somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না, সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি---------------

১৪ ই এপ্রিল, ২০১৭ সকাল ৯:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



** সবাইকে নতুন বছরের অনেক অনেক শুভেচ্ছা!!

মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা। ------ কবিগুরু।

বাবা-মার প্রথম সন্তান আমি, জন্মেছি শহরে। বাবার চাকুরীসূত্রে অস্থায়ী নিবাস ছিল ঢাকা শহরে, শিক্ষাজীবনও ঢাকাতেই শুরু হয়েছিল। তখন স্কুলে দু’টো বড় ছুটি হতো, গ্রীস্মের ছুটি (আ্মের ছুটি) আর বার্ষিক পরীক্ষার পরে শীতের ছুটি। যে কোন এক ছুটিতে দাদা বাড়ী অন্য ছুটিতে নানাবাড়ী। নানা বাড়ীতেতো যেতেই হবে। কয়লার ইঞ্জিনের রেলগাড়িতে চড়ে যেতাম, কত যে প্রশ্ন এত আগুন পড়ছে কেন, কোত্থেকে এলো? আবার চাঁদটাও আমাদের সাথে সাথে যাচ্ছে কেন? ট্রেন থেকে নেমে, দুই ঘোড়ার টমটমে চড়ে নানাবাড়িতে যেতাম, ছোট মামা আসতেন স্টেশনে। সব খালাতো, মামাতো ভাই-বোনেরা মিলে প্রায় ডজন খানেক সমবয়সী ভাই-বোন ছিলাম আমরা, আর এক সাথে হতাম ছুটিতে। আমার ছিল সাত মামা, এক খালা, এখন কোন মামাই বেঁচে নেই!! মামাতো ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যিনি, তার বয়স আমার চেয়ে ৬/৭ বছর বেশী। আদরও করতেন আবার শাষণেরও ওস্তাদ ছিলেন। একদিন আমরা ছোটরা শিউলি ফুল কুড়ানো নিয়ে ঝগড়া করেছি। পরদিন সকালে ফুল কুড়াতে গিয়ে দেখি গাছটা আর নেই, নানার নির্দেশে গাছটা কেটে ফেলেছে বড় ভাই। সেদিন কী কান্নাই না কেঁদেছিলাম। আমাদের মন ভালো করার জন্য বড়ভাই, বিকেলে নৌকায় বেড়াতে নিয়ে গেলেন। আমার নানাবাড়ীর পাশের ছোট্ট নদীটার নাম বড়াল নদী। ছোট হলেও গভীর ছিল। বর্ষায় পানি দুইকূল ছাপিয়ে যেত। তখন মালামাল বোঝাই বড় বড় মহাজনী নৌকা চলতো সে নদীতে।


চৈত্র বৈশাখ মাসে বৃষ্টি না হলে এভাবেই ছোট ছেলেরা বাড়ী বাড়ী যেয়ে মাটিতে গড়াগড়ি করতো, বাড়ীর মুরুব্বী মহিলারা তাদের উপরে পানি ঢেলে দিতেন।

গ্রীস্মের দুপুরে গোসল করতে যেতাম পুকুরে। বয়সে বড় ভাই-বোন যারা, তারা ছোটদের সাঁতার শেখাতেন। সাঁতারের প্রতিযোগীতাও চলতো। কে সাঁতরে কতদূর যেতে পারে। তার আবার পুরস্কারও দেওয়া হতো। পুকুরে গোসল শেষে ফিরতাম আম বাগানের ভিতর দিয়ে। মাঝে মধ্যেই টুপ টাপ পাকা আম পড়তো। সেটা কে আগে ধরতে পারবে, এই নিয়ে কাড়াকাড়ী। বিকেলে খেলা চলতো, দাড়িয়া বাঁধা, বৌচি, কানামাছি, সাতগুটি। রাতে বসতো গান, কবিতা, গল্প বলার আসর। সে আসরে নানা-নানীও যোগ দিতেন। ছুটি শেষে একে একে ফেরার পালা। মা তার বাবার বাড়ী ছেড়ে আসতে কেঁদে বুক ভাসাতেন। আমরা বোনেরাও কাঁদতাম, বিচ্ছেদের বেদনায়।
চৈত্র সংক্রান্তিতে হতো চড়ক পূজা সাথে চড়ক মেলা। চড়ক পূজায় পিঠে বাণ [বিশেষ বড়শি] ফুড়িয়ে চড়ক গাছের সাথে বাশঁ দিয়ে তৈরি করা বিশেষ চড়কার ঝুলন্ত দড়ির সাথে বেঁধে দেওয়া হয় পিঠের বড়শি । আর বাণ বিদ্ধ সন্ন্যাসীরা ঝুলতে থাকে শূন্যে । রাতে নীল পূজার পর সন্ন্যাসীরা সবাই থাকে নির্জলা উপোস । পরদিন বিকাল বেলা চড়ক পূজা শেষে উপোষ ভাঙ্গেন তারা ।



চড়কে ঝোলার সময় সন্ন্যাসীদের আশীর্বাদ লাভের আশায় শিশু সন্তানদের শূন্যে তুলে দেন অভিবাবকরা । সন্ন্যাসীরা শূন্যে ঘুরতে ঘুরতে শিশুদের মাথায় হাত বুলিয়ে আশির্বাদ করেন । অনেক সময় কোলেও তুলে নেন । আর উড়ন্ত অবস্থায় দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে বাতাসা ছিটান । যাদের ভাগ্য ভালো তারাই ঐ প্রসাদ ভাগ্য লাভ করেন । পরলোকে এই সন্নাসীদের শিব ঠাকুর স্বর্গে যাবার বর দিবেন বলেই ওদের বিশ্বাস । এগুলো বড়রাই দেখতেন, আমাদের ছোটদের সেখানে নেয়া হতো না, ভয় পাব বলে।

শীতের ছুটিতে যেতাম দাদাবাড়ী। ওখানেও একদল ভাইবোন, মহা আনন্দ, ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে এসেছি। পড়াশোনার পিছুটান একেবারেই নেই, মজা আর মজা। দাদীর হাতের শীতের পিঠা, ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের। একেক দিন একেক রকমের পিঠা। ভোর বেলায় খেজুরের রস খাওয়া, আবার রসপুলী পিঠাও খাওয়া চলতো।



ট্রেনে যাতায়াতের সময় দেখতাম, ফেরী করে পুঁথি বিক্রি হতো। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো নিয়ে পুঁথি লেখা হতো। আবার ফেরীওয়ালা সুর করে পড়ে শোনাতেন। আমার খুব ভাল লাগতো। আমার দাদী খুব পছন্দ করতেন পুঁথি শুনতে। আমি ট্রেন থেকে কিনে নিয়ে, দাদিকে পড়ে শোনাতাম। ঐ ফেরীওয়ালার পড়া শুনে শিখেছিলাম আমি পুঁথী পড়া।



শীতের যে কোনো পুর্ণিমায় বসতো কবিগানের আসর। শুধু স্টেজে হ্যাজাক জ্বলতো, স্রোতারা শুনতেন খোলা মাঠে চাঁদের আলোয় বসে। কখোনো হয়তো সামিয়ানা টাঙিয়ে দেয়া হতো। পৃথক দুই দলের মধ্যে প্রতিযোগীতা চলতো। দলের প্রধান ছিলেন মূল কবিয়াল। দলের প্রধান কোনো এক বিষয় নিয়ে শুরু করতেন, তারপর চলতো যুক্তি খন্ডনের পালা। একদল হেরে না যাওয়া পর্যন্ত চলতো এই “কবিগান”, এক রাত, দু’রাত এমনকি তিন রাত ধরেও চলতো। দাদা সাথে নিয়ে যেতেন, সেই “কবিগান” শুনতে। আমার বাবা ছিলেন, দাদার একমাত্র সন্তান। তাই আমাদের আদর পাবার সীমা ছিল না।



চৈত্র সংক্রান্তী, দোল পূর্ণীমায় মেলা হতো। মাঝে মাঝে মেলার জন্যও আমরা দেশে যেতাম । হিন্দু মুসলমান সবাই উপভোগ করতো সেই মেলা, চলতো এক সপ্তাহ ধরে। এতে নাগরদোলা, যাত্রা, সার্কাস ছিল প্রধান আকর্ষণ। আমরা কিনতাম, মাটির হাঁড়ি-পাতিল, মাটির পুতুল, মাটির নানা ধরনের প্রানী, বেলুন সহ আরো কত যে খেলনা। খাবার জিনিষ, ঝুরি-বুন্দিয়া, মিস্রি দিয়ে বানানো নানান রকমের ফুল, প্রানী। তা’ ছাড়া বাড়িতে হতো বিভিন্ন রকমের মোয়া, নাড়ু, মুড়ি, চিড়া, দই, মিষ্টি, পিঠা। সেইসব খাবার খাওয়া আর সবার বাড়ীতে বেড়ানো হতো মেলার দিনে। ঈদের আনন্দের চেয়ে মেলার আনন্দ বেশী হতো। মেয়ে জামাই নাইওর আসতো মেলাতে। জামাই-এর দায়িত্ব ছিল বড় মাটির পাতিল (আমাদের অঞ্চলে বলে কোলা) ভরে ঝুরি-বুন্দিয়া সহ বিভিন্ন শুকনো খাবার মেলা থেকে কিনতে হবে শ্বশুড়বাড়ীর জন্য। সেই খাবার শ্বাশুড়ী আবার বিলিয়ে দিতেন আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে। আমাদের ছোটবেলায় পহেলা বৈশাখ নিয়ে কোন আনন্দ উৎসব ছিল না, তাই আমার স্মৃতিতে নেই। স্মৃতিতে আছে শুধু হালখাতার আনন্দ দেখা। দাদার সাথে যেতাম সে আনন্দে শরিক হতে। আজ স্মৃতিগুলো ধিরে ধিরে ঝাপসা হয়ে আসছে!দিনে দিনে বড় হয়ে উঠেছে অতীত আর ছোট হয়ে আসছে জীবন!




ছবিঃ গুলো গুগোল থেকে নেওয়া।


ঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃ
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুলাই, ২০২০ রাত ১২:৩৩
২৮টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×