somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছন্দের বারান্দা-১

১৩ ই অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ২:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজকাল অনেকেই আমার কাছে ছন্দ শিখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ছড়াসাহিত্য নিয়ে কাজ করছি তাই তরুণ ছড়াকারগণই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমন আগ্রহ দেখান। অনেকের আগ্রহকে প্রায় সময়ই গুরুত্ব না দিয়ে এড়িয়ে যাই। কারণ আমি মনে করি ছন্দজ্ঞান ছাড়াও ছড়া বা কবিতা লেখা সম্ভব। একজন নবীন ছড়াকারকে প্রথমেই ছন্দের কাঠামো ও কঠিন কঠিন নিয়মাবলী জানার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। আগে ছড়াকার হতে হবে তারপরে জানতে হবে ছড়ার ব্যাকরণ। ছন্দ সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান রেখেও অনেকেই ভালো ছড়া বা কবিতা নির্মাণ করতে পারেন না। আবার ছন্দজ্ঞানে অজ্ঞ অনেকের পক্ষেই ভালো ছড়া বা কবিতা নির্মাণ করতে দেখা যায়।
.
অনেক ছড়াকারকেই ‘আপনি এটা কোন্ বৃত্তে লিখেছেন’ প্রশ্ন করলে তাকে আমতা আমতা করতে দেখা যায়। কেউ কেউ ‘জানিনা’ বলেই সংক্ষেপে উত্তর দেন। অথচ ছড়াটি ছন্দের গ্রামারে উত্তীর্ণ, হয়তো স্বরবৃত্তে কিংবা মাত্রাবৃত্তে। প্রায় অধিকাংশ ছড়াকারই নিজের কানকে শিক্ষক হিসেবে মানেন। অর্থাৎ ছড়া পাঠ করার সময় নিজের কানে যদি কোনো ধরনের ধাক্কা না লাগে তাহলে ধরে নেন ছড়াটিতে ছন্দপতন ঘটেনি। অতএব আগে ছন্দ জানা জরুনি নয়, আগে ছড়াকার হওয়া জরুরি বলেই আমি মনে করি। আমার ছন্দ বিষয়ক এই আয়োজন তাই ছড়াকারদের জন্য, যারা এখনও ছড়া লিখতেই জানেন না এমন বন্ধুদেরকে পোস্ট এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। যারা ছড়াকার হবার জন্য ছন্দ শেখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেছেন তাদের প্রতি অনুরোধ, বেশি করে ভালো ছড়া পাঠ করুন। দেখবেন আপনিও একসময় ছড়া লিখতে পারবেন। ছড়া লিখতে হলে ছন্দবিজ্ঞানী হতে হয় না। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলেরাও ছন্দ শেখার আগেই কবিতা লিখেছেন।সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক নিজেই বলেছেন, ’পেছনের দিকে তাকিয়ে এখন শিউরে উঠি যে লেখার কৌশল কতখানি কম জেনে -- আরো ভালো, যদি বলি কিছুই না জেনে, একদা এই কলম হাতে নিয়েছিলাম।’
.
ইতোপূর্বে আমি ‘বাংলা ছন্দের প্রাথমিক ধারণা’ শিরোনামে ফেসবুকে দুটি নিবন্ধ পোস্ট করেছি। আজ ছন্দবিষয়ক মৌলিক কিছু কথা বলে সরাসরি স্বরবৃত্ত ছন্দ সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই।
.
অক্ষর পরিচিতি:
....................
অনেকেই বর্ণকে অক্ষর মনে করতে পারেন। যেমন- অ, আ, ক, খ এগুলো প্রত্যেকটি এক একটি বর্ণ বা অক্ষর। তবে বাংলা সাহিত্যের ছন্দবিজ্ঞানে অক্ষর বলতে ‘বাগযন্ত্রের স্বল্পতম প্রয়াসে বা এক ঝোঁকে শব্দের উচ্চারিত অংশকেই’ বুঝায়। অক্ষর অনেকটাই ইংরেজি Syllable-র মতো। যেমন-
কারবালা= কার, বা, লা ৩ অক্ষর
নদীনালা= ন, দী, না, লা ৪ অক্ষর
অন্ধ= অন্, ধো ২ অক্ষর।
.
বাংলা ছন্দে অক্ষর দুই প্রকার। যথা- ১) মুক্তাক্ষর ও ২) বদ্ধাক্ষর।
১) মুক্তাক্ষরঃ যে সব ধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখের প্রবহমান বাতাস জিহবার কোনো বাধা ছাড়াই বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে তাদের মুক্তাক্ষর বলে।
যেমন- কা, দি, বা, লে ইত্যাদি।
.
২) বদ্ধাক্ষরঃ যে সব ধ্বনি উচ্চারণের সময় জিহবা মুখের প্রবহমান বাতাসকে আটকে দেয় তাদের বদ্ধাক্ষর বলে।
যেমন- বর, আয়, থাক, নিক ইত্যাদি।
.
যতি বা ছন্দ-যতি : কোনো বাক্য পড়ার সময় শ্বাসগ্রহণের সুবিধার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে অন্তর অন্তর যে উচ্চারণ বিরতি নেয়া হয়, তাকে ছন্দ-যতি বা শ্বাস-যতি বলে। যতি মূলত ২ প্রকার- হ্রস্ব যতি ও দীর্ঘ যতি। অল্পক্ষণ বিরতির জন্য সাধারণত বাক্য বা পদের মাঝখানে হ্রস্ব যতি দেওয়া হয়। আর বেশিক্ষণ বিরতির জন্য, সাধারণত বাক্য বা পদের শেষে দীর্ঘ যতি ব্যবহৃত হয়।
পর্ব : বাক্য বা পদের এক হ্রস্ব যতি হতে আরেক হ্রস্ব যতি পর্যন্ত অংশকে পর্ব বলা হয়। যেমন-
যতকাল রবে/ পদ্মা যমুনা/
গৌরী মেঘনা/ বহমান
ততকাল রবে/ কীর্তি তোমার/
শেখ মুজিবর/ রহমান।
(বঙ্গবন্ধু ।। অন্নদাশঙ্কর রায়)
.
মাত্রা : একটি অক্ষর উচ্চারণে যে সময় প্রয়োজন হয়, তাকে মাত্রা বলে। বাংলা ছন্দে ছন্দে একেক অক্ষরের মাত্রাসংখ্যা একেক রকম হয়। মূলত, এই মাত্রার ভিন্নতাই বাংলা ছন্দগুলোর ভিত্তি। বিভিন্ন ছন্দে মাত্রাগণনার রীতি বিভিন্ন ছন্দের আলোচনায় দেয়া আছে।
.
বাংলা সাহিত্যে ছন্দবিজ্ঞানের আরও অনেক খুঁটিনাটি তথ্য রয়েছে যা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যেতে হচ্ছে। কারণ ছড়াকারদেরকে সংক্ষেপে ছন্দ সম্পর্কে মৌলিক বিষয়ে অবগত করাই এই নিবন্ধের (পোস্টের) উদ্দেশ্য।
.
বাংলা ছন্দের প্রকারভেদ সম্পর্কে আমরা সকলেই অবগত। ছন্দ মূলত ৩টি-
১) স্বরবৃত্ত,
২)মাত্রাবৃত্ত ও
৩)অক্ষরবৃত্ত ।
(অবশ্য বিংশ শতক থেকে কবিরা গদ্যছন্দেও কবিতা লিখতে শুরু করেছেন। এই ছন্দে সেই সুশৃঙ্খল বিন্যাস না থাকলেও ধ্বনিমাধুর্যটুকু অটুট রয়ে গেছে, যে মাধুর্যের কারণে ধ্বনিবিন্যাস ছন্দে রূপায়িত হয়।)
যেহেতু স্বরবৃত্ত ছন্দকে ‘ছড়ার ছন্দ’ বলা হয় তাই আজ কেবল স্বরবৃত্ত ছন্দ নিয়ে আলোচনা করেই এই নিবন্ধের (পোস্টের) ইতি টানবো।
.
স্বরবৃত্ত ছন্দ:
...............
স্ববৃত্ত ছন্দকে অনেকেই ছড়ার ছন্দ বলে থাকেন। যদিও মাত্রাবৃত্ত এবং অক্ষরবৃত্তেও ছড়া লেখা হয়। তবে শ্বাসাঘাত প্রধান ছন্দ হিসেবে বাংলা সাহিত্যে প্রচলিত ৩টি ছন্দের মধ্যে স্বরবৃত্ত ছন্দকেই ছড়ার ছন্দ হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। ছড়ার পাশাপাশি গান রচনার ক্ষেত্রেও এই ছন্দ সচরাচর ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
.
স্বরবৃত্ত ছন্দের নামকরণ:
স্বরবৃত্ত নামটি প্রবোধচন্দ্র সেন প্রদত্ত নাম, যদিও তিনি পরবর্তীকালে নিজেই এই ছন্দের নাম 'দলবৃত্ত' প্রস্তাব করেন। তবে এখন বাংলা ছন্দে 'স্বরবৃত্ত' নামটিই প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
.
স্বরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্যসমূহ:
..................................
঳ স্বরবৃত্তের মূল বিষয়টিই আবর্তিত হয় দুটি সিলেবল বা দলকে (মুক্ত ও বদ্ধ দল) ঘিরে।
঳ স্বরবৃত্ত দ্রুত লয়ের ছন্দ।
঳ এই ছন্দের মূলপর্ব বা পূর্ণপর্ব চার মাত্রাবিশিষ্ট।
঳ সব অক্ষরকেই ১ মাত্রা গুণতে হয়।
঳ মুক্তদল বা মুক্তাক্ষর এবং রুদ্ধদল বা বদ্ধাক্ষর উভয়ই একমাত্রাবিশিষ্ট।
঳ পর্বগুলো ছোট এবং দ্রুতলয়বিশিষ্ট।
঳ এই ছন্দে যতি এবং দল ঘন ঘন পড়ে বলে বাগযন্ত্র দ্রুততা লাভ করে।
঳ প্রতি পর্বের প্রথম অক্ষর শ্বাসাঘাতযুক্ত।
.
ছন্দ বিশ্লেষণ:
যদি ‘অন্ধ’ শব্দটিকে মাত্রার জন্য ব্যবচ্ছেদ করা হয়, তবে এখানে সিলেবল আছে দুটি। প্রথমটি অন্ (বদ্ধ) এবং ধ(মুক্ত)। এখানে বর্ণ তিনটি কিন্তু উচ্চারণের সময় দুটিতে ভাগ হচ্ছে। আবার যদি ’আকাশ’ শব্দটি ব্যবচ্ছেদ করা হয় তবে আ(মুক্ত), কাশ (বদ্ধ)।
উদাহরণ:
১.
নারকেলের ওই/ লম্বা মাথায়/
হঠাৎ দেখি/ কাল (৪+৪+৪+১)
ডাবের মতো/ চাঁদ উঠেছে/
ঠাণ্ডা ও গোল/গাল। (৪+৪+৪+১)
(না ঘুমানোর দল।। আল মাহমুদ)
.
২.
মা মণিটার/ চোখ এড়িয়ে (৪+৪)
গলির মোড়ের/ পুল পেরিয়ে (৪+৪)
রোদের সাথে/ বুক মিলিয়ে (৪+৪)
পাখনাভরা/ রঙ বিলিয়ে (৪+৪)
এখান থেকে/ অনেক দূরে (৪+৪)
যদি আমি/ যেতাম উড়ে (৪+৪)
প্রজাপতির/ মতো, (৪+২)
কেমন মজা/ হতো? (৪+২)
(যদি আমি।। শামসুর রাহমান)
পূর্ণ পর্ব ৪, অতিপর্ব ২)
.
৩.
আয় ছেলেরা/ আয় মেয়েরা/
ফুল তুলিতে/ যাই (৪+৪+৪+১)
ফুলের মালা/ গলায় দিয়ে/
মামার বাড়ি/ যাই। (৪+৪+৪+১)
(মামার বাড়ি।। জসীম উদ্দীন)
.
৪.
নুরু, পুশি,/ আয়শা, শফি/ সবাই এসে/ছে (৪+৪+৪+১)
আমবাগিচার/ তলায় যেন/ তারা হেসে/ছে।(৪+৪+৪+১)
(বনভোজন।। গোলাম মোস্তফা)
.
৫.
বাঁশ বাগানের/ মাথার উপর /
চাঁদ উঠেছে/ ওই (৪+৪+৪+১)
মাগো আমার/ শোলোক বলা /
কাজলা দিদি কই ∣∣ (৪+৪+৪+১)
(যতীন্দ্রমোহন বাগচী)
.
আজ এ পর্যন্তই। পরবর্তী নিবন্ধে (পোস্টে) মাত্রাবৃত্ত ছন্দ নিয়ে কথা হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ২:০০
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×