মাইকের অপব্যবহার (১ম পর্ব)
২। এখানে ব্যাপারটি শুধু এই ছিল না যে, হযরত আয়েশা রাঃ তাঁর কষ্টের প্রতিবিধান চাচ্ছিলেন। মূলত তিনি ইসলামি সমাজের এই মূলনীতিটিকে পরিস্কার ও প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছিলেন যে, কারও দ্বারা কেউ যেন কষ্ট না পায়। সাথে সাথে তিনি দ্বীনের দাওয়াত ও তাবলীগের গাম্ভীর্যপূর্ণ পদ্ধতি কি তাও ব্যক্ত করতে চাচ্ছিলেন। ইমাম আহমাদ রহঃ তাঁর প্রণীত মুসনাদে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন যে, একদা উম্মুল মুমিনীন যে, হযরত আয়েশা রাঃ পবিত্র মদিনায় একজন বক্তার জন্য ওয়াজ ও তাবলীগের আদব কায়দা সবিস্তারে আলোচনা করেন। তার মধ্যে তিনি এ কথাও বলেন, “নিজের আওয়াজকে তোমর মজলিসে উপবিষ্ট লোকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখ এবং তাদেরকেও ততক্ষণ পর্যন্ত দ্বীনের কথা শোনাও, যতক্ষণ তাদের মুখমন্ডল তোমার দিকে ফেরানো থাকে। তারা মুখ ঘুরিয়ে নিলে তুমিও কথা বন্ধ করে দাও.... এমন যেন কখনও না হয় যে, মানুষ পরস্পরে কথা বলছে, আর তুমি তাদের কথার মধ্যে কথা বলতে আরাম্ভ করছো। এমতাবস্থায় তুমি চুপ হয়ে যাবে। তারপর তারা আবেদন করলে তাদেরকে দ্বীনের কথা শোনাবে” -মাজমাউজ যাওয়ায়েদ ১/১৯১
৩। হযরত আতাহ ইবনে আবি রাবাহ রহঃ উচু স্তরের একজন তাবেঈ ছিলেন। তাফসির ও হাদীস শাস্ত্রে তাঁর ব্যূৎপত্তি সর্বজন স্বীকৃত। তিনি বলেছেন, ‘আলিমের উচিত তার শব্দ যেন তার মজলিস অতিক্রম না করে’। (আদাবুল ইমলা ওয়াল ইস্তিমলা, সামআনি কর্তৃক প্রণীত পৃঃ ৫)
৪। উপরোক্ত আদব সমূহ মূলত মহানবী সাল্লুল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় কথা ও কর্ম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা – একবার মহানবী সাল্লুল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত উমর ফারুক রাঃ এর নিকট দিয়ে অতিক্রম করেন। তিনি তখন তাহাজ্জুদ নামাজে উচ্চস্বরে কোরাআন তিলাওয়াত করছিলেন। তখন হুজুর পাক সাল্লুল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিকট উচ্চস্বরে কোরাআন তিলাওয়াত করার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। হযরত উমর রাঃ উত্তরে বলেন- আমি ঘুমন্তদেরকে জাগাই আর শয়তানকে ভাগাই। তখন হুজুর সাল্লুল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বললেন, তোমার আওয়াজকে আরেকটু খাটো করো। (মেশকাত ১/১০৭)
এছাড়া হযরত আয়েশা রাঃ হতে বর্ণিত আছে যে, মহানবী সাল্লুল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাহাজ্জুদের জন্য জাগ্রত হতেন তখন অতি আস্তে বিছানা থেকে উঠতেন। (যেন নিদ্রিতদের নিদ্রার ব্যাঘাত না হয়)
৫। এ সমস্ত হাদীস ও বর্ননার আলোকে উম্মাহর সকল ফকীহ এ ব্যাপারে একমত যে, তাহাজ্জুদ নামাজে এত উচুঁ স্বরে কোরআন তেলাওয়াত করা, যার দ্বারা অন্যের ঘুমের ব্যাঘাত হয় মোটেও যায়েজ নেই। ফকীহগন লিখেছেন, কোন ব্যাক্তি যদি তার বাড়ির ছাদে এমন সময় উচ্চস্বরে কোরআন তেলাওয়াত করে, যখন মানুষ ঘুমাচ্ছে, তাহলে তেলাওয়াতকারী গোনাহগার হবে। (খোলাছাতুল ফাতওয়া ১/১০৩; শামী ১/৪০৩ ও ৪৪৪)
একবার এক ব্যাক্তি ইস্তিফতার আকারে (ফতোয়া বিভাগে সমাধান চেয়ে) এই প্রশ্নটি করেছিল যে, কতক মসজিদে তারাবীর নামাজে মাইকে এত উচ্চস্বরে কুরআন পড়া হয় যে, মহল্লার মহিলাদের জন্য নামাজ পড়া কঠিন হয়ে যায় এবং যে সমস্ত অসুস্থ ও দুর্বল লোকের রোগের কারণে তাড়াতাড়ি ঘুমানো প্রয়োজন, তারা ঘুমাতে পারে না। তাছাড়া বাইরের লোকেরা পবিত্র কুরআনের আদব রক্ষা করে তেলাওয়াত শুনতে পারে না। অনেক সময় এমনও হয় যে, তেলাওয়াতের মাঝে সিজদার আয়াত এসে যাওয়ায় শ্রোতাদের উপর সিজদাহ ওয়াজিব হয়ে যায়, অথচ সিজদার আয়াত বলে অনেকে বুঝতেই পারেনা, কিংবা বুঝতে পারলেও উযূ না থাকার কারণে সিজদা করতে পারে নাএবং পরবর্তীতে ভূলে যায়। এমতাবস্থায় তারাবীর নামাজে , বাইরের মাইক জোরে চালিয়ে কুরআন তেলাওয়াত করা শরীয়তে জায়েজ আছে কি?
প্রশ্নটি বিভিন্ন আলিমের নিকট পাঠিয়ে দেয়া হয়। সবাই সর্বসম্মতভাবে এই উত্তর দেন যে, এমতাবস্থায় বিনা প্রয়োজনে বাইরের মাইক জোরে চালিয়ে তারাবীতে কুরআন তেলাওয়াত করা শরীয়তে জায়েজ নেই। ফতোয়াটি ‘মাসিক আল বালাগের’ মুহাররম ১৪০৭ হিজরি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। বাস্তবেও এটি কোন বিতর্কিত মাসআলা নয়। সকল দল ও মতের উলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত। সম্মুখে পবিত্র রমজান মাস আরাম্ভ হতে যাচ্ছে । এ মাসটি আমাদের নিকট কঠোরভাবে শরীয়তের বিধান পালনের দাবী জানায়। রমজান মাস ইবাদতের মাস। এ মাসে যত অধিক হারে নামাজ, তেলাওয়াত ও জিকির হবে ততই ভালো। তবে আমাদেরকে সমস্ত ইবাদত এমন পন্থায় সম্পাদন করা উচিত, যেন এতে করে কারো কষ্ট না হয় এবং অবৈধ পন্থা অবলম্বন করার কারণে ইবাদতের সওয়াব নষ্ট না হয়। শুধুমাত্র প্রয়োজন পরিমান মাইক ব্যবহার করবে। এর অধিক নয়।
উপরোক্ত আলোচনার আলোকে অনুমান করা যায় যে, শরীয়ত অন্যকে কষ্ট দেয়া পরিহার করতে কি পরিমান গুরুত্ব দিয়েছে। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত এবং ওয়াজ নসিহতের মত পবিত্র কাজেও যখন শরীয়তের এই নির্দেশ যে, প্রয়োজনের অধিক এ সবের আওয়াজও বাড়ানো যাবেনা, তাহলে গান বাদ্য ও অন্যান্য অসার ও হারাম বিষয় সম্পর্কে নিজেই অনুমান করে দেখুন যে, এগুলোতে মাইক ব্যবহার করা কত বেশী গোনাহর ব্যাপার।
লেখক- মুফতী মুহাম্মদ তাকী উসমানী
অনুবাদ- মাওলানা জালাল উদ্দিন