somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

চলেপথিক
আমি মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী, কারণ মুক্তচিন্তা হলো এমন এক প্রকার দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি যা বলে যে বিজ্ঞান ও যুক্তির আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ , মতামত গঠনের ক্ষেত্রে প্রথা, অন্ধবিশ্বাস এবং কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রভাবান্বিত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় ।

ইসলাম একটি রাজনৈতিক মতবাদ

১৭ ই জুন, ২০১৫ রাত ৮:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তৃতীয় কিস্তিঃ-

উমাইয়া খিলাফতের পতনের পর আব্বাসীয়রা শাসন ক্ষমতায় অধিষ্টিত হয় । আব্বসীয় খিলাফত নবী মুহাম্মদের চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব এর বংশধরদের কতৃক ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে কুফায় প্রতিষ্টিত হয় । তিনি ছিলেন মুহাম্মদের সর্ব কনিষ্ঠ চাচাদের অন্যতম । মুহাম্মদের সাথে নিকটআত্মীয়তার কারণে তারা উমাইয়াদের হটিয়ে নিজেদের রাসুলের প্রকৃত উত্তরসূরি হিসাবে দাবী করে। উমাইয়াদের নৈতিক ও প্রশাসনিক ভাবে আক্রমণ করে আব্বাসীয়রা নিজেদের আলাদা হিসাবে তুলে ধরে।
আব্বাসীয় বিদ্রহ ব্যপক ভাবে আরবদের দ্বারা সমর্থিত ছিলো । যারা ছিল মূলত মরুর বসতি স্থাপনকারী ও তাদের মাওয়ালী অর্থাৎ অনারবরাও তাদের পক্ষে ছিলো । আব্বাসের প্রপৌত্র মুহাম্মদ ইবনে আব্বাসী নবী মুহাম্মদের পরিবারকে ক্ষমতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রথম পারস্যে প্রচারণা শুরু করেন । এরপর আব্বাসের ৪র্থ বংশধর আবদুল্লাহ খোরাসান প্রদেশ ও শিয়া আরবদের সমর্থন লাভ করেন । তিনি ৭৫০ সালে উমাইয়াদের জাবের যুদ্ধে পরাজিত করেন এবং নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেন । ইতিহাসে তিনি আবুল আব্বাস আস সাফা নামে পরিচিত হন ।
আব্বাসীয়দের শাসনের প্রথম পরিবর্তন ছিলো সাম্রাজ্যের রাজধানী দামেস্ক থেকে বাগদাদে সরিয়ে আনা , এর উদ্দেশ্য ছিলো যাতে পার্সিয়ানদের অধিক কাছে টানা যায় । ৭৬২ খ্রিষ্টাব্দে ট্রাইগ্রিস নদীর তীরে বাগদাদ প্রতিষ্টিত হয় । শাসন ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় দায়িত্ব পালনের জন্য উজির নামক নতুন পদ সৃষ্টি করা হয় । বাগদাদকে গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা রাখা পার্সিয়ানরা বাগদাদে পৃথিবীর প্রথম কাগজ কলের প্রচলন ঘটায় । এভাবে আব্বাসীয় শাসনামলে নতুন এক বুদ্ধিবৃত্তিক পূর্ণ জাগরণ ঘটে । মোঙ্গল নেতা হুলাগু খানের বাগদাদ দখলের পর ১২৮৫ সালে আব্বাসীয় খিলাফত বিলুপ্ত হয় ।

আব্বাসীয়দের ক্ষমতায় আগমন ও রাজধানী দামেস্ক থেকে বাগদাদে স্থান্তারের পর থেকে হুলাগু খানের বাগদাদ দখলের আগ পর্যন্ত সময়কালকে ইসলামের স্বর্ণ যুগ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয় । আব্বাসীয়রা কুরআন ও হাদিসের জ্ঞানের প্রতি উৎসাহমূলক বাণীতে অনুপ্রাণিত হয়ে বাগদাদে বায়তুল হিকমা প্রতিষ্ঠা করে। বায়তুল হিকমা আব্বাসীয় আমলে প্রতিষ্টিত একটি গ্রহ্নাগার, অনুবাদকেন্দ্র ও শিক্ষা প্রতিষ্টান। ৯ম থেকে ১৩শ শতক পর্যন্ত পার্সিয়ান ও খ্রিষ্টানসহ অসংখ্য পণ্ডিত ব্যক্তি এই গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্টানে জড়িত ছিলেন । ভারতীয়, গ্রীক ও পার্সিয়ান রচনা ব্যবহার করে পণ্ডিতরা বৈশ্বিক জ্ঞানের বিরাট ভান্ডার অর্জন করেন এবং এর মাধ্যমে নিজেদের আবিস্কারের দিকে এগিয়ে যান ।

তাদের জ্ঞানের প্রতি আগ্রহের কারণে এসময় মুসলিম বিশ্ব বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসা ও শিক্ষার এক বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র হয়ে উঠে । হারিয়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে এমন সব ধ্রুপদি কাজ আরবি, ফার্সি, তুর্কি, হিব্রু ও ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয় । মুসলিম বিশ্ব তখন বিভিন্ন সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়ার স্থলে পরিণত হয় এবং প্রাচীন রোম, চীন, ভারত, পারস্য, মিশর, উত্তর আফ্রিকা, গ্রীক ও বাইজেন্টাইন সভ্যতা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যায় । মধ্যযুগের বেশ কিছু সংখ্যক চিন্তাবিদ ও বিজ্ঞানী ইসলামী বিজ্ঞানকে খ্রিষ্টান পাশ্চাত্যে পৌছানোয় ভূমিকা রাখে । তাঁরা গ্রীক দার্শনিকদের রচনা সিরিয়াক ও পরবর্তীতে আরবিতে অনুবাদ করে এবং এরিস্টেটল কে ইউরোপীয়দের সাথে পরিচিতি ঘটান ।

আব্বসীয় আমলে মুসলিম জগতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয় । নবম শতকে বাগদাদে ৮০০ জন ডাক্তার ছিলো এবং এনাটমি ও রোগের উপর ব্যাপক আবিষ্কার সর্ম্পন হয় । হাম ও গুটি বসন্তের মধ্যে পার্থক্য এই সময় বর্ণিত হয় । খ্যাতনামা পার্সিয়ান বিজ্ঞানী ‘ ইবনে সিনা ‘ বিজ্ঞানীদের অর্জিত বিশাল এই জ্ঞানকে লিপিবদ্ধ করেন এবং তাঁর বিশ্বকোষ আল কানুন ফিততীর ও কিতাবুল শিফা সে সময় বেশ প্রভাব বিস্তার করে । তিনি ও আরও অনেকের গবেষণাকর্ম রেনেসাঁর সময় ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের প্রভাবিত করে ।
মধ্যযুগে মুসলিম বিশ্বে জ্যোতিবিজ্ঞান আল বাত্তানির মাধ্যমে বিকাশ লাভ করে । আল বাত্তানি, ইবনে রুশদ, নাসিরউদ্দিন তুসি, মুয়ায়েউদ্দিন উরদি ও ইবনে আল শাতির কতৃক ভূকেন্দ্রিক মডেলের সংশোধন পরবর্তীতে কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক মডেলে ব্যবহারিত হয় । ইসলামী জগতে প্রথম মান মন্দির খলিফা আল মামুন এর আদেশে ৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয় । এর নির্মাণে বায়তুল হিকমার পণ্ডিতরা সরাসরি কাজ করেন ।
মুসা নামক ভাতৃদ্বয় আহম্মদ ইবনে মুসা ও হাসান ইবনে মুসা ছিলেন সে যুগের দক্ষ প্রকৌশলী । তারা ‘কিতাবুল হিয়াল’ নামক যন্ত্র সংক্রান্ত গ্রহ্ন লেখেন । এতে একশতেরও বেশী বর্ণনা ও সেগুলোর ব্যবহার বিধি ছিলো । এর মধ্যে ছিলো একটি ‘ স্বয়ংক্রিয় ভাবে খেলতে সক্ষম যন্ত্র ‘ এইটি প্রোগ্রাম করা কোন যন্ত্রের সর্বপ্রাচীন উদাহরণ ।
মুসলিম আলকেমিস্টরা মধ্য যুগের ইউরোপীয় আলকেমিস্টদের প্রভাবিত করেন, বিশেষ করে জাবির ইবনে হাইয়ানের রচনার মাধ্যমে । পাতনসহ বেশ কিছু রাসায়নিক প্রক্রিয়া মুসলিম বিশ্বে উদয় হয় এবং এর পর ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে ।
স্বর্ণ যুগের বৈজ্ঞানিক ইবনে আল হাইসাম ১০১২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর গ্রহ্ন ‘কিতাব আল মানজিরে’ বৈজ্ঞানিক পদ্দতির বিকাশ ঘটান। তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিলো তত্ত্বের সাথে পরীক্ষালব্দ উপাত্তের সমন্বয়ের জন্য পরীক্ষণের ব্যবস্থা করা যা মুসলিম বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে শুরু হয় । ইবনে আল হাইসাম বস্তু দেখার ক্ষেত্রে আলোর চোখের ভিতরে প্রবেশের প্রমান দেন যা একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিস্কার হিসাবে ধরা হয় ।‘ ব্রেডলি স্টেফেন্স ‘ হাইসামকে বৈজ্ঞানিক পদ্দতির বিকাশ ঘটানোর জন্য বিশ্বের প্রথম বিজ্ঞানী হিসাবে উল্লেখ করেন । এ ছাড়া জ্যোতিবিজ্ঞান ও পদার্থ বিজ্ঞানে অনেক মৌলিক গবেষণা হয় । মুহাম্মদ জাফর ইবনে মুসা পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রের বিশ্বজনীনতার কথা প্রথম বলেন ।

বিজ্ঞানী আল খোয়ারিজমি তাঁর গ্রহ্ন ‘ কিতাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালাত ‘ এ বীজগণিত নিয়ে আলোচনা করেন আর এই গ্রহ্নটি থেকেই ইংরেজী এলজেব্রা শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে । তাই অনেকে তাকে বীজগণিতের জনক বলে থাকেন । তিনি ভারত উপমহাদেশের বাইরে আরবি সংখ্যা পদ্দতি ও হিন্দু-আরবি সংখ্যা পদ্দতির সূচনা করেন ।

প্রযুক্তিগত দিক থেকে মুসলিম বিশ্ব চীনের কাছ থেকে কাগজ উৎপাদনের কৌশল গ্রহণ করে । কাগজের ব্যবহার চীন থেকে অষ্টম শতকে মুসলিম বিশ্বে ও দশম শতকে স্পেন ও বাকি ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে । বারুদ তৈরির প্রক্রিয়াও চীন থেকে মুসলিম বিশ্বের মাধ্যমে বিস্তৃত হয় । বায়ু কলের ব্যবহারের ফলে এসময় সেচ ও কৃষিতে অগ্রগতি সাধিত হয় ।

এই সময় ইসলামী দর্শনের উদ্ভব ঘটে, তবে ইসলামিক দর্শন বলতে ইসলামিক সংস্কৃতিতে গড়ে উঠা দর্শনের ধারাকে বোঝায় । এটা শুধু মাত্র ধর্মীয় ব্যপার নয় এবং শুধু মাত্র মুসলিমরাই এতে অবদান রাখেনি এতে এরিস্টটল এর কর্মের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে । দেড়শত বছর যাবত সহজলভ্য গ্রীক ভাষার সকল বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক কর্ম অনুবাদ করা হয় । এরিস্টটলের গ্রহ্নের মাধ্যমে অনুবাদ শুরু হয়ে পিথাগোরাস, প্লেটো, ইউক্লিড, প্লাটিনাস, গ্যাবন, চবক, আর্যভট্ট ও ব্রহ্মগুপ্তের লেখা অনুবাদ করা হয় । অধিকাংশ ক্ষেত্রে নাম ও পরিভাষা বদলানো হয় যেমন টলেমির ‘আলমাজেস্ট’ যা ছিলো মূলকর্ম মেগালে সিনটেক্সিস এর আরবি রূপ ।
ইসলামী দর্শন অথবা আরবি দর্শন হলো জীবন, বিশ্বজগৎ , নৈতিকতা, সমাজ এবং মুসলিম বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত আরও অনেক বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত সমস্যার উপরে নিয়মাতান্ত্রিক গবেষণা, অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা । ইসলামী দর্শন মূলত দুই ভাগে বিভক্ত কালাম ও ফালসাফা । ফালসাফা গ্রীক শব্দ, এইটি গ্রীক দর্শন থেকে উৎসরিত । অপরদিকে কালাম অর্থ কথা বা বক্তব্য এইটি যুক্তিতর্ককে দর্শনে ব্যবহার করে । ইসলামিক দার্শনিকদের মধ্যে সবাই মুসলিম ছিলেন না, ইয়াহিয়া ইবনে আদির মত খ্রিষ্টান ও মাইমোনিডিস এর মত ইহুদিরাও ইসলামী দর্শন ঐতিহ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন । ইবনে আল-রাওয়ান্দি ও মুহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাযীর মত অনন্য ব্যক্তিবর্গ ইসলামকে আক্রমণ করার জন্য দর্শন শাস্ত্রকে ব্যবহার করেছিলেন ।

৮ম শতাব্দীতে বাগদাদে সর্বপ্রথম স্বাধীনভাবে দার্শনিক অনুসন্ধান হিসাবে প্রাচীন ইসলামী দর্শনের উদ্ভব ঘটে । ৮ম থেকে ১২০০ শতাব্দী হলো প্রাথমিক ইসলামী দর্শনের ব্যপ্তিকাল, মূলত এই সময়কালকে ইসলামী স্বর্ণযুগ বলা হয় । দার্শনিক আল-কিন্দি এর সূচনা করেন এবং ইবনে রুশদের হাতে এর প্রাথমিক সময়কালটির সমাপ্তি ঘটে । আল-কিন্দির দর্শনের প্রধান বিষয় ছিলো মূলধারার ইসলামী ধর্মতত্ত্বের সাথে সার সংযোগ । অনেক ইসলামী চিন্তাবিদের মত তিনিও ধর্মতত্ত্বের সাথে সম্পর্ক নির্ণয়ের চেষ্টা করেছিলেন । জ্ঞানের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কিন্দি তিনটি পৃথক বিষয় প্রবর্তন করেন । যেমন ১। ইন্দ্রিয় ২। বুদ্ধি ও ৩। কল্পনা, তাঁর মতে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা অভিজ্ঞতা অর্জন করি আর বুদ্ধি প্রজ্ঞার জন্ম দেয় আর এই দুয়ের মাঝে সমন্ময়সাধন করে কল্পনা । বিষয়টি এই ভাবে বলা যায়, ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা বিশেষের অভিজ্ঞতা অর্জন করি এবং বুদ্ধির মাধ্যমে সার্বিকের প্রজ্ঞা অর্জন করি , কল্পনা এই বিশেষ অভিজ্ঞতা ও সার্বিকের প্রজ্ঞাকে সম্বিলিত করে । কিন্দির এই মতবাদের সাথে ইমানুয়েল কান্ট এর সমন্বয়বাদী জ্ঞানতত্ত্বের মিল আছে । কান্টের ৯০০ বছর আগে কিন্দি এরকম তত্ত্বই প্রচার করেছিলেন। আল-কিন্দির আত্মা বিষয়ক চিন্তায় প্লেটোর সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায় । তিনি মনে করতেন আত্মা এবং জড় সম্পূর্ণ পৃথক দুটি সত্ত্বা, এর মধ্যে আত্মাই উচ্চতর। আত্মা থেকেই সব কাজের উৎপত্তি ঘটে, জড়ের কাজ কেবল আত্মার নির্দেশ পালন করা । ধর্মতত্ত্বের অনেক ধরনের সংঙ্গা ও বিশ্লেষণ হতে পারে । যেমন ‘হিপোর আউগুস্তিন’ লাতিন শব্দ Theologian এর সংঙ্গা দিতে গিয়ে বলেছেন ঈশ্বর সম্পর্কিত আলোচনা বা যুক্তি উপস্থাপন ।

সে যুগের ধর্মতাত্ত্বিকরা দর্শন, এথনোগ্রাফি, ইতিহাস, আধ্যাত্মিকতা এবং আরও অনেক বিষয় থেকে ব্যাখ্যা ও যুক্তি গ্রহণ করে ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা করেন বা পরীক্ষার মাধ্যমে সমালোচনা করেন বা ক্ষেত্রবিশেষে অগ্রগতি সাধনও করেন । যেমন- নিজের ধর্ম বা প্রথাকে আরও সঠিকভাবে বোঝার চেষ্টা করা , নিজের নয় এমন ধর্মকেও বোঝার চেষ্টা করা , বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে তুলনা করা , কোন ধর্মীয় প্রথাকে সংস্কার করা , ধর্মের জ্ঞান ভান্ডার থেকে সাহায্য নিয়ে অধুনা উদ্ভূত কোন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা , নিদৃষ্ট কোন ধর্মের দিকে ইঙ্গিত না করে সাধারন ভাবে ঈশ্বর বা আধ্যাত্মিকতা নিয়ে আলোচনা করা ও কোন ধর্মীয় যুক্তিকে চ্যালেঞ্জ করা । এক কথায় ধর্ম, ধর্মের প্রভাব এবং ধর্মীয় সত্যের প্রকৃতি নিয়ে পদ্ধতিগত ও যৌক্তিক অধ্যায়নের নামই ধর্মতত্ত্ব । জ্ঞানের এই শাখার বহুল আলোচিত বিষয়ের মধ্যে রয়েছে ঈশ্বর, মানবতা, বিশ্বজগৎ , নির্বাণ বা মুক্তি এবং পরলোকতত্ত্ব ।

নবী মুহাম্মদের পর তাঁর চার সাহাবার শাসনকাল পর্যন্ত ইসলামের নৈতিক কোঠরতা বিদ্যামান ছিলো, পরবর্তী উমাইয়া বংশের রাজত্বকালে তার বন্ধন ক্রমে শিথিল হয়ে পড়ে । উমাইয়া শাসনের শেষদিকে অর্থাৎ ৮ম শতাব্দীর শুরুতেই বসরায় একদল তরুণ মুসলিমের আবির্ভাব হয়, তারা ঘোষণা করেন সত্যের অন্বেষণে চিন্তাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে । এ দলটি ছিলো সে সময়কার মুসলিম বসরার সুপ্রসিদ্ধ তাপস হাসান বসরির শিষ্য । এই বিদ্রহিদের প্রথম অভিযান শুরু হয় অদৃষ্টের বিশ্লেষণ নিয়ে । অদৃষ্টবাদ নিয়ে আল-কুরআনে দুরকম উক্তি আছে । সে যুগে অধিকাংশ মুসলিম ছিলো ঘোর অদৃষ্টবদী এবং নিজেদের একান্ত নিঃসহায় ভেবে নিয়ত আল্লাহ্‌র কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতো । বিদ্রহিদের যুক্তি ছিলো আল্লাহ্‌ যদি কাউকে পাপ পথে রাখেন এবং কাউকে পুণ্য পথে রাখেন তাহলে পাপ এবং পুণ্য উভয়েরই উৎস তিনি । আর যা প্রমানিত হয় না এমন কিছুই গ্রহণ করতে তারা রাজি ছিলেন না । শাস্ত্রপন্থীগণ তাদের এই মতবাদের নাম দিলেন মুতাজিলা অর্থাৎ দলত্যাগী । এ দলের প্রধান হাসান বসরির অন্যতম শিস্য ওয়াসিল ইবনে আতা ছিলেন এই মতবাদের প্রবক্তা । পরবর্তীতে এই মুতাজিলা মতবাদের ফলেই আব্বাসীয় আমলের ইসলামের স্বর্ণ যুগের সুচনা ঘটে ।

সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে ইউরোপে লর্ড বেকন প্রমূখ মনিষীবৃন্দ যেমন গতানুগতিক জ্ঞান অনুশীলন পরিত্যাগ করে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার প্রবর্তন করেন প্রাচ্যে নবম শতাব্দীর মুসলিম তরুণরা তেমনি কেবলমাত্র লজিক ও বিজ্ঞানকেই সত্যাসত্য নির্ধারণের মাপকাঠি হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। এই আলোক যুগের শ্রেষ্ট জ্যোতিষ্ক ছিলেন আল-কিন্দি, আল-ফারাবি, আবু সিনা, ওমর খৈয়াম, আল-রাযী, আবু ওয়াফা, ইবনে রুশদ প্রমুখ পণ্ডিত । তারা কেউ শাস্ত্র ত্যাগী নাস্তিক ছিলেন না তবে তাদের চিন্তার বৈশিষ্ঠ ছিলো প্রমানিকতা ।
শরিয়তপন্থী শাস্ত্রকারদের সাথে তাদের এই নিয়ে বিরোধের কারণে নানা সময়ে তারা নির্যাতনেরও শিকার হয়েছেন এমন কি রাজসরকার থেকেও নেমে আসতো লাঞ্ছনা ও দুর্ভোগ । কিন্তু এসব বিপদ আপদ তারা গ্রাজ্য করতেন না । যা সত্য বলে বুঝতেন তাতেই অটল থাকতেন ।

সে যুগের মুসলিম দার্শনিকরা এই মনবল কোথা থেকে পেলেন তা অনুসন্ধান করলে দেখা যায় তাদের সাংসারিক জীবন যাত্রা প্রণালীতেই এর কারণ নিহিত রয়েছে । এই সকল দার্শনিক অন্যান্য দেশের ন্যায় যাজক শ্রেণীভুক্ত ছিলেন না । এদের অধিকাংশই হেকিম ছিলেন এবং চিকিৎসা দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন । পরের মনতুষ্টির জন্য কখনও নিজ চিন্তাশক্তিকে পঙ্গু করতেন না । তাই মুসলিম দর্শন ইউরোপীয় দর্শনের ন্যায় রাজধর্মের দাসত্ব না করেই নিজ পায়ে দাঁড়াতে পেরেছিল । স্বেচ্ছাচারী মুসলিম শাসকদের দাম্ভিগতা ও শাস্ত্রকারদের বিধিনিষেধের চাপে মুসলিম সমাজে ইতিপূর্বে যে জড়তা জমাট বেঁধে ছিলো, এই সকল স্বাধীনচেতা দার্শনিকদের জীবন ব্যাপি ত্যাগ ও সাধনার ফলে তাতে আবার গতিবেগ সঞ্চারিত হয় । দার্শনিক আল ফারাবি গ্রীক ভাষার সুপণ্ডিত ছিলেন তার লিখিত ভাষ্য দীর্ঘদিন এশিয়া ও ইউরোপে এরিস্টটলের ম্যটাফিজিক্স এর সাথে পরিশিষ্ঠরূপে পঠিত হতো ।

ইসলামের জ্ঞান সাধনায় ইবনে রুশদ এর প্রধান অবদান শস্ত্রের এলাকা থেকে দর্শন ও বিজ্ঞানকে স্বতন্ত্র সীমানা নির্দেশ । সে যুগে মোল্লাদের বিশ্বাস ছিলও জগতের যা কিছু জ্ঞান বা জ্ঞানের সম্ভবনা সমস্তই ধর্ম- গ্রহ্নে নিহিত আছে । কথিত আছে মুসলিম বাহিনী যখন আলেকজান্ডারিয়া জয় করে তখন খলিফা উমর বলেছিলেন— আলেকজান্ডারিয়া পুস্তকাগারে যে লক্ষ লক্ষ পুস্তক সঞ্চিত আছে সেগুলি যদি কুরআনে নিহিত জ্ঞানরাশির অতিরিক্ত কিছু শিক্ষা না দেয়, তবে সেগুলো বাহুল্য মাত্র । আর ঐ সকল পুস্তক যদি কুরআন এর বাহিরের কোন জ্ঞান মানুষকে শিক্ষা দেয় তবে ঐ সকল পুস্তক হারাম । তাই কোন মতেই ঐ গুলিকে বাঁচাইয়া রাখা চলে না । ( তবে এই কথাটি সত্যি নয়, তা শুধু মুসলিমদের অন্ধগোঁড়ামির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে ) কুরআন আর হাদিস এর শিক্ষা যদি মানুষকে বিজ্ঞানী বানাতে পারতো তাহলে এই বাংলাদেশেই যে পরিমাণ শায়েক আর তফসিরকারক আছেন তারা সবাই এক একজন বিজ্ঞানী হতেন এবং আজকের পৃথিবীতে নাসার মত প্রতিষ্ঠান আমেরিকায় না হয়ে বাংলাদেশেই প্রতিষ্ঠিত হতো।
শরীয়তপন্থীদের এই অন্ধগোঁড়ামি যে অমূল্য জ্ঞান বিজ্ঞানের ভাণ্ডারকে নাস্তিকতা আখ্যা দিয়ে উচ্ছিষ্টের মত ডাস্টবিনে ছুড়ে দিয়েছিলো, তা সোনারখনি হিসাবে কুড়িয়ে নিয়ে ইউরোপীয়রা ইসলামী বিশ্বকে দুইশত বৎসর পিছনে ফেলে আজ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম আসনে প্রতিষ্ঠিত । আর বর্তমান মুসলিমরা মধ্যযুগের ইসলামী খেলাফতের নষ্টালজিতে আক্রান্ত হয়ে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে ইউরোপ আমেরিকার পাতা ফাঁদে পা দিয়ে নিজেরাই নিজেদের রক্তের হলীখেলায় মেতে উঠেছে ।

আব্বাসীয়রা উমাইয়া আমলে অনারবদের প্রতি সামাজিক অসাম্যের ফলে সৃষ্ট অসন্তোষের কারণে ক্ষমতায় এলেও সাম্রাজ্য দ্রুত আরব পরিচয় ধারণ করে । অন্য ভাষা থেকে রচনা আরবিতে অনুবাদ করা হয় । এতে এক নতুন ইসলামী পরিচয় জন্মলাভ করে যা পূর্ব সময়ের আরব সংস্কৃতির সাথে মিথস্ক্রিয়া করে । সে সময় এ সংস্কৃতি ইউরোপিয়ানদের কাছে ছিলো বিশ্বয়কর ।
মধ্যযুগে ইসলামী বিশ্বে জন্ম নেওয়া সবচেয়ে পরিচিত সাহিত্য হলো সহস্র এক রজনীর গ্রহ্ন যা ‘ আরব্য রজনী ‘ নামে পরিচিত । মূল ধারণা ইসলামপূর্ব ইরানী উপাদান থেকে আসে ও এর সাথে ভারতীয় উপাদান যুক্ত হয় । গল্পগুলোর অনেক চরিত্র পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে সাংস্কৃতিক আইকন হয়ে উঠে; যেমন আলাদিন , সিন্দবাদ ও আলিবাবা ।

৭ম শতাব্দীতে ইসলামের ইরান বিজয়ের পর ধিরে ধিরে একটি সাহিত্যিক ভাষা হিসাবে আধুনিক ফার্সির আবির্ভাব ঘটে । ভাষাটিতে আরবি ভাষা থেকে প্রচুর শব্দ ধার নেওয়া হয় এবং লেখার জন্য আরবি লিপি গ্রহণ করা হয় । ৯ম-১০ম শতাব্দীতে পারস্যের প্রাচীন উপকরণগুলি ইসলামের সাংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যেতে শুরু করে । একি সাথে ইসলাম ও আরবির মধ্যে একক সম্পর্ক ঘুচিয়ে ইসলামের নতুন এক বিশ্বজনীন ভাষা হিসাবে আবির্ভূত হয়, যা একাধারে ইসলামের প্রসার এবং সংরক্ষণে বড় ভূমিকা রাখে ।
এই সময়কার শ্রেষ্ট কবি ছিলেন ‘রুদাকি’ যাকে ফার্সি কবিতার জনক বলা হয় । পরবর্তীতে তাঁর পথ অনুসরণ করে ফার্সি সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করান যারা তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কবি ফিরদৌসী, উনসরি, আসজাদি, ফারুকি, নাসের খসরু, ওমর খৈয়াম, শেখ সাদি, রুমি ও হাফিজ প্রমুখ।
এদের মধ্যে ওমর খৈয়াম ছিলেন রুবাই বা চতুষ্পদী কবিতার শ্রেষ্ট কবি । তিনি কবিতায় তাঁর দর্শন বর্ণনা করে গেছেন, যে দর্শনে সংশয়বাদী চিন্তা ভাবনা স্থান পেয়েছে । ওমর খৈয়ামের একটি রুবাইয়াৎ যেমন --
“ সদ্য ফলের আশায় মোরা খেটে মরি রাত্রি দিন ,
মরণ পারের ভাবনা ভেবে আঁখির পাতা পলকহীন ।
মৃত্যু আঁধার মিনার হতে মুয়াজ্জিমের কন্ঠ পাই ,
মূর্খ তোরা কাম্য তোদের হেথায়
হোথায় কোথাও নাই ।“ চলবে ---
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:৫৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিনেতা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৫



বলতে, আমি নাকি পাক্কা অভিনেতা ,
অভিনয়ে সেরা,খুব ভালো করবো অভিনয় করলে।
আমিও বলতাম, যেদিন হবো সেদিন তুমি দেখবে তো ?
এক গাল হেসে দিয়ে বলতে, সে সময় হলে দেখা যাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×