somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন বীরাঙ্গনার জীবন

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১২:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১৯৭১ সালের উত্তাল আন্দোলনে আমি ছিলাম রাজশাহীতে।
২৭শে মার্চ অন্ধকার থাকতে থাকতে আমরা গ্রামের বাড়িতে রওনা হলাম সামান্য হাতব্যাগ নিয়ে। হঠাৎ স্থানীয় চেয়ারম্যানের জীভ এসে দাঁড়ালো আমাদের সামনে। বাবাকে সম্বোধন করে বললেন ডাঃ বাবু আসেন আমার সঙ্গে।
হয়ত জ্ঞান হারিয়েছিল আমার। সচেতন হয়ে উঠে বসতেই বুঝলাম এটা থানা, সামনে বসা আর্মি অফিসার। বললাম, আমাকে বাবা মার কাছ থেকে কেঁড়ে এখানে আনা হয়েছে কেন? অফিসার হেঁসে উত্তর দিলেন, তোমার নিরাপত্তার জন্য।
সন্ধ্যার কিছু আগে চেয়ারম্যান সাহেব এলো। সবকিছু জেনেও আমি ওর পা জড়িয়ে ধরলাম। কাকাবাবু আমাকে বাবার কাছে রেখে আসুন। আপনার মেয়ে সুলতানা সঙ্গে আমি এক সঙ্গে খেলাধূলা করেছি, স্কুলে পড়েছি, আমাকে দয়া করুন। উনি ঝারা দিয়ে আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। মানুষ কেমন করে মুহূর্তে পশু হয়ে যায় ঐ প্রথম দেখলাম। এরপর ১৬ই ডিসেম্বরের আগে মানুষ আর চোখে পড়েনি।
প্রথমে আমার উপর পাষবিক নির্যাতন চালায় একজন বাঙ্গালী। আমি বিস্ময়ে বোবা হয়ে গিয়েছিলাম। সে রাতে আরও কতজন আমার উপর অত্যাচার করেছিল বলতে পারবো না। তবে, ৬/৭ জন হবে। অফিসারের হাত ধরে মিনতি করে বলেছিলাম ‘আমাকে রক্ষা করবার কথা বলছেন , আমি তো রক্ষা পেয়েছি। এবার আমাকে ছেড়ে দিন। আপনি আমার ভাই, আপনার বয়সী আমার বড় ভাই আছে । অফিসারটি হঠাৎ আমার মুখে কিছু থুথু ছিটিয়ে কিসব গালাগালী করে গেলো। আমি নিস্তব্ধ নিথর বসে রইলাম। মনে হলো কেন আমি তার চরনে প্রথম অর্ঘ্য হলাম না, এটাই তার ক্ষোভ। কিন্তু সেতো তার অক্ষমতা।
আমি এখন জড় পদার্থ। যে যখন যেখানে টেনে নিয়ে যে অত্যাচার করেছে , সয়ে গেছি। সম্ভব হলে দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করেছি “জয় বাংলা”
কারো বোধগম্য হলে কিছু থু থু, কিছু লাথি উপহার পেয়েছি। আমাদেরকে শাড়ী বা দোপাট্টী ব্যবহার করতে দেওয়া হতো না। কোন ক্যাম্পে নাকি কোন মেয়ে শাড়ী ফাঁস লাগিয়ে আত্বহত্যা করেছে। তাই আমাদের পড়নে পেডিকোট আর ব্লাউজ। যেমন ময়লা, তেমনি ঠেড়া কুঁড়া। দুচোখ জ্বলে ভরে উঠতো , বাবার কথা মনে হতো। ‘মা এবার কি শাড়ী নিবি? আমি বলতাম তুমি যা দেবে। আদরে মাথায় হাত রেখে বলতেন, ‘মা আমার যে ঘরে যাবে, সে ঘর শান্তিতে ভরে উঠবে।’ বাবা, তুমি কি জানতে তোমার মেয়ে কোন ঘরে যাবার জন্য জন্মায়নি। তার জন্মলগ্নে শনির দৃষ্টি ছিলো। সে শত গনের ঘরনি, যাযাবর রমনী।

পরদিন হঠাৎ আমাদের ভেতর একটি মেয়ে মারা যায়। অত্বসত্ত্বা ছি ছিলো, সকাল থেকেই প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো। কাঁটা পাঠার মতো হাত পা ছুটতে ছুটতে আস্তে করে ঘুমিয়ে পড়লো। মুখখানা নীল হয়ে গেল। ভোররাতে সব কেমন নিঃশব্দ, নিঃস্তব্ধ মনে হলো। সুফিয়ার মা বললো- “হালারা পালাইলো নাকি?” ওর কথায় যেন শরীরে অসুরের বল পেলাম। দরজা ধাক্কাতে লাগলাম, চেঁচাতে আরম্ভ করলাম। হঠাৎ শুনি, -”জয়য়য়য়য় বাংলা, জয়য়য়য় বঙ্গবন্ধু” । মনে হলো আমি বেঁচে গেছি। কিন্তু জানতাম না, তখনও যে কত মরণ আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। ৩/৪ দিন ওখানে থাকবার পর একজন ডাক্তার আমাকে জানালেন আমি গর্ভবতী। আমি কোথায়, কার কাছে যেতে চাই? ঠোঁট চেপে বললাম কারো কাছে নয়, আমার মতো দুঃস্ত মেয়েদের জন্য আপনারা যে ব্যবস্তা করবেন আমার জন্যও তাই করুন। বাবা এলেন, দুহাত শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে কেঁদে উঠলেন।

ঠিক এমন করে একদিন আমরা ৭/৮ জন বঙ্গবন্ধুকে দেখতে গিয়েছিলাম অফিসের মাধ্যমে । সেদিন আমাদের চোখের জলে বঙ্গবন্ধুর বুকটা ভিজে গিয়েছিল । বলেছিলেন- “তোরা আমার মা। তোরা তোদের জীবনের শ্রেষ্ঠ ধন উৎসর্গ করেছিস স্বাধীনতার জন্য। তোরা শ্রেষ্ট বীরাঙ্গনা। আমি আছি তোদের চিন্তা কি?” সত্যি সেদিন মনে হয়েছিল আমাদের বঙ্গবন্ধু আছেন আমাদের আর চিন্তা কি? কিন্তু বাবার বুকে তো সে অশ্রুপাত করতে পারলাম না। মুখ তুলে বললাম, বাবা আমি কি এখন যাবো তোমার সঙ্গে? বাবা একটু থেকে ইতস্ত করে বললেন, না মা, আজ আর আমি তোমাকে নিতে পারবো না। আস্তে করে বাবার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিলাম।
দাদা এসেছিলেন কলকাতা থেকে আনা শাড়ী নিয়ে। দাদা অবশ্য একটা কথা বলে গেলেন যেটা বাবা বলতে পারেননি। “আমরা যে যখন পারবো তোকে এসে দেখে যাবো। তুই কিন্তু আবার হুট করে ও বাড়িতে গিয়ে উঠিস না। আর তা ছাড়া আমাদের ঠিকানায় চিঠি পত্রও লিখার দরকার নেই।তুই তো ভালই আছিস। সরকার থেকে ক্ষতিপূরণ পেয়েছি, তা দিয়ে বাড়ি ঘরও মেরামত করা হয়েছে।” হঠৎ ঘুরে দাঁড়ালাম ওর দিকে আর তাকাইনি। বাবা-দাদাও তাহলে আমার সতীত্ব, মাতৃত্বের দাম নিয়ে সরকারের কাছ থেকে? নতুন ঘর তুলেছে, পুরাতন ঘর মেরামত করেছে। ওরা ও ঘরে থাকবে কি করে?
বাস্তব বড় কঠিন। আমি বীরঙ্গনা, আমাকে নিজের পায়ের উপর ভর করে দাঁড়াতে হবে। বাইরে যেতে না পারলে আমি মরে যাবো। এ সমাজ আমাকে গ্রহণ করবে না। জুলাই মাসের এক বিকেলে আমার আপন বলতে যা ছিলো অতীতের সঙ্গে সব অতল জলে ডুবিয়ে দিয়ে আমি এয়ার ফ্লোটে ওঠে বসলাম। অন্তরে উচ্চারণ করলাম জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু । তোমার দেওয়া বীরাঙ্গনা নামের মর্যাদা যেন আমি রক্ষা করতে পারি।

দেশ স্বাধীন হলো। কেউ গাজী, কেউ শহীদ, কেউ বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম সবার কত সম্মান সুখ্যাতি। অথচ আমি? আমি কিছুই চাইনি। শুধু চেয়েছিলাম আমার নারীত্বের মর্যাদা, আর প্রিয় জন্মভূমির বুকে একটি আশ্রয়। যে দাদা, বাবা আমাকে দুঃবৃত্বের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি তারাই বিচারকের আসনে বসে আমাকে অসূচি, অপবিত্র জ্ঞানে পরিত্যাগ করেছেন। কি সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা, ভাবলে ঘৃণা হয়। আমার মৃত্যুর পরে তোমরা কেউ আমাকে বাংলাদেশে নেবার চেষ্টা করো না। জন্ম দিলেই জননী হওয়া যায়, কিন্তু লালন পালন না করতে মা হওয়া যায় না। প্রতি নিঃশ্বাসে আমি অভিসম্পাত দেই বাঙ্গালি জাতিকে তাদের হীনমনণ্যতার জন্য, তাদের মা কে অসম্মান, অপমান করার জন্যে। একটি মাত্র মানুষ সেদেশে জন্মেছিলেন যার স্নেহস্পর্শে আমি ধন্য হয়েছি । আমি তো তুচ্ছ অনাদুরে গন্য। কিন্তু তোমরা তো পিতৃীঘাতি। সমগ্র বিশ্ব আজ তোমাদের ধীক্কার দিচ্ছে কুচক্রি, পিতৃীহন্তা, লোভী, প্রতারক। বিশ্বসভায় তোমাদের স্থান নেই।

(নীলিমা ইব্রাহিমের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত টুকরো টুকরো কিছু ঘটনা)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১২:১৩
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×