somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘আসুন, লেজ টেনে ধরি...’

১৭ ই মে, ২০২২ রাত ২:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


[ক]
জাং (جنگ) শব্দটি মধ্য ফার্সি (yng, jnng, ǰang) থেকে উৎপত্তি। এর অর্থ সংগ্রাম, লড়াই, যুদ্ধ ইত্যাদি। যেমন– ফার্সিতে গৃহযুদ্ধকে ‘জং-ই দাক্সেলি’ বলা হয়। জাং শব্দটি বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্নভাবে স্থান পেয়েছে। যেমন–
→ গুজরাটি: જંગ (jang) যুদ্ধ।
→ অটোমান তুর্কি: جنك(jank) যুদ্ধ।
→ তুর্কি: Cenk (jang) যুদ্ধ।
→ তাজিক: ҷанг (jang) যুদ্ধ।
→ উর্দু: جنگ (jang) যুদ্ধ।
ব্যুৎপত্তিগত বিচারে ‘জঙ্গ’ থেকেই জঙ্গি শব্দের উদ্ভব। সে হিসেবে ‘জঙ্গি’ অর্থ সাধারণভাবে যোদ্ধা বা লড়াকু। প্রয়োগিক অর্থে এটি ১৫ শতকের ল্যাটিন ‘যোদ্ধা’ থেকে এসেছে। যার অর্থ ‘সৈনিক হিসাবে কাজ করা’। [তথ্যসূত্রঃ MacKenzie, DN (1971), অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, পৃষ্ঠা 46]

শাব্দিক বা রূপক ভাবে যোদ্ধা, সৈনিক বা যুদ্ধে ব্যবহৃত বস্তু বুঝাতে জঙ্গ বা জঙ্গি শব্দগুলো ব্যবহৃত হতো। ইতিবাচক কারণের জন্য লড়াই করলে সবাই জঙ্গি। কেউ যদি দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে তবে সে-ও একজন জঙ্গি বা সৈনিক। কেউ যদি দেশের জন্য লড়াই করে, সেও একজন সৈনিক বা জঙ্গি। আভিধানিক বা ব্যবহারিকভাবে এগুলি নিন্দনীয় বা খারাপ অর্থেও ব্যবহৃত হতো না। যেমন–

১। বৃটিশ ইন্ডিয়ার কমান্ডার ইন চিফকে ‘জঙ্গিলাট’ (জঙ্গি+Lord) বলা হতো।” [শ্রী শৈলেন্দ বিশ্বাস, সংসদ বাংলা-ইংরেজি অভিধান। পৃঃ ৪৬২।]

২। খ্রিস্টানরা তাদের গির্জা বা চার্চের সদস্যদের জঙ্গি (সৈনিক) বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ মনে করেন। যেমন– “খ্রিস্টান চার্চ জঙ্গিদের উদ্দেশ্য হল– পাপ, শয়তান ও এই বিশ্বের অন্ধকারের শাসক, উচ্চক্ষেত্রে আত্মিক অধঃপতন-এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা।” [এফিসিয়ান্স ৬ঃ১২]

৩। অঘোষিত বা গেরিলা যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে, শত্রু যোদ্ধাদের প্রায়ই সৈন্য হিশেবে নয় বরং জঙ্গি হিসাবে উল্লেখ করা হয়, কারণ তারা একটি আনুষ্ঠানিক সেনাবাহিনীর সদস্য নয়। গেরিলা যোদ্ধা হলেন একজন অর্ধসামরিক বা সশস্ত্র বেসামরিক ব্যক্তি যে একটি ছোট দলের অংশ হিসেবে একটি বড়ো সরকারী সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করে। গেরিলারা সশস্ত্র বেসামরিক বাহিনী হয়েও নাশকতা বা ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি, অভিযান ও আড়ালে আবডালে থেকে ক্ষুদ্র যুদ্ধ, হিট-এন্ড-রান কৌশল এবং গতিশীলতা সহ বিভিন্ন সামরিক কৌশল ব্যবহার করে থাকেন। আমাদের ৭১এর সংগ্রামী দেশপ্রেমি গেরিলা বাহিনীরা জঙ্গি (চতুর সৈনিক) হিশেবে পরিচিত, সন্ত্রাসী হিশেবে নয়।

৪। আকাশপথে যুদ্ধের নিমিত্তে যে বিমানগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলোকে বলা হয় (a fighter-plane) জঙ্গি বিমান। আবার পানিপথে যুদ্ধের জন্য যে জাহাজগুলো ব্যবহার হতো সেগুলোকে বলা হয় (a battle ship) জঙ্গি জাহাজ। জঙ্গি শব্দ যদি সন্ত্রাসী অর্থে ব্যবহৃত হয় তবে বিমান বা জাহাজগুলো হয়ে যায় সন্ত্রাসী বিমান বা জাহাজ অথবা জঙ্গি বাদ দিয়ে সেগুলোর অন্য নামকরণ করতে হয়।

৫। আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) এর পিতার নাম ছিল আবু ছালেহ জঙ্গি মুছা। ইতিহাস বলে তিনি উচ্চ স্তরের আল্লাহর ওলি ছিলেন। এমন ব্যক্তিকে সন্ত্রাসী বলা যায় কি?

৬। নুরুদ্দিন জঙ্গি রহঃ আরবের একজন ধার্মিক বাদশাহ ছিলেন। ৫৫৫ হিজরিতে আল্লাহ তায়ালা স্বপ্নযোগে তাঁকে নবীজির লাশ চুরির চক্রান্তকারীদের চেহারা হুবহু চিনহিত করে দিলেন। অতঃপর তিনি আল্লাহর রহমতে সকল চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিলেন। এ হেন ব্যক্তি সন্ত্রাসী হতে পারে কি?

৭। Radical Feminism বা চরমপন্থী নারীবাদ। এদেরকে জঙ্গি নারীবাদ‌ও বলা হয়। এদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো সমাজের ভিত্তি পুনর্গঠন করা, যেখানে পুরুষের আধিপত্যকে সমস্ত সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে নির্মূল করা হয়। সাধারণত চরমপন্থী নারীবাদীরা সমাজে চলা পুরুষতন্ত্রবাদের শেকড় তুলে ফেলার জন্য তীব্র এবং সহিংস আন্দোলন গড়ে তুলে থাকেন। [Willis, Ellen (১৯৮৪)। "Radical Feminism and Feminist Radicalism"। Social Text (9/10)]
তাহলে পশ্চিমাদের সৃষ্টি চরমপন্থী এই নারীবাদীদের সন্ত্রাসী তকমা দেওয়া-ই যেতে পারে, তাই না?

[খ]
Military ও Militant শব্দ দুটির উৎপত্তিস্থল এক‌ই এবং প্রায় পাশাপাশি অর্থ বহন করলেও প্রয়োগিক অর্থে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। যেমন–
Military অর্থ সামরিক, যুদ্ধনিরত, যুদ্ধপ্রিয়, সৈন্যবল, সংগ্রামী ইত্যাদি। Military বা সামরিক শব্দটি সাধারণত একটি রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী বোঝাতে একটি বিশেষ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সামরিক বাহিনী হলো একটি দেশকে সুরক্ষিত ও রক্ষা করার জন্য দায়ী সশস্ত্র বাহিনী।
আর Militant হলো জঙ্গি শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ। যার অর্থ যুদ্ধরত সৈনিক, বিদ্রোহী সৈনিক, সিপাহী, বিপ্লবী, সংগ্রামী এবং উদ্দেশ্য সাধনে আক্রমণাত্মক মনোভাবসম্পন্ন সৈনিক। অক্সফোর্ড ডিকশনারী অনুযায়ী– Militant (জঙ্গি) হলো: যে ব্যক্তি তার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য শক্তি বা জোরালো প্রভাব ব্যবহার করা সমর্থন করে।
এখানে মূল পার্থক্য হচ্ছে– Militant বা জঙ্গিরা আনুষ্ঠানিক Military বা সামরিক বাহিনীর সদস্য না হয়েও তাদের চেয়ে একধাপ এগিয়ে থাকা...। নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকা। এমনকি মিলিট্যান্টরা উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মিলিটারিদের সাথেও যুদ্ধ করতে দ্বিধাবোধ করে না। যেমন– ৭১এ মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী সামরিক বা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। এক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের দৃষ্টিতে ছিল Militant বা জঙ্গিবাহিনী কিংবা বিদ্রোহী সৈনিক। অর্থাৎ কারো কাছে এটা টিকে থাকার লাড়াই, স্বাধীনতার লড়াই, আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার লড়াই। আবার কারো কাছে সন্ত্রাসী কমকান্ড বা জঙ্গিবাদী কার্যকলাপ।

ম্যেরিয়াম ওয়েবস্টার কলেজিয়েট ডিকশনারী অনুযায়ী militant (জঙ্গি) হচ্ছে–
(1) Engaged in warfare or combat : fighting.
(2) Aggressively active (as in a cause).
অর্থাৎ: মিলিট্যান্ট (জঙ্গি): যুদ্ধ বা সম্মুখসমরে লিপ্ত ব্যক্তি, যুদ্ধরত। উগ্রভাবে সক্রিয়।’’ দ্বিতীয় অর্থটিকে আরো একটু ব্যাখ্যা করে মাইক্রোসফট এনকার্টা অভিধানে মিলিট্যান্ট বা জঙ্গি শব্দের অর্থে বলা হয়েছে: (aggressive: extremely active in the defense or support of a cause, often to the point of extremism): ‘‘আগ্রাসী, কোনো বিষয়ের পক্ষে বা সমর্থনে চরমভাবে সক্রিয়, যা প্রায়শ চরমপন্থা পর্যন্ত পৌঁছায়।’’

এ সকল অর্থ কোনোটিই সরাসরি বে-আইনী অপরাধ বুঝায় না। এ সকল অর্থে আমাদের দেশের সকল রাজনৈতিক, আদর্শিক, পেশাজীবি ও সামাজিক দলই ‘মিলিট্যান্ট’ বা ‘জঙ্গি’। কারণ সকলেই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য শক্তি বা ‘প্রেসার’ প্রয়োগ পছন্দ করেন এবং সকলেই তাদের নিজেদের আদর্শ ও স্বার্থ রক্ষায় বা প্রতিষ্ঠায় ‘উগ্রভাবে সক্রিয়’।

সুতরাং একতরফাভাবে নির্দিষ্ট একটা ধর্মের ব্যক্তিদেরকে নেতিবাচক (সন্ত্রাসী) অর্থে জঙ্গিবাদী তকমা দেওয়াটা অনাড়িপনা বৈ-কিছু নয়। গোমূর্খ অগাচণ্ডী বুদ্ধিজীবী এবং পশ্চিমাঘেঁষা মিডিয়ার প্রভাবে কোনো শব্দ যখন আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তখন প্রাজ্ঞ লোকদের উচিত নয় নির্বাক হয়ে বসে থাকা; বরং শব্দগুলোকে এদের হাত থেকে উদ্ধার করে শব্দের যথোচিত প্রয়োগ করা।

–“কাওছার হাবীব”
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০২২ রাত ২:৫৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তোমাকে লিখলাম প্রিয়

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০২ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০১


ছবি : নেট

আবার ফিরে আসি তোমাতে
আমার প্রকৃতি তুমি,
যার ভাঁজে আমার বসবাস,
প্রতিটি খাঁজে আমার নিশ্বাস,
আমার কবিতা তুমি,
যাকে বারবার পড়ি,
বারবার লিখি,
বারবার সাজাই নতুন ছন্দে,
অমিল গদ্যে, হাজার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

×