"দেশে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে" কথাটি শুনলে মনের মণিকোঠায় অজান্তে ভেসে উঠে একজন লুঙ্গিকাঁচা মারা, ছেড়া গেঞ্জি পরা, হাতে চকচকে কাঁচি নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষকের প্রতিচ্ছবি। এটা চরম তৃপ্তিদায়ক, সুখের। এই নিষ্পাপ হাঁসিটাই বলে দেয় আগামী কয়েক মাস কৃষক পরিবারের পেট ভরে দু'বেলা খাওয়ার গ্যারান্টি আর শাকভাত-ডালভাত খাওয়ার আনন্দের হাতছানি। বাবা-মাকে ডাক্তার দেখানোর আশা। বউকে একটি রঙিন শাড়ি কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষার বিজয়ী হাঁসি, বাচ্চাদের স্কুলে পাঠিয়ে বইখাতা কিনে দিতে পারার আনন্দ, আত্মীয় পরিজনকে দাওয়াত করে বাড়িতে নিয়ে আসার বাসনা।
কৃষিপ্রধান এই দেশের শতকরা ৯০% মানুষ কোন না কোনো ভাবে কৃষক পরিবারের সাথে সম্পর্কীত। কৃষকরা স্যাটেলাইট দিয়ে ঘূর্ণিঝড় তাড়ানো হয় নাকি বোমা ফলানো হয় তার খবর রাখে না। বাংলাদেশের বিমানের নাম পালকি নাকি উল্কি তা জানে না। রোবট সুফিয়া কি বললো তার খবর রাখে না। তাদের একমাত্র চাওয়া গতর খাটিয়ে ঝড়-তুফানে, বন্যা-খরায় না খেয়ে ধানক্ষেত পাহারা দেওয়া, কাঙ্খিত দিন গোনা। এযে বড় আনন্দের।
গত দুইদিন আগে একটি পত্রিকায় পড়লাম এক কেজি ইলিশ কিনতে হলে দুই মন ধান বিক্রি করতে হয়! কৃষকরা তো কবে থেকেই অভিজাত ইলিশের গা ঘেষা বন্ধ করে দিয়েছেন। অথচ ফ্রিতে সমুদ্র/নদী থেকে পাওয়া ইলিশের এতো দাম! কৃষকরা দিনকে রাত করে মাথার ঘাম পায়ে ঠেকিয়ে, সুদ করে, ঋণ করে, গাঁটের পয়সা খরছ করে আমাদের পাতে ভাত তুলে দিচ্ছে তবুও নেই ন্যায্য দাম।
গত কয়দিনে পত্রিকায় কিছু খবর পড়ে যতটুকু না কষ্ট পেয়েছি তার চেয়ে বেশি আতঙ্কিত হয়েছি। শ্রমিকের অভাবে অনেক কৃষক নাকি তাদের জমির ধান ঘরে তুলতে পারছেন না। একজন কৃষককে তো দুঃখে নিজের ধানক্ষেতে আগুন লাগিয়ে দিতে দেখলাম। এ বিষয়গুলো খালি চোখে খুব হালকা-পাতলা মনে হলেও এর ব্যাপকতা ভয়াবহ! কৃষকরা এক বিঘা ধান চাষ করে যে শ্রম ও অর্থ খরছ করেন তা ধান বিক্রি করে উঠে না। এটা এখন চরম বাস্তবতা। এতে প্রতি বছর কৃষকরা লোকসান গুনছেন। এখন তাদের দেয়ালে পীঠ ঠেকে গেছে।
কৃষকরা এখন ধানের পরিবর্তে বিকল্প ফসল চাষ করছেন। এটা ভাল কথা। কিন্তু এই বিকল্প শস্য উৎপাদন আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেবে আগামী দিনগুলোতে। একটা সময় আসবে দেশ বিদেশি চালের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে; এটা শতভাগ ভাত খাওয়া জাতির জন্য মোটেও ভাল সংবাদ নয়। আমাদের গ্রামের অবস্থা সম্পন্ন পরিবারগুলো এখন আর ধান চাষ করে না; কারণ, ধান চাষ এখন আর লাভজনক শস্য নয়। শত শত একর জমি প্রতি বছর পড়ে থাকে কোন চাষবাস ছাড়া।
প্রতি বছর বাজেট আসলেই সিগারেটের দাম বাড়ে। অথচ চালের দাম সে অনুপাতে বাড়ে না। উত্তরবঙ্গের অনেক কৃষক এখন ধানের পরিবর্তে তামাক চাষে উদ্যোগী হচ্ছেন। এতে লাভের অংশটা বেশ ভারী। টোবাকো কোম্পানীগুলো নাকি অগ্রীম টাকা দেয়, কীটনাশক দেয়, সার দেয়ে। এছাড়া কৃষকদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় সহযোগিতা করে। একটা সময় যদি সারা দেশের কৃষকরা ধানের পরিবর্তে তামাকে উৎপাদনে মনযোগী হয় তবে আমি মোটেও অবাক হবো না। সারাদেশ তামাকে সয়লাব হবে। আমরা ভাতের পরিবর্তে সিগারেট খাব। ব্রিটিশ-আমেরিকান টোবাকোর মতো বেনিয়ারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাবে এদেশ থেকে। আর আমরা একটা গাঞ্জা খোর, বিড়িখোর জাতি হয়ে বিদেশি রিলিফ খেয়ে কোনমতে বেঁচে থাকবো।
সরকার কৃষকদের সার ও কীটনাশকে ভর্তুকী দিচ্ছেন। এটা অবশ্যই সাধুবাদ যোগ্য। কিন্তু কৃষককে বাঁচিয়ে রাখতে হলে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আরো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবী। না হলে আগামী কয়েক বছরে কৃষকরা ধান উৎপাদন বন্ধ করে দেবেন নিশ্চিত। এজন্য ধান উৎপাদনকারী কৃষক এবং তাদের কৃষি জমিগুলো চিহ্নিত করে প্রতি বছর ভর্তুকী দিতে হবে। এই টাকার অঙ্কটা একর প্রতি তিন হাজার-পাঁচ হাজার হতে পারে। প্রতি বছর বাজেটের একটি অংশ দিয়ে সরকারকে নিজ উদ্যোগে 'কৃষিবীমা' করতে হবে। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি দূর্যোগে যাতে কৃষকরা বাঁচতে পারে। আধুনিক কৃষি সরঞ্জাম অল্প দামে কৃষকদের কাছে পৌছে দিতে হবে।
সরকার এ বিষয়ে সচেতন হলে কৃষক বাঁচবে, আর কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে।।
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১৯ ভোর ৪:০৮