ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলাম। এশিয়া কাপে বাংলাদেশ শ্রীলংকার মধ্যকার টি-২০ খেলা চলছে। বাড়ির কাছেই বাজারে গেলাম খেলা দেখতে। ভাবলাম অনেক মানুষ মিলে খেলা না দেখলে কী জমে। চাচাতো ভাই লাবু সহ বাজারে আলামিনের চায়ের দোকানে খেলা দেখতে বসলাম। মুহুর্তেই জমে গেল বিশাল ভীড়। অনেকে দাঁড়িয়েই খেলা দেখছে। দ্রুত দুটি উইকেট পড়ে গেলেও সাব্বির বেশ দ্রুতলয়ে রান তুলছিল। হাততালি আর উল্লাসে পুরো দোকানটা সরগরম হয়ে আছে। এর মধ্যে একটা জিনিস খেয়াল করে ভালো লাগলো যে ছেলে-বুড়ো সবাই এখন আগের চেয়েও আরো ভালো বুঝতে পারছে খেলাটা। এই যেমন কোন বোলারকে একটু রয়েসয়ে খেলতে হবে, কার বলে রানের গতিটা বাড়িয়ে নিতে হবে। দেখলাম যে, প্রতিটি ওভারে এমনকি কটা ডট বল হচ্ছে কিংবা কত রান হবে সেটাও সবাই আলোচনা করছে। খেলা দেখার জন্য একজন ক্রিকেটপ্রেমীর এর চেয়ে ভালো পরিবেশ আর কি চাই। খুব মন আনন্দের সঙ্গেই বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের অংশটুকু দেখে ফেল্লাম। ব্যাটিং শেষে ছোটোভাই লাবুকে খেলা দেখার পরিবেশ নিয়ে মুগ্ধতার কথাটা বলেই ফেল্লাম। কিন্তু তারপরই সে যা বলল তা শুনে আমি তো পুরোপুরি থ মেরে গেলাম। দেখলাম খেলা শেষ হওয়া মাত্র দর্শকদের বড় একটা অংশ একসঙ্গে দোকান থেকে হাওয়া। ভাবলাম সব এদিক ওদিক গেছে বোধহয়। কিন্তু লাবু বলল, তারা সবাই পাশে কলেজের মাঠে গেছে বাজি ধরতে। জিজ্ঞেস করলাম কিসের বাজি? বলল প্রতি ওভারে কতটা ডট বল হবে, কে কয়টা উইকেট পাবে, সবচেয়ে বেশি রান কে করবে এমনকি কে কত রেঞ্জের মধ্যে রান করবে সেটা নিয়েও বাজি হয় এখানে। দৈনিক গড় লেনদেন হাজার বিশেক টাকা। বাজি ধরে বেশিরভাগই উঠতি বয়সী স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ছেলেরা। তবে যুবক বয়সী এমনকি আধুবড়োরাও রয়েছে এই বাজিকরের তালিকায়। এরাই নাকি বড় বড় অঙ্কের বাজি ধরে। কথাটা শুনে বিশ্বাস হতে চায়নি। আমি নিজেই দেখতে গেলাম আসলে হচ্ছেটা কী? গিয়ে দেখি কথা সত্য। ক্রিকেট নিয়েই বাজি হচ্ছে এবং সেটা রীতিমতো আগাম টাকা জমা দিয়েই। মনে হলো মাথার মধ্যে আকাশ ভেঙে পড়লো। এতদিন ক্রিকেটে বাজিকরদের কালো থাবা নিয়ে আমরা ভারতীয়দের গালিগালাজ করে এসেছি। অথচ এই ক্যান্সার যে আমাদের দেশে বাসা বেধে পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানের দর্শকদের মাঝেও ছড়িয়ে গেছে তা জানা ছিল না।
আমি তারপরও ভাবলাম এটা দুয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতে পারে। পরে খবর নিয়ে জানতে পালাম, রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচশ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত ঠাকুরগাঁও জেলার অনেক গ্রামেই চলছে ক্রিকেট নিয়ে এই বাজির কালো খেলা। পরের দিন বিষয়টা নিয়ে কথা বললাম আমার এক দুরসম্পর্কের মামার সঙ্গে। বয়সে আমার চেয়ে বছর তিনেকের বড়। দুই সন্তানের বাবা। পেশা কৃষি এবং সঙ্গে কিছু ব্যবসাও আছে। তিনি খুব গর্বের সঙ্গে বাজারে আমাকে বল্লেন মামা মিষ্টি খাও। মাতৃকূলের আত্মীয় মিষ্টি খেতে আহ্বান করেছেন, ফেলে তো দেওয়া যায় না! খেলাম দুটো মিষ্টি। তিনি বল্লেন কালকে রাতে বাংলাদেশের খেলায় হাজার টাকা জিতেছি মামু, খুশিতে তোমারে মিষ্টি খাওয়াইলাম। আমিও মওকা বুঝে আলাপ জমালাম। তিনিও গড়গড় করে এই বাজি নামক জুয়ার অনেক তথ্যই দিলেন। তার কাছে জানলাম তাদের গ্রামে বাংলাদেশ দল শুধু না, বিপিএল, আইপিএল এমনকি বিগব্যশসহ সব ধরনের ক্রিকেট, যেগুলো টিভিতে সম্প্রচারিত হয় সেগুলো নিয়ে বাজি ধরা হয়। তাদের পাড়ার মোড়ের দোকানে এক এক দিন ক্রিকেট খেলার সময় কম করে হলেও দশ হাজার টাকা বাজি ধরা হয়। তিনি খুব গর্ব করে বর্ননা করলেন গতরাতে কিভাবে তার লাভ এতগুলো টাকা লাভ হলো। তার ভাষায়, "মামা বুঝতে হইবো তো বলটা কিরম। না বুইঝা হাকাউ বাজি ধরলে তো লস। আগে বলের মুভমেন্ট বুঝতে হইবো আর ব্যাটটা কিরহম চলতাইছে তাও বুঝা লাগবো। তাইলেই না বাজি ধইরা লাভ হইবো।" তিনি আরো জানালেন আমার মায়ের আপন ছোটভাই অর্থাৎ আমার ছোটোমামা গতরাতে পাঁচ'শ টাকা হেরেছেন। তখন বুঝলাম গত কয়েকদিনে আমার মামা ক্রিকেট নিয়ে হঠাৎ এত আগ্রহ কেন দেখাচ্ছিলেন। যে লোক আগে ক্রিকেট খেলায় গোল হয় কীভাবে সেই প্রশ্ন করত সে এখন কেন হঠাৎ শ্রীলংকা দলের বোলার রঙ্গনা হেরাথের খেলা বিশ্লেষন করে সেটা আমি তখন বুঝতে পারলাম।
ক্রিকটে খেলাটা নিয়ে তার এই আগ্রহ এবং উত্তেজনা সৃষ্টি এই দেশের আর বাকি ক্রিকটেপ্রেমীদের মধ্যেও। ক্রীড়ামোদি এই দর্শকরাই এই দেশের ক্রিকটের সবচেয়ে বড় সম্পদ বলে বিবেচিত হয়েছে। এর কারনেই ক্রিকেট বাণিজ্য সহ ক্রিকেট খেলাটির ব্যাপক সম্প্রসারন হয়েছে এই দেশে। কিন্তু প্রতিটি জিনিসের ভালো মন্দ উভয় দিক রয়েছে। বাড়তি এই আগ্রহ যদি আমার এই মামার মত আমার গাঁয়ের এই ছেলেগুলোর মত বাজি ধরার জন্য হয় তাহলে বলতে হবে এটা এই দেশের ক্রিকটের জন্য বড় একটা অশনিসংকেত। এই বাজি এখন পাড়ায় পাড়ায় চায়ের দোকানে চলছে। লেনদেনের হার ২০ হাজার থেকে পঞ্চাশে সীমাবদ্ধ আছে কিন্তু কয়েকদিন পর এটা থাকবে না। একগ্রাম থেকে দুই. চার দশ গ্রাম হতে সময় লাগবে না। হয়তো ভালো করে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, আরো ছড়িয়ে গেছে। এরপর যেটা হবে সেটা হল, দশগ্রামের বাজিকররা মিলে একটু সংগঠিত হতে পারলে এটা প্রাতিষ্ঠানিক রুপ ধারন করবে। এই বাজির বীজ এরই মধ্যে আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন শুধু একটু উপযুক্ত সংগঠক আর কাঠামো গড়ে ওঠার অপেক্ষা। হয়তো ব্যবসা করে টাকা করার ধান্দা থাকলে নিজেই লেগে পড়তাম। খুব কম সময়ে কোটিপতি হওয়ার জন্য বাংলাদেশে এর চেয়ে উপযুক্ত ব্যবসার পরিবেশ আর হয় না। আরেকটি ব্যাপার আমাদের মাথায় রাখতে হবে। আমাদের দেশে মোবাইল ইন্টারনেট এবং মোবাইল ব্যাংকিং যে হারে প্রসার লাভ করেছে ক্রিকেটে বাজি ধরার এই প্রবণতা যদি অনলাইনে কোনো একটা কাঠামোত দাঁড়িয়ে যায় সেটি কিন্তু দাবানলের চেয়েও দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হবে আমাদের দেশের সমাজ-কাঠামো। এমনিতেই সমাজে নীতি নৈতিকতা আর মুল্যবোধ পড়তির দিকে। তার মধ্যে ক্রিকেটের মত জনপ্রিয় খেলাকে ঘিরে বাজিকরদের এই ব্যবসা যদি ছড়িয়ে পড়ে তাহলে আর সত্যিকার অর্থেই রক্ষে থাকবে না।
ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশ এখনো উদীয়মান শক্তি। এই দেশের ক্রিকেট এখনো একটু একটু করে শক্তি সঞ্চয় করছে। এই অগ্রযাত্রায় ক্রিকেট বাজি কতটা খারাপ প্রভাব ফেলবে তার কথা চিন্তা করতে গেলে সত্যিই শিউরে উঠতে হয়। এরই মধ্যে আমরা ক্রিকেট বাজি বা ম্যাচ ফিক্সিংয়ের কারনে হারিয়েছি তর্কযুক্তভাবে এই দেশের ক্রিকেটে সেরা ব্যাটসম্যান আশরাফুলকে। যতদুর জানা গেছে, আশরাফুলকে বেপথে চালনার পেছনে রয়েছে ভারতীয় বাজিকররা। কিন্তু এই বাজিককরা যদি বাংলাদেশেই তৎপর হন। তারা যদি হন আমার মামা কিংবা আপনার ভাই, তখন ব্যাপারটা কি দাঁড়াবে একবার ভেবে দেখেছেন কখনো? জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের কতভাবে সামলে রাখবেন? কোনো না কোনোভাবে এই বাজিকরদের কালো হাত নাগাল পেয়ে যাবেই তাদের। এরপর আছে ঘরোয়া ক্রিকেট এবং বয়সভিত্তিক দলগুলো। এখন আমাদের জাতীয় ক্রিকটে লীগ এমনকি ঢাকা লীগের ম্যাচও টেলিভিশনে দেখানো হয়। সামনে দেশে নিজস্ব একটি ক্রীড়া চ্যানেল আসবে শুনছি। সেটা এলে ঘরোয়া ক্রিকটের সম্প্রচারর আরো বাড়বে। আর এসব ম্যাচকে ঘিরে বাড়বে ক্রিকেটের অন্ধকার জগতের তৎপরতা। শতকোটি টাকার লেনদেন হবে এক একটা ম্যাচে। অবক্ষয় হবে ঘরোয়া ক্রিকটের। তার প্রভাব পড়বে জাতীয় দলের ওপর। ক্ষতিগ্রস্থ হবে ষোলকোটি বাঙালিকে আবেগে ভাসিয়ে আবার ঐক্যবদ্ধ করবার একমাত্র শক্তি ক্রিকেট। দুর্বল হয়ে যাবে বেঙ্গল টাইগারদের এক একটা থাবা। আমাদের দিকে আঙুল তুলবে বিশ্ববাসী।
এই ভয়াবহ পরিণতি ঠেকাতে আমাদের সমাজের সবাইকে সেচতন হতে হবে। বিশেষত ক্রিকেট নিয়ে যে কোনো ধরনের বাজি ধরাকে নিরুৎসাহিত করে জাতীয় গণমাধ্যমে প্রচারণা চালাতে হবে। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদেরও আছে অনেক কিছু করার। তবে বড়সড় উদ্যোগটা বিসিবি এবং দেশের ক্রীড়া প্রশাসনকেই নিতে হবে। তা না হলে এই বাজিকরদের কালো হাত বড় হতেই থাকবে এবং একবার বড় আকারে সংগঠিত হয়ে গেলে এর মাশুল গুনে হারাতে হবে আগামী দিনের অনেক আশরাফুলকে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৩৬