অন্তিম পর্ব
সেদিন ও বৃষ্টি পড়ছিল অঝোর ধারায়। সকাল সাড়ে দশ টা কি এগারো টা হবে। এমন সময় রুপমের কলীগ সাদিক সাহেবের ফোন।
- ভাবী একটা খারাপ সংবাদ আছে। আপনাকে একটু ঢাকা মেডিকেলে আসতে হবে এক্ষুনি।
তারপর যা শুনলো তার জন্য মেহজাবিন মোটেই প্রস্তুত ছিল না। নিস্তব্ধ, নিথর হয়ে গেল হয়ে সে। শুধু আকাশ নয়, সমগ্র পৃথিবীটাই ভেঙ্গে পড়েছে যেন তার মাথায়। অশ্রুকে জড়িয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল মেহজাবিন।
রুপম এক্সিডেন্ট করেছে। অফিসে যাওয়ার পথে রাস্তা পার হওয়ার সময় বেপরোয়া চালক রুপমকে চাপা দিয়ে চলে যায়। চাপা দিয়ে যায় একটি পৃথিবী, একটি সংসার আর অনেকগুলো স্বপ্নকে। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই চলে যায় রুপম, এ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। স্ত্রী ও সন্তানের প্রগাঢ় ভালবাসার বন্ধন ছিড়ে। মেহজাবিন কে একা করে।
ইদানীং একটু অন্যমনস্ক আর উদাসীন থাকত রুপম। অল্পতেই রেগে যেত। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলত, “আর ভাল লাগে না কোন কিছু”। কোন অজানা গন্তব্যের টান অনুভব করত কি না কে জানে।
রুপম ছিল আবেগী আর অভিমানী। ভালবাসার কাঙ্গাল ছিল ও। একটা সময় ছিল যখন ও ভাবত কেউ ওকে ভালবাসবে না কখনও। তাইতো বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী মেহজাবিন যখন তাকে প্রথম প্রপোজ করেছিল তখন সে হেসে বলেছিল, “তুইও আমার সাথে মজা করিস!” “না, মজা করছি না, সিরিয়াসলি বলছি, আমি তোমাকে ভালোবাসি”- উত্তর দিয়েছিল মেহজাবিন।
না, মেহজাবিন মজা করেনি। সত্যিই ভালবেসেছিল রুপম কে। তাইতো রুপম চলে যাওয়ার পর ও আর কোন বাঁধনে জড়ায়নি। কাউকে রুপমের জায়গায় প্রতিস্থাপন করতে পারেনি। পঁচিশ বছর পেরিয়ে গেছে। মেহজাবিন একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষকতা করে। দুই কামরার ছোট্ট মেয়ে অশ্রুকে নিয়ে এখনও স্বপ্ন দেখে যায়। অশ্রু অনেক বড় হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। পড়া প্রায় শেষের দিকেই।
গতকাল থেকেই শরীর টা খারাপ লাগছিল মেহজাবিনের। তাই আজ ছুটি নিয়েছে। অশ্রু ক্লাসে গিয়েছে। আজ ও মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। মেহজাবিন আলমারী থেকে এলবাম বের করে ঝাপসা চোখে রুপমের ছবিতে হাত বুলিয়ে অস্ফুট স্বরে বলতে থাকে, “ওগো, দেখ বাইরে আজও বৃষ্টি হচ্ছে, তুমি ভিজবে না। চলো না, আজ দু’জন একসাথে ভিজি”।
মেহজাবিন বিশ্বাস করে রুপম ওর আশেপাশেই আছে। ওকে সবসময় দেখে রাখে। ওর শুন্যতা বোধ করে কিন্তু ওর অনুভব খুজে পায় প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে। আজও ওর বুকের ভেতরটা ডুকরে কেদে ওঠে । মনে মনে বলতে থাকে, “কেন এত তাড়াতাড়ি চলে গেলে। কেন আমার ভালবাসা দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে গেলে”। মেহজাবিন ভাবতে থাকে কবিতার লাইন দুটো,
“ভাবি, এ জীবন কেন ছোট হায়,
সাজাতেই যেন ফুরিয়ে যায়”।
আজও বৃষ্টি হয়, তবে যতটা না বাইরে তার চেয়ে বোধহয় মেহজাবিনের চোখের পাতাতেই বেশি। আর এ নিরন্তর শ্রাবন রুপমের ভালোবাসার টানে কি না কে জানে। কারন অশ্রু যে রুপমের খুব প্রিয়।
(সমাপ্ত)