somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিশ্বায়ন (Globalization) (পর্ব-১)

১৪ ই জুলাই, ২০১৬ সকাল ৭:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



পাঠক গণের উদার দৃষ্টি ভঙ্গী কামনা করছি। আমাদের আজকের প্রবন্ধটি মূলত কুরানের এমন একটি আয়াত নিয়ে যুগ যুগ ধরে যেই আয়াতটিকে মুসলিম সমাজ ভুল বুঝে এসেছে। রচনাটি প্রচলিত চিন্তিধারার সাথে সংঘাত সৃষ্টি করবে। মুলত এটি একটি গবেষণামূলক রচনা- তাই সঙ্গত কারণেই আমরা আয়াতটির ব্যাখ্যাকে ১০০% বিশুদ্ধ কিংবা চূড়ান্ত সত্য হিসেবে দাবি করছিনা। যারা কুরান নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করতে ভালবাসেন এই রচনাটি শুধুমাত্র তাদের জন্য।

মনে রাখা দরকার যে মহান স্রষ্টা আমাদের বারবার পবিত্র কুরআনে সৃষ্টিজগত ও কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবার তাগিত প্রদান করেছেন, এবং কুরান এও ঘোষণা করছে যে-পূর্ববর্তীদের ন্যায় আমাদের কোন নিদর্শন কিংবা মুজিযা উপহার দেয়া হবেনা শুধুমাত্র কুরান ব্যতীত। এবং আমরা বিগত ২০০-১০০ বছর ধরে কুরআনের এমন সব বানী আজ কেবল বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার ফলেই সবেমাত্র আমরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছি যে মহান স্রষ্টা প্রণীত কুরান কিভাবে সকল যুগের দাবীকে চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করতে পারে এবং কিভাবে সময়ের প্রয়োজন মেটাতে পারে। যেমন- বিগ-বাঙ্ক, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ, প্রজনন বা ভ্রূণ তত্ত্ব, অভিকর্ষবল, ব্লাকহোল এবং এমন অসংখ্য বিজ্ঞান-বিশুদ্ধ আয়াত যা “কুরআন বিজ্ঞানময়”- আল্লাহ্‌র এই বানীটিকেই কিভাবে বারবার সত্য প্রতিপন্ন করে চলেছেন। মুলত এই রচনাটি কোন বিজ্ঞান- বিষয়ক গবেষণা নয়। এটি শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র একটি ভবিষ্যৎবানী মূলক আয়াতের গবেষণালব্ধ রচনা মাত্র। তাই এই ব্যাখ্যার দায়ভার শুধু মাত্র আমার নিজের। আমার ভুল হতে পারে, সেক্ষেত্রে এটি শুধুমাত্র নিছক একটি ভুল ব্যাখ্যা মাত্র। কিন্তু আল্লাহ্‌ কোন ভুল করেননা, তিনি শাশ্বত ও কুরআন আল্লাহ্‌ প্রদত্ত এক চির অম্লান শাশ্বত বানী। পবিত্র কুরআন মানুষের কোন ভুল ব্যাখ্যার দায়ভার বহন করেনা। নিশ্চিত ভাবে এই রচনটি কুরআন গবেষকদের জন্য চিন্তার এক নতুন সূত্র প্রদান করবে। হতে পারে এর মাধ্যমে অনেকে বিস্মিত ও আন্দোলিত হবেন কিংবা অনেকে এই ক্ষুদে লেখককে অবহেলায় ভ্রুকুটি করবেন- বিষয়গুলো ইদানীং আমাকে দুঃখিত কিংবা বিচলিত করেনা।

তাই আবারও আমি প্রিয় পাঠকের উদার চিত্ত ও দৃষ্টিভঙ্গি কামনা করছি। আপনি ইচ্ছা করলেই আল্লাহ্‌র অনুগ্রহে ৩০ পারার হাফেজ হতেই পারেন- কিন্তু পৃথিবীর কোন হাফেজ অনুবাদের হাফেজ নয়।


পবিত্র কুরআনের ১৮:৯৯ নং আয়াতটিকে খুব সম্ভবত আমরা এতদিন ভুল বুঝে এসেছি। আয়াতটির প্রচলিত কুরআন গুলোতে অনুবাদ করা হয়েছে কিছুটা এভাবে-

“সেদিন আমি উহাদিগকে ছাড়িয়া দিবো এই অবস্থায় যে তাদের একদল অপর দলের উপর তরঙ্গের ন্যায় ঝাঁপিয়া পড়িবে, শিঙ্ঘায় ফুঁৎকার দেয়া হবে-অতঃপর তাদের সকলকে একত্রে সমবেত করা হবে”

এবার উক্ত আয়াতের অর্থ আমি জ্ঞানী পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি যা আপনি ইচ্ছা করলেই কোন উন্নতমানের আরবি অভিধানে চেক করতে পারেন-

এবার লক্ষ্য করুণ-

উক্ত আয়াতে ( وَنُفِخَ )-অর্থসমূহ হল- Break, made to waver (to and fro) produce sound- Blast of truppet, repture, swelling, blow, currrent of,

Air, blow up on, Disaster, Blast of truppet, repture, swelling, blow, currrent of, Air, blow up on e.t.c.


আবার ( الصُّورِ) -শব্দটির অর্থগুলো যা আসে তা হল- ‘turn the face towards, bend, incline to one side.


এই অর্থগুলোই প্রস্তাব করে যে আমজকের প্রচলিত সঙ্কীর্ণ ভাবধারায় অতি সরলীকরণে যে অনুবাদ করা হয়েছে সেসব অনুবাদের ভাবধারার চেয়ে আয়াতটিকে অনেক বৃহৎ পরিসরে ভাববার আবকাশ আছে। তাই সঙ্গত কারণেই আরও Vast ভাবে চিন্তা করলে অর্থগুলোর দাবী অনুসারে আয়াতের অর্থগুলো একত্র করলে সবচেয়ে নির্ভুল যে অনুবাদটি হতে পারে সেই অনুসারে আমাদের প্রস্তাবিত অনুবাদ হল- “সে যুগে তাদের একদলকে অপরের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল করা হবে পুনঃ পুনঃ আঘাতকারী তরঙ্গের ন্যায় । দুর্বিপাকের বাঁশি বেজে উঠবে কিংবা বিস্ফোরণের ন্যায় একমুখী পতন ঘটবে, অতঃপর সকলেই পরিণত হবে এক অভিন্ন বিশ্বদল বা বিশ্বজাতিতে (গ্লোবালাইজেশন)।

[ধন্যবাদ মেজর জাহান স্যারকে এই অনবদ্য অনুবাদটি উপহার দেয়ার জন্য।]


আমাদের বিশ্বাস-এই আয়াতটি কিয়ামতের কোন আয়াত নয়, বরং এটি কিয়ামতের পূর্ববর্তী সমসাময়িক বিশ্বের দৃশ্যপটের একটি ভবিষৎবাণী সম্বলিত আয়াত, যা এর পূর্ববর্তী আয়াতগুলোর প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রদান করলে আহলে-ইয়াজুজ-মাজুযের বা আর্মাগেডেনের সমসাময়িক যুগের একটি রূপরেখা বা ইঙ্গিত প্রদান করে। আর এখানে শিঙ্গায় ফুঁৎকারের পরিবর্তে “দুর্বিপাকের বাঁশি বেজে উঠবে”-এটিকে আমরা রূপকঅর্থে ভাববার প্রয়াস পেয়েছি।

অতএব সম্মানিত পাঠক! আবেগের বশবর্তী হয়ে সমালোচনার আগ্রাসন না চালিয়ে, আক্ষরিক অর্থের বন্ধিশালা থেকে বেড়িয়ে এসে-যদি আমাদের প্রস্তাবিত ব্যাখ্যা অপেক্ষা সত্যের অধিক নিকটতর ব্যাখ্যা জানা থাকে তবে কোন তত্ত্বমূলক জ্ঞান-দীপ্ত উত্তর প্রদান করবেন আশাকরি। মহান স্রষ্টাই আমাদের বলেছেন- “তোমার প্রতিপালকই ভাল জানেন কে সত্যের অধিক নিকটতর পথে আছেন”-[আল-কুরান]।


আমরা শিঙ্ঘায় ফুঁৎকার কিংবা কিয়ামতের অনুরূপ কোন তত্ত্বকে অস্বীকার করছিনা, শুধুমাত্র এই আয়াতটিকে আমরা কিয়ামতের পূর্ববর্তী যুগের ইয়াজুজ-মাজুজ/দাজ্জালের যুগের প্রেক্ষাপট বা আলামত হিসেবে চিহ্নিত করবার প্রস্তাব পেশ করছি মাত্র।

আমাদের বিশ্বাস ইয়াজুজ-মাজুক কোন অতিপ্রাকিতিক জীব নয়- বরং তারা বনী আদমেরই বংশতভুত ফ্যাসাদসৃষ্টিকারী মানুষের দল/জাতি। কেননা সহি মুসলিমে আল্লাহ্‌র রাসুল স্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করেছেন- যে ইয়াজুজ-মাজুজ বনী আদমেরই একদল অত্যাচারী জাতি, তিনি স্পষ্ট ভাবে বলেছেন আহলে কিতাবিদের দুই জাতিই শেষ যামানার ইয়াজুজ-মাজুজ। আরও স্পষ্ট ভাবে বলতে গেলে আল্লাহ্‌র রাসুল (সাঃ)ইয়াজুজ মাজুজ বলতে ইহুদী-খৃষ্টানদের ফ্যাসাদ ও তাদের প্রভাব-বলয়কেই বুঝিয়েছেন। ডঃ নজর ইসলাম, কাজি জাহান মিয়া সহ বহু চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবী এবং স্কলার তাদের উচ্চমানের কুরআন-হাদিসের জ্ঞান-গর্ভ গবেষকনার মাধ্যমে তা চিহ্নিত করেছেন।

স্পষ্টত এই আয়াতটি একটি গ্লোবাল বা সিঙ্গুলার সোসাইটির রূপরেখা চিত্রায়ন করে। ১৮:৯৯ নং আয়াতটির আগের আয়াতগুলোর প্রাসঙ্গিকতা বিচার করলে আমরা সুস্পষ্ট রুপে এমনতর চিত্র দেখতে পাই যে ইয়াজুজ–মাযুজ এর যুগে অর্থাৎ শেষ কালে পৃথিবী একটি একক জাতিসত্ত্বায় পরিনত হবে। এটাই মূলত ১৮:৯৯ নং আয়াতের প্রস্তাবনা। সহি-হাদিস বিশ্লেষণে ইয়াজুজ –মাযুজ বলতে আমরা বিশ্বব্যাপী ইহুদী – খ্রিষ্টান সম্প্রদায় এর প্রভাব বা সাম্রাজ্যকে চিহ্নিত করতে পারি। আর আল-কুরআনের এই একক জাতিসত্তার ধারনাও যা আজকের দুনিয়ায় বাস্তবে- হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এ যুগে মোবাইল , কম্পিউটার , ইন্টারনেট তথা স্যাটেলাইট টেলিভিশান আজ পুরো পৃথিবীকেই মানব জাতির হাতের মুঠোই এনে দিয়েছে। ঘরে বসেই মানুষ পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারছে। আজ থেকে কয়েকশত বৎসর আগেও যখন যাতায়াত ব্যবস্থা ততোটা উন্নত ছিলনা, যখন এক দেশ থেকে অন্য দেশ ভ্রমণ ছিল খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। শুধুমাত্র বাণিজ্যিক লেনদেন কিংবা যুদ্ধের প্রয়োজন ছাড়া যখন মানুষের এক দেশ থেকে অন্ন দেশ ভ্রমনের খুব বেশি সুযোগ ছিলনা বললেই চলে। যার ফলে মধ্যযুগের পৃথিবীর এক জাতির মানুষের সাথে অন্য জাতির খুব বেশি সংমিশ্রণ ঘটেনি। এজন্য তখন প্রত্যেক জাতির মাঝেই তাদের নিজ নিজ স্বতন্ত্রতা ও আলাদা বৈশিষ্ট্য খুব ভালভাবে বজায় ছিল। এবং তখন প্রত্যেক জাতিই তাদের পূর্বপুরুষ থেকে চলে আশা স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, ভাবধারা ও স্বকীয় মূল্যবোধের গণ্ডিতে আবদ্ধ ছিল।

নবোপলীয়-পুরোপলীয় যুগের পর মানুষ তার মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করতেই সারাদিন ফসল তথা কৃষিকাজে ব্যস্ত থাকতো, তাই চিন্তা-ভাবনার সুযোগ খুব বেশি ছিলনা বলেই প্রাচীন সভ্যতাগুলোতে মানুষিক বিকাশে বিকশিত হবার উৎকর্ষতা অর্জন করতে মানবজাতিকে একটি দীর্ঘ সময় পাড়ি দিতে হয়েছিল। তারপর যখন একটু সমৃদ্ধি এলো মানুষ তখন তাদের কৃষি কাজের প্রয়োজনীয় প্রজুক্তি আবিষ্কার করতে সক্ষম হল। এর পর একের পর এক তাদের নব নব আবিষ্কারে ফলে জীবনযাত্রা আরও সহজ হতে শুরু করল। এরপর ধীরে ধীরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের চাহিদা বাড়তে থাকলো, সময়ের দাবি ও প্রয়োজনীয়তা মানুষকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত থেকে আরও উন্নততর করে তুলল। যাতায়াত ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এলো। ফলশ্রুতিতে অতীতে যেখানে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যাতায়াত করতে ১ মাসের পথ অতিক্রম করতে হত সেখানে আজ মানুষ এখন ১ দিনেই পৌছাতে পার, অতীতে যেখানে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি জমাতে মানুষের ৬ মাস সময় লাগতো সেখানে আজ কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পূর্ব-থেকে পশ্চিমের কোন ভূখণ্ডে অবতীর্ণ হতে পারে। যার ফলে গ্লোবাল মার্কেটিং সিস্টেম ও ইন্টারনেট আজ পুরো পৃথিবীকে মানুষের হাতের মুঠোয় তুলে দিয়েছে। আপনে ইচ্ছা করলে ঘরে বসেই এখন ইউরোপীয় পণ্যদ্রব্য ক্রয় করতে পারেন, ঘরে বসেই অনলাইনের মাধ্যমে বিদেশী পণ্য ক্রয় করতে পারেন, ঘরে বসেই বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে পারেন ।

ডিজিটাল ফিজিক্স এই যুগে ঘরে বসেই মানুষ পৃথিবীর পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্তের খবরাখবর জানতে পারছে । অনলাইনে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের এর সাহায্যে দুনিয়ার একপ্রান্তের মানুষ অন্য প্রান্তের মানুষ এর সাথে ভাব আদান-প্রদান করতে পারছে, শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন বৈপ্লবিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে যে-এখন পৃথিবীর এক অঞ্চলের মানুষ অন্য দেশে চাকুরী কিংবা ব্যবসা করতে পারে। ইন্টারনেট, টিভি-র মাধ্যমে মানুষ অন্য দেশ এর সংস্কৃতি সম্বন্ধে জানতে পারছে।যার ফলে এক সংস্কৃতির মানুষ অন্য সংস্কৃতির দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। আর এর প্রভাবটা ক্রমশ এতোটাই প্রকোট আকার ধারণ করেছে যে মানুষ তার নিজ নিজ সংস্কৃতির স্বকীয়তা ও মূল্যবোধ ভুলতে শুরু করেছে। নিজ নিজ ট্র্যাডিশনাল জাতীয়তাবোধ কিংবা গৌরববোধ যেন ধ্বসে পড়েছে। তরঙ্গের মাধ্যমে আজ এক জাতির মূল্যবোধ অন্য জাতির মাঝে আঁচড়ে পরছে- আর এই গ্লোবাল মিশ্রিত পৃথিবীর সকল জাতির কিছু কিছু বৈশিষ্ট ও মূল্যবোধ নিয়ে গঠিত হয়েছে একটি একক বিশ্বজনীন জাতীয়তা, একটি একক মূল্যবোধ, আরও স্পষ্ট ভাবে বলতে গেলে পুরো পৃথিবী আজ একটি একক বিশ্বদল বা একক বিশ্বরাষ্ট্রে পরিনত হয়েছে। পৃথিবীর সকল জাতি তরঙ্গের ন্যায় একটি একক আন্তর্জাতিক দলে রপান্তরিত হয়েছে।

প্রত্যেক জাতির মধ্যেই কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয় চরিত্র বিদ্যমান থাকে। একটি জাতির ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্ম বিশ্বাস ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা অপরাপর জাতির চেয়ে আলাদা হতে পারে, আবার অনেকক্ষেত্রে তাদের চিন্তাধারা ও মূল্যবোধ অন্য জাতির জীবন প্রণালী বা রীতিনীতি হতে সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধীও হতে পারে। প্রত্যেক জাতির স্বকীয়তা মুলত সেই জাতির পরিবেশমণ্ডলী, ঐতিহাসিক প্রভাব, ধর্মীয় মূল্যবোধের উপরই অনেকাংশে নির্ভরশীল ।

মোটকথা , একটি জাতির স্বতন্ত্রতা বলতে সেই জাতির মৌলিক বিশ্বাস , রীতিনীতি , পোশাক-পরিচ্ছদ, সামাজিক চাহিদা ও জীবন ব্যবস্থার মৌলিক রূপরেখা বা কাঠামোকে নির্দেশ করে। যেহেতু মানুষ হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের কিছু মৌলিক চাহিদা চিরন্তন। তাই পৃথক– পৃথকজাতিস্বত্বা হওয়া সত্ত্বেও প্রত্যেক জাতির মধ্যে কিছু অভিন্ন মৌলিকতা পরিলক্ষিত হওয়া স্বাভাবিক। তবে এই অভিন্নতার সীমানার বাহিরে প্রত্যেক জাতিই তাদের বিভিন্নতাগুলো আলাদাভাবে উপভোগ করে। কিন্তু যখন একটি জাতি এই উপভোগ্য জীবন প্রণালীর বিভিন্নতাগুলো হারাতে শুরু করে, যখন তাদের ট্র্যাডিশনাল বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা হারায় , এবং ভিন্নতর জাতিসত্তার জীবন প্রণালীর বৈশিষ্ট্য ও চাহিদাগুলো যখন এক ও অভিন্ন চরিত্রে তাদের মধ্যে প্রবেশ করে, তাহলে সেখানে জাতিগত ভিন্নতা বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে না, আর তা যদি পুরো পৃথিবীব্যাপী সকল ভূখণ্ডের সকল জাতির মধ্যেই প্রতিয়মান হয়- তখন সারা পৃথিবী পরিনত এক ও অভিন্ন জাতি-সত্ত্বায়। বিস্ময়কর ভাবে একত্রীকরণের এই জোয়ারে পুরো পৃথিবীতে আজ এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন। আজ আমরা পরো পৃথিবীতে এমন এক প্রজন্ম জন্ম নিতে দেখেছি যারা তাদের হাজার বছরের পূর্বপুরুষের রীতিনীতি কৃষ্টি-ক্যালচার, বিশ্বাস-চেতনা, মূল্যবোধ-রুচি, সংস্কৃতি এককথায় তাদের পূর্বপুরুষের বিশ্বাস, ট্র্যাডিশন ও জাতীয়তাবাদের দেয়াল চূর্ণ-বিচূর্ণ করে একটি আন্তর্জাতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করে ফেলেছে। অনেকে এখানে যুক্তি দেখাতে পারেন- পৃথিবীতে যখনই যেই জাতি পরাশক্তি ছিল, এবং যেই জাতি তাদের নিজ নিজ সময়ে পৃথিবীর অপরাপর জাতির চেয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শক্তিমত্তা ও প্রযুক্তির প্রকর্ষতায় উন্নততর ছিল- তখন তুলনামুলকভাবে দুর্বল জাতিগুলো তাদের উৎকর্ষতায় প্রভাবিত হয়ে তাদের কৃষ্টি-ক্যালচার গ্রহণ করেছে।

হাঁ আমি স্বীকার করছি এই যুক্তি পুরোপুরি অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। তবে মানব জাতির ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করুণ একসময় বাইজেন্টাইন কিনবা পার্সিয়ানগনও দুনিয়াতে পরাশক্তি ছিল- কিন্তু তা ছিল একটি নিদৃষ্ট জাতির যোগ্যতা ও উৎকর্ষতার ফলাফল। কিন্তু ভারতবর্ষকে কি তারা সেই সময় ট্র্যাডিশনের আগ্রাসনে খুব বেশি আন্দোলিত করতে পেরেছিল। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল হযরত(সাঃ)-এর মাধ্যমে মুসলমানগণ যে গ্লোবাল বা আন্তর্জাতিক মিশন নিয়ে সারা পৃথিবীতে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করল; অত্যন্ত প্রতাবের সাথে ১০০ বছর পৃথিবী শাসন করার পরও কি আরবগণ ইউরোপকে তাদের ভাষা ও ট্র্যাডিশন দ্বারা খুব বেশি আন্দোলিত করতে পেরেছিল- যেমনটি পাশ্চাত্য সমাজ আজ সারা পৃথিবীকে তাদের সেকুলারিজমের জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে- এমনকি এক্ষেত্রে তারা জোরজবরদস্তি করার আগেই। রেনেসাঁর জ্বরে পুরো ইউরোপ যখন আক্রান্ত তখন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে কি করে সেকুলারিজম প্রবেশ করল-যেই সমাজ ব্যবস্থা ইসলামের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষীক।

অনেকে যোগাযোগ মাধ্যমের উৎকর্ষতাকে এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করবেন—

হ্যাঁ ! আমি এখানে কোন কারণকে অস্বীকার করছিনা। কারণ যাইহোক- মূল বিষয় হল বর্তমানে আমরা একটি সিঙ্গুলার সোসাইটিতে বাস করছি- এটাই মূল সত্য।

তবে এই বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত একটি কনসেপ্ট আছে।

আমার বিশ্বাস মুহাম্মাদ(সঃ)একটি আন্তর্জাতিক চেতনা ও লক্ষ্য নিয়ে পৃথিবীর বুকে পদার্পণ করেছিলেন। এবং পবিত্র কুরানে খোদ স্রষ্টা আমাদের ঘোষণা দিয়েছেন- সারা দুনিয়াময়য় একটি এই গ্লোবাল জীবন ব্যবস্থাকে অন্য সব মতাদর্শের উপর সমুন্নত তথা বিজয়ী করবেন।

আল্লাহ্‌র অঙ্গীকার অনুসারে পুরো পৃথিবীতে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবার কথা। যা এখনও সম্পন্ন হইনি। একসময় মুসলিমগণ এই লক্ষ্য নিয়ে অর্ধ-বিশ্ব পর্যন্ত আল্লাহর রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল- সেই সময়ের রাজা-মহারাজাদের সকল তাগুতি শাসনক্ষমতাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে। কিন্তু তারপর একসময় আমাদের পতনও হয়েছে আমাদের বাপ-দাদাদের ইমান বিক্রয়ের ফলে। আর নবীজির ভবিষ্যৎবানী অনুসারেও কিয়ামতের পূর্বে সারা পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হবার কথা। বাইবেলের ভবিষৎবাণী অনুসারে যীশু দ্বিতীয়বার পৃথিবীতে আসাবার পর পুরো পৃথিবীর মানবীয় শাসন-কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্ব ছিনিয়ে নিয়ে তা ঈশ্বরের নিকট অর্পণ করবার কথা- যা হাদিস দ্বারাও সমর্থিত। তাহলে এখানে মনে রাখা দরকার ঈসা(আঃ) আসবার পূর্বে পুরো পৃথিবীজুড়ে ইয়াজুজ-মাজুজ বা দাজ্জালের একছত্র প্রভাব থাকার কথা। যেহেতু আল্লাহর পরিকল্পনা অনুসারে শেষ যুগের দুনিয়া এমন একটি রূপরেখা পরিগ্রাহ করবে যেখানে পুরো পৃথিবী একটি একক সিস্টেমে চলবে- আর এমন আন্তর্জাতিক বা গ্লোবাল সিস্টেমের আওতায় পুরো মানব জাতিকে আনতে হলে প্রয়োজন দুনিয়ার সকল মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে বর্ডার বা মাটির সীমারেখা, দেশপ্রেম, জাতিয়তাবাদ, গোত্র-বর্ন ও ভাষাগত পার্থক্য মুছে ফেলা। কারণ এমন জাতিগত ভিন্নতা থাকলে কখনই সিঙ্গুলার অর্ডার বা আন্তর্জাতিক গ্লোবাল ওয়ার্ড সৃষ্টি হবার কথা নয়। আর এই কারণেই বুঝি মহান স্রষ্টা ইসলামের মধ্যে আরবের চাপিয়ে দেয়া ট্র্যাডিশন ও ভাষাগত ধর্ম ও ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছেন-কারণ একটি গ্লোবাল গ্লোবাল জীবনবিধান যদি একটি নিদৃষ্ট জাতির অক্ষর ও ট্র্যাডিশনাল ফ্রেমে বন্ধি হলে থাকে তবে কোনভাবেই বিশ্বময় ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হতে পারবেনা।

আগামিতে আমরা এমন এক সময়ের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছি যখন ইসলাম আর আরবিয় ফ্রেমে আটকে থাকবেনা। পৃথিবীর কোন বন্ধ্যা আলেম বা চরমপন্থি দল তা থামাতে পারবেনা। আজকের পৃথিবীতে একটু গভীরভাবে দৃকপাত করলেই বোঝা যাবে কি করে আল্লাহ্‌ ইসলামকে আরবের বন্ধন থেকে মুক্ত করে ইসলামের স্বকীয় ভাবধারা উন্মোচন করে চলেছেন- যাতে পুরো পৃথিবীর মানুষকে ইসলামের মুল লক্ষ্য অনুধাবন করতে বেগ না পোহাতে হয়-আর এই মানুষিকতা তৈরির জন্যই স্রষ্টা আমাদের এমন এক দুনিয়াতে প্রবেশ করাচ্ছেন যেখানে কোন মাটি বা ভাষা এই গ্লোবাল মূল্যবোধের অন্তরায় সৃষ্টি না করে। আমরা যদি নাও চাই আল্লাহ আমাদের উপর তা চাপিয়ে দেবেন এই কারণে যে এছাড়া সারা পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা অসম্ভব।

হাঁ এমনটা হতে পারে যে আরবগণ তাদের ভাষা ও ট্র্যাডিশন অপরাপর জাতির উপর চাপিয়ে দিয়েছিল একটি মহৎ লক্ষ্যে। কারণ তারা একটি সিঙ্গুলার সোসাইটি সৃষ্টি করতে চেয়েছিল- এবং তারা সেক্ষেত্রে কিছুটা সফল হলেও সেই সময়ের মধ্যযুগীয় প্রেক্ষাপটে পুরো মানব জাতীর মনোজগতে এতো উচ্চ লেভেলের লক্ষ্য অনুধাবন করার জন্য সেই সময়ের মানব সমাজ মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে প্রস্তুক ছিলনা। অন্য ভাবে বলতে গেলে সেই সময়ে খোদ আরবগণও যেখানে ইসলামে প্রবেশ করবার পরই খুব বেশিদিন তাদের গোত্র-প্রীতির মোহ কাটাতে পারেনি, যেখানে সুযোগ পাওয়া মাত্র তারা ইসলামের মধ্যে রাজতন্ত্র ঢুকিয়ে ইসলামের আসল লক্ষ্যকে কলুষিত করেছিল-সেখানে তাদের পক্ষে কি করে সম্ভব বিশ্বের অপরাপর জাতির মনোপটে ইসলামের মূল লক্ষ্যে প্রবেশ করানো…?? তা হওয়া সম্ভব ছিলনা= কেননা তখন এক জাতি অপেক্ষা অন্য জাতির মধ্যে ছিল বিস্তর ব্যবধান।

তবে এখন সেই সংকট আল্লাহ প্রায় মুছে ফেলেছেন ।অনুভূতির একাত্মতার এই রেভুলেশানে আজকের দুনিয়াতে পৃথকীকরণ বিশ্বাসগুলো ক্রমশ চূর্ণ–বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে এক অভিনব চরিত্রে !!! আমরা বাঙালী জাতি যে আজ লুঙ্গী ছেড়ে জিন্স-প্যান্ট পরিধান করতে শিখেছি তা মুলত এই সিঙ্গুলারিটিরই প্রভাব । যেখানে আজ থেকে কয়েকশত বছর আগেও ভিনিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন জাতি বা সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে পোশাক-পরিচ্ছদ, বেশভূষায় এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হত; সেখানে আজ পৃথিবীর প্রতিটি জাতির মধ্যেই এসেছে এক অভিন্ন রুচি।

সচেতন ভাবেই হোক কিংবা অবচেতন ভাবেই হোক পৃথিবীর সকল মানুষের চাওয়া পাওয়া,লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, পোষাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, আচার-আচরণ, ধ্যান-ধারণা, চিন্তা–চেতনায় একবিস্ময়কর একীভূতকরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে !! এখানে লক্ষণীয় যে মহান স্রষ্টা উক্ত আয়াতে তরঙ্গের ন্যায় এক জাতি বা দল অন্য জাতি বা দলের উপর আঁচড়ে পড়ার কথা।

আমরা সেসব তরঙ্গের সাথে পরিচিত সেসব তরঙ্গ কোন সীমানা বা বর্ডার মানেনা। আর মহান স্রষ্টা এখানে আমাদের তরঙ্গ বলতে সেটাই বুঝিয়েছেন যে শেষ কালে একটি জাতির মূল্যবোধ কোন সীমারেখার মধ্যে বন্ধি থাকবেনা। এক জাতির চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ কিংবা সংস্কৃতি তরঙ্গের সাহায্যে এর বাঁধ না মানা তরঙ্গের ন্যায় এক সীমানা থেকে অন্য সীমানায় আঁচড়ে পড়বে। আর এভাবেই পুরো পৃথিবীর মিশ্রিত রুচিগুলো নিয়ে সৃষ্টি হবে স্বতন্ত্র একটি সার্বজনীন আন্তর্জাতিক জাতিস্বত্বা – যেখানে পৃথিবীর কোন ধর্ম বা পূর্ব-পুরুষের নিয়মের শৃঙ্খল এখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারবেনা। এই আন্তর্জাতিক জাতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, চিন্তা-চেতনা, ভাবধারা-সংস্কৃতি, বেশভূষা, আচার-আচরন, জীবন ব্যবস্থা, ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক উপলব্ধি, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা, সমাজ জীবন এককথায় মানব জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগ এক খাতে প্রবাহিত হবে । আর আজকের দুনিয়ার দিকে দৃকপাত করলেই এমন একটি সিঙ্গুলার ওয়ার্ড পরিলক্ষিত হয়। তার অর্থ যে বর্তমানে আমরা মহাপ্রলয়য়ের আগে ইয়াজুজ-মাজুজ বা আর্মাগেডেনের যুগে পদার্পণ করেছি!!

আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) ভাষায় বলতে গেলে “পচেঁ যাওয়া দুর্গন্ধময়’’ ভৌগলিক সীমারেখা ও ভাষাভিত্তিক জাতিতত্ত্বের অহম কিংবা বর্ণবাদ ভিত্তিক চিন্তা-চেতনা ক্রমশ ক্ষয়ে গিয়ে বিশ্বব্যাপী একটি একক বিশ্বাসভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। আজ বাংলাদেশ, ভারত মালয়েশিয়া থেকে শুরু করে ইউরোপ-আমেরিকার সকল প্রজন্মের নরনারীর চাহিদা ও রুচিবোধ প্রায় একই রকম। এখন Skid Row, G&R কিংবা Children of Bodom শুধু ইউরোপেই নয়- তারা জাপানেও সমানভাবে জনপ্রিয়। Alexi Lihoo- এর ডাবল প্যাডেলের রিফ এবং তার স্ক্রিমিনমাথা বিপ্লবী কণ্ঠে আজ জাপানিরাও একাত্মতায় আন্দোলিত হয়ে হেডব্যাঙ্ক দেয়।

এই সিঙ্গুলার ওয়ার্ডের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল- Death Metal সঙ্গীত। এখানে লক্ষণীয় যে Death Song এর লিরিক্সগুলো সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও তারা স্ক্রিমিং ভয়েস দ্বারা সেই প্রতিবাদী লাইনগুলো হিডেন রাখেন। কিন্তু কেন?? – ৮০’র দশকেও তো Alternative Rock ,Pank বা Heavy Metal জন্রার ব্যান্ডগুলো তাদের বিপ্লবী লিরিক্সের দাবী অনুসারে চিৎকারের ভাষায় গান গাইলেও-তাদের কণ্ঠে বোধগম্যতার স্পষ্ট সুরে তাদের ম্যাসেজ প্রকাশ করতো। তখন এমন স্ক্রিমিন ব্যাবহার করা হতোনা যে জাতে শ্রোতা তাদের ম্যাসেজ বুঝতে অক্ষম হন। তাহলে আজ কেন তারা এই ধারাকে ভিন্নস্রোতে প্রবাহিত করলেন??- যদিও এখনকার মেটাল লিরিকগুলোতে এই ৩০-৪০ বছর আগের চেয়ে আরও আগ্রাসি, আরও আপোষহীন ম্যাসেজ সম্বলিত হয়ে থাকে যা দিন দিন মানুষের মানুষিক বিকাশকেই নির্দেশ করে। আমি নিজেও একসময় মেটালহেড ছিলাম বিঁধায় বিষয়টির সাথে আমি গভীরভাবে পরিচিত আর আমি নিজেও যেহেতু ব্যক্তিগতভাবে ডেথ জন্রার একজন ক্ষুদ্র প্রতিনিধি ছিলাম যেহেতু এই বিষয়ে আমি সম্পূর্ণরূপে জ্ঞাত। সেই সময়গুলোতে অনেককেই আমাকে প্রস্ন বা অভিযোগ করেছিল- যে ডেথমেটালে নাকি লিরিকের চেয়ে রিফ-লিডকে বেশি প্রাধান্য দেয়- আসল কথা হল এইসব প্রশ্নকারীরা সেইসব নামধারী মুসলমানদের ন্যায়- যারা বংশগতভাবে নিজেদের মুসলমান ভাবেন কিংবা তাদের ধারনায় নামের পূর্বে ধাঁর করা মোহাম্মাদ লাগানো থাকলেই যেন মানুষ মুস্লিম হয়ে যায়- অথচ কুরআনের বানীতে মহান আল্লাহ্‌ স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন- “হে বিশ্বাসীগণ তোমরা আত্মসমর্পণ না করিয়া (অর্থাৎ মুস্লিম না হয়ে) কোন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করিয়না”- মোট কথা শুধু মুখে কালেমা আওড়ালে কিংবা আল্লাহ্‌ ও রাসুলে বিশ্বাসস্থাপনই যথেষ্ট হয়- এর জন্য মুমিনের গুণাবলী ধারণ করে আল্লাহ্‌র আনুগত্যে অটল থেকে বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমেই মুস্লিম হতে হয়। আল্লাহ বলেন-“ তোমরা শুধুমাত্র (আল্লাহ্‌ ও রাসুলে) বিশ্বাসস্থাপন করেছ বলেই কি আল্লাহ তোমাদের ছেঁড়ে দিবেন বলে মনে কর (বা জান্নাত লাভের আসা কর) অথচ আল্লাহ্‌ এখনও তোমাদের জীবনে পরীক্ষার পর পরীক্ষার মাধ্যমে এটা নিশ্চিত করেননি যে তোমাদের মধ্যে কে তার জন্য জিহাদ করছ এবং কে তজ্জন্য দৃঢ়পদ”

তাহলে বোঝা গেল শুধু ইমানই যথেষ্ট নয়- বরং আল্লাহ্‌ প্রদত্ত শত বাধা-বিপত্তির পরীক্ষায় দৃঢ়পদ থেকে (দ্বীন প্রতিষ্ঠার) জিহাদের দায়িত্ব পালন এবং আল্লাহ্‌র আনুগত্যে অবিচল থাকা ছাড়া জাহান্নাম ত্থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।

আসলে এরাতো এমন ধরণের মুসলিম যারা –ইসলামের সংজ্ঞা পর্যন্ত জ্ঞান নন। ইসলাম অর্থ- সমর্পণ ও আনুগত্য, আবার মুসলিম অর্থ- আত্মসমর্পণকারী।

তাহলে আল্লাহ্‌র নিকট নিজেকে সপে দিয়ে আল্লাহ্‌র প্রতিটি বিধি-বিধান, আইন-কানুন, আদেশ-নিষেধের আনুগত্য করাকেই কেবল ইসলাম বলে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র নিকট আত্মসমর্পণ করে আল্লাহ্‌র প্রতিটি বিধি-বিধান, আইন-কানুন, আদেশ-নিষেধে পালন করে সেই মুসলিম। আনুগত্য ছাড়া যেমন নামের উপরে মোঃ টাইটেল ধারণ কিংবা বিশ্বাসের জোরে যেমন মুসলিম হওয়া যায়না- আর আনুগত্যবিহীন অবস্থায় নিজেকে মুসলিম হিসেবে দাবি করলে যেমন তাকে ভণ্ড-মুনাফেক ছাড়া কিছুই বলা যায়না, ঠিক যেমন বিসমিল্লাহ্‌ পাঠ করেছি বলেই কোন হারাম খাদ্যকে ভক্ষণ করা হালাল হয়ে যায়না; ঠিক তেমনি- বিসমিল্লাহ্‌ লিখা থাকলেই একটি সংবিধানের আল্লাহ্‌র আইনের বিপরীধ কোন আইন-কানুন প্রণয়ন বৈধ হয়ে যায়না- একটি রাষ্ট্রকে তখনই ইসলামী রাষ্ট্র বলা যাবে –যখন সেই রাষ্ট্রের সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বিচারালয়, প্রসাসন ও শাসনব্যবস্থার প্রতিটি বিভাগ আল্লাহ্‌ প্রদত্ত দিক নির্দেশনা ও হুকুম-বিধান দ্বারা পরিচালিত হবে। কুরআনে স্পষ্টভাষায় বলা হয়েছে-“আইন প্রণয়নের অধিকার শুধু আল্লাহ্‌র” আল্লাহ্‌র অবতীর্ণ বিধান অনুসারে যারা বিচার-শাসন সম্পাদন করেনা তারাই কাফের, ফাসেক, জালেম।”

সুতরাং উক্ত আয়াত মুসলমানদের জন্য এমন একটি সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে- যার ফলে একজন মুসলমানের পক্ষে কখনই ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়- কারণ আল্লাহ্‌র সীমারেখা লঙ্ঘন করলেই কুরান তাকে আল্লাহদ্রোহি(তাগুদ), কাফের, ফাসেক, জালেম হিসেবে চিহ্নিত করে।

যাই হোক- Death Metal এর লিরিক হিডেন মূলত আজকের বিকশিত সমাজ ও মানব মস্তিষ্কের উৎকর্ষতারই দাবী। যারা এটি বোঝেননা তারা ওই আল্লাহর প্রণীত সংবিধান কুরানবিবর্জিত তাগুতি রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই ইসলামী রাষ্ট্র মনে করে –যে তথাকথিত ইসলামী রাষ্ট্রে আল্লাহ্‌র সংবিধান লঙ্ঘন করে মদ,জুয়া, পতিতাবৃত্তির বৈধতার লাইসেন্স দেয়া হয়, যে রাষ্ট্রে সুদ একটি প্রতিষ্ঠিত অর্থনীতি যার বিরুদ্ধে স্বয়ং আল্লাহ্‌ ও রাসুল যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন- যার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে দিয়ে গেছেন ইসলামের মহান খলিফা আবুবকর।

আজ মানুষের এমন একটি পৃথিবীতে বাস করছে- যেখানে পৃথিবীর সকল মানুষের চাওয়া-পাওয়া, দাবী-দাওয়া, সমস্যা-বিগ্রহ একই রকমের, আর এই কারণেই আজ Death Metal লিরিকগুলোকে হিডেন করা হয়- এখানে তাদের প্রতিবাদী ম্যাসেজগুলোকে এই কারণে হিডেন করা হচ্ছে যাতে সঙ্গীতের উচ্চমানের রীফ-লিডের আন্দোলনে আন্দোলিত হয়ে, শুধু নিছক হেডব্যাঙ্কের আড়ালে গানের আসল আহবান ও ম্যাসেজ হারিয়ে না যায়- বরং উক্ত গানের লিরিকে যে ম্যাসেজ নিহিত রয়েছে তাকে গানের একটি আলাদা ও স্বতন্ত্র উপাদান হিসেবে প্রকাশ করা হচ্ছে। এখানে লিরিক গুলোকে গুরুত্বহীন ভাবাতো হচ্ছেই না বরং একে আলাদা স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে-যাতে স্রোতা তা পড়ে দেখে- কারণ বেশীরভাগ সময়ই আমরা দেখেছি- কম্পোজিশান অনবদ্য হবার কারণে গানের আসল বার্তা বা আহবান হারিয়ে যায়। পশ্চিমা সমাজ এটির গুরুত্ব বোঝে বলেই তা করেছে- কিন্তু অজ্ঞ দেশীরা নিজেদের গ্লোবাল মেটালহেড হিসেবে দাবী করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা পুস্তকবহনকারী গাধা অপেক্ষা বেশি কিছু না- তারা সেইসব হাফেজদের ন্যায় যাদের আরবিতে কুরআন মুখস্ত থাকলেও এর মর্মার্থ ও অর্থ ধারণ করতে অক্ষম। এই কারণেই বাংলাদেশে মেটাল বেমানান। এই কারণে যে তারা গোঁড়া জাতীয়তাবাদী। অথচ তারা কিন্তু ঠিকই Artcell-এর অনিকেতপ্রান্তর কভার করে যাচ্ছে- কিন্তু তারা অনিকেত প্রান্তরের বর্ণবাদ ও বর্ডার বিরোধী ম্যাসেজ অনুধাবন করতে পারছেনা, কিংবা বাংলার ক,খ,গ এর অন্ধ অক্ষরপ্রেমে তা বুঝতে রাজী নয়। সত্যিই বাঙ্গালীধর্মের মানুষদের ধার্মিকই বলতে হয়।

আজ হিন্দু, মুসলিম, ইহুদি কিংবা খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ সকল জাতিই ক্রমশ ধর্ম-নিরপেক্ষ জীবনপ্রনালি মেনে নিয়েছে। একজন হিন্দু – মুসলিম এর মধ্যে বিয়ে এখন খুবই সাধারণ ব্যাপার । প্রত্যেকধর্মের অনুসারী কিংবা জাতিই এখন একসাথে ‘ভ্যালেন্টাইন-ডে“ কিংবা ‘ফ্রেন্ডশিপ ‘ডে, জন্মদিন,ম্যাদার-ডে, কিংবা হিন্দুদের হলিখেলার উৎসব পালন করে । স্রষ্টা এখন আর কোন দেশে আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা রাখেনা। যদিও সব ধর্ম গ্রন্থই আমাদের বলে স্রষ্টা সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী , তথাপিও আজ প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীই আজ জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী মেনে নিয়েছে- যা কয়েকশ বছর পূর্বেও কল্পনাতীত ব্যাপার ছিল। মানুষই এখন মানুষের প্রভু। মানুষেই এখন মানুষের দাস।

ধর্ম বলতে এখন যা কিছু অবশিষ্ট আছে তা হল কিছু আনুষ্ঠানিকতা। মুসলিম, হিন্দু, ইহুদী, নাসারাসহ সকল ধর্মের অনুসারীগণ আজ তাদের গডকে মসজিদ-মন্দির কিংবা চার্চ-গির্জায় বন্ধী করে রেখেছে। রাষ্ট্রীয় দপ্তর-বা অফিস-আদালতে স্রষ্টার দিকনির্দেশনার কোন প্রয়োজন নেই।

ইয়াজুজ-মাজুজ এর এই যুগে সত্যিই আজ দুর্বিপাকের বাঁশি বেজে উঠেছে। আজ জাতি-গোত্র-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষই আজ একই ভাষায় কথা বলতে চায়, একই রকম সুরে গান গায়, একই রকম কষ্টে ব্যাধিত হয়, একই রকম স্বপ্নে বিভোর হয়, একই রকম নেশায় মগ্ন হয়, পুরো পৃথিবী একই সাথে প্রবৃত্তির দাসত্বে উল্লোসিত হয় ,একই উৎসবে আন্দোলিত হয়।

“তোমাদের ধর্ম তোমাদের এবং আমাদের ধর্ম আমাদের” কুরআনের এই বানী আজ পৃথিবী থেকে উঠে গেছে। অন্যায়ের প্রভু দাজ্জাল আজ মানুষকে এই বার্তার উপর অনুশীলন করতে শিখিয়েছে যে-“ধর্ম যারা যার- কিন্তু উৎসব সবার”- একারণে মুসলমানরাও আজ নাসারাদের ক্রিসমাস উৎসব পালন করে, হিন্দু-মুসলিম আজ একসাথে মদ খায়, এমনকি নাসারাদের ‘প্রতারণা দিবস” বা এপ্রিল ফুল আজ মুসলমানরাও পালন করে যেদিন ক্রুদসেডারগন মুসলমানদের বলির পাঁঠা বানিয়েছিল প্রতারনার মাধ্যমে।

মোট কথা- আমরা বর্তমানে একটি গ্লোবাল সমাজের বাসিন্দা। এর এই গ্লোবাল সোসোসাইটির যারা উচ্চতর অবস্থান থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে তারাই কুরান এর পরিভাষায় ইয়াজুজ -মাযুজ। আজকের উন্নত টেকনোলজি, মিডিয়া, বিশ্ব-অর্থনীতি /কর্পোরেট ওয়ার্ল্ড, বিশ্ব-রাজনীতি মুলত তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে………………!!!!
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৯:৩৭
১৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত যেসব বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে…

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:০৭




মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত যেসব বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে…
১. প্রথমে বলেছেন মৃতদের পেটে কাটাছেড়ার ডাহা মিথ্যা। পরে স্বীকার করেছেন দাগ থাকে।
২. আশ্রমে বৃদ্ধদের চিকিৎসা দেয়া হয় না। কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) পক্ষ নিলে আল্লাহ হেদায়াত প্রদান করেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:৪২



সূরা: ৩৯ যুমার, ২৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৩। আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম হাদিস, যা সুসমঞ্জস্য, পুন: পুন: আবৃত। এতে যারা তাদের রবকে ভয় করে তাদের শরির রোমাঞ্চিত হয়।অত:পর তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগটা তো ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে গেলো :(

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৫৭



আমি আমার ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে। ব্লগটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ প্রথম আলো ব্লগ আমায় লেখালেখিতে মনোযোগী হতে শিখিয়েছে । সে এক যুগ আগের কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

লুঙ্গিসুট

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



ছোটবেলায় হরেক রঙের খেলা খেলেছি। লাটিম,চেঙ্গু পান্টি, ঘুড়ি,মার্বেল,আরো কত কি। আমার মতো আপনারাও খেলেছেন এগুলো।রোদ ঝড় বৃষ্টি কোনো বাধাই মানতাম না। আগে খেলা তারপর সব কিছু।
ছোটবেলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:২৫

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

ছবি কৃতজ্ঞতা: অন্তর্জাল।

একবার শাইখুল হাদিস মুফতি তাকি উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হল, জীবনের সারকথা কী? উত্তরে তিনি এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×