দৈনিক 'স্বপ্নভূমি'- পত্রিকাটি হাতে নিতেই দৃষ্টি গেল বড় বড় অক্ষরের হেডলাইনের দিকে- "হাত বাড়ালেই ইলিশ"। শিরোনামটি দেখে আগ্রহ নিয়ে পত্রিকার খবরটি পড়লাম। রিপোর্টারের ভাষায় গত সাত দিন থেকে ইলিশ উপচে পড়ছে কারওয়ান বাজারের আড়তগুলোতে। যেন ইলিশের পাহাড় জমে পর্বত হয়ে গেছে। এভারেস্টের সমান ইলিশের স্তুপ! বিক্রেতারা বিপুল পরিমান ইলিশের ঠেলা সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে। বাসা-বাড়িতে গিয়ে বউ-বাচ্চার মুখটি দেখার ফুরসৎ পর্যন্ত নেই। খাওয়া-মুতা পর্যন্ত বাদ দিয়ে বঙ্গোপসাগরের ইলিশ নিয়ে মহা ব্যস্ততা। হাজার হোক জাতীয় মাছ বলে কথা। এলাহি কাণ্ড!!
অনেকটা রোহিঙ্গাদের মতো; যেন আসতে আসতে নেই কোন শেষ। যত দূর চোখ যায় শুধু ইলিশ আর ইলিশ । ক্রেতারা মহা ধুমধামে ইলিশ কিনছেন। সাথে বউ-শ্বাশুড়ি-শালা-বিয়াই সব। এ যেন 'ইন্টারন্যাশনাল হিলসা ফেস্টিভ্যাল'। এমন ফেস্টিভ সংবাদে উত্তেজিত হয়ে রকেট গতিতে খবরটি শেষ করতে মনোনিবেশ করলাম। অনেক দিন পর মনের মতো একটি নিউজ পত্রিকা ছাপা করছে। পত্রিকার রিপোর্টার সহ সংশ্লিষ্ট চৌদ্দগোষ্টীকে ধন্যবাদ দিলাম।
রিপোর্টে আরো দেখলাম এই মৌসুমে নাকি (২০১৯) ইলিশের উৎপাদন ২৫% বৃদ্ধি পাবে। গত মৌসুমে ইলিশের উৎপাদন হয়েছিল ৪ লাখ মেট্রিক টনের বেশি। এবার তা হতে পারে পাঁচ লাখ মেট্রিক টনের কাছাকাছি। বাপরে বাপ! এক বছরেই একলাখ মেট্রিকটন বাড়তি! আহ্ শান্তি পেলাম। এমনটিই তো চা-ই-। মৎস্য অধিদপ্তরের মতে এবার বর্ষা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় এবং পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদীতে প্রচুর স্রোত থাকায় ইলিশ সাগর থেকে নদীতে উঠে আসতে পারছে না। এজন্য বাজারে অন্যান্য বারের তুলনায় ইলিশের যোগান তুলনামূলক ভাবে কম। তবে এ সমস্যা বেশিদিন থাকবে না, অল্প কিছুদিন পর থেকে শুরু হবে ইলিশ ধরার মহোৎসব! তখন নাকি পানির দামে ইলিশ মিলবে!!
যেইমাত্র পড়া শেষ, সঙ্গে গিন্নিকে নিয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে দিলাম ছুট। সাথে বড় বড় দু'টি চটের বস্তা। বলা তো যায় না হালি যদি শ'টাকা হয় তাহলে দুই-চার ডজন আনা যাবে। একটা সিএনজি নিয়ে সোজা কারওয়ান বাজার। দোয়া পড়তে লাগলাম যাতে যোগানের অভাবে সস্তা দামে ইলিশ কেনা থেকে বঞ্চিত না হই। বাজারে গিয়ে তো আক্কেল গুড়ুম অবস্থা, দোকানদার এক কেজি ওজনের একটি ইলিশের দাম চাচ্ছে দুই হাজার পাঁচশো থেকে তিন হাজার টাকা। হ্যা, তি-ন-হা-জা-র টাকা মাত্র! ইঁদুর কপাল আমার!!
সারা বাজার ঘুরে ঘুরে দেখলাম একই অবস্থা। অবশেষে ইলিশ কিনতে না পেরে নিজেকে সান্তনা দিলাম, এখনো দাম আমার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে না আসলেও পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী শীঘ্রই দাম কমবে, তখন অবশ্যই কিনতে পারবো! গিন্নিকে বোঝালাম- দেখো, ইলিশগুলো দেখতে এক্কেবারে জাটকার/পিচ্চি সাইজ! এতো ছোট ইলিশের পোনা কিনা ঠিক হবে না; এগুলো ধরা/বিক্রি করা যেমন অন্যায় ক্রয় করাও ঠিক তাই। টেলিভিশনে দেখোনি? জাটকা মারা ও বিক্রয় করা আইনত দন্ডনীয়। সুবিধা হলো আমার গিন্নি জাটকার সাইজ কত বড় পর্যন্ত হয় সে বিষয়ে ওয়াকিবহাল না হওয়ায় ম্যানেজ করতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। বেচারীর মুখটা কেমন যেন কালবৈশাখী সাজের মতো হয়ে গেল। তবে প্রতিবাদ ছাড়াই মেনে নিল।
কিন্তু না পরের দুই মাসেও ঝাটকাগুলো ইলিশে ট্রেন্সফার হয়নি। সস্তায় ইলিশ কেনার খায়েশ মিটে গেল, অদূর ভবিষ্যতে সে সম্ভাবনাও নেই। তারপরও সপ্তাহে দুইদিন করে কারওয়ান বাজারে যেতাম। অনেকটা মনকে সান্তনা দেওয়ার খাতিরে। যদি অল্প দামে আলাদীনের চেরাগ জোটে! প্রতিদিন পত্রিকার রিপোর্টের কোন আলামত না পেয়ে ফিরে আসতাম। গিন্নি প্রতিদিন আগ্রহ নিয়ে দরজা খুলতো, তবে আমার ঝড়ো কাক মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতো না।
স্বাদ, ঘ্রাণ আর রূপ-লাবণ্যের জন্য চাঁদপুরী ইলিশের চাহিদা ব্যাপক। এজন্য মাছের বাজারে গেলে বিরস বদনে চাঁদনী সুন্দরীদের রূপ-লাবণ্য একটি বারের জন্য হলেও দেখে আসি। অনেক মায়া হয়! ডিম ওয়ালা রূপালী সুন্দরীরাই আমার ফেভারিট। মাছের আন্ডা ভাজি এই অধমের ভীষণ প্রিয়। অবস্থা সম্পন্ন বাসা/বাড়ির সামনে দিয়ে গেলে ইলিশের কড়া ঘ্রাণে যখন অন্তরটা জুড়িয়ে যায় তখন নিজেকে সান্তনা দিয়ে দমিয়ে রাখতে বড়ই কষ্ট হয়। রন্ধন শিল্পীকে নিষ্টুর আর বেরসিক মনে হয়। এই ঘ্রাণ প্রহসনের!
সরষে ইলিশ, ইলিশ পোলাও, ইলিশ কোফতা, ইলিশ কাসুন্দি, ইলিশ ভাজি, পটেটো ইলিশ ইত্যাদি কত পদের রেসিপি আছে আঙুলে গোনে শেষ করা যাবে না। তবে 'নুডলস ইলিশ' নামের কোন রেসিপি আবিষ্কৃত হয়েছে কি না জানা নেই। পয়লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ সার্চ লাইট দিয়ে খুঁজলেও আসছে বছরগুলোতে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। তবে টাকা ওয়ালাদের টেনশনের কোন কারণ নেই। ইলিশ কোনদিন আপনাদের সাথে বিট্রে করবে না। প্রমিস!
পানতা নিয়ে থাকলে বসে
ইলিশ মাছের আশায়,
একটা ইলিশ পথ ভুলে কী
ঢুকবে আমার বাসায়?
কেষ্ট বলে, শুনছো কথা!
বলে কী মোর দুলায়,
এই বাজারে ইলিশ নিয়া
কেমনে মাথা ঘামায়?
থালায় নিয়ে রাখছি পুঁটি
উদযাপনের আশায়,
লও সবে বৈশাখী মোর
রাঙা নিমন্ত্রণের খাতায়,
খেজুর পাতার আসন পেতে
বসবো সবাই দাওয়ায়,
করবো ভাগ মহা আনন্দে
পুঁটি-পান্তার থালায়।।
ভরা মৌসুমে যদি এত দাম হয় তবে এ বছর হয়ত আর ইলিশ খাওয়া হবে না। যদিও এক-দুই কেজি ইলিশ কেনার সামর্থ আমার আছে, তারপরও এই দামে ইলিশ কিনব না। বলতে পারেন এটা আমার প্রতিবাদ। যৌক্তিক ভাবে এক কেজি ওজনের একটি ইলিশের দাম হওয়া উচিত ছিল ৩০০-৩৫০ টাকার মধ্যে। ইশিল ছাড়াও জীবন চলে, সান্তনা দিলাম নিজেকে। বাজারে ইলিশ বিক্রেতাদের আমার কাছে কেন যেন বনেদী বনেদী লাগে। একটু দামাদামী করলে বিরক্ত হয়, তাচ্ছিল্যের দৃষ্টতে তাকায়। নিজেকে বড়ই অসহায় মনে হয়। অপদার্থ!
হিসাব করে দেখলাম এক কেজি ইলিশের দামে প্রায় ৬০ কেজি ভাল মানের চাল পাওয়া যায়। ধানের বীজ উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারে চাল হিসাবে বিক্রি করা পর্যন্ত কতগুলো ধাপ পেরিয়ে আসতে হয়, এজন্য কৃষককে প্রচুর খাটতে হয়। অনেক টাকা-পয়সা খরছ করতে হয়, মাঝে মাঝে বন্যা-খরার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কিন্তু ইলিশ তো প্রাকৃতিক নিয়মে সমুদ্রে বড় হয়, ইলিশ পালতে তো খরছের প্রয়োজন পড়ে না। এর কোন মালিকানাও নেই।
তাহলে ষাট কেজি চালের দামে এক কেজি ইলিশ কিনতে হবে কেন?
আবার ইলিশ নদী বা সমুদ্রের কাছ থেকে কিনে আনতে হয় না, তাহলে এত দামের যৌক্তিকতা কোথায়? দামটা কি ন্যায়সঙ্গত? কোন্ অদৃশ্য শক্তির ছোয়ায় দাম এত বেশি তা আমার বোধগম্য হয় না। অর্থনীতিতে একটি কথা আছে; যেগান বাড়লে চাহিদা কমে, আবার যোগান কমলে চাহিদা বাড়ে। আবার দাম কমলে চাহিদা বাড়ে, দাম বাড়লে চাহিদা কমে। কিন্তু ইলিশের বেলায় হয়ত অর্থনীতির এ সূত্র খাটে না।
গত দুই-তিন বছর থেকে শুনতে পাচ্ছি দেশের চাহিদার কথা চিন্তা করে সরকার ইলিশ রপ্তানী বন্ধ করে দিয়েছেন। তাহলে প্রশ্ন হল এত বিপুল পরিমান ইলিশ কোথায় যায়? মঙ্গল গ্রহে তো এখনও মানব বসতি শুরু হয়নি। বিদ্যুতের মত সিস্টেম লসও হওয়ার কথা নয়। তাহলে কী এগুলো জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হচ্ছে? আশা করি সরকার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবেন। শুনেছি ইলিশ মাছ ডাঙায় তোলার অল্প কিছুক্ষণ পর নাকি মারা যায়। এমনও হতে পারে জেলে-পাইকার-আড়তদার হয়ে ভোক্তা পর্যন্ত আসতে আসতে ইলিশগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। বিষয়টি মোটেও অসম্ভব নয়! সম্ভব!!
লন্ডনের শেডওয়েলে বড়বড় মাছের দোকানগুলোতে বাংলাদেশী ইলিশ মাছ সারা বছর পাওয়া যায়। যতক্ষন দোকানগুলো খোলা থাকে ক্রেতাদের ভীড়ে জমজমাট থাকে। অনেকটা ঈদের শপিংয়ের মতো। আমি হিসাব করে পাইনা সারা বছর ধরে এত টাটকা ও বড় সাইজের ইলিশগুলো ইংল্যান্ডের বাজারে কোথা থেকে আসে? দামও তুলনামূলক কম। সারা বছর প্রায় সমান দাম থাকে।
আসলে সত্য কথা হল ভরা মৌসুমে ইলিশ ধরে দেশের ব্যবসায়ীরা বরফ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে রাখে। পরবর্তী সময়ে চাহিদা অনুযায়ী সারা বছর বেশী দামে বিভিন্ন দেশে পাচার করে থাকে। এজন্য ভরা মৌসুমেও বাংলাদেশের মানুষ ন্যায্য দামে ইলিশ কিনতে পারে না।
লন্ডনে এক কেজি ওজনের ইলিশেরর দাম পনেরো-বিশ পাউন্ড হলেও সেখানকার মানুষের ক্রয় ক্ষমতা আমাদের চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ বেশী। সেখানে একজন সাধারন চাকরিজীবির আয় মাসে এক লক্ষ টাকার বেশী। তারপর আছে সরকারী বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা। বাচ্চাদের জন্য ফ্রি স্কুল, সবার জন্য ফ্রি স্বাস্থ্যসেবা, যাদের বাড়ি নাই তাদের জন্য ফ্রি ঘরের ব্যবস্থা। আর আছে নগদ হিসাবে ইনকাম সাপোর্ট, ফ্যামেলি ক্রেডিট, চাইল্ড বেনিফিট ও বয়ষ্কদের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা ইত্যাদি।
বাবা-মা বয়ষ্ক হলে ঘর থেকে শুরু করে তাদের যাবতীয় খরছ সরকার প্রদান করে। এজন্য উপার্জনকারীদের বেতনের/আয়ের টাকা খরছ করতে হয় না। তাই বেশী দামে ইলিশ কেনা তাদের কাছে কোন ব্যাপার না।
আমাদের দেশে একজন মানুষের মাসে ৫০,০০০ টাকা বেতন হলেও মাস শেষে বাড়ি ভাড়া, ফ্যামেলি খরছ, বাচ্চাদের স্কুল-কলেজের ফি, চিকিৎসা ও ঔষধ খরছ এবং গরীব আত্মীয়-স্বজনদের কিছু সাহায্য-সহযোগিতার পর কর্তার হাতে যা অবশিষ্ট থাকে তা দিয়ে ইলিশ কেনার সামর্থ থাকার কথা নয়। ৩,০০০ টাকা কেজির ইলিশকে তখন তার কাছে ৩০,০০০ টাকা মনে হবে। তবে যাদের ডানে-বামে (কালো টাকা) ইনকাম আছে তাদের জন্য দাম কোন ব্যাপার না।
সরকারের কাছে আর্জি জাতীয় মাছ ইলিশকে জাতীয় জাদুঘরের ন্যায় একটি প্রদর্শনী কেন্দ্রে রেখে দেওয়া হোক। যাতে টিকেট কেটে আমাদের মত দরিদ্র মানুষ, যাদের ইলিশ কেনার সামর্থ্য নেই তারা দেখতে পারে। এতে সরকারের রাজস্ব আয়ও বৃদ্ধি পাবে। শিক্ষার্থীরা ছবি দেখে জাতীয় মাছ ইলিশ চিনতে পারবে। পেটের খিদে না মিটুক, চোখের খিদেটা মিটবে। আর বিদেশীরা বেড়াতে আসলে গর্ব করে বলতে পারবো,............ লেট সি, ইটস্ হিলসা। আওয়ার ন্যাশনাল ফিস।।
#রি-পোস্ট।
চাইলে পড়তে পারেন-
আমার সবচেয়ে পঠিত পোস্ট।
সবচেয়ে লাইকপ্রাপ্ত গল্প-ধূমকেতু
ধর্ষণ ও ধর্ষক (বাংলাদেশ/বহির্বিশ্ব)
অনুবাদ গল্প-(দি নেকলেস)
দি গিফট অফ দ্যা ম্যাজাই
গল্প লেখার সহজ পাঠ
সবচেয়ে পঠিত প্রবন্ধ।
আধুনিক কবিতার পাঠ (সমালোচনা)
আলোচিত ফিচার 'দি লাঞ্চিয়ন'।
ব্রিটেনের প্রবাস জীবন- স্মৃতিকথা।
সবচেয়ে পঠিত গল্প।
ছবি ব্লগ (লন্ডনের ডায়েরি-১)।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:২৪