আজ পহেলা মে, মহান মে দিবস। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিবস। সব বঞ্চনা, নির্যাতন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সংগ্রাম আর অধিকার আদায়ের রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত গৌরবময় দিন আজ। ১৮৮৬ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে হে মার্কেট চত্বরে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণে অনেক শ্রমিক হতাহত হন। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। দেশে দেশে গড়ে ওঠে মেহনতি জনতার ঐক্য। অবশেষে শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর রক্তঝরা দিনটিকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হচ্ছে মে দিবস। এ উপলক্ষে বাংলাদেশে আজ সাধারণ ছুটি। সব ধরনের শিল্পকারখানা থাকবে বন্ধ। সংবাদপত্র কার্যালয় বন্ধ থাকার কারণে আগামীকাল কোনো সংবাদপত্র প্রকাশিত হবে না। বেতার-টিভিসহ বিভিন্ন বেসরকারি চ্যানেল দিবসের তাত্পর্য তুলে ধরে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে।
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ার মূলে রয়েছে শ্রমিকদের বিশাল অবদান। তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রম, সততা ও কর্মনিষ্ঠার ফলে গড়ে উঠেছে অনেক শিল্পকারখানা। মহান মুক্তিযুদ্ধেও ছিল শ্রমিকদের বিশেষ অবদান। বিভিন্ন সংগ্রামে শ্রমিকরা পথে নেমে এসেছেন চিরকালই। কিন্ত স্বাধীন দেশে শ্রমজীবী মানুষের স্বপ্নগুলো আজও বাস্তবে রূপ নেয়নি। বর্তমান রাজনৈতিক সরকারের আমলে দ্রব্যমূল্যের অব্যাহত ঊর্ধ্বগতির কশাঘাতে কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ প্রতিনিয়ত বাঁচার সংগ্রাম করছেন। বিদ্যুত্, গ্যাস ও বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় অগণিত শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়েছেন অসংখ্য শ্রমিক। বেকারত্বের অভিশাপে লাখো শ্রমিকের পরিবার নিঃস্ব হয়েছে। শ্রম আইন থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা নেই। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ঠিকমত মজুরি দেয়া হয় না। নারী শ্রমিকদের মজুরি কম, নানাভাবে বঞ্চিত তারা।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া পৃথক বাণী দিয়েছেন। এছাড়াও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী পৃথক বাণীতে শ্রমজীবী মানুষকে মে দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান তার বাণীতে বলেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে শ্রমজীবী মানুষের অবদান অপরিসীম। সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তুলতে শিল্প উদ্যোক্তা, মালিক, শ্রমিক—সবার সম্মিলিত প্রয়াস একান্তভাবে কাম্য। শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাদের কল্যাণ নিশ্চিতকরণে পরিবেশবান্ধব নিরাপদ কর্মস্থল, ন্যায্য মজুরি, প্রশিক্ষণ, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং মালিক-শ্রমিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক খুবই জরুরি। মহান মে দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, শ্রমজীবীদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা সুনিশ্চিত করে সুখী ও সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডকে আমরা দ্রুত এগিয়ে নিতে চাই। এজন্য প্রয়োজন মালিক-শ্রমিক ঐক্য এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতা। তাই এবারের মে দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়, ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি কর’ অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছে বলে আমি মনে করি। উত্পাদনে গতিশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকার শ্রমিকদের কল্যাণসাধনে বদ্ধপরিকর। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া তার বাণীতে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, এবং প্রতি মুহূর্তে কর্মহীন হওয়ার আতঙ্ক-উত্কণ্ঠায় জর্জরিত দেশের শ্রমজীবী জনগণ আজ দুঃসহ সময় অতিক্রম করছেন। সরকারের ভ্রান্ত নীতি এবং সরকারি দলের নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির ফলে শত শত শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে গেছেন। ২০০৭ সাল থেকে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ নেই। বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের দ্বার প্রায় রুদ্ধ হয়ে গেছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে গেছে। ফলে নতুন কর্মসংস্থান নেই বললেই চলে। অন্যদিকে বিদ্যুত্-গ্যাসের অভাব এবং উন্মুক্ত সীমান্ত দিয়ে অবাধে চোরাচালানের ফলে অবশিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতায় পরাজিত হয়ে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ছাঁটাই হচ্ছে লাখ লাখ কর্মজীবী নারী ও পুরুষ। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রচলিত শ্রম আইন সংস্কারসহ শ্রমিকদের কল্যাণে গৃহীত বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে বিরোধীদলীয় নেতা আরও বলেন, ওইসব আইন যথাযথভাবে কার্যকর ও বাস্তবায়ন হলে শ্রমিকদের অনেক সমস্যা দূর হতো। কিন্তু সরকার এদিকে নজর না দিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন দখল, বিরোধী দল-সমর্থকদের চাকরিচ্যুতি ও হয়রানিমূলক বদলির কাজে ব্যস্ত। সরকারের জাতীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় আজ পালিত হচ্ছে। দিনের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের আলোচনা সভা, শ্রমিক সমাবেশ, শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক, কবিতাপাঠ, গীতিনাট্য ও প্রদশর্নী। সরকারিভাবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সকালে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হবে। এতে শ্রম, কর্মসংস্থান, প্রবাসী কল্যাণ এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন উপস্থিত থাকবেন। এছাড়াও দেশব্যাপী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শিক্ষক, সাংবাদিক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, নারী, কৃষক, আইনজীবী সম্প্র্রদায়সহ সমাজের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন দিবসটি পালনে ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছে।
এদিকে মহান মে দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি রুহুল আমিন গাজী ও মহাসচিব এম এ আজিজ এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি আবদুস শহিদ ও সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ বাকের হোসাইন এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন সরকারের দলন, শ্রমজীবী সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন, চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দিয়ে মেহনতি সাংবাদিক-কর্মচারীদের বেকার করে দেয়া, আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলা-মামলার মাধ্যমে হয়রানি এবং বাসস ও বিটিভিসহ রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যমে বিরোধী মতের সাংবাদিকদের হয়রানি ও চাকরিচ্যুত করার মাধ্যমে সরকারের তৈরি করা এক দুঃসহ প্রেক্ষাপটে এবারের মে দিবস অনেক বেশি তাত্পর্যময়। তারা নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আরও সচেতন ও সক্রিয় হতে মেহনতি সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানান। বিএফইউজে নেতারা যথাযোগ্য মর্যাদায় মে দিবস পালনের জন্য অঙ্গ ইউনিয়নগুলোর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। দিবসটি উপলক্ষে আজ সকাল ১০টায় ডিইউজে কার্যালয়ে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।