somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

চলেপথিক
আমি মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী, কারণ মুক্তচিন্তা হলো এমন এক প্রকার দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি যা বলে যে বিজ্ঞান ও যুক্তির আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ , মতামত গঠনের ক্ষেত্রে প্রথা, অন্ধবিশ্বাস এবং কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রভাবান্বিত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় ।

ধর্মের প্রাচীন ইতিহাস (সংগ্রহ)

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ইষ্রা! এক ইহুদী ধর্মাচার্যের নাম। তবে ইতিহাসে তার গুরুত্ব শুধুই একজন ধর্মযাজক হিসেবে নয়। কারণ তার রচিত ধর্মীয় বিধানই আজ আড়াই হাজার বছর পরে নারকীয় নৃশংসতায় ফিলিস্তিনী শিশু হত্যার মূল প্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশুদ্ধ রক্তের জাতি এই দম্ভে দম্ভিত হয়ে যায়নবাদী ইসরাইল নৃশংস গণহত্যায় বারবার মেতে উঠছে ফিলিস্তিন ভূখন্ডের আদি বাসিন্দাদের ওপর, যারা গত তিন হাজার বছরের ইতিহাসে কখনও ইহুদিদের ওপর এই ধরনের নিষ্ঠুরতা চালায়নি। এ নিষ্ঠুরতার মূলে রয়েছে আচার্য ইষ্রার বিশুদ্ধ জাতিতত্ত্বের নারকীয় বিধান, যা তিনি প্রবর্তন করেন ব্যাবিলন থেকে পারসিক সম্রাট আর্তাজারেক্সেসের দয়ায় ইহুদীদের শেষ দলের সাথে জেরুজালেমে ফিরে আসার পর (ওল্ড টেস্টামেন্ট: ইষ্রা:৭:১)। ফিরে এসেছিলেন তিনি ৪৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।

৫৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারসিক সম্রাট সাইরাসের দয়ায় ব্যাবিলনের দাস্যজীবন থেকে ইহুদীদের প্রথম দলটির প্রত্যাবর্তনের ৯৪ বছর পরে সম্রাট আর্তাজারেক্সেসের অনুমতি পেয়ে আচার্য ইষ্রার নেতৃত্বে ব্যাবিলনে বসবাসরত বাদ বাকি ইহুদীরা বেরিয়ে পড়ল জেরুজালেমের পথে। এ দলে ইহুদীদের সংখ্যা ছিল সতেরশ। এক সময় তারা পৌছেও গেল জেরুজালেমে। এই প্রত্যাবর্তন নেবুচাদনেজারের জেরুজালেম ধ্বংসের ১৪৩ বছর পর। এই সময় ধরে কয়েক পুরুষ গত হয়েছে। তবুও ব্যাবিলনের বন্দি ইহুদীরা ক্যালদীয় বা পারসীয় হতে পারেনি। যে শিশুর জন্ম হয়েছে ব্যাবিলনে, সেও তার বার্ধক্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত স্বপ্ন দেখেছে জেরুজালেমে ফিরে যাওয়ার। তাই এই প্রত্যাবর্তন ছিল ইহুদীদের জন্য এমন অভাবিত আনন্দের, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না।
সম্রাট আর্তাজারেক্সেস ইষ্রাকে জেরুজালেমের ধর্মীয় আচার্য নিযুক্ত করলেন। সেই সময়ের অন্যান্য সমাজের মতই ইহুদী সমাজও তীব্র শ্রেণী শোষণের কলংক থেকে মুক্ত ছিলনা। দাসকেন্দ্রিক অর্থনীতি ছিল তখনকার সমাজের ভিত্তি। মিসর ও ব্যাবিলনে দাস্য জীবনের যন্ত্রণার সাক্ষী ইহুদীরা নিজেদের ভেতরেও এ ব্যাবস্থাকে চালু করল। ঋণগ্রস্থ ইহুদীরা ক্রমে দাস হয়ে পড়ছিল ধনী ইহুদীদের। ধনী ইহুদীদের এই জাগতিক লালসার পথে ধর্ম কোন বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। কারণ, যে মুসার অনুশাসন ও বিধি বিধান ছিল তাদের ধর্মের ভিত্তি, তা সংরক্ষণের অভাবে ঢালাওভাবে বিকৃত হওয়ার অবকাশ ছিল। ইব্রাহিম থেকে মুসা সবাই বিদ্রোহ করেছেন দাস শোষণের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাজশক্তির বিরুদ্ধে, দাস শ্রেণীর কাতারে দাঁড়িয়ে। সুতরাং তাদের বিধানে দাস শোষণের বিরুদ্ধে চেতনা থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ অধঃপতন দেখে মোটেও ভাবিত হন না আচার্য ইষ্রা। বরং বিপুল উৎসাহের সাথে তিনি ইহুদীদের নিয়ে গেলেন ভয়ংকর সর্বনাশের পথে। এ সর্বনাশের নাম বিশুদ্ধ জাতিতত্ত্ব। এটাই আধুনিক যায়নবাদের ভিত্তি। অ্যাসিরিয়রা উত্তরের সামারিয়া দখলের পরে সেখানে অ-ইহুদীদের থাকতে দিয়েছিল (ওল্ড টেস্টামেন্ট: ২বাদশাহনামা:১৭)। সেখানকার অ-ইহুদীদের সাথে মিশ্রণ ঘটে যায় স্থানীয় ইহুদীদের ও ব্যাবিলন থেকে জেরুজালেমে ফিরে আসা ইহুদীদের সাথেও মিশ্রণ ঘটে স্থানীয় ইহুদীদের (ওল্ড টেস্টামেন্ট: ইষ্রা:১০:১৮-৪৪)। তাতে নাকি বিশুদ্ধতা হারিয়েছে ইহুদী রক্ত। বিজাতীয়দের সাথে ইহুদীদের এই মিশ্রণ ক্রুদ্ধ করে তোলে আচার্য ইষ্রাকে। তিনি ছিলেন ইহুদী ধর্মজগতের মধ্যমণি, মুসার ভাই হারুনের সপ্তদশ উত্তরপুরুষ! তাঁর পূর্বপুরুষদের তালিকা রয়েছে ওল্ড টেস্টামেন্টের পবিত্র বংশাবলী পুস্তকে। অতএব তিনি ইহুদীদের ওপর যাজকতন্ত্রের প্রভাব খাটাবার একচ্ছত্র অধিকারী বনে গেলেন। তার মুখ নিঃসৃত কথাই হয়ে যায় ধর্মীয় বিধান। ইহুদীরা এ বিধান না মেনে যাবে কোথায়? তাই তিনি ইহুদীদেরকে তাদের পরজাতীয় স্ত্রী ও সন্তানদেরকে প্রত্যাখ্যানে বাধ্য করার জন্য ওল্ড টেস্টামেন্টে সংযুক্ত করলেন ইহুদী জাতির বিশুদ্ধতার বিধান। যে রক্ত হিম করা বিধানটি তিনি জারি করেছিলেন তা হলো- যে সব ইহুদী পুরুষরা পরজাতীয় মেয়েদের স্ত্রী করেছে, সেই সব স্ত্রীদের এবং তাদের গর্ভজাত পুত্র-কন্যাদের ত্যাগ করতে হবে। (ওল্ড টেস্টামেন্ট: ইষ্রা:১০:১১)। এ ঘোষণা একজন মানুষের হতে পারে না। একজন নিষ্ঠুর দানবের, যিনি ধর্মের আলখেল্লা গায়ে জড়িয়ে বলী দিলেন পূর্বতন নবীদের শিক্ষাকে। হাজার হাজার নারী-পুরুষ শিশুর ক্রন্দন তাকে স্পর্শ করল না। আচার্য ইষ্রার এই দানবীয় অনুশাসনের কথা পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর অনুসারীরা ওল্ড টেস্টামেন্টে সংরক্ষিত করেছে। ওল্ড টেস্টামেন্টের বংশাবলীর দ্বিতীয় খন্ডে ইষ্রার নিজের কথার শ্লোকগুলোতে এটি বর্ণিত আছে।

জেরুজালেমে ফেরা ইহুদীদের সর্বশেষ দলটির প্রতি আচার্য ইষ্রার বিশুদ্ধকরণ অনুশাসন কতটা জীবন বিরুদ্ধ ও অমানবিক ছিল তা তুলে ধরেছেন প্রয়াত লেখক সাংবাদিক সত্যেন সেন তাঁর ‘পাপের সন্তান’ গ্রন্থে। এখানে পাপের সন্তান মানে হল ইহুদী পুরুষদের পরজাতীয় স্ত্রীদের গর্ভজাত সন্তানরা। আচার্য ইষ্রার অনুশাসন অনুসারে ব্যাবিলনে পরজাতীয় কন্যাদের সাথে যারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তাদের ঔরসে ঐসব স্ত্রীদের গর্ভজাত সন্তানরা হল পাপের সন্তান। এদেরকে প্রত্যাখ্যান করার হুকুম তিনি জারি করলেন। সেই সাথে পরজাতীয় স্ত্রীদেরও। ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণনা থেকে জানা যায়, আচার্য ইষ্রার এই অমানবিক অনুশাসনের বিরুদ্ধে জোনাথন, যহসিয়, মশুল্লম, শব্বথয়সহ ব্যাবিল প্রত্যাগতদের অনেকেই তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে (ওল্ড টেস্টামেন্ট:ইষ্রা:১০:১৫)। কিন্তু তাদের এ প্রতিবাদ আচার্য ইষ্রাকে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি। নির্বিকার চিত্তে তিনি জবাব দিলেন, পরজাতীয় মেয়েদের গর্ভজাত সন্তানরা পাপের সন্তান। এরা যত শীঘ্র লোপ পাবে, যিহোবার রাজ্য তত নিষ্কলঙ্ক হয়ে উঠবে। ধর্মের নামে আচার্য ইষ্রার এই যাজকতন্ত্রের যুপকাষ্টে বলি হয়ে গেল হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, যুবা-বৃদ্ধ।

এর আগে ৫৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট সাইরাস ইহুদীদের প্রথম যে দলটিকে স্বদেশ ফেরার অনুমতি দিয়েছিলেন তারা ওল্ট টেস্টামেন্ট লিপিবদ্ধ করার কাজে হাত দেয়। মুসার সময়কাল ধরা হয় ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে প্রায় ৭৬২ বছর। এতদিন পরে তাঁর বাণী লিপিবদ্ধ করার কাজের শুরু। কিভাবে সম্ভব মুসা যা বলেছিলেন হুবহু তা লিপিবদ্ধ করা? বংশ পরম্পরায় চলে আসা মুসার বাণীর কতটুকু ছিল আসল, আর কতটুকু ছিল অপভ্রংশ, আর কতটুকু ছিল বক্তাদের নিজস্ব সংযোজন - তা কে বলতে পারে? তার ওপর আবার লিপিকররাও ছিলেন ধর্মবেত্তা। তারাও তাদের সুবিধামত ভেজাল মিশ্রিত করেছেন। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ আচার্য ইষ্রার ইহুদী রক্তের বিশুদ্ধতার বিধান।

ইহুদীদের প্রথম যে দলটি জেরুজালেমে ফিরে এসে ওল্ড টেস্টামেন্ট লিপিবদ্ধ করার কাজে হাত দেয়, তাদের ৯৪ বছর পরে ইহুদীদের শেষ দলের সাথে আচার্য ইষ্রা জেরুজালেম ফিরে আসেন। এরপর তিনি ওল্ড টেস্টামেন্টে ইহুদী রক্তের বিশুদ্ধতার যে বিধান সংযুক্ত করলেন, তা একান্তই তার নিজস্ব। এটা কোনক্রমেই নবী মুসার বাণী হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ নবীরা উঠে আসতেন সাধারণ মানুষদের স্তর থেকে এবং তাদের অনুসারীদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ছুটে যেতেন সাধারণ মানুষের কাছেই। এ ধরনের বর্ণবাদী জাতিতত্ত্বে সাধারণের আকৃষ্ট হওয়ার কোন কারণ নেই। বরং নবীদেরকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সাধারণের মধ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ধারণা প্রতিষ্ঠা করে অত্যাচারী রাজশক্তির বিরুদ্ধে লড়তে। বিশুদ্ধ জাতিতত্ত্ব নয়, বরং একত্ববাদই ছিল এ লড়াইয়ের মূল প্রেরণা।
ইবরানী ও ইসরাঈলী ধর্মমতের ধারায় একটি ব্যাপার সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। তা হলো, ধর্মের আদলে রাজদ্রোহ। ইতিহাসে দেখা যায়, যখনই রাজশক্তি ধর্মকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের চূড়ান্ত রূপদান করেছে, অর্থাৎ রাজা নিজেকে খোদা হিসেবে ঘোষণা করেছে, তখন দাস ও প্রজাদের ওপর শোষণ ও অত্যাচার সর্বোচ্চ মাত্রা অতিক্রম করেছে। আর এর বিপরীতে একজন ইব্রাহিম কিংবা মুসার (আঃ) আবির্ভাব ঘটেছে একত্ববাদের ঘোষণা নিয়ে, অত্যাচারী শাসকের দেবত্ব অস্বীকারের মাধ্যমে। যেহেতু সেই সমাজে ধর্ম ছিল জীবনের শক্তিশালী ভিত্তি এবং শোষণ ছিল ধর্মীয় যুক্তিতে প্রতিষ্ঠিত, তাই শোষিত মানুষের বিদ্রোহও এলো ধর্মীয় বিদ্রোহের আদলে। রাজশক্তির দৈব কর্তৃত্বের দাবি অস্বীকার করাই হল এই বিদ্রোহের মূল প্রেরণা। বহু দেবতাবাদ আর একত্ববাদের মধ্যকার সংঘাত হল শোষক ও শোষিতের মধ্যকার সংঘাত। ইব্রাহিম (আঃ) যে একত্ববাদের ধর্মমত প্রচার করেছেন তা সুস্পষ্টভাবেই রাজদ্রোহের শামিল এবং রাজতন্ত্রের জন্য একটি হুমকি। তাই তাঁকে তাঁর অনুসারিদের নিয়ে দেশত্যাগ করতে হয়েছিল। পরবর্তীতে ফারাও দ্বিতীয় রামেসেস একইভাবে নিজেকে খোদা দাবী করলে ইব্রাহিমের (আঃ) উত্তরসূরী মুসার (আঃ) নেতৃত্বে ইহুদীরা তা অস্বীকার করে রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে আসে। এটা থেকে প্রমাণিত হয় যে, একত্ববাদের বার্তা সুস্পষ্টভাবে পরাক্রমশালী রাজশক্তির দেবত্বকে অস্বীকার করে বিদ্রোহের প্রেরণা জাগায়। এ ধর্মীয় অনুশাসনে মানুষের জাত, বংশ, জন্মগত পরিচয় ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং এক স্রষ্টার প্রতি তার বিশ্বাস ও আনুগত্য হল আসল। যার বিধানে মানুষে মানুষে কোন দৈব প্রভেদ নেই। স্রষ্টার দৃষ্টিতে মানবজাতি এক ও অভিন্ন। এটাই একত্ববাদী ধর্মমতের মূল চেতনা।

আচার্য ইষ্রার এই বিধান যে তাঁর একান্তই নিজস্ব বিধান, একে মুসার (আঃ) অনুশাসনের সাথে কোনভাবেই সংযুক্ত করা যায় না, সেটা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ইতিহাসের পথ ধরে হাটলে। আমরা জানি, প্রধান প্রধান ইসরাইলী নবীরা কিভাবে পরজাতীয় কন্যাদের বিবাহ করেছেন। যা ইষ্রার বিধানে মাহপাপ। বিখ্যাত নবীদের অন্য জাতীয় নারী বিবাহের ঘটনাসমূহ নিশ্চিতভাবে ইষ্রার বিধানকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। ইব্রাহিম (আঃ) বিয়ে করেছিলেন মিসরীয় নারী হাজেরাকে (ওল্ড টেস্টামেন্ট:তাওরাত-১ম খন্ড:১৬:৩)। হযরত ইসহাক (আঃ) ও ইয়াকুবের (আঃ) স্ত্রীরা ছিলেন ইরামীয় (ওল্ড টেস্টামেন্ট:তাওরাত-১ম খন্ড:২৪ ও ২৮)। মুসা (আঃ) বিয়ে করেছিলেন ইথিওপীয় মহিলাকে (ওল্ড টেস্টামেন্ট: তাওরাত-৪র্থ খন্ড:১২:১)। দাউদ (আঃ) বিয়ে করেছিলেন হিট্টীয় (আর্যদের একটি শাখা) নারী বৎশেবাকে। একবার রাজ প্রসাদের ছাদ থেকে তিনি এক স্ত্রী লোককে স্নান করতে দেখেন। সাথে সাথে এই নারীকে তাঁর পছন্দ হয়ে যায়। কিন্তু মহিলাটি ইহুদী বংশীয় ছিলনা। সে ছিল ইলিয়ামের কন্যা, হিট্টীয় উরিয়ের স্ত্রী বৎশেবা। এই পরজাতীয় বৎশেবাকে দাউদ (আঃ) তার আপন স্ত্রী বানালেন (ওল্ড টেস্টামেন্ট: ২ শামুয়েল:১১:২৭) । তাঁর গর্ভেই জন্ম নেন সলোমন (আঃ) এবং তিনিও বিয়ে করেছিলেন ফারাওয়ের কন্যাকে। এছাড়াও মোয়াবীয়, আমোনীয়, ইদোমীয়, সিডনীয় ও হিট্টীয় রমণীরাও তাঁর পত্নী ছিল (ওল্ড টেস্টামেন্ট: ১ বাদশাহনামা :১১:১)। এই সলোমন (আঃ) নির্মিত ধর্মগৃহই ইহুদী ধর্মের মূল ধর্মীয় স্থাপনা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইসরাইলী নবী পিতৃসূত্রে ইসরাইলী বংশীয় হলেও মাতৃসূত্রে ছিলেন অন্য বংশীয়। শুধু নবী কেন, অনেক সাধারণ ইসরাইলীরাও অন্য জাতীয়দের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে। দাউদের (আঃ) জেরুজালেম দখলের পর এর পতন ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে। এর মধ্যে পেরিয়ে যায় চার শতাধিক বছর। এই সুদীর্ঘ সময়কালে ইহুদী রক্তের সাথে সংমিশ্রণ ঘটে স্থানীয় কেনানীয় ও ফিলিস্তিনিদের রক্তের।

ইষ্রা সমগ্র মানব জাতিকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। যেখানে একটি হল তাঁর জাতি, যাদের শরীরে বিশুদ্ধ রক্ত প্রবাহিত। আর অন্যটি হল বাকি দুনিয়ার সকল মানুষ, যাদের শরীরে দূষিত রক্ত প্রবাহিত। কিন্তু ইহুদী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তাদের জাতিগত বিশুদ্ধতার একেবারে গোড়ায় গলদ রয়েছে এবং পরজাতীয়দের সাথে ইহুদী রক্তের সংমিশ্রণের ঘটনায় ইতিহাস সমৃদ্ধ। বর্তমান যায়নবাদ মনে করে ইহুদীরা স্রষ্টার চোখে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি ও বাকি পৃথিবীর সবাই তাদের থেকে নিকৃষ্ট। তাই ইহুদীদের সাথে অন্য জাতীয় ও অন্য ধর্মীদের বিবাহ নিষিদ্ধ। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারটি হল স্রষ্টার দৃষ্টিতে একমাত্র খাঁটি এই ইহুদী ধর্মে অন্য কেউ প্রবেশও করতে পারবেনা। ইহুদী ধর্মী হবে একমাত্র ইহুদী বংশজাত লোকজন। অন্য কেউ নয়। বাদ বাকী যারা ইহুদী ঘরে জন্ম নেয়নি, তাদের ভাগ্যে কল্যাণ নেই। আবার তাদের ইহুদী হওয়ার সুযোগও নেই। এই বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিই যায়নবাদের মূল ভিত্তি। এর সাথে মিল রয়েছে ভারতীয় ব্রা‏হ্মণ্যবাদের। অর্থাৎ শুধু জন্ম পরিচয়ই মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করছে। কিন্তু জন্ম কারও ইচ্ছার বিষয় নয় এবং এতে কারও হাত নেই ।
পৃথিবীতে কি এমন কোন জাতির অস্তিত্ব সম্ভব যাদের রক্তে অন্য কোন জাতির রক্তের সংমিশ্রণ নেই? এর উত্তর এক কথায় হবে ‘না’। পরম বিশুদ্ধ জাতি বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। পরমভাবে জাতি বলেও কোন কিছু নেই। সমগ্র মানবজাতির উৎস হিসেবে তিনটি মহাজাতিকে বিবেচনা করা হয়- ককেশীয়, নিগ্রো ও মঙ্গোলীয়। এ তিনটি মহাজাতির গোড়াও আবার সুদুর অতীতে গিয়ে এক হয়ে যায়। আসলে জাতীয়তার বড়াইটা খুবই দূর্বল ভিত্তির উপর টিকে থাকে। আরেকটা ব্যাপার হল জাতিগত বিশুদ্ধতা ধরে রাখা কিংবা জাতীয় সত্ত্বাকে দীর্ঘকাল বাঁচিয়ে রাখার আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কি? আজ মানব সভ্যতা এমন এক পর্যায়ে চলে এসেছে যেখানে জাতিগত সংকীর্ণতা জীবনের পথে একটি বাঁধা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

দুনিয়ার সব জাতি যদি একাকার হয়ে যায়, তাহলে তাতে কি কোন সমস্যা আছে? এতে কোন সমস্যা তো নেই-ই বরং তা পৃথিবীর জন্য অত্যন্ত কল্যাণকর ব্যাপার হবে। সভ্যতা আসলে সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে। তবে তা মোটেও এক জাতির উপর আরেক জাতির আধিপত্য বিস্তারের মধ্য দিয়ে নয়, বরং প্রত্যেকের স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের চূড়ান্ত বিকাশের মধ্য দিয়েই সম্ভব। অতীতে যতগুলো জাতির অস্তিত্ব ছিল তার অধিকাংশই আজ বিলুপ্ত। আজ আর সেই জাতিভিত্তিক সভ্যতার কোন অস্তিত্ব নেই। যেসব জাতি গড়ে তুলেছিল সিন্ধু সভ্যতা, মেসোপটেমীয় সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা। তারা কি আজ আর টিকে আছে? তারা হারিয়ে গেছে কালের আবর্তে। আসলে তারা হারিয়ে যায়নি। বরং তারা আজও টিকে রয়েছে এসব অঞ্চলের ভূমিসন্তানদের মধ্যে আজকের নানান জাতিগুলোর মধ্যে। এভাবে পৃথিবী থেকে জাতিসত্ত্বার বিলুপ্তিতেই জন্ম নেয় নতুন জাতিসত্ত্বা। প্রাচীন জাতিগুলোর উত্তরাধিকারেই হলো আজকের জাতিগুলো। এরাও একদিন হারিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। এত কোন সমস্যা নেই। বরং এটাই হওয়া উচিত।

তাহলে ইহুদী জাতিটার পৃথিবীতে এতদিন ধরে টিকে থাকার আদৌ কি কোন দরকার ছিল, যেখানে প্রাচীন আমলের তাদের সমসাময়িক জাতিগুলোর একটাও আর স্বরূপে নেই? এই প্রশ্নের কোন সদুত্তর কখনও পাওয়া যায়নি। প্রাচীন সুমেরীয়, ব্যাবিলনীয়, অ্যাসিরীয়, ক্যালদীয়, মিডীয়, হিট্টীয় ইত্যাদি জাতির ইতিহাস থেকে বিলুপ্তি মানব জাতির জন্য কোন ক্ষতির কারণ হয়নি। তাহলে কেন ইহুদী জাতিটির এই টিকে থাকা? এর কারণ হল অন্য জাতিগুলো নতুন জাতিতে বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু ইষ্রার বিধান ইহুদীদের জাতিসত্ত্বাকে বিলুপ্ত হতে দেয় নি। কিন্তু তা পৃথিবীর জন্য কোন মঙ্গলজনক বিষয় হয়নি। বরং আপদ হিসেবে এই জাতিটি ইতিহাসের পাতায় নিজেদের নাম উঠিয়েছে।

ইষ্রা এটি কেন করেছিলেন? তার কারণ তিনি চেয়েছিলেন ইহুদীদের ওপর যাজকতন্ত্রের নিরংকুশ আধিপত্য ও দাপট। এই যাজকতন্ত্র কোন অংশেই রাজতন্ত্র থেকে কম যায় না। ইতিহাসের বিশাল অংশ জুড়ে আমরা খ্রিস্ট ধর্মীয় যাজকতন্ত্রের দাপট দেখতে পাই। এর আদি সংস্করণটি হলো এই ইহুদী যাজকতন্ত্র। যাজকতন্ত্র নামের এই নিষ্ঠুর ব্যাধিটি ইসরাইলী নবীদের বিপ্লবী ধর্মমতের সকল প্রাণশক্তি কেড়ে নিয়েছে। ধর্মকে নিয়ে গেছে প্রাণহীন আচার সর্বস্বতার দিকে। সৃষ্টিকর্তার নামে হয়েছে নোংরা ব্যবসা। ধর্মব্যবসা আর যাজকতন্ত্র একে অপরের পরিপূরক। যে সৃষ্টিকর্তার বাণী দিয়ে নবীরা নিপীড়িত মানুষকে রাজদ্রোহের পতাকাতলে সমবেত করেছেন সেই সৃষ্টিকর্তার নামে যাজকতন্ত্র খেটে খাওয়া মানুষের ঘাড়ে চাপিয়েছে করের বোঝা। স্রষ্টার নামে যাজকতন্ত্র নিজেদের অনুশাসন দৃঢ় করার জন্য মনগড়া বিধান চাপিয়েছে জনসাধারণের ওপরে। আমরা দেখেছি ইহুদি সমাজে কিভাবে বৈষম্য ও শোষণ ফিরে এসেছিল। এই বৈষম্যের সুফলভোগী শোষক শ্রেণির প্রয়োজনেই জন্ম নেয় যাজকতন্ত্র যা শোষণের দৈব বৈধতা এনে দিয়েছিল। আচার্য ইষ্রার বিধান ছিল শোষণ প্রক্রিয়ার পরিপূরক এই যাজকতন্ত্র সৃষ্টির পটভূমি। যে একত্ববাদ এসেছিল দৈব শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বার্তা নিয়ে, সেই একত্ববাদের অনুসারি সম্প্রদায় এভাবেই একদিন বিসর্জন দিল একত্ববাদের মূল চেতনাকে। তাদের অভ্যন্তরেই চালু হল দৈব শোষণ, একত্ববাদী ধর্মীয় ব্যবস্থার বিকৃত রূপ যাজকতন্ত্রের মদদে।

আর্যভাষী দেশে দেশেঃ-
প্রাচীন হিব্রুভাষীদের ঘিরে ইতিহাসের যে আবর্তন আমরা দেখেছি, তাতে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে মিসরীয় সভ্যতা, মেসোপটেমীয় সভ্যতা এবং পারস্য সভ্যতার কথা। মেসোপটেমীয় ৪ টি সভ্যতার অবস্থান ছিল দজলা ও ফোরাত নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে। আলেকজান্ডার এই অঞ্চলের নাম দেন ‘মেসোপটেমিয়া’ অর্থাৎ দুই নদীর মধ্যবর্তী জায়গা। মেসোপটেমীয় সভ্যতাগুলো হল-বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন শহর নিয়ে গড়ে ওঠা সর্বপ্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতা, প্রাচীন ব্যাবিলন নগরীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওটা আমোরীয়দের প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, নিনেভা শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অ্যাসিরীয় সভ্যতা এবং নতুন ব্যাবিলন নগরীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ক্যালদীয় সভ্যতা। মেসোপটোমীয় সভ্যতাগুলোর পরে আসে আর্য পারস্য সভ্যতা। তখনও পর্যন্ত দুনিয়ার আর কোথাও এত জমজমাট সভ্যতার দেখা পাওয়া যায় না।

এর বাইরে সিন্ধু ও চৈনিক সভ্যতা ছাড়া এশিয়ার আর কোথাও উল্লেখযোগ্য কোন নগর সভ্যতা গড়ে ওঠেনি। সিন্ধু সভ্যতাও বহু আগে খ্রিস্টপূর্বে ৩২৫০ থেকে ২৭৫০ সালের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। কোন এক অজানা কারণে এশিয়ার অনেক অঞ্চলে তখনও সভ্যতার আলো পৌঁছায় নি। তবুও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠা সভ্যতাগুলোই ছিল পৃথিবীর সেরা সভ্যতা।
অন্যদিকে আফ্রিকা ও ইউরোপের সামান্য জায়গা ছাড়া বাকী পুরোটাই ছিল ঘোর অন্ধকারে ঢাকা। আফ্রিকার মিসর ছাড়া বাকী পুরো মহাদেশটাই ছিল অন্ধকারে। এ সময় সভ্যতায় সবচেয়ে পিছিয়ে ছিল ইউরোপ। গোটা ইউরোপ জুড়ে তখন অন্ধকারের রাজত্ব। ইউরোপের মূল ভূখন্ডে তখন ঘুরে বেড়াচ্ছে যাযাবর টিউটন জাতির লোকেরা। আর্যদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত ইউরোপের কোন ইতিহাস নেই। কারণ আদিম জীবনের তেমন কোন ইতিহাস থাকে না।

ইউরোপের মূল ভূখন্ডে সভ্যতার সূচনা ঘটায় এশিয়া মাইনর থেকে আসা আর্যরা। ‘আর্য’ বলতে এখন আর জাতি বোঝায় না। বরং ছাড়াছাড়ি হওয়ার আগে এশিয়া মাইনরের উত্তরের অধিবাসীরা যে ভাষায় কথা বলত, সেই ভাষাটিকে ‘আর্য’ ভাষা বললে বেশি সঠিক বলা হয়। জাতিসত্ত্বার ভিত্তি হল স্বাধীন ভূখন্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস। আর্যরা ছিল মেষপালক ও যাযাবর প্রকৃতির। সম্ভবত খাদ্যাভাবের ফলে তারা ৩৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, যা চলতে থাকে পরবর্তী ২০০০ বছর ধরে। ২০০০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে তারা এশিয়ার ভারত, মধ্যপ্রাচ্যের পারস্য অর্থাৎ ইরান, এশিয়া মাইনরের পশ্চিম অংশ তুরষ্ক এবং ইউরোপের দক্ষিণে গ্রিস ও ইতালিতে বসতি গড়ে তোলে। ছাড়াছাড়ি হবার পর এই দলগুলো আলাদা আলাদা এক একটা জাতি হিসেবে গড়ে উঠেছিল। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভাষাও তৈরি হয়েছিল-সংস্কৃত, ফারসি, হিট্টীয় ভাষা, গ্রিক আর ল্যাটিন। ছাড়াছাড়ি হবার আগে পর্যন্ত এরা সকলেই যে একই ভাষায় কথা বলত, তা এই কটি প্রাচীন ভাষার অনেক মিল দেখে বোঝা যায়। পৃথিবীর সকল ভাষায় মূল উৎস যে ৭টি ভাষা বংশ চিহ্নিত করা হয়েছে তার অন্যতম হল আর্যদের ভাষা এ ভাষার নাম ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা।

আর্যদের যে শাখাটি ইউরোপের দক্ষিণে গিয়ে পৌঁছেছিল তাদের বংশধররাই একসময় গড়ে তোলেছিল গ্রিক ও রোমান সভ্যতা ও এরও আগে গড়ে তোলে মাইসেনীয় সভ্যতা। এ সময় ইউরোপের অন্ধকার ইতিহাস বাঁক নিল আলোর দিকে। মিশরীয় ও সুমেরীয় সভ্যতার সূচনার কয়েক হাজার বছর পরে গড়ে ওঠে গ্রিক ও রোমান সভ্যতা। আর্যদের একটি শাখা যখন এভাবে ইউরোপকে নিয়ে চলেছে, ইতিহাসের পথে, তখন আর্যদের আরেকটি শাখা মেসোপটেমীয় সভ্যতার অবসান ঘটিয়ে গড়ে তোলেছে বিশাল পারস্য সাম্রাজ্য।
গ্রিক সভ্যতার উত্থানের সময় মধ্যপ্রাচ্যের পারস্য সভ্যতা ছিল শক্তিতে দুনিয়ার সেরা। ৫৩৮ খ্রিস্টপুর্বাব্দে পারস্য সম্রাট সাইরাস এ শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। পারস্য সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়েছিল মিসর থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের সিন্ধু নদ পর্যন্ত। এর আগে এত বড় সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব পৃথিবীতে আর দেখা যায় না। গ্রিকদের সাথে পরাসীয়দের সম্পর্ক মধুর হয় নি। পরষ্পরের সাথে তারা যুদ্ধে জড়িয়েছে বারবার। এ যুদ্ধে অবিশ্বাস্য ভাবে প্রত্যেকবারই পারসীয়রা হেরে গিয়েছে গ্রিকদের কাছে, বিপুল সৈন্যশক্তি থাকা সত্ত্বেও। পারসীয়দের এ পরাজয় গ্রিকদের উত্থানের পথ সুগম করে। পারস্য সভ্যতাকে ফেলে গ্রিক সভ্যতা পৌছে যায় সভ্য দুনিয়ার শীর্ষে। খ্রিস্টপুর্বে ৪৮০ থেকে ৪৩০ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ ৫০ বছর গ্রিকরা সভ্যতায় দুনিয়ার শীর্ষে থাকলেও তাদের প্রতিপক্ষ পারসীয়দের সাথে আর কোন যুদ্ধে জড়ায় নি।

গ্রিক সভ্যতার পুর্বে অবশ্য ইউরোপ এশিয়ার মধ্যবর্তী ইজিয়ান সাগরকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল আরেকটি ইউরো-এশিয়া সভ্যতা। এর নাম ইজিয়ান সভ্যতা। এ সভ্যতা ছিল দুটি অংশে বিভক্ত। একটি ছিল ইজিয়ান সাগরের দ্বীপমালা ও তুরষ্কের উপকুল এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা মিনীয় সভ্যতা এবং অপরটি ছিল গ্রিসের উপকূলবর্তী মাইসেনিয়া শহরকে কেন্দ্র করে বিকশিত মাইসেনীয় সভ্যতা।
ইজিয়ান সাগরের প্রশস্ত দ্বীপ-‘ক্রীট’ দ্বীপকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল মিনীয় সভ্যতা। ক্রীট দ্বীপের ‘নসাস’ শহর ছিল মিনীয় সভ্যতার মূল কেন্দ্র। শহরটি ছিল সাগর থেকে ৩ মাইল ভেতরে। দেয়াল ঘেরা এই শহরে ছিল চমৎকার সব প্রসাদ। ক্রীটের ভৌগলিক অবস্থা ছিল বানিজ্যের জন্য অনুকূল। আবার পাহাড় আর সাগরের বেষ্টনী বিদেশী আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। ধারণা করা হয় একটি কৃষক সম্প্রদায় ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম ক্রীটে বসতি গড়ে তোলে। শহর সমূহ গড়ে ওঠে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে, অর্থাৎ মিশরীয় ও সুমেরীয়দের প্রাচীন শহরগুলোর সমসাময়িক ছিল সেগুলো। ক্রীটের রাজাদের উপাধি ছিল ‘মিনস’। আর এ থেকেই তাদের রাজ্যের নাম হয় মিনীয় রাজ্য। মিনীয়দের যেসব লেখা পাওয়া গেছে, তা আজও পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। যে সব লিখন পদ্ধতি পাঠোদ্ধারের বাইরে রয়ে গেছে, তার মধ্যে অন্যতম হল এইসব মিনীয় লিপি। ক্রীটবাসীদের বাণিজ্যপোত যাতায়াত করত মিসর এবং পূর্ব ও পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে।
অন্যদিকে ইজিয়ান সভ্যতার অন্য অংশটি গড়ে তোলে ইউরোপে আসা প্রথম দিকের আর্যভাষীরা। মিনীয়দের সংস্পর্শে আসা এই আর্যরা গ্রিসের উপকূলীয় শহর মাইসেনিয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলে মিনীয় প্রভাব সমৃদ্ধ এই সভ্যতা। এটাই ইউরোপর মূল ভূখন্ডের সর্বপ্রাচীন সভ্যতা। যা ছিল আর্যদের অবদান।

আর্যভাষীদের সাথে সভ্যতার ইতিহাস ইহুদিদের মতই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। তবে ইতিহাসে তাদের ভূমিকা ইহুদিদের মত পরাধীনতা সর্বস্ব নয়, বরং তৎকালীন পৃথিবীর বিশাল আকারের সভ্যতাগুলো গড়ে তুলেছিল তারাই। প্রকট দখলদারি চরিত্র থাকার কারণে তারা অনেক দেশ দখল করে নিতে পেরেছিল। ভারতবর্ষে আসা আর্যদের রচিত রামায়ন, মহাভারতে তাদের এই চরিত্রটিই প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। রামায়নে যে লঙ্কার রাখা রাবনের উল্লেখ রয়েছে, তিনি ছিলেন এ ভূখন্ডের প্রকৃত অধিবাসী এবং সেই সাথে বলা যায় ভূখন্ডের স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধের সবচেয়ে পুরনো বীর। আধিপত্যবাদী রামের দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ দেওয়া এই অনার্য বীরকে আর্যরা তাদের রামায়নে রাক্ষস বলে চিহ্নিত করেছে। স্বাধীনতাকামী অনার্যদের তারা রাক্ষস-খোক্ষস অভিধায় ভূষিত করেছে। সেভাবে সন্ত্রাসী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন তৃতীয় বিশ্বের বীরদেরকে সন্ত্রাসী অভিধায় চিহ্নিত করে থাকে। ভারতে আসা আর্যদের সাথে এখানকার অনার্যদের রক্তের সংমিশ্রণের ফলে বাঙালী জাতির মত বহু মিশ্র জাতির সৃষ্টি হয়েছে। সংমিশ্রণ ঘটেনি এমন জাতিও রয়েছে যেমন- তামিল, দ্রাবিড় ইত্যাদি।
এখানকার আর্যদের রচিত রামায়ন মহাভারতের সাথে গ্রিসের আর্যদের রচিত ইলিয়াড ওডিসির দারুন মিল দেখা যায়। রামায়নের গীতা ছিলেন দেবতার স্ত্রী আর ইলিয়াড-ওডিসির হেলেন ছিলেন দেবরাজ জিউসের জারজ কন্যা। উভয়েই অপহৃত ও মুক্ত হয়েছিলেন দীর্ঘ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এভাবে দুনিয়া জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে আর্যদের কীর্তির কথা।

কাস্পিয়ান সাগর সংলগ্ন এশিয়া মাইনরের উত্তরের তৃণভূমি এলাকা ছিল আর্যদের আদি নিবাস। ভাষার দিক থেকে তারা ছিল ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাভাষী। সংখ্যায় বেড়ে গেলে একসময় তারা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন দিকে। একটি শাখা দক্ষিণ পুর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে এসে পৌঁছায় ভারতে। একটি শাখা দক্ষিণ পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে ইরান অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে। এদের মধ্য দিয়েই বিকাশ লাভ করে পারস্য সভ্যতা। আরেকটি শাখা দনিয়ুব নদী অতিক্রম করে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে বলকান উপদ্বীপে এসে পৌঁছায়। এরাই গ্রিক-রোমান জাতির পূর্বপুরুষ। ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাভাষী এই জনগোষ্ঠী গ্রিসের মূল ভূখন্ডে বসতি গড়ে তোলে। এই অঞ্চলের সাথে মিনীয়দের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। ক্রমে এখানে মিনীয় সংস্কৃতি প্রবেশ করতে থাকে। মাইসেনিয়া শহর ছিল এই সংস্কৃতি বিকাশের কেন্দ্র। তাই এই অঞ্চলে গড়ে ওঠা সংস্কৃতি মাইসেনীয় সংস্কৃতি নামে পরিচিত হয় ।
মাইসেনিয়াতে ইজিয়ান সংস্কৃতি উন্নতির চরমে পৌঁছে ১৫০০ থেকে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে। মিসর, ক্রীট, সাইপ্রাস ও উত্তরের বিভিন্ন নগরের সাথে মাইসেনিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। এক সময় ইজিয়ান সভ্যতারও অবসান ঘটে। আর্যদের অন্য একটি শাখা ডোরীয় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী এক আক্রমণকারি গোষ্ঠি উত্তর দিক থেকে এগিয়ে আসে মাইসেনিয়ায়। ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে সমগ্র ইজিয়ান অঞ্চল এদের অধিকারে চলে যায়।
ইজিয়ান অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী আর্যরা বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। যেমন-এচীয়, আইওলীয়, ইওলীয় এবং ডোরীয়। ১১৫০ থেকে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে সমগ্র গ্রিস চলে যায় ডোরীয়দের দখলে। এই ডোরীয়রে সাথে মিশ্রণ ঘটেছিল ইজিয়ান আর্যদের। ফলে একটি শক্তিশালী জাতির উদ্ভব হয়। গ্রিস জুড়ে তারা ক্রমে একটি নতুন সভ্যতা গড়ে তোলতে শুরু করে। এ সভ্যতার একটি বিশেষত্ব ছিল। তা হল, এটি কোন নদীতীরে গড়ে ওঠেনি। তখন পর্যন্ত সবগুলো সভ্যতাই নদীতীর বা সমুদ্রতীরে গড়ে উঠতে দেখা গেছে। গ্রিক সভ্যতাই প্রথম, যা ভূখন্ডের গভীরে গড়ে উঠেছে পাহাড়ী এলাকার কাছে।

ভৌগলিকভাবে গ্রিস দেশটা ছিল কিছুটা ভিন্ন। খাড়া খাড়া পাহাড়ের কারণে দেশটি ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে বিভক্ত। ফলে জন্ম হয় অনেকগুলো নগর রাষ্ট্রের। ১১০০ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কালে গ্রিসের ইতিহাসের তেমন কোন উপাদান খুঁজে পাওয়া যায় না। একমাত্র হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসিতে এ সময়ের কথা কাহিনীর চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। এসব কাহিনীতে দেখা যায় দেবদেবী আর মানুষে মাখামাখি সম্পর্ক। সেমেটিকদের মতো সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার অনুশাসন মেনে চলার কোন ব্যাপার তাদের মাঝে ছিল না। ইলিয়াড ও ওডিসিতে রামায়ন-মহাভারতের মতই প্রচলিত সামাজিক ধর্মের চেহারা ফুটে উঠেছে। গ্রিকদের সেই ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় ইলিয়াড ও ওডিসি এখন আর ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা পায় না; বরং সাহিত্যের মর্যাদা পায়। অন্যদিকে রামায়ন-মহাভারত এখনও সনাতন ধর্মের অনুসারিদের কাছে ধর্মীয়ভাবে পাঠ্য ।
ইলিয়াড-ওডিসি এবং রামায়ন-মহাভারতের দেবদেবীর ধারণা এত কাছাকাছি যে, দুই অঞ্চলের ধর্ম আলাদা দুটি ধর্ম নাকি একই ধর্ম তা নিরূপণ করা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি সিরিয়ার উত্তরের আর্যদের আরেকটি গোষ্ঠী মিতানীদের ধর্মবিশ্বাসেও ভারতীয় বৈদিক দেব-দেবীর অস্তিত্ব দেখা যায়। তুরস্কের বোগাজকুই নামক জায়গায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে আর্যভাষী মিতানীদের সম্বন্ধে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র প্রভৃতি বৈদিক দেবতারা মিতানীদেরও দেবতা ছিল। তবে এসব দেব-দেবীর ধর্মের চেয়ে পৃথিবীতে এক সর্বশক্তিমান স্রষ্টায় বিশ্বাসী ধর্মের ধারাসমূহ নিরংকুশভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে।
একত্ববাদী সেমেটিক ধর্মের ধারায় উদ্ভুত খ্রিস্টধর্মের তোড়ে গ্রিক ও রোমান দেব-দেবীরা ভেসে গেছে ইতিহাসের বিস্তৃতির আড়ালে। আর একত্ববাদী ধারায় সবচেয়ে র্যা ডিকেল ধর্মমত ইসলামে প্রবেশ করেছে ভারতীয় আর্যদের হাতে নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার অনার্য শুদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ। আর্য ধর্মীয় ধারায় অবশ্য ভারতবর্ষীয়দের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনও টিকে আছে। এখনও আর্য ব্রাহ্মণরা মন্ত্র পাঠ করে আর্যভাষার অন্যতম নির্দশন সংস্কৃত ভাষায়।

অন্যদিকে ইরানী তথা পারসীয় আর্যরা প্রথমে জরথ্রুস্তবাদ ও পরে ইসলামে প্রবেশ করে। এর আগেও পারসীয়দের দেখা যায় একেশ্বরবাদী ইহুদিদের পৃষ্ঠপোষকতায়। পারস্য সম্রাটদের বিপুল অর্থ বিত্ত সহকারে ইহুদি ধর্মের পেছনে পৃষ্টপোষকতার কথা, ওল্ড টেস্টামেন্টার ইষ্রার পুস্তকে সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। তবে এই পৃষ্টপোষকতা ইহুদি আচার্য ইষ্রাকে শোষিত মানুষের প্রতিনিধিত্বকারি একত্ববাদী ধর্মের মূল চেতনা থেকে বিপথে নিয়ে যায়। নিজের যাজকতন্ত্রের ক্ষমতাকে নিরংকুশভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ধর্মকে তিনি বানিয়েছিলেন শোষণের হাতিয়ার, যা তাকে ঠেলে দেয় ইহুদি জাতির উপর বিশুদ্ধতার অনুশাসন চাপানোর দিকে। আর এ কাজের বৈধতা প্রমাণের জন্য তিনি ব্যবহার করেছিলেন নিজের বানানো অবৈধ দৈব বিধানের যুক্তি। ধর্মকে শোষণের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবৈধ ও বানোয়াট দৈব বিধান প্রবর্তনের এই পর্বটিতে এসে ভারতীয় আর্যভাষীদের সাথে হিব্রু ভাষীদের দারুন মিল দেখা যায় । প্রাচীন মানুষের ভিন্ন দুটি ঐতিহাসিক ধারা হিব্রু ভাষী ও ভারতীয় আর্যভাষীদের মধ্য থেকে উদ্ভুত বর্ণবাদের দুটি আলাদা ধারা যায়নবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রকৃতিতে অভিন্ন। ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের শেকড় অনুসন্ধানের পরে আমরা আবার ফিরে যাব আর্য ইতিহাসের সবচেয়ে সুদৃষ্টান্ত, গ্রিক সভ্যতার কথায়।

প্রাচীন জীবন ও অর্থনীতিতে শ্রেণি বিভাজনের ব্যাপারটি খুবই স্পষ্ট। সমাজের একদিকে অপ্রয়োজনীয় ফুর্তি বিলাসের বিপুল আয়োজন আর অন্যদিকে এসবের মূল্য দিচ্ছে শ্রমজীবী দাস, কারিগর ও প্রজাসাধারণ। যে ক্রীতদাস ও প্রজাদের শ্রমের সুফল ভোগ করে মালিক ও বড়লোকদের এত বিলাসিতা, সেই ক্রীতদাস ও প্রজারা প্রতিদানে পেত বড়লোকের চাবুকের ঘা, নিষ্ঠুর অত্যাচার ও দুঃখ দারিদ্র পীড়িত মানবেতর জীবন। এ অবস্থাটা বজায় রাখার জন্য সুবিধাভোগী বড়লোক শ্রেণির হাতে যেসব শক্তিশালী অস্ত্র ছিল তার অন্যতম হল তাদের স্বরচিত ধর্ম। সেই সব ধর্মে দেখা যায় খড়গহস্ত দেবী আর বল্লমধারী দেবতাদের ছড়াছড়ি। শোষণের ওপর গড়ে ওটা সমাজ ব্যবস্থাটাকে এসব দেব-দেবীরা পাহারা দিতেন। বড়লোকদের সাথে শোষণের অংশীদার ধর্ম যাজক ও পুরহিতকুল শোষণে জর্জরিত মানুষদের বোঝাত, তাদের দুর্গতির মূল হল দৈব বিধানের প্রতি অশ্রদ্ধা, পূর্বজন্মের পাপ ইত্যাদি। সমাজবিধির লংঘন কিংবা বিদ্রোহের শাস্তি হিসাবে দেখানো হত দেব-দেবীর বল্লমের ভয়, অভিশাপের ভয়। এ ভয়ে জবুর্থবু হয়ে থাকত শোষিত মানুষ। তাই মনমত দৈববিধান প্রবর্তনে কোন অসুবিধা ছিল না।

গ্রিক দেব-দেবীরা যেভাবে সাহিত্যের চরিত্র হয়ে উঠেছেন তার বিপরীতে ভারতীয় দেব-দেবীরা হয়ে উঠেছেন শোষণের পাহারাদার। প্রাচীন ভারতের আর্য ধর্মের শোষণ ও বর্বরতার প্রতীক হলে ওঠার পর্বটি শুরু হয় মনুর বিধানের মধ্য দিয়ে। ইহুদি আচার্য ইষ্রার জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশুদ্ধতার বিধানের আর্য সংস্করণ যিনি নিয়ে এলেন তার নাম মনু। ভারতীয় আর্য ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় রাজ-রাজড়াদের শোষণের দৈব অধিকার প্রতিষ্টায় তিনি সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। আর্য রক্তের বিশুদ্ধতা ও শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার জন্য তিনি ফিরিয়ে আনলেন বেদের বর্ণবাদী অনুশাসন। এ অনুশাসন পালনে কঠোরতা আরোপ করতে গিয়ে তিনি যে সংহিতা রচনা করলেন তার নাম মনুসংহিতা। কি আছে সেই মনুসংহিতায়? যা আছে তা শুনলে আতংকে রক্ত হিম হয়ে যায়। অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতায় অনার্যদের জন্য একটি নরকতুল্য পৃথিবী সৃষ্টি করলেন মনু তাঁর এই মনুসংহিতায়। তাদেরকে বানালেন আর্যদের ক্রীতদাস, অস্পৃশ্য ও অপবিত্র জীব। এরা হল শুদ্র। অন্যদিকে আর্যদের বানালেন সৃষ্টির প্রভু। এরা হল ব্রাহ্মণ - প্রভুর জাত। এদেরকে স্পর্শ করাও শুদ্রের জন্য মহাপাপ। অন্য দিকে কোন ব্রাহ্মণ যদি নিকৃষ্ট জাত শুদ্রদের কাউকে মেরেও ফেলে তাহলে যে সামান্য পাপ হবে, তা মোচনের জন্য তিন রাত দুধ পান করা বা এক যোজন রাস্তা হাটা অথবা নদী স্নান করাই যথেষ্ট। এছাড়াও বিড়াল, নেউল, কুকুর, গোসাপ, প্যাঁচা বা কাক মেরেও শুদ্র হত্যার প্রায়শ্চিত্ত করা যাবে। (মনুসংহিতা, শ্লোক ১৩১ ও ১৩২)।

হাম্মুরাব্বির আইন সংহিতায় নিম্নজাত মুশকেলুমের ওপর উচ্চজাত আওএলুমের যে দৈব শ্রেষ্টত্ব দেওয়া হয়েছে, তার সাথে মনুর বিধানের মিল পাওয়া যায়। তবে মনুর বিধান তার চেয়েও অনেক বেশী অন্যায় ও পক্ষপাতদুষ্ট। মনুর কথায় দাসত্বের জন্যই শুদ্রের সৃষ্টি (মনুসংহিতা ৮:৪১৩)। ক্ষুন্ন না হয়ে, প্রসন্নমনে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের সেবা করা শুদ্রগণের প্রধান কর্তব্য (মনুসংহিতা ১:৯৯)। শুদ্র নামের এই দাসদের কোন পারিশ্রমিক দিতে হত না। কিন্তু গতর খাটাবার জন্যই তো এদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তাই মনু বিধান দিলেন-শুদ্রভৃত্যকে উচ্ছিষ্ট অন্ন, জীর্ণ বসন, জীর্ণ শয্যা বা কুটির দান করিবে (মনুসংহিতা ১০:১২৫)। ভারতবর্ষের আদি সন্তান এই শুদ্রদের সম্পদ সৃষ্টির অধিকার ছিল, কিন্তু ভোগের অধিকার ছিল না। ভোগের অধিকার ছিল মালিকদের (মনুসংহিতা ৮: ৪১৬ এবং ৪১৭)। তিন বর্ণের মানুষদের চেয়ে যাতে শুদ্রদের আলাদাভাবে চেনা যায় সেজন্য প্রতি মাসে তাদের কেশ মুন্ডনের নির্দেশ দিলেন মনু (মনুসংহিতা ৫:১৪০)। এটাই হল মোটামোটিভাবে ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদের নৃশংস ও দানবীয় চেহারা।

আধুনিক ভারতের সংবিধান রচয়িতা শুদ্রজাত ড.বি.আর. আম্বেদকর ১৯৪৮ সালে অস্পৃশ্যদের আধুনিক আইনের মারপ্যাঁচে মনুবাদের বেড়াজালে আটকানোর জন্য মহাত্মা গান্ধী কর্তৃক তাদের হরিজন নামে অভিহিত করার ফন্দি ও কৌশলের প্রতিবাদে জানাতে গিয়ে তাঁর The Untouchables: A Thesis on the Orgins of untouchabitity গ্রন্থে বলেন, “হিন্দু সভ্যতা ......... মানব সভ্যতাকে ক্রীতদাস বানাবার একটি কৌশল। এর যথার্থ নামকরণ হওয়া উচিত ‘কলঙ্ক’। একটি সভ্যতাকে আর কী অভিধায় চিহ্নিত করা যায়, যা সাধারণ মানুষকে ........ যাদের অস্তিত্বকে দেখা হয় সামাজিক মেলামেশা থেকে বাইরের কোন প্রাণী হিসেবে ....... যাদের একটুখানি স্পর্শ অপবিত্র বলে বিবেচিত হয়”।
মনুর পরে ব্রাহ্মণ্যবাদী নিষ্ঠুরতায় যিনি সবচেয়ে বেশী কৃতিত্বের পরিচয় দেন তিনি হলেন শংকরাচার্য। তার আবির্ভাবকাল ৬৭৭-৭২০ খ্রিস্টাব্দ। শশাংকের রাজত্বকালের শেষদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিজয় পতাকা উড়িয়ে তিনি কেরালা থেকে বের হলেন ভারতভূমি পরিক্রমণে। তার এই পরিক্রমণ সম্পর্কে তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মীয় পুস্তকে বলা হয়েছে। শংকরের আগমণে বৌদ্ধবিহার গুলি কম্পমান হইত এবং ভিক্ষুগণ ছত্রভঙ্গ হইয়া পলায়ন করিত। - ড. মনিকুন্ত হালদার, বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস। পৃষ্টা ৩২৩।

মনুর বিধানে শুদ্ররা অস্পৃশ্য হলেও তবু তো তারা ব্রাহ্মণ্যধর্মের অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু বৌদ্ধ? সে তো বর্ণেরই বাইরে। অতএব সে কদাচারী, পাপিষ্ট এবং একদমই পরিত্যাজ্য। তাকে হত্যা করলে পাপ তো হবেই না, বরং দ্বিজ ব্রাহ্মণের অর্জিত হবে পূণ্য। এর মানে হলো যারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম মানে না, তারা কুকুর, সাপ বা বেজীরও অধম। এদেরকে শায়েস্তা করার জন্য মহাব্রাহ্মণ শংকরাচার্য নিখাদ হিংস্রতায় ভারতজুড়ে চালালেন নারকীয় বৌদ্ধ হত্যাযজ্ঞ। ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাদে আর্য ব্রাহ্মণ পুষ্যমিত্র শুঙ্গ যে বৌদ্ধ নিধনযজ্ঞ শুরু করেন, তার দানবিক ব্যাপ্তি ঘটিয়ে শংকরাচার্য রাজকীয় সৈন্য সহযোগে হত্যা করলেন অসংখ্য বৌদ্ধধর্মাবলম্বীকে। শংকরাচার্যের আজ্ঞাবহ রাজা সুধন্বা প্রভৃতির মত রাজাদের হত্যার শিকার ৬৪০০০ বৌদ্ধের কথা উদ্ধৃত হয়েছে প্রাচীন শিলালিপিগুলোতে (রাহুল সাংকৃত্যায়ন : ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান পতন, পৃষ্টা ১২)।
শংকরাচার্য যে রাজ্যে পা রাখতেন সেখানকার বৌদ্ধধর্মীরা প্রাণভয়ে বনেজঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিতেন। বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি তার নিষ্ঠুরতার নমুনা হল, তার নির্দেশে ওদের হাত পা বেঁধে নিক্ষেপ করা হত ফুটন্ত তেলভর্তি কড়াইয়ে। যে বর্ণের ভিত্তিতে আর্য ব্রাহ্মণবাদের এত নিষ্ঠুরতা সেই বর্ণের বিশুদ্ধতার ভিত্তি কতটুকু ছিল? ইহুদি রক্তের বিশুদ্ধতার যায়নবাদী ভিত্তি যেভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে ইব্রাহিম-মুসা-দাউদ-সলোমনের পরজাতীয় কন্য বিবাহের ঘটনায়, ঠিক সেভাবেই আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদের ভিত্তি খসে পড়ে-খোদ মহাভারতের রচয়িতা ব্যাস দ্বৈপায়নের শুদ্র মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়ার ঘটনায় এবং বেদের অন্যতম রচয়িতা ঋষি বশিষ্ঠর বেশ্যা গর্ভজাত হওয়ার ঘটনায় (দীনেশচন্দ্র সেন : বৃহৎ বঙ্গ, প্রথমখন্ড, পৃষ্টা ১২০) ।
ব্যাস দ্বৈপায়ন এবং বশিষ্ঠ দুজনেই ব্রাহ্মণ ধর্মের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যদিও তাদের মধ্যকার সময়ের ব্যবধান অনেক। একজন মহাভারতের রচয়িতা অপরজন বেদের রচয়িতা। দুজনকেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সংগে বলা হয়-মহর্ষি অর্থাৎ মহা ঋষি। ঋষি নামক এই পরজীবী শ্রেণিটির সৃষ্টি আর্যরা ভারতে আসার ২০০ বছর পরে।

আর্যভাষীরা হিন্দুকুশ পর্বতমালা পেরিয়ে উপমহাদেশে প্রবেশ করে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। তারা প্রথমে এসে পৌঁছায় গান্ধার রাজ্যের তক্ষশিলায়। তক্ষশিলার অবস্থান বর্তমান পাকিস্তানে এবং গান্ধার রাজ্যের বর্তমান নাম আফগানিস্তানের কান্দাহার। সেই সময়ে আর্যরা ছিল নিরক্ষর কিন্তু ভারতভূমির অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলন ছিল লেখার। লেখ্য সংকেত লিপির সাহায্যে তারা লেখত। অথচ আর্যরা ভারতভূমির এই প্রাকৃতজনদের অভিহিত করল ‘অনার্য’ নামে যার আভিধানিক অর্থ অসভ্য ও অসুর এবং নিজেদের অভিহিত করল ‘আর্য’ নামে যার অর্থ সুসভ্য, শ্রেষ্ঠ। শিকারজীবী আর্যদের চেয়ে কৃষিজীবী অনার্যদের সমাজ ব্যবস্থাও ছিল উন্নত-যদিও তখনও রাষ্ট্র গড়ে ওঠেনি। রাষ্ট্র না থাকায় দাসতন্ত্র বা সামন্ততন্ত্রও গড়ে ওঠেনি। দাস শ্রম শোষণের ওপর ভিত্তি করে যে সমাজ গড়ে ওঠে তা দাসতন্ত্রী সমাজ, আর কৃষক প্রজাদের ফসলের ভাগ কেড়ে নেওয়ার যে অত্যাচারি ব্যবস্থা তার নাম সামন্ততন্ত্র। ভারতবর্ষের প্রাচীন অনার্য সমাজে তখনও এরকম ভাঙন সৃষ্টি হয় নি। শ্রেণি শোষণের উপযোগী অর্থনীতি তখনও যথেষ্ট বিকশিত হওয়ার বাকী। তাই কৃষিজীবী অনার্যদের মাঝে প্রচলিত ছিল এক ধরনের গুচ্ছগ্রাম ব্যবস্থা। একগুচ্ছ গ্রাম নিয়ে একেকটি স্বাধীন মানব বসতি গড়ে উঠত। এর নাম ছিল ‘জন’। আর জনের শাসক ছিলেন জনপতি। জনপতি নির্বাচিত হতেন জনের সকল সদস্যের সম্মতিতে। এসব জনপতিদের কেউ কেউ সাম্যবাদী নিয়ম ভঙ্গ করে সামন্ত হয়ে উঠতে চেয়েছেন, বাড়তি সুবিধা ও বিলাসীতার আশায়। কিন্তু জমিতে দাস খাটিয়ে কিংবা প্রজা বসিয়ে ফসলী কর আদায়ের মত উন্নত পর্যায়ে অর্থনীতি বিকশিত না হওয়ায় এসব স্বৈরাচারী জনপতিদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াত সৈন্যবল নিয়ে বিভিন্ন জনের গরু-ছাগল ডাকাতি করা। আর অনার্যদের সব কিছুর চেয়ে এই ব্যাপারটাই সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করল আর্যদের। আর্য জনপ্রতিদের মধ্যে যারা মুগুরভাজা শরীরের অধিকারি তারা হয়ে উঠলেন গরু মোষ ডাকাতির সর্দার।

ভারত ভূমিতে এসে কালক্রমে পশুপালনই হয়ে ওঠে আর্যদের প্রধান জীবিকা। অনার্যদের কাছ থেকে তারা অনেক কিছুই শেখে। তবে একটি ব্যাপারে তারা অবশ্যই অনার্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গিয়েছিল। এটা হল আধিপত্য ও শোষণকে চিরস্থায়ী করার কাজে ধর্মের ব্যবহার। অনার্য স্বৈরাচারী জনপতিরা একাধিপত্যকে চিরস্থায়ী করার কোন কৌশল আবিষ্কার করতে পারেনি। ফলে যখনই জন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে তাদেরকে গদি ছেড়ে পালাতে হয়েছে। অন্যদিকে আর্য জন পতিরা রাজত্বকে বিদ্রোহের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নিযুক্ত করলেন ঋষি নামক এক পরজীবী শ্রেণিকে। ততদিনে গরু-ছাগল ডাকাতি করে আর্য জনপতিরা ফুলে ফেঁপে হয়ে উঠেছেন ছোট ছোট সামন্ত বা রাজা। আর সামন্ততন্ত্রকে আধ্যাত্মিক কৌশলে নিরাপদে রাখার কাজে নিযুক্ত ভাঁড়াটে ঋষিরা নিজেরাই সৃষ্টি করলেন এক পাল দেবতা, যাদের বাস মর্তে নয়-স্বর্গ নামক এক কাল্পনিক জগতে। এরা অপরিমেয় ক্ষমতার অধিকারী। গোত্রাধিপতি থেকে যারা পরিণত হয়েছেন রাজায়, তাদের লাঠিয়াল ও বল্লমধারী বাহিনীর শক্তির সাথে এবার যুক্ত হল ঋষিদের সৃষ্টি এসব দেবতাদের শক্তি। রাজা সর্বদাই এসব দেবতাদের পছন্দের ব্যক্তি এবং দেবভক্তি আর রাজভক্তিতে কোন তফাৎ নেই। রাজভক্তিতে ঘাটতি থাকলে দেবতা অসন্তুষ্ট হন। মৃত্যুর পরে যেতে হবে দেবতাদের কাছেই। রাজদ্রোহী পাপীদের জন্য তখন ভয়ংকর শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন দেবতারা। ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে সাবলীল ভাষার ফুটিয়ে তুলেছেন পন্ডিত রাহুল সাংকৃতায়ন তাঁর ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’ বইটিতে।
এ ভূখন্ডে কালক্রমে শোষণবাদী আর্য ধর্ম একটি আকার ধারন করতে থাকে। এ ধরনের ব্যাপারে সময় লাগে ঢের। ইতোমধ্যে আর্যরা ভারতবর্ষে আসার পরে পেরিয়ে গেছে প্রায় ৩০০ বছর। সমান্ততন্ত্র, তখন দানা বাঁধছে ভারতের মাটিতে। স্বয়ংসম্পূর্ণ গুচ্ছগ্রাম অর্থনীতি যাচ্ছে হারিয়ে। তার জায়গায় আসছে ছোট ছোট রাজা। ছোট ছোট রাজ্য। অনার্য জন এর জনপতিরা রাজা হয়ে উঠতে পারেননি স্থায়ী ভাবে। কিন্তু আর্য জনপতিরা পান্ডা পুরুত সমেত দস্তুরমত রাজা হয়ে উঠছেন। তাই ক্ষমতার বেলায় শক্তিশালী আর্য রাজাদের কাছে জনগুলো পরাজিত হতে লাগল। এমনকি আর্য গোত্রপতি-রাজারাও পরষ্পরের সাথে লিপ্ত হত যুদ্ধে! স্বার্থ জাত মানে না।
ক্ষমতার লড়াইয়ে যারা টিকে থাকল তাদের ব্যক্তিশাসনের ভিত মজবুত করার কাজে নিযুক্ত মুনি ঋষিরা নানা দৈব বিধি বিধান প্রবর্তন করে চলেছেন দেবতার নামে। এসব দৈব বিধি-বিধানই সংকলিত হয় ঋকবেদে। ততদিনে প্রাথমিক যুগের যেসব আর্য গোত্রপতি গরু, মোষ ও ছাগল ডাকাতির ঘটনায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন, তার পরিণত হয়েছেন কিংবদন্তিতে। যুদ্ধবিজয়ী এসব ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন প্রবাদপুরুষ। আরো কয়েক পা এগিয়ে ঋকবেদের রচয়িতা অতি উৎসাহী তিন ঋষি বশিষ্ট, বিশ্বামিত্র ও ভরদ্বাজ এদেরকে বানিয়ে ফেললেন দেবতা। এর হলেন ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র, অগ্নি প্রভৃতি। এরা প্রত্যেকেই সুদুর অতীতে ছিলেন মর্ত্যরে মানুষ এবং বিখ্যাত গরুচোর। স্বয়ং ইন্দ্র, যিনি স্বর্গ দেবতাদের রাজা তাঁর সকল সুকর্ম-কুকর্মের মধ্যে প্রধানতম কাজটি ছিল গরু চুরি। (দিনেশচন্দ্র সেন; বৃহৎ বঙ্গ, প্রথম খন্ড, পৃষ্টা-২৪৪)। পশুপালন ভিত্তিক সেই সমাজে ধনসম্পদ বলতে এরা একমাত্র গরুকেই বুঝতো। এমন কি এদের ভাষায় যুদ্ধ আর গরুলাভের ইচ্ছা বোঝাতে একটাই শব্দ প্রচলিত ছিল।

ঋকবেদ রচনা শুরুর সময়কালে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। গঙ্গা-যমুনার সন্নিহিত উত্তর-পশ্চিম ভারতের প্রাচীন দেশ রোহিলাখন্ড ও মধ্যদোয়াব অঞ্চলের নাম তখন পঞ্চাল। পঞ্চালের রাজা দিবোদাসের রাজবেদী নিরাপদ রাখতে এগিয়ে এলেন তিন পরজীবী ঋষি। এরাই হলেন বশিষ্ট, বিশ্বামিত্র ও ভরদ্বাজ। পুরনো দিনের বিখ্যাত গরুচোরদেরকে তারা বানালেন পরম ক্ষমতাধর দেবতা। এমনকি এসব দেবতাদেরও একজন স্রষ্টার জন্ম দিলেন। তার নাম ঈশ্বর। তিনি দেবতাদেরও স্রষ্টা। দেবতারাও তার অনুগ্রহ প্রার্থী। তার বিধানই দেবতাদের বিধান। কী সেই বিধান? ঋষিরা জানিয়ে দিলেন রাজাকে দেবতারা পাঠিয়েছেন শাসন করতে। তার বিরুদ্ধাচরণ করলে দেবতারা ক্ষুদ্ধ হবেন, ঈশ্বরও ক্ষিপ্ত হবেন। আর ঈশ্বর ক্ষিপ্ত হলে নেমে আসবে বিপর্যয়। এই ঘোষণা দেওয়া হল যজ্ঞ করে, যার নাম অশ্বমেধ যজ্ঞ। এই ঘোষণার সাথে শুরু হলো ঋকবেদ নির্মাণের কাজ। তৈরি হয়ে গেল সামন্তবাদী শোষণের ভিত। গরু-মোষ হরণে পারদর্শী প্রাচীন আর্য গোত্রপতিরাই এ ব্যবস্থায় পরিণত হলেন বিখ্যাত দেবতায়। গরু-মেষ চুরিকে কেন্দ্র করে বেধে যাওয়া যুদ্ধে তাদের বিজয় ও বিক্রমই তাদের এনে দেয় এই গৌরব। ৪টি বর্ণের বিভাজন তখনও সৃষ্টি হয় নি। তবে ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণের-প্রাথমিক চেহারাটি দেখা দিচ্ছিল ধীরে ধীরে। এদের কর্মক্ষেত্রেও এসে গিয়েছিল বিভাজন। একজনের কাজ রাজপাট করা, দখল-লুণ্ঠন-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আর অন্যজনের কাজ ধর্মীয় যুক্তিতে রাজকৃত অন্যায়কে ঈশ্বরের বিধান বলে প্রচার করা। তবে এই প্রতারণাও খুব বেশি দিন চালিয়ে যাওয়া মুশকিল হয়ে উঠল। কারণ শ্রমজীবী মানুষের বুকের ওপর চেপে বসা দেবতাদের বিধানগুলো দিন দিন আরও দুঃসহ হয়ে উঠছিল। তাই মানুষ বিধানের জাল কেটে বেরিয়ে পড়তে চইছিল। অতএব শঙ্কিত রাজার রাজবেদী রক্ষার জন্য নতুন কৌশল জরুরি হয়ে উঠল। আর তা আবিষ্কার হয়ে গেল একসময়। এর নাম পূণর্জন্মবাদ। সৃষ্টি হল ব্রহ্মা। এসব ধারণা আবিষ্কার করলেন স্বয়ং রাজন। তবে ঘোষিত হল পুরোহিতের মুখ দিয়ে, শতশত গো-মহিষ বলি দিয়ে যাগযজ্ঞের আয়োজন করে। এসব ঘটনা ঘটল ঈশ্বর সৃষ্টি ও ঋকবেদ রচনার কয়েকশ বছর পরে।
পঞ্চালভূমির রাজা দিবোদাসের রাজবেদীকে নিরাপদ করার জন্য রাজ-উচ্ছিষ্টভোগী ঋষি বশিষ্ট, বিশ্বামিত্র ও ভরদ্বাজ যে ঢাল তৈরী করেছিলেন তা ৭০০ বছর ধরে নিরাপদে রেখেছে দিবোদাসের বংশধারার রাজত্বকে। কিন্তু এই ঢালে ফুটো দেখা দিল দিবোদাসের উত্তর পুরুষ রাজা প্রবাহনের বেলায়। তিন ঋষি সৃষ্ট দৈব অনুপান এতদিনে তেজ হারিয়েছে। দেবতারাই রাজাকে পাঠিয়েছেন শাসন করতে এই দৈব বিধান আর কাজ দিচ্ছিল না। শোষণে জর্জরিত প্রজা সাধারণের মনের খটকা ক্রমেই বাড়ছিল। কারণ তাদের শ্রমের ফসল গিয়ে উঠবে রাজার ঘরে আর রাজার ভোগ বিলাসের উপকরণ জুগিয়ে চলবে তারা-এমন দৈব বিধান তারা আর মেনে নিতে পারছিল না। দেবতা নামক অদৃশ্য সত্ত্বার নামে চালু করা এসব বিধানের প্রতি তাদের অবিশ্বাস বেড়ে যাচ্ছিল। তাই রাজা প্রবাহন রাজত্বকে মজবুত অবলম্বন দেওয়ার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করলেন ব্রহ্মাকে। এর আগের ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি প্রভৃতি দেবতাদের কেউ দেখেনি। তাই লোকের মনে সন্দেহ তৈরি হচ্ছিল। এজন্য প্রবাহন সাকার দেবতাদের স্থলে নিরাকার ব্রহ্মের আমদানি করলেন, যাকে প্রত্যক্ষ দেখার কথাই উঠে না। ব্রহ্মের দর্শন পেতে হলে চাই সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়। আর সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয় লাভ করতে হলে চাই সাধনা। আর সাধনার যে ফিরিস্তি দেওয়া হল তাতে ছাপ্পান্ন পুরুষ ধরে সাধনা করেও মানুষ সফল হতে পারবে না, ভ্রমাচ্ছন্ন থেকে যাবে (রাহুল সাংকৃত্যায়ন: ভোগলা থেকে গঙ্গা, পৃষ্টা ১৩৮-১০৯,১১০)।
বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের নৌকা হাজার বছরও কাজ দেয়নি কিন্তু প্রবাহনের নৌকায় দু’হাজার বছর পরও পরধনভোগী রাজা ও সামন্তরা পার হতে পারবে। এর সাহায্যে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণ মিলিতভাবে ঐশ্বর্য ভোগ করতে পারবে। কিন্তু ব্রহ্মের চেয়েও বড় হল প্রবাহনের দ্বিতীয় আবিষ্কার (প্রাগুক্ত)। আবিষ্কারটি হল, মরে গিয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসা - অর্থাৎ পূণর্জন্মের ধারণা। এতদিনে বৈষম্য ও শোষণের পক্ষে খাটানো হয়েছিল শুধু মাত্র দৈব বিধানের যুক্তি। এবার আমদানী হল অনেকগুণ শক্তিশালী যুক্তির। ধনীদের ফূর্তি ও বিলাসীতার ফলে শোষিত গরীবের জীবনে যে দুঃখ ও দুর্দশা নেমে আসে তা ব্যাখ্যা করা হল পুর্বজন্মকৃত ফল হিসেবে। একদিকের ভোগ বিলাস আর অন্য দিকের দুঃখ দারিদ্রতাকে আগের জন্মের সুকর্ম-দুষ্কর্মের ফল হিসেবে দেখানো হল। শোষকের ধন শুধু দেব কৃপায় পাওয়া বস্তু নয় বরং পুর্ব জন্মের সুকর্ম ও দেব ভক্তির পুরষ্কার। আর গরীবের দুর্দশা পুর্বজন্মের পাপের শাস্তি। এভাবে দেবকৃপায় পাওয়া শোষণের অধিকারের যুক্তির স্থলে কাল্পনিক পুর্ব জীবনের সুকর্মের পুরষ্কার হিসেবে শোষণের অধিকার পাওয়ার যুক্তি একটি শক্তিশালী ভিত্তি এনে দিল সামন্তবাদী শোষণে। দরিদ্র প্রজারা পূণর্জন্মের আশায় সারা জীবনের তিক্ততা, কষ্ট এবং অন্যায়কে হাসিমুখে মেনে নিতে শিখল। ধন্য প্রবাহন! ধন্য তার যুক্তি! পুরোগামী ঋষিরাও যা পারেনি, ধর্মের অন্ন ভক্ষণকারি ব্রাহ্মণরাও যা পারেনি, অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে সেই কাজ সম্পন্ন করলেন প্রবাহন। আর্য ইতিহাসের এই কুৎসিত অধ্যায়, যা সম্পন্ন হয়েছিল আনুমানিক ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে সে সম্পর্কে প্রখ্যাত শেকড় সন্ধানী লেখক মাসুদুল হক বলেছেন: “এবং এসে গেলেন ব্রহ্মা। এসে গেল পূণর্জন্মবাদ, তৈরি হয়ে গেল মানুষকে চিরকালের মত শৃঙ্খলিত করার, তার শ্রম-ডাকাতির জন্য মহাজালিয়াতি পূর্ণ , মহাপ্রতারণামূলক এবং কুৎসিত কদাকার দলিল। যদিও সাহিত্যের মানদন্ডে এটি-এই বেদ, তৎকালীন মানুষের এক অনন্য সাধারণ সৃষ্টি তথাপি সভ্যতার ইতিহাসে মানুষকে শৃঙ্খলিত করার, মনুষ্যত্বের লাঞ্ছনা আর অবমাননার এই চিরকালীন দলিলের তুল্য দ্বিতীয়টি মেলা ভার।” - মৌলবাদ, পৃষ্টা-১৩৪।

দিবোদাস তিন ঋষি-বশিষ্ট, বিশ্বামিত্র ও ভরদ্বাজকে দিয়ে সাধারণ মানুষের ওপরে প্রভুত্ব করার যে ঢাল তৈরি করেন তার পাশাপাশি প্রবাহন তৈরি করলেন এক অভেদ্য নতুন ঢাল যার ভেদ্যতা নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনি। একমাত্র একজনই সেই ঢালের অভেদ্যতা ভেদ করার দুঃসাহস দেখালেন। তাঁর নাম গৌতম বুদ্ধ। তাঁর জন্ম ৫৬৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, মৃত্যু ৪৮৩ খ্রিষ্টপুর্বাব্দে। ৫১৪ খ্রিস্টপুর্বাব্দে ২৯ বছর বয়সে সেমেটিক নবীদের মত ধ্যান করতে চলে যান নির্জনে। ছয় বছর ধ্যানের পর হলেন বিশেষ জ্ঞান প্রাপ্ত। এর পর নামলেন নতুন ধর্ম প্রচারে। এই নতুন ধর্মে শোষিতরা দলে দলে দীক্ষা নিতে আসলেও ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের জন্য তা অস্তিত্বের হুমকি হয়ে দেখা দিল। ততদিনে ক্ষমতার দৌঁড়ে ক্ষত্রিয়কে ফেলে এগিয়ে গিয়েছেন ব্রাহ্মণ। রাজা প্রবাহনের পর ধীরে ধীরে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠা ব্রাহ্মণের কাছে অসহায় আত্মসমর্পনে বাধ্য হন ক্ষত্রিয় রাজা।
একসময়ের রাজ উচ্ছিষ্টভোগী ব্রাহ্মণ ধর্মের বাণীর জালে আটকে ফেলে ক্ষত্রিয় রাজাকে এবং নিজেই হয়ে ওঠে সর্বেসর্বা। কারণ তার হাতেই তো আছে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার দন্ড। তার মুখ নিঃসৃত বাণীই রাজার কাছে হয়ে ওঠে অলঙ্ঘনীয় বিধান। ব্রাহ্মণ পরিণত হয় অবতারে। ব্রাহ্মণ্যবাদের এই বসন্তের দিনে বুদ্ধের আগমণ। বুদ্ধের দর্শন হয়ে ওঠে এদের প্রাণের শত্রু। পরবর্তীতে মনু ও শংকরাচার্য বৌদ্ধধর্মীদের ওপর যে কঠোরতা আরোপ করেন তা আমরা দেখেছি। তবে ব্রাক্ষণ্যবাদ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলেও বেদের অনুশাসন পালনে বুদ্ধের সময়েও যথেষ্ট শিথিলতা দেখা যায়।
মহাভারতের রচনাকাল ৪০০ খ্রিস্টপুর্বাব্দের দিকে। সে সময়ে বেদ নির্দেশিত বর্ণভেদ পালনে কঠোরতা দেখা যায় না। শোষিতের সম্পদ লুট করেই ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় সন্তুষ্ট ছিল। বাড়তি ঘৃণা প্রদর্শনের প্রয়োজন এত বেশি ছিল না। তাই উচ্চ বর্ণের সাথে নিম্ন বর্ণের বেদ বিরোধী দৈহিক মিশ্রণে কোন ক্ষতি ছিল না। সেই সময়ের নিয়োগ প্রথা এর স্বাক্ষ্য দেয়। নিয়োগ প্রথায় সন্তান জন্ম দানে অক্ষম রমণীর ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় স্বামী বংশ রক্ষায় নিম্ন বর্ণের রমণীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করত। একে ব্যভিচার মনে করা হত না। খোদ মহাভারতের সৃষ্টিকর্তা মহা কবি ব্যাস দ্বৈপায়নের জন্ম শূদ্রা মায়ের গর্ভে এবং তিনি নিজেও নিম্নজাত মহিলার গর্ভের সন্তানের জনক। এমনকি তার বাবাও নিম্ন বর্ণের গর্ভজাত। তিন পুরুষের এই বিচ্যুতি দেখে বোঝা যায় বর্ণবাদ তখন শাস্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

ব্যাস দ্বৈপায়নের পিতা মহর্ষি পরাশর ছিলেন নিখাদ ব্রাহ্মণ। তারই ঔরসে খাঁটি শুদ্র ধীবর কন্যা সত্যাবতীর গর্ভজাত ব্যাস দ্বৈপায়ন লিখেছেন পৃথিবীর পাঁচটি মহাকাব্যের একটি। এর ২০০ বছর পরে ভারতীয় সমাজকে বর্ণবাদের লৌহশেকলে বাঁধতে চালু হল মনুর বিধান। আনুমানিক ২০০ খ্রিস্টপুর্বাব্দের দিকে রচিত হয় মনুসংহিতা এবং বৈদিক সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে অমানবিক ও নিষ্ঠুর অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। নারকীয় উল্লাসে মনু শ্রমজীবী মানুষকে নিম্ন বর্ণে স্থান দিয়ে তাদের উপর চাপিয়ে দিলেন উচ্চ বর্ণের ঘৃণা-অত্যাচার-নিষ্ঠুরতা ও প্রভুত্বকে। এটা সমগ্র বৈদিক সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে কুৎসিত এবং জঘন্য দৃষ্টান্ত। মহাভারত সৃষ্টির দুই তিনশ বছর পরে মনু এ বিধান দেন। এর পরবর্তী সময়ে খ্রিষ্টপুর্ব ১৮৫ সালে ভারত ভূমিতে বৌদ্ধ নিধনযজ্ঞ শুরু করেন পুষ্যমিত্র শুঙ্গ। এরও দীর্ঘদিন পরে আবির্ভূত হন শংকরাচার্য। রাজকীয় ও নিজস্ব সৈন্যবাহিনী নিয়ে তার বৌদ্ধ হত্যাযজ্ঞ বৈদিক সভ্যতার ইতিহাসের পরবর্তী বড় নিষ্ঠুরতার ঘটনা। এর পরেও খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত উদয়নাচার্য, রামানুচার্য, বাচষ্পতি মিশ্র প্রমুখ ব্রাহ্মণাচার্যরা বৌদ্ধ নিধন ও ভারতভূমি থেকে বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্তি ঘটানোর হেন কোন প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকেন। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এর বর্ণনায় ব্রাহ্মণ্যবাদী হত্যাযজ্ঞ ও নিষ্ঠুরতার শিকার বৌদ্ধদের কথা পাওয়া যায়। বৌদ্ধদের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদের এই সহিংসতা বন্ধ হয় ভারতবর্ষে মুসলিম আগমনের পরে। মুসলিম সামন্তরা ব্রাহ্মণদের হাত থেকে কেড়ে নিল ভারত ভূমির ক্ষমতা। সেই সাথে এ ভূখন্ডে প্রবেশ করল সেমেটিক ইসলাম ধর্ম। এই সময়ে ব্রাহ্মণ্যবাদ আহত কেউটের মত শুধুই ফোঁস ফোঁস করেছে। ১৭৫৭ সালের পরে ভারতভূমি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাতে চলে গেলে আহত কেউটে সোজা হয়ে ফণা তোলে দাঁড়ায়। সাতশ বছর পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ছত্র ছায়ায় ব্রাহ্মণ্যবাদ আবার দানবিক মুর্তিতে আবির্ভূত হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী এখন বৌদ্ধরা নয় - মুসলিমরা। তাই ব্রিটিশের হাতে মুসলিম শাসকই হোক আর বিপ্লবীই হোক, পরাজিত হলে মনু শংকরাচার্যের উত্তরসূরিরা আনন্দে ভেসে যেত। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশের জয় কামনা করে কবি ঈম্বরচন্দ্র গুপ্ত বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে লিখলেন-
যবনের যত বংশ একেবারে হবে ধ্বংশ
সাজিয়েছে কোম্পানীর সেনা
গরু জরু লবে কেড়ে চাপ দেড়ে যত নেড়ে
এই বেলা সামাল সামাল।
এখানেই শেষ নয়। দিল্লীর যুদ্ধ কবিতায় লিখলেন:চিরকাল হয় যেন ব্রিটিশের জয়। আরও লিখলেন:
‘ভারতের প্রিয়পুত্র হিন্দু সমুদয়
মুক্ত সুখে বল সবে ব্রিটিশের জয়।’

এছাড়াও ঝাঁসির রানী যবন মুসলমানদের মতই তার প্রভু ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অপরাধে তার ভাষায় হয়ে গেলেন ‘ঠোঁট কাটা-কাকী’।
ব্রিটিশের গোলামীর ইতিহাসে আরেকজনের পারদর্শীতাও আলোচিত হতে পারে। তিনি বঙ্কিমচন্দ্র। ১৮৫৭ সালের ২২ জুন ইংরেজ সৈন্যরা যখন সিপাহী বিদ্রোহীদের পরাজিত করে দিল্লী দখল করে সেই দিনটি ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের জন্য মহাআনন্দের। এই কদর্য আনন্দের প্রকাশ ঘটালেন তিনি সংবাদ ভাস্কর এ প্রকাশিত এর রচনায় বিপ্লবীদের পাপিষ্ট বলে অভিহিত করে এবং ইংরেজদের জয়ে আনন্দ নৃত্যের আহবান জানিয়ে।

ব্রাহ্মণ্যবাদ এভাবে পরিণত হয় সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাসে। ব্রিটিশ প্রভুর গোলামীতে তার কোন খুত ছিল না। ভারতীয় আর্য সভ্যতার সমগ্র ইতিহাসটাই এভাবে পরিণত হয়েছে সমগ্র মানব সভ্যতার ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ে যা বৈদিক প্রতারণা, ব্রাহ্মণ্যবাদ-বর্ণবাদ, মনুবাদ এবং নারী নির্যাতনের এক ঘৃণ্য দলিল ছাড়া আর কিছু নয়। এ সভ্যতা কলঙ্কের শীর্ষে পৌঁছে যায় বর্ণবাদী অনুশাসনে সভ্যতার আসল কারিগর শ্রমজীবী মানুষের পবিত্র দেহকে অস্পৃশ্য ঘোষণা দিয়ে; নারকীয় নৃশংসতায় সতীদাহের মত প্রথার প্রবর্তন করে; পুরুষতান্ত্রিক শৃঙ্খলে নারীর অধিকারকে বন্দী করে এবং সর্বোপরি নারী, অন্যধর্মী ও অন্ত্যজ হিন্দুসহ সমাজের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের অধিকার ও মর্যাদাকে শোষণ, ঘৃণা ও অত্যাচারের বেদীতে বলী দেয়ার মধ্য দিয়ে। মানবতার পরাজয়ের এক করুণ ইতিহাস হল এই বৈদিক ও আর্য সভ্যতা। রোমান গ্লাডিয়েটরদের কথা বাদ দিলে এই ভারতীয় আর্য সভ্যতার বিভিন্ন উপাদান - অস্পৃশ্যতা-বর্ণবাদ-নিরীহ মানুষকে দেবতার উদ্দেশ্য বলী দেয়া-সতী পোঁড়ানো-বিধবাকে বেশ্যা হতে বাধ্য করা - এসবই হবে সমগ্র সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্য ও নারকীয় নির্দশন। মানুষের মর্যাদা ও মানবতার অবমাননার এত করুণ চিত্র, এত বড় সামাজিক পরিমন্ডলে আর কোথাও দেখা যায় না। আর্য ব্রাক্ষণ্যবাদ ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসে এই একবিংশ শতকেও গুজরাটের মুসলিম হত্যায় মেতে ওঠে সমান নৃশংসতায়। মানুষের খোলস ছেড়ে দানবের চেহারায় বেরিয়ে আসেন মনু-শংকরাচার্যের উত্তরসুরি গুজরাটের কসাই নরেন্দ্র মোদী।
মোটামোটিভাবে এসবই হল ভারতীয় বৈদিক আর্য সভ্যতার ইতিহাস। এ ইতিহাস গৌরবের নয়, কলঙ্কের। তবুও তা পড়তে হবে, জানতে হবে। জীবনকে কলঙ্কের ভারমুক্ত করার জন্যই তা প্রয়োজন। আগামী জীবনকে বর্ণবাদ, বৈষম্য ও শোষণমুক্ত করে গড়ে তোলার জন্যই এ ইতিহাসকে জানতে হবে। সেইসব শ্রমজীবী মহামানবেরা, যারা সভ্যতার আসল কারিগর, যাদের বুকের ওপর গড়ে ওঠেছে সভ্যতা; ইতিহাসের প্রতিটি ভাঁজে লুকিয়ে রয়েছে তাদের দুঃসহ জীবনের করুণ কাহিনী। তারা সভ্যতার পিলসুজ। মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে। উপরের সবাই আলো পায়, সেই আলোতে বাবুসাহেবরা খেলা করে। অথচ ইতিহাসে তারাই সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত। বাবুদের ইতিহাস তাদের প্রতি সম্মান দেখানো দুরের কথা, করুণাও প্রদর্শন করে না। ইতিহাসের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা তাদের অসম্মান, লাঞ্ছনা ও অবমাননার কাহিনী জানতে হবে পড়তে হবে। জানতে হবে তাদের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও সংগ্রামের কাহিনী যা এখনও শেষ হয়ে যায় নি। বাবুদের অত্যাচারও বন্ধ হয় নি। বাবুদের ভাঁড়াটে সশস্ত্র বাহিনী হামলে পড়ে ভারতের জঙ্গলে, শিকার করে নিয়ে আসে মাওবাদী বিদ্রোহীর লাশ। সৌখিন বাঘ শিকার-নয়, বাবুরা হিংস্র উল্লাসে মেতে উঠেন মাওবাদী শিকারে। এর নাম অপারেশন গ্রিন হান্ট, যা শুরু করেছে বাবুদের রাষ্ট্র। তাই বুঝতে হয় ইতিহাস এখনও বড়ই অসমাপ্ত। ইতিহাস সেদিনই সমাপ্ত হবে যেদিন শ্রমজীবী মানুষ তার নায্য অধিকার ফিরে পাবে। যেদিন মানুষ তার প্রাপ্য ফিরে পাবে এবং সেদিনই শুরু হবে মানুষের গৌরবের ইতিহাস। তার আগে কখনোই নয়।

সমগ্র মানব সভ্যতার ইতিহাসে গৌরবের চেয়ে কলঙ্কের নির্দশন অনেক বেশি। শোষণ আর অপচয়ের অপর নামই সভ্যতা। তবে এর বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামের ইতিহাসটাও ক্ষুদ্র নয় মোটেও। সভ্যতার ইতিহাসে একদিকে যেমন খুঁজে পাওয়া যায় শোষণ আর কলঙ্ক অন্য দিকে তেমনই খুঁজে পাওয়া যাবে বিদ্রোহ-বিপ্লব-সংগ্রাম। তবে শোষকের ইতিহাসে তা স্থান পায় নি। তাই সেই সকল গৌরবের কাহিনীর অনেক কিছুই আমরা জানতে পারব না কখনোই। ভারতীয় বৈদিক আর্য সভ্যতার ইতিহাসে যেভাবে শোষণ ও কলঙ্ক ছড়িয়ে আছে তার বিপরীতে সংগ্রামের গৌরবময় অধ্যায়গুলো এতটা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে নি। কারণ সংগ্রাম আজ অবধি চুড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে পারে নি। তাই সংগ্রাম বারে বারে পরাজিত হয়ে হারিয়ে যায়। কিন্তু আবার ফিরে আসে।
সভ্যতা বিশ্বকে যতটা না আলোকিত করেছে তার চেয়ে ঢের বেশি নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার জন্ম দিয়েছে। সংগ্রাম যেহেতু চুড়ান্তভাবে বিজয়ী হতে পারে নি, তাই তা সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করে না। এ কারণে সকল ক্ষেত্রেই শোষক ও সুবিধাভোগী শ্রেণিই সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করছে। তবে শোষক শ্রেণির এ প্রতিনিধিত্ব আর্যদের অন্যান্য শাখা যথা পারসীয় ও দক্ষিণ ইউরোপীয়দের ক্ষেত্রে নিরংকুশ ভাবেই কলংকের নয়। দাস শোষণের কলংকে কলুষিত হলেও সেসব সভ্যতা মানব সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসে অনেক ক্ষেত্রেই অবদান সৃষ্টি করতে পেরেছে। মধ্যপ্রাচ্যের সেমেটিক সভ্যতা গুলো এবং দক্ষিণ ইউরোপীয় আর্য নগর সভ্যতাগুলোর বেশ কিছু উদ্ভাবন আজও আমাদের কাজে লাগছে।
বর্ণমালা, ভাষা, সংখ্যা গণনা, ক্যালেন্ডার, গণিত, জ্যামিতি, স্থাপত্য, নগর পরিকল্পনা, দর্শন-চিন্তা, যন্ত্র কৌশল, আইন, সাহিত্য, জ্ঞান শাস্ত্র এবং সর্বোপরি শিল্প কলায় এসব সভ্যতা মানুষের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। পরিশ্রমের বোঝাটা শোষিত শ্রেণির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে যে অবকাশটা পাওয়া যায় তা বৈদিক ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা যেভাবে শুধু ষড়যন্ত্র ও নোংরা কৌশল উদ্ভাবনের পেছনে ব্যয় করেছে সেরকমভাবে না করে দক্ষিণ ইউরোপীয় আর্যরা কিছুটা হলেও সময়কে জ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন ও শিল্পকলার পেছনে ব্যায় করেছে। গ্রিসে জন্ম নিয়েছেন এস্কাইলাস, সফোক্লিসের মত ন্যাট্যকার, পিথাগোরাসের মত গণিতবিদ, সক্রেটিস-প্লেটো-এরিস্টটলের মত দার্শনিক, হেরোডোটাসের মত ইতিহাসবিদ, ফিদিয়াসের মত ভাস্কর এবং ডেমোক্রিটাসের মত প্রকৃতি বিজ্ঞানী। যদিও তারা দাস শোষণের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছিল তাদের সভ্যতা তবুও জ্যোতিবিজ্ঞান, চিকিৎসা, স্থাপত্যকলা, সঙ্গীত ক্রীড়া এসব ক্ষেত্রে গ্রিকরা দুনিয়ার সেরা ছিল। এমনকি এথেন্সের পেরিক্লিসের মত রাষ্ট্রনায়কও সেই যুগের ইতিহাসে বিরল।

আর্য সভ্যতার হেলেনিয় ও হেলেনিস্টিক অধ্যায়ঃ-
ভারতবর্ষে যেমন ঋকবেদ ইউরোপে তেমনি ইলিয়াড আর ওডিসি সবচেয়ে পুরনো কাব্য। তবে ঋকবেদে যেভাবে গরু দখল নিয়ে যুদ্ধ বাধতে দেখা যায় এবং গরু দখলকে সবচেয়ে বীরত্বের কাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে তার সাথে ইলিয়াড ও ওডিসির মিল নই। সেগুলোতে যুদ্ধের পটভূমি ছিল ভিন্ন। গোড়াতেই এগুলো কোথাও লেখা হয় নি। মুখে মুখে গান করে চারন কবিরা গ্রিক বীরদের এই সব বীরত্বের কাহিনী শুনিয়ে বেড়াত। হোমার নামে একজন চারণ কবিই এই দুটি কাব্যের রচয়িতা। কিন্তু হোমার আসলে কে ছিলেন তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারা যায় না। তিনি কোন দেশের কোন শহরে বাস করতেন তা নিয়ে পন্ডিতদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। হোমারের রচিত এ দুটি মহাকাব্য ছাড়াও হেসিয়ড নামে আরেকজন কবির রচিত ‘ওয়ার্কস এন্ড ডেইজ’ এবং ‘বার্থ অব দি গডস’ নামে দুটি কাব্যও ছিল। এ সবই ৭০০ খ্রিস্টপুর্বাব্দের আগের রচনা। অর্থাৎ সেই সময়ের ভারতবর্ষের বৈদিক সমাজে জন্মান্তরবাদ চালু হচ্ছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের নিনেভা শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওটা অ্যাসিরিয় সাম্রাজ্যের কাছে পতন ঘটছে ইহুদিদের ইসরাইল রাজ্যের।
মহাকাব্য গুলোতে গ্রিক সভ্যতার আদি পর্বের যে ছবি পাওয়া যায়, তা থেকে মোটামোটিভাবে জানা যায় যে, পশুপালন আর শিকার চালু থাকলেও, খাবার জোগাড়ের প্রধান উপায় ছিল চাষবাস। যুদ্ধ বিগ্রহের মধ্যে অপর পক্ষের যারা বন্দী হতো, জমিজমায় বা ব্যবসাবাণিজ্যে তাদের খাটিয়ে নেওয়া থেকেই শুরু হয়েছিল ক্রীতদাস প্রথা। মহাকাব্য গুলির এই যুগকে বলা হয় বীরদের যুগ। প্রধান দুটি মহাকাব্যের রচয়িতা হোমারের নামে এই যুগকে হোমারীয় যুগ ও বলা হয়। গ্রিকদের বিশাল দেবতা ডিয়োকেলিয়ানের পুত্র হেলেনের বংশধর তারা। পুরাকালের ন্যায়পরায়ন রাজা ছিলেন ডিয়োকেলিয়ান। হেলেনের বংশধর বলে গ্রিকরা নিজেদের বলতো হেলেনিয়। এজন্যই গ্রিক সভ্যতা হেলেনিয় সভ্যতা নামে পরিচিত।
হোমারীয় যুগে গ্রিকদের ধর্ম ছিল সরল। গ্রিক দেবতারা ছিলেন মানুষের মতই। বৈদিক দেবতাদের মত তারা আকাশে বাস করতেন না। বরং গ্রিকদের বিশ্বাস ছিল দেবতারা বাস করতেন উত্তর গ্রিসের অলিম্পাস পাহাড়ের চূড়ায়। হোমারীয় যুগের শেষ দিকে অলিম্পিক প্রতিযোগিতার প্রচলন হয়। প্রথম অলিম্পিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় ৭৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। অলিম্পাস পাহাড়ের পাদদেশে এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত। দেবরাজ জিউসের সম্মানে এই খেলার আয়োজন হত। অলিম্পিক ছিল সমগ্র গ্রিসের অধিবাসীদের সাংস্কৃতিক বন্ধনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম।

সময়ের বিবর্তনে একসময় গ্রিসে ভেঙ্গে পড়তে থাকে হোমারীয় যুগের গ্রাম সম্প্রদায়। ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাদের দিকে এক একটি অঞ্চল ঘিরে গড়ে উঠতে থাকে নগর রাষ্ট্র সমূহ। যেমন মূল ভূখন্ডে ছিল এথেন্স, থিবস ও মেগারা; পেলোপনেসাস অঞ্চলে ছিল স্পার্টা এবং করিন্থ; এশিয়া মাইনরের তীরে ছিল মিলেটাস ইত্যাদি। এদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় ছিল স্পার্টা ও এথেন্স। এদেরকে একত্রে বলা হয় হেলেনিয় সভ্যতা।

৫৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে স্পার্টা গ্রিসের মধ্যে সব চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এটি ছিল মূলত একটি সামরিক নগররাষ্ট্র। অন্যদিকে উত্তরের প্রতিবেশী এথেন্স নগররাষ্ট্রটি গড়ে উঠেছিল স¤পূর্ণ ভিন্ন চিরত্র নিয়ে। রাজতন্ত্রের জায়গায় ভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা পৃথিবীতে প্রথম নিয়ে আসল এথেন্সবাসীরা। অবশ্য সেমেটিক নবীদের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্য ও মিশরে রাজতন্ত্র বিরোধী ধর্মীয় অনুশাসনমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভিন্নধর্মী দৃষ্টান্ত এরও আগে দেখা গিয়েছে। তবে নবীদের অনুশাসনের কার্যকারিতা দেখা যায় তাদের জাতিসমূহের পরাধীনতা থেকে উত্তরণের কালপর্বে, বিদ্রোহী ও যাযাবর অবস্থায় এবং স্রষ্টার বিধান দিয়ে সমাজ চালানো নবীদের পক্ষে লোকজনের অবাধ্যতার কারণে অনেক সময় খুবই কঠিন হয়ে যেত। দাউদের (আঃ) জেরুজালেম বিজয়ের পরে নবী শাসিত ইহুদিদের মাঝেও রাজতন্ত্রী ব্যবস্থা স্থায়ী হয়ে যায়। স্থায়ী ভাবে অন্য ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রথম দেখা গেল এথেন্সে। এগুলো হল অভিজাততন্ত্র, গণতন্ত্র ইত্যাদি। তবে এসব ব্যবস্থায় শোষিত ও দাসশ্রেণি আগের অবস্থায়ই থেকে যায়।
হাম্মুরাব্বির পরে পৃথিবীতে মানবরচিত আইন প্রবর্তনের বড় ঘটনাও প্রথম ঘটে এথেন্সে। ৬২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ড্রাকো নামে একজন অভিজাত একটি আইন সংকলন তৈরি করেন এথেন্সে। ড্রাকোর আইন খুবই কঠোর ছিল। তাই বলা হত, এ আইন কালির বদলে রক্ত দিয়ে লেখা হয়েছে। সামান্য বাঁধা কপি চুরির অপরাধেও মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান ছিল এতে।

গ্রিস যখন ধীরে ধীরে মাথা তোলে দাঁড়াচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে তখন মেসোপটোমীয় সভ্যতার শেষ ধাপ ক্যালদীয় সাম্রাজ্য কেড়ে নিচ্ছে পারসীয়রা। ৫৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্য সম্রাট সাইরাস দখল করে নেন ক্যালদীয় সামাজ্য। পারসীয়রা গ্রিসের উত্থানকে ভাল চোখে দেখল না। পাশ্চাত্যের সাথে প্রাচ্যের কোন বড় সংঘাতের প্রথম দৃষ্টান্ত হল গ্রিকদের সাথে পারসীয়দের যুদ্ধ। পারস্য সাম্রাজ্যের পশ্চিমে ভূমধ্যসাগরের উপকূলে যেসব গ্রিক শহর গড়ে উঠেছিল তারা পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনতা থেকে নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করল। এই বিদ্রোহে এথেন্স তাদের সাহায্য করেছিল। তাই পারস্য সম্রাট দারায়ুস সিদ্ধান্ত নিলেন গ্রিস আক্রমণ করার। তাঁর সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ৫২১ থেকে ৪৮৫ সাল পর্যন্ত। এই সম্রাট দারায়ুসের সাথে ভারতীয়দের ইতিহাসের একটি যোগসূত্র আছে। তা হল ভারতের অধিবাসীদের জন্য হিন্দু নামটি সম্রাট দারায়ুসের নৌ সেনাদের দেয়া। সম্রাটের নৌঅধ্যক্ষ সাইলাস পারস্য সামাজ্যকে পশ্চিম ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত করার উদ্দেশ্যে নৌ বাহিনী নিয়ে এগিয়ে এসে সিন্ধু নদের পথে ঢুকে পড়েন এবং এর অববাহিকা অঞ্চল দখল করতে করতে এগিয়ে যান। এ সময় পারসীয় নৌ সেনাদের মুখে সিন্ধু নামটি বিকৃত উচ্চারণে হয়ে যায় হিন্দু এবং এই নদ অধ্যুষিত এলাকার বাসিন্দারা তাদের কাছে পরিচিতি পায় হিন্দু নামে। এ ঘটনার সময়কাল ছিল ৫০০ খ্রিস্টপুর্বাব্দের দিকে। ভারতবর্ষে তখন বুদ্ধের আগমন ঘটেছিল। সিন্দু নদ হতে পুর্ব ইউরোপ পর্যন্ত তখন পারস্য সামাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল। এই সময়ে সম্রাট দারায়ুস তাঁর রাজ্যের অন্যদিকে গ্রিস দখলের জন্য তাঁর জামাতার নেতৃত্বে অন্য আরেকটি নৌ বহর পাঠালেন। কিন্তু ঝড়ের কবলে পড়ে সব জাহাজ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তিনি ফিরে এলেন।
৪৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট দারায়ুস নিজেই সেনাবাহিনী সজ্জিত করলেন গ্রিসের উল্টো দিকে তুরস্কের উপকূলে। তারপর গ্রিসের সব শহরে দ্রুত পাঠিয়ে দিলেন। ভয়ে ও আতংকে গ্রিসের অধিকাংশ নগর রাষ্ট্র অধীনতার স্বীকৃতি স্বরূপ তাদের শহরের মাটি ও পানি তুলে দিল দূতদের হাতে। কিন্তু স্পার্টা ও এথেন্স অধীনতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দূতদের ফেলে দিল পানির কুয়ার নিচে। তাই সম্রাট দারায়ুস ৬০০ জাহাজ বোঝাই করে ২০০০০ সৈন্য নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে নামলেন গ্রিসের উপকূলে। এথেন্স থেকে ২৬ মাইল দূরে ম্যারাথনের সমতল ভূমিতে স্থাপন করলেন সৈন্য শিবির। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এথেন্সের ১০০০০ সৈন্য এগিয়ে এল মিলটাইডিসের নেতৃত্বে। ম্যারাথনের মাঠে তাদের মরণপন প্রতিরোধ যুদ্ধের মুখে পারসীয়রা নির্মমভাবে পরাজিত হল। এই আনন্দ সংবাদ পৌঁছে দেয়ার জন্য ফিডিপাইডিস নামক একজন এথেন্সবাসী ম্যারাথন থেকে এক দৌড়ে ছুটে যান এথেন্সে। সংবাদটি জানিয়েই তিনি মুখ থুবড়ে পড়ে মারা যান। তাঁর সম্মানেই প্রতিবার অলিম্পিকে এখন ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।

দারায়ুসের এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চাইলেন তার ছেলে সম্রাট জারেক্সেস। ওল্ড টেস্টামেন্টে এই জারেক্সেস সম্পর্কে বলা হয়েছে, “ইনি সেই জারেক্সেস যিনি ভারত থেকে ইথিওপিয়া দেশ পর্যন্ত একশ সাতাশটা বিভাগের উপর রাজত্ব করতেন” (ইষ্টের পুস্তক-১:২) । ৪৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রায় দেড় লক্ষ সৈন্য নিয়ে তিনি স্থলপথ ঘুরে রওনা দিলেন গ্রিসের উদ্দেশ্যে। তারা থার্মোপিলির সংকীর্ণ পথে বাঁধা দিতে আসা ৭০০০ গ্রিক সৈন্যকে পর্যদুস্থ করে এগিয়ে গেল এথেন্সের দিকে। এথেন্সে যখন তারা প্রবেশ করল তখন আর কাউকে খুঁজে পেল না। এথেন্সবাসীরা তখন জাহাজে চড়ে আশ্রয় নিয়েছে সেলামিস উপসাগরে। এথেন্সের পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে উঠে পারসীয়রা দেখতে পেল এথেন্সবাসীদের। জারেক্সেস সেই পাহাড়ে তাবু খাঁটিয়ে বসলেন তাঁর বিরাট নৌ বহর কিভাবে এথেন্সবাসীদের ধ্বংশ করে তা দেখার জন্য। কিন্তু সেখানে বসে তিনি আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, গ্রিকদের কৌশলের কাছে হেরে গিয়ে বিশাল পারসীয় নৌ বহর লন্ডভন্ড হয়ে গেল। হতভম্ব জারেক্সেস বাকী নৌবহর ও সৈন্য সামন্ত নিয়ে ফিরে গেলেন নিজের দেশে। সেলামিস উপসাগরে পারসীয়দের এই পরাজয় সমগ্র সভ্যতার ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। যদি সেদিন পারসীয়রা জিততে পারত তাহলে গ্রিক বা রোমান সভ্যতার কোন অস্তিত্ব ইতিহাসে থাকত না। এমনকি পশ্চিমা সভ্যতা বলেও কোন কিছু থাকত না। প্রাচ্য আর ইউরোপ নৃতাত্ত্বিকভাবে একাকার হয়ে যেত।
গ্রিক সভ্যতার ইতিহাসে এর পরপরই শুরু হল সোনালী যুগ, যা চলতে থাকে ৪৩০ খ্রিষ্টপুর্বাব্দ পর্যন্ত। খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০ থেকে ৪৩০ - এই ৫০ বছরেই গ্রিক সভ্যতা জ্ঞান-চিন্তা চর্চা, চিকিৎসা, সঙ্গীত, স্থাপত্য, শিল্পকলা, সাহিত্য-দর্শনে উন্নতির চূড়ায় পৌঁছে যায়। জ্ঞান বিজ্ঞান, চিন্তা-চেতনায় এথেন্স সারা পৃথিবীকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এ যুগে এসেছেন পেরিক্লিসের মত রাষ্ট্রনায়ক, তাঁর বন্ধু হেরোডোটাসের মত ইতিহাসবিদ। নাটকে সৃষ্টি হয় কমেডি, ট্রাজেডি, প্রভৃতি ধারা। এস্ফিথিয়েটারে হত অভিনয়। এস্কাইলাসের বন্দি প্রমিথিউস, সফোক্লিসের ইদিপাস, আন্তিগোনে এ যুগেরই নাটক। এ যুগেই জন্ম হয় মহান দার্শনিক সক্রেটিসের। এনাক্সিগোরাস তখন এথেন্সে বসে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে ঢেলে সাজাচ্ছেন। এ যুগের প্রভাব আজও আমাদের জীবনে রয়ে গেছে। তবে এ কথা ভুললে চলবে না এতসব গৌরবের আসল কারিগর হল এথেন্সের সেই সব ক্রীতদাস ও শ্রমজীবী মানুষেরা যাদের কথা হারিয়ে গেছে ইতিহাসের অন্তরালে। তারাই তিলে তিলে শ্রম দিয়ে নির্মাণ করেছে গৌরবময় এ সভ্যতা। দাস শোষনই ছিল এথেন্সের সমৃদ্ধির ভিত্তি। তাই গৌরবের সমস্ত কৃতিত্ব দিতে হবে তাদেরকেই।
অন্যদিকে অবকাশ ভোগী শ্রেণিকে এ জন্যও কৃতিত্বের কিছুটা দিতে হবে যে, তারা রোমানদের মত অযথা দাস নিপীড়নের পৈশাচিক কান্ড কারখানা করেনি। রোমানদের মত তারা দাসদের গ্লাডিয়েটর হতে বাধ্য করেনি বা দাসদের গলায় চাকা পরিয়েও রাখেনি। বরং অবসরে তারা এক্রোপলিসে বসে থিয়েটার দেখতো। ক্রীতদাসদেরও তারা পড়ালেখা শিখাতো ছোট বাচ্চাদের শিক্ষকতার কাজ করিয়ে নেয়ার জন্য। সময় এবং সম্পদকে শুধু বিকৃত রুচি আর স্থুল প্রবৃত্তির পেছনে ব্যয় না করে সৃষ্টিশীলতা ও শিল্পের পেছনে তারা কিছুটা হলেও ব্যয় করত।
এথেন্সের গৌরব প্রতিবেশী নগর রাষ্ট্রগুলো ভাল চোখে নিল না। ফলে উন্নতির চরমে পৌঁছেও এক সময় দুর্যোগ নেমে আসে এথেন্সে। স্পার্টার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা পেলোপনেসিয় লিগ ও এথেন্সের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ডেলিয়ান লিগের অন্তর্ভূক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বেঁধে যায় যুদ্ধ। ইতিহাসে এই যুদ্ধকে পেলোপনেসীয় যুদ্ধ বলা হয়। এই যুদ্ধে চুড়ান্তভাবে পতন ঘটে এথেন্সের। যুদ্ধ শুরুর দু’বছরের মাথায় মহামারি প্লেগরোগে আক্রান্ত হল এথেন্স। এ রোগ এতই ছোঁয়াচে ও ভয়ংকর যে নিমিষেই একটি জনপদকে নিশ্চিহৃ করে দিতে পারে। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে ৪২৯ খ্রিস্টাব্দে মারা গেলেন এথেন্সের দীর্ঘ দিনের কর্ণধার পেরিক্লিস। ৩৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্স চলে যায় স্পার্টার অধীনে। ততদিনে সবগুলো শহর যুদ্ধের ধকল সইতে না পেরে চূড়ান্তভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছে।

গ্রিক সভ্যতা যখন এই আত্মঘাতী যুদ্ধ ভেঙে পড়ছে, গ্রিসের উত্তর দিকের একটি দেশ তখন মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। এর নাম মেসিডোনিয়া। হেলেনিয় জ্ঞান বিজ্ঞানের ছোঁয়া লেগেছিল এই ভূখন্ডে। তাই ইতিহাসে এর পরিচয় হয় হেলেনিস্টিক সভ্যতা নামে। এই ভূখন্ডের রাজা ছিলেন দ্বিতীয় ফিলিপ। তিনি ৩৫৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই ভূখন্ডে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্টা করেন। ৩৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে স্পার্টা ছাড়া অন্য সব গ্রিক নগররাষ্ট্র মেসিডোনের অধিকারে চলে আসে। পারস্য ছিল রাজা ফিলিপের প্রধান প্রতিপক্ষ। পারস্য বিজয়ের জন্য তিনি সমগ্র গ্রিক শক্তিকে একত্র করার চেষ্টা করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি গ্রিক নগররাষ্ট্র গুলোকে নিয়ে হেলেনিক লিগ নামে একটি মৈত্রী জোট গঠন করলেন। প্রাচ্য ভূমি দখলের পাশ্চাত্য পরিকল্পনার বড় ঘটনা এটাই ইতিহাসে প্রথম। আর প্রাচ্য বিজয়ের এই প্রথম পরিকল্পনা হয়েছিল সংঘবদ্ধ বা জোটবদ্ধভাবে। আজ এতদিন পরেও তৃতীয় বিশ্বে পাশ্চাত্য দখলদারির অভিযান হয় জোটবদ্ধভাবে। ইঙ্গ-মার্কিন জোট, ন্যাটো জোট প্রভৃতি জোটের নেতৃত্বে তৃতীয় বিশ্বে দখলদারি অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। তবে এসব ক্ষেত্রে তাদের প্রতিপক্ষ পারস্য সাম্রাজ্যের মত কোন রাজকীয় শক্তি নয় বরং অনেক ক্ষেত্রেই তা বেসরকারিভাবে সংগঠিত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি। পাশ্চাত্যের আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র সমূহের বিরুদ্ধে ইসলামী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান, বিশ্ব সভ্যতায় সেমেটিক ধর্মীয় ধারার শক্তিশালী প্রভাব কিভাবে আজকের দিনেও কার্যকর তা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

রাজা ফিলিপ প্রাচ্য আক্রমণের যে পরিকল্পনা করেছিলেন তা বাস্তবায়নের আগেই তিনি মারা পড়লেন আততায়ীর হাতে। এটা খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৬ সালের ঘটনা। এর পরে সিংহাসনে বসলেন তার ২০ বছর বয়সী পুত্র আলেকজান্ডার। পিতার অসমাপ্ত স্বপ্ন পুরণে আলেকজান্ডার পারস্য সম্রাট জারেক্সেসের মত ব্যর্থ হন নি। প্রাচ্যের ওপর পাশ্চাত্যের বিজয় ইতিহাস তিনিই সর্বপ্রথম নিশ্চিত করেছিলেন। ইতিহাসে আলেকজান্ডারের গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ তিনিই পাশ্চাত্যের প্রথম মানুষ যিনি প্রাচ্য জুড়ে তার সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করতে পেরেছিলেন। এতদিন পর্যন্ত লোকে জেনেছে শুধু মিসরীয়, ব্যাবিলনীয়, অ্যাসিরীয়, ক্যালদীয় ও পারস্য সাম্রাজ্যের কথা। ইতিহাসের দীর্ঘ পরিসরে ছড়িয়ে ছিল শুধু এসব সাম্রাজ্যের দাপটের কথা। আলেকজান্ডার এসব সাম্রাজ্যের পাশাপাশি ইতিহাসে প্রথম যুক্ত করলেন ইউরোপের মেসিডোনিয় সাম্রাজ্যের কথা। তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা এ তিন মহাদেশ জুড়ে।
আলেকজান্ডার প্রথমেই দৃষ্টি দিলেন তার পিতার রেখে যাওয়া প্রতিপক্ষ পারস্য সাম্রাজ্যের দিকে। ততদিনে পারস্য সাম্রাজ্যের বয়স ২০০ বছরেরও বেশি। সেই সময় পর্যন্ত সভ্যতার ইতিহাসে এ সাম্রাজ্য ছিল আয়তনে সবচেয়ে বড়। এ বিশাল সাম্রাজ্যকে দখল করার জন্য পশ্চিম দিক থেকে এগিয়ে এলেন আলেকজান্ডার। ৩৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হেলেসপন্ট অতিক্রম করে এসে পারস্য সাম্রাজ্য আক্রমণ করেন আলেকজান্ডার। একের পর এক পারস্য শহর জয় করে এগিয়ে যেতে লাগলেন মিসরের দিকে। পারস্য শহর ব্যাবিলন, সুসা, পার্সেপোলিস, ইকতেবানা, জেরুজালেম সবই চলে এল আলেকজান্ডারের হাতে। ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্য রাজ তৃতীয় দারায়ুস নিহত হলে আলেকজান্ডার সমগ্র পারস্য সাম্রাজ্যের অধিপতি হন। এখানেই শেষ নয়। পারস্য থেকে বিপুল ধনরত্ন নিয়ে তিনি অগ্রসর হলেন ভারতের দিকে। আফগানিস্তান বিজয় করে তিনি খাইবার গিরিপথ অতিক্রম করে ঢুকলেন ভারতবর্ষে। সিন্ধুর তীর পর্যন্ত বিস্তৃত করলেন তার সাম্রাজ্য। এই ভারতে এসেই আলেকজান্ডার তার সেনাপতিকে বলেছিলেন, “সত্যিই সেলুকাস! কী বিচিত্র এ দেশ।” কথিত আছে ভারতের কাঁঠাল খেয়ে আলেকজান্ডারের সৈন্যরা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ইতোমধ্যে মেসিডোনিয়া থেকে তাদের বেরিয়ে আসার দশ বছর পেরিয়ে গেছে। তাই আলেকজান্ডার আর না এগিয়ে ক্লান্ত সৈন্যদের নিয়ে রওনা দিলেন স্বদেশের পথে। এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় ব্যাবিলনে পৌছে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন আলেকজান্ডার। এটা ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ঘটনা। কথিত আছে আলেকজান্ডার বলতেন, মৃত্যুর পরে তার হাত দুটি যেন কফিনের দু পাশে ঝুলিয়ে দেয়া হয়, যাতে পৃথিবীর মানুষ দেখতে পায় দুনিয়া বিজয়ী বীর নিঃস্ব অবস্থায় পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছেন। গল্পে আছে, আলেকজান্ডার নাকি পৃথিবীর মানচিত্র দেখে হতাশ হয়ে বলেছিলেন- “হায়! দখল করার মত কোন দেশই আর অবশিষ্ট নেই।”

আলেকজান্ডার ছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটলের ছাত্র। তার বাবা ফিলিপ ছেলেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা দার্শনিকের কাছে পড়িয়েছিলেন। তাই আলেকজান্ডার জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি খুবই উৎসাহী ছিলেন। তিনি ছিলেন জ্ঞান ও শিল্পের পৃষ্টপোষক। তবে আলেকজান্ডার যুদ্ধের ময়দানে খুবই নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিতেন। থিবস অধিকার করে শুধু তার বীরত্বকে প্রদর্শন করার জন্য ৭০০০ মানুষকে হত্যা করেছিলেন। এটাই ইতিহাসের এক অদ্ভুত সত্য। যে যত বড় হত্যাকারি ইতিহাসে সে ততো বড় বীর। বিজ্ঞানের পৃষ্টপোষকতাও করতেন তারাই। অ্যাসিরীয় সম্রাট আসুরবানিপালের-(৬৬৮-৬৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) মতই আলেকজান্ডার যুদ্ধক্ষেত্রে পরিচয় দিতেন চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতার। কিন্তু গড়ে তুলেছিলেন পৃথিবীর সেরা লাইব্রেরি। এ লাইব্রেরি তিনি স্থাপন করেছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ায়। পুরনো সভ্যতা মিসরের নীল নদের মোহনায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন আলেকজান্দ্রিয়া শহর। এছাড়াও সিরিয়ায় এন্টিয়ক নামে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নগর তিনি গড়ে তুলেছিলেন। আলেকজান্ডার আলেকজান্দ্রিয়াকে তাঁর রাজধানী বানাতে চেয়েছিলেন। এখানে স্থাপন করেছিলেন লাইব্রেরি। তাঁর লাইব্রেরিতে প্রায় পাঁচ লক্ষ বই ছিল। আসুরবানিপালের নিনেভার লাইব্রেরির পরে এটা সভ্যতার ইতিহাসের দ্বিতীয় বড় লাইব্রেরি। শুধু লাইব্রেরি নয় এটা ছিল একাধারে বিশ্ববিদ্যালয়, মিউজিয়াম, শিক্ষাকেন্দ্র, গবেষণা ও জ্ঞান চর্চার জায়গা।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য তিন সেনাপতির মাঝে ভাগ হয়ে যায়। আলেকজান্দ্রিয়া কেন্দ্রিক আফ্রিকান অংশটি নেন টলেমি, গ্রিস ও মেসিডোনিয়াকে নিয়ে ইউরোপীয় অংশটি নেন এন্টিগোনাস আর মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ে এশীয় অংশটি নেন সেলুকাস। সেলুকাস রাজধানী করেন এন্টিয়ককে, টলেমি করেন আলেকজান্দ্রিয়াকে। টলেমির সময়ে আলেকজান্দ্রিয়া জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার চর্চায় সারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেন্দ্রে পরিণত হয়। আলেকজান্দ্রিয়া যেন হয়ে ওঠে নতুন এথেন্স। বিভিন্ন দেশের বড় বড় পন্ডিতদের স্কলারশিপ দিয়ে টলেমি আলেকজান্দ্রিয়ায় নিয়ে যান। আজকে আমরা বিদ্যালয়ে যে জ্যামিতি পড়ি, তার প্রায় পুরোটাই টলেমির সময়ে আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিতে বসে আবিষ্কার করেন গণিতবিদ ইউক্লিড। জ্যামিতির ওপর রচিত ইউক্লিডের ‘এলিমেন্টস’ বইটি ছিল তের খন্ডে সমাপ্ত। বিদ্যালয়ে যে জ্যামিতি শিখানো হয় তার অধিকাংশই নেওয়া হয় ‘এলিমেন্টস’ এর প্রথম ছয় খন্ড থেকে। ইউরোপে মধ্যযুগে বাইবেলের পর সবেচেয়ে জনপ্রিয় ছিল এই বইটি।

শুধু আলেকজান্দ্রিয়া নয়, আলেকজান্ডারের সাথে আরেকটি শহরের ইতিহাসের যোগসূত্রও আলোচনার দাবী রাখে। সেই শহরের নাম জেরুজালেম। ইতিহাসের সেই অমর জেরুজালেম! আলেকজান্ডার মিসর ও জেরুজালেম দখল করেন ৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। ৩৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিসর ছেড়ে অগ্রসর হন পুর্ব দিকে। আলেকজান্ডার যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই শাসন ক্ষমতায় বসিয়েছেন মেসিডোনীয় বা গ্রিকদের। এদের সাথে স্থানীয়দের রক্তের মিশ্রণ ঘটে যায়। বর্তমান আফগানিস্তানের কটা চুলের অধিকারিরা এ সংমিশ্রনের সাক্ষ্য বহন করছে। তাদের শরীরে বয়ে চলেছে গ্রিক ও মেসিডোনীয়দের রক্ত। জাতিতে জাতিতে এই মিশ্রণ পৃথিবীর জন্য কল্যাণকর এবং তাই হওয়া উচিত আরও বেশি পরিমাণে। কারণ জাতীয় সংকীর্ণতা ও দম্ভ পৃথিবীতে শুধু বিপর্যয় ও মানবতার অবমাননাই ঘটিয়েছে। এর সবচেয়ে ঘৃণ্য নিদর্শন ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণবাদ ও ইষ্রার ইহুদি জাতির বিশুদ্ধতার বিধান। ইষ্রার নগরী জেরুজালেমেও আলেকজান্ডার স্বদেশী শাসক বসান। সেখানে নিশ্চিত ভাবেই বিজয়ীদের সাথে স্থানীয় ইহুদিদের রক্তের সংমিশ্রণ ঘটেছে। ইষ্রার ইহুদি জাতির বিশুদ্ধতার বিধান মিলিয়ে গিয়েছে হওয়ায়।
--- সমাপ্ত ---
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:১১
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×