
'অ। তুমি ধনুর পোলা। তোমার বাহের লগেতো আমার প্রায়ই কতা হয়। আহা, বরো ভালো মানুষ দেখলে এক কাপ চা না খাওয়াইয়া ছারবোই না।'
চোখেমুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে তাঁর মুখের দিকে তাকালাম। তিনি আবার বললেন, 'এইহানে তিন কাডা ভুই আছে, নিচু জমি বইল্লা চাষ বাস করি না। এইবার পাট বুনাইছি। ফলন ভালোই হইছে। দেহনা কেমন লকলকাইয়া বারতাছে। গত পরশু নিরানি দিছিলাম। আইজ আবার সার দিয়া গেলাম। তা পোলা তুমি পরাশোনা করো তো?'
'জে।'
'কোন ক্লাসে পরো?'
'জে, ক্লাস সেভেন।'
'রোল নাম্বার কত?'
'জে, এক।'
'মাশাল্লা, মাশাল্লা হুইন্না খুশি হইলাম। আমাগো রাজা এইবার মেট্টিক পাশ দিছে। স্টার মার্ক পাইছে তোমারো কিন্তু ওর মতন রেজাল্ট করা চাই। তা তুমি এই হানে কি জন্যে আইছিলা?'
'জে, এমনেই।'
'না, এইডাতো ভালো কথা কইলানারে বাপ! বন-বাদারে একলা গোরাফিরা করাতো ভালো না। যাও বারি যাও।'
'জে, আচ্ছা।'
আর কথা না বাড়িয়ে হাটা ধরলাম। কিছুক্ষণ পরে পিছন ফিরে তাকালাম। রাজার বাবা ছেলের কাঁধে হাত রেখে হেঁটে যাচ্ছেন। রাজাকে ভারী হিংসে হচ্ছে আমার। আমার বাবা কেন আমার কাঁধে এভাবে হাত রেখে কোন দিন হাটে না?
*
সন্ধার পরে আজ একটু সকাল সকালই ইতি, বিথি এবং আমাকে খেতে দিলেন মা। কারণ আমরা সবাই জানি যে বাবা আজ বাড়িতে আসার পরে কী তুমুল কাণ্ড ঘটবে। ভাত খেয়ে আমরা তিন ভাই বোন চুপটি মেরে, হাতে বই নিয়ে বসে আছি আর অপেক্ষা করছি বাবার তাণ্ডবলীলা দেখার। বিথি বলল, 'দাদা, ও দাদা।'
'কী?'
'বেবাকে এমুন চুপ মাইররা আছে ক্যান? কতা কওনা ক্যান?'
'কী কতা কমুরে, তুই পর।'
'না, পরমু না। তুমি কও চুপ মাইররা আছো ক্যান?'
'বাবা আইজ রাগ করছে তাই সবাই চুপ মাইররা আছে।'
বিথি আর কোন কথা বলল না। সবাই চুপচাপ। সামনে বই থকলেও কিছুতেই মনোনিবেশ করতে পারছিলাম না। ইতি, বিথি বইয়ের পাতা উল্টিয়ে, উল্টিয়ে ছবি দেখছে। পাশের ঘরে মা বসে আছেন, অন্ধকারে, একাকি। কী করছেন তিনি এখন? নিশ্চয় কাদছেন। আর কী করবেন! ইতি বলল, 'দাদা?'
'কী?'
'কি ভাবতাছ?'
'কই, কিছুনাত!'
'দাদা?'
'কি?'
'একটা কতা কই।'
'ক।'
'বাবা কি আইজ মায়রে মারবো।'
'জানিনা, ইতি তুই চুপ কর।'
'ক্যান চুপ করমু ক্যান? তুমি জাননা?'
'জানি।'
'তাইলে কও ক্যান মারবো?'
'মারলে যে আমাগো মা'র আর কোনোখানে যাওয়ার যাগা নাই, হেইরনিজ্ঞা মারবো।'
'সব মায়েদেরই তো যাওয়ার যাগা আছে, তাইলে আমাগো মা'র যাওয়ার জাগা নাই কেন?' দাদা মা'র কি অপরাধ? আমাগো কি অপরাধ, দাদা?'
বিথির এ প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নাই। শুধু বললাম, 'চুপ করতো, চুপ কর।'
বিয়ের পর স্বামীরা বউদের মারবে এটা আমদের দেশে কোন ব্যতিক্রমি ঘটনা না। প্রতি ঘরে ঘরে অহরহই ঘটছে। নারীদের যথাযথ সন্মান নাই। নারীর প্রতি করা হয় শারিরীক নির্যাতন। আর ঐসব নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করে পুরুষের মনোরঞ্জন করাই নারীর ধর্ম।

বাবা বাড়িতে এসেই শুয়ে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে মা'ও গেলেন, তাঁর হাতে ভাতের থালা। থালাটা পাশের চেয়ারে রেখে বাবাকে ডাকলেন, 'ওডেন হাত মুখ ধোন, ভাত খান। বাবা প্রথমে খুবই স্বল্পভাষী। মা দু তিন বার ডাকাডাকির পর বললেন, 'আমি খাইছি তোমরা খাওগিয়া।'
'হ। কইলেই অইলো! কোতায় খাইছেন? ওডেন অহানে আগে ভাত খান তারপর যা করার করবেন।'
মা যতই সাধসাধি করেন বাবা ততই কঠিন হন। কিন্তু মা নাছোড় বান্দা। তিনি বাবাকে না খাইয়ে ছাড়বেন না। যদিও এই সাধাসাধির পরবর্তী অধ্যায়ে কি হবে তা তিনি জানেন। মা বাবার হাত ধরে টান দিলেন। বললেন, 'আমি অন্যায় করছি শাস্তি দিবেন কিন্তু ভাত না খাইয়া নিজেরে কষ্ট দিবেন ক্যান?'
বাবা মা'র হাত ছাড়িয়ে ঝাড়ি দেন, 'সর এইহানতোনে সর কইতাছি। আমার চোহের সামনেতোনে সইররা যা। আইজকা আমার মরা বাহে আইলেও আমারে ভাত খাওয়াইতে পারবো না। তুই সর আমার সামনেতোন। চোতমারানি মাগী। আমারে তোর ভাত খাওয়ান নাগবো না। তুই চগম-চগম কইররা ঘোরগা আর বেডাগো চেহারা দ্যাহাগা।'
মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবারো বাবার হাত ধরে টান দিলেন। বললেন, 'ওডেন...'
ব্যস আর কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। বাবা আচমকা উঠে এসে লাথি বসালেন মা'র পেটে। বাবার রাগ এখন চরমে। রাগের সময় মাথা ঠিক থাকে না। লাথি, চড়, কিল, ঘুষি। যেভাবে খুশি সেভাবে মারলেন মা'কে। মা তার নীরব ভাষায় কাঁদতে লাগলেন মেঝেতে গড়াগড়ি খেয়ে। বাবা আকাশ পাতাল ফাটিয়ে চিল্লাতে লাগলেন। 'চোতমারানি মাগীরে কইছি আমার চোহের সামনেতোন সরতে। চোতমারানি মাগী তুই কাইলকা বিয়ান অওয়ার আগেই বাইরাবি কাইলকা জানি আর এট্টারেও না দেহি আমার বাইত্তে, তাইলে কইলাম ছাপ জবাই কইররা হালামু।'
দু চার বাড়ির মানুষ সব জমা হলো আমাদের বাড়ির উঠানে। সবাই উপভোগ করতে লাগলো আমার বাবা মা অভিনীত নাটক।
সে রাতে বাবার বিছানায় মা'র যাগা হলো না।
*
তার পরের দিন থেকে বাবার, বাড়িতে ভাত খাওয়া, বাজার দেওয়া, কারো সাথে কথা বলা পুরোপুরি বন্ধ করে দিলেন। দিনের বেলা বাড়িতে আসেন না। আর আসলেও কারো সাথে কথা বলেন না। যেন আমরা তার সম্পূর্ণ অচেনা হয়ে গেছি। আর আমরাও ভয়ে কখনো তার কাছে যাই না। যেভাবে শান্তি সেভাবেই তাকে থাকতে দেই। কেননা তিনি যা চাইবেন, তার অন্যথা কখনো হবে না, হবার নয়।
একদিন দু'দিন-এক সপ্তাহ চলে যায় এভাবে। মা যেভাবে পারেন আমাদের জন্য একবেলা লবন ভাতের ব্যবস্থা করেন। এইসব দিন একমাত্র সাক্ষী, মা'র আর আমার চোখের জল। যা কোনোদিন ভোলার নয়। আমাদের পেটের ক্ষুধা মা'র ভালোবাসার কাছে হার মানে। মা আমাদের ভালোবাসেন। অযুত, লক্ষ কষ্টের মাঝে মা আমাদের তিন ভাই বোন ছাড়া আর কিচ্ছু ভাবেন না।
এভাবে কিছুদিন চলার পরে আচমকা একদিন, বাবা বাড়িতে এসে বলেন,'এই যে ইতি ভাত আছেনি? কয়ডা ভাত আনদি মা, আমার খুব খিদা নাগছে। মা যেভাবেই পারেন, বাবার জন্য ভাতের ব্যবস্থা করেন। আমরা যে এ কয়দিন, না খেয়ে, শত, সহস্র কষ্টের মাঝে ছিলাম, সে অনুভবটুকু মা বাবাকে বুঝতে দেন না। আর বাবাও তা কখনো বুঝতে পারে না অথবা না বোঝার ভান করে থাকেন। আমাকে ডেকে বলেন,'এই যে রাজা বাজারে ল তো বাপ বাজার কইরা দিমানে।'
সব ঠিকঠাক। দুধে ধোয়া ভালো মানুষটি। যেন কিচ্ছু হয়নি। সব কিছু চলতে থাকে আগের মত। এতেই মা খুশি, আমরা খুশি। কিন্তু এভাবে বেশিদিন চলে না। এক মাস, দু'মাস-তারপর হটাত একদিন, কারণে অথবা অকারণে বাবা রাগ করেন, মা'কে মারধোর করেন, বাড়িতে খাওয়া বন্ধ করে দেন। ঐ একই ঘটনার পুণরাবৃত্তি।

যে ক'টা দিন বাবার মেজেজ, মর্জি ভালো থাকে সে ক'টা দিন আমাদের আনন্দে কাটে, আমরা সুখে থাকি। প্রতিটি কর্ম দিবস শেষে বাবা যখন ঘরে ফিরে আসেন, মা তখন বাবাকে সন্তুষ্ট করতে, সেবা যত্নে অতিরিক্ত রকম ব্যস্ত হয়ে পড়েন। রাতের খাবার শেষে ঊঠোনে পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়েন বাবা। চারদিকে ফুটফুটে জ্যোৎস্না, ঝিরঝিরে হাওয়া, মাথার উপর সুনিলাকাশ, ভরাট চাঁদ। বাবা পাটিতে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন আর পান চিবুতে,চিবুতে তৃপ্তির ঢকুর তোলেন। আমরা সবাই বসি তার তার চার পাশে। হয়তো, বিথি বলে,'বাবা একটা কিচ্ছা কন।'
'আমি কি কিচ্ছা কমু?'
'একটা হাসির কিচ্ছা কন।'
'আমি তো কোন কিচ্ছা জানি নারে মা। তার'চে তুমি একটা কবি কও দেখি, ঐযে কাইলকা কি যানি পরতেছিলা।'
'ও ঐটা। তাইলে আফনে ওইট্টা বহেন। '
বাবা উঠে বসেন। বিথি অভিনয় করে চেচিয়ে ছড়া বলে-'আসছে আমার পাগলা ঘোড়া,ওরে বাবা সরে দাঁড়া....'
বিথিটা বড্ড ফাজিল। ওরে বুবু সরে দাঁড়ার যাগায় ওরে বাবা লাগিয়েছে। বাবা হাসতে, হাসতে গড়িয়ে পড়েন। ইতি আর বিথি ঝাপিয়ে পড়ে তাঁর কোলে। ইতি বলে,' নেন বাবা এবার একটা কিচ্ছা কন।'
'আমি তো কিচ্ছা জানিনারে মা। তার'চে তর মায়রে ধর, হেই'ই ভালা কিচ্ছা জানে।'
ওরা তাই করে। মা'কে জড়িয়ে ধরে। মা চাঁদের বুড়ির গল্প, ঘুম পাড়ানির গল্প বলে ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। ওরা ঘুমিয়ে পড়ে। আমি চুপচাপ শুয়ে থাকি আকাশের দিকে চেয়ে। আমার চোখে ঘুম আসে না। কিন্তু ওরা ঘুমিয়েছে দেখে চোখ বুজে ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকি। কোন সাড়া দেই না। বাবা ও মা ঘনিষ্ট হয়ে ওঠেন। ফিসফাস করে সংসারের টুকুটাকি বিষয় নিয়ে আলাপ করতে থাকেন। রাত বাড়তে থাকে। বাড়ির পেছনে বাঁশ বাগানে নাম না জানা কোন পাখি ডেকে ওঠে, কুক-কুক-কুক আমার বড় ভালো লাগতে থাকে।

অতি প্রয়োজন ছাড়া বাবার সঙ্গে আমার কথা হয় না। সত্যি কথা বলতে কী আমিই তাকে এড়িয়ে চলি। কেন জানি রাগি মানুষের সাথে আমি মিশতে পারি না। যখন তাঁর মন ভালো থাকে, তখন তিনি আমাকে মাঝেমাঝে ডাকেন, কথাবার্তা বলেন,'রাজা?'
'জে বাবা।'
'পরাশোনা কেমন চলতাছে?'
'জে, ভালো।'
'খালি ভালো হইলে হইবো না। ফাসক্লাস হইতে হইবো।'
'জে, বাবা।'
'টাহা পয়সার জন্য চিন্তা নিবানা। তোমার বাপ গরীব হইলে কী হইবো, কইলজাডা বরো আছে। কইলজডা হইলো আসল, বুজলা? দরকার অইলে আমি তোমারে শইল্লের রক্ত বেইচ্চা পরামু।'
আমার চোখ ছলছল করে ওঠে। নির্বাক চেয়ে থাকি মাটির দিকে। পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মাটি খুড়তে থাকি। বাবা বলেন,'তোমার কিছু দরকার অইলে চাওনা কেন আমার কাছে?'
আমি চুপ করে থাকি। বাবা পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে দিয়ে বলেন, 'এইডা রাহো, খরচ কইরো।'
আবার কখনো কখনো হয়তো স্কুলে যাবার সময় পেছন থেকে ডাক দেন, 'ও ,রাজা?'
থমকে দাঁড়িয়ে বললাম,'জে, বাবা।'
'স্কুলে যাইতাছ?'
'জে।'
বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। যে জামাটা গায়ে দিয়েছি তা পেছনের দিকে খানিকটা ছিড়ে গেছে, মা সেলাই করে দিয়েছেন। সেলাই করা জাগাটা হয়তো কোন কারণে আবার ফসকে গেছে। হটাত সেখানে বাবার চোখ পড়াতে তিনি চমকে উঠলেন,'একী! তুই ছিরা জামা গায়ে দিয়া স্কুলে যাচ?'
আমি আমতা আমতা করে বললাম, 'বাবা আমার একটাই জামা।'
বাবা অতি মাত্রায় দুঃখিত হলেন, 'কস কী? আমার একটা মাত্র পোলা , আর সে ছিরা জামা গায়ে দিয়া স্কুলে যায়!'
বাবা আমাকে তাঁর সাথে নিয়ে গেলেন। তখনই নতুন জামা কিনে দিলেন। এসব ঘটনা আমার জীবনে খুব বেশি একটা ঘটে না। তবুও বাবার উপরে জমে থাকা অভিমান, ঘৃণা মূহুর্তে উধাও হয়ে ভালোবাসায় পুর্ণ হয়ে যায়।

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫৪
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের সংগ্রামী জনতার স্লুইস গেট আক্রমণ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২১


(ছবির লাল দাগ দেয়া জায়গাটিতে গর্ত করা হয়েছিল)

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

২৩শে এপ্রিল পাক সেনারা ফুলছড়ি থানা দখল করে। পাক সেনা এলাকায় প্রবেশ করায় মানুষের মধ্যে ভীতিভাব চলে আসে। কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাড়ির কাছে আরশিনগর

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫০


বাড়ির কাছে আরশিনগর
শিল্পকলা একাডেমির আশেপাশেই হবে চ্যানেলটার অফিস। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল মৃণাল। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এক-দু'জনকে জিগ্যেসও করল বটে, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না।

কিছুদূর এগোনোর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতার সুফল কতটুকু পাচ্ছে সাধারণ মানুষ

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:২৮

(১) আমলা /সরকারের কর্মকর্তা, কর্মচারীর সন্তানদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব হতাশাজনক। মুক্তিযুদ্ধের ১৯৭১ সালের রক্ত দেওয়া দেশের এমন কিছু কখনো আশা কি করছে? বঙ্গবন্ধু এমন কিছু কি আশা... ...বাকিটুকু পড়ুন

এলজিবিটি নিয়ে আমার অবস্থান কী!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১০ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৫

অনেকেই আমাকে ট্রান্স জেন্ডার ইস্যু নিয়ে কথা বলতে অনুরোধ করেছেন। এ বিষয়ে একজন সাধারণ মানুষের ভূমিকা কী হওয়া উচিত- সে বিষয়ে মতামত চেয়েছেন। কারণ আমি মধ্যপন্থার মতামত দিয়ে থাকি। এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×