হুজুর আমাকে খুবই পছন্দ করতেন। প্রায়ই দাঁড় করিয়ে নানা প্রশ্ন করতেন, আমিও সাধ্যমত উত্তর দিতাম।
একদিন তিনি নিয়মমাফিক আমাকে বললেন, বলতো ইসলাম কিভাবে বিশ্বশান্তিতে অবদান রাখতে পারে?
বললাম: সবাই যদি মুসলমান হয়ে যায়, তাহলে তো আর যুদ্ধ- হানাহানি থাকবে না। কারণ সব হানাহানি তো ধর্ম নিয়াই।
হুজুর বললেন, মুমিনের ব্যাটার মত বলছিস! আল্লার খাঁটি বান্দার মত বলছিস। সবার দিকে তাকায়া আরেকবার বল!
আমিও সবার দিকে তাকিয়ে বিশ্বশান্তি বিষয়ে আমার তত্ত্বখানা আরেকবার ঝেড়ে দিলাম। বুকটা গরবে ফুলে উঠল।
কিন্তু খুব বেশিক্ষণ আল্লা কারো ভালো চান না। বিরতির পরই কিবরিয়া স্যারের ক্লাস। অন্য সব স্যারের ক্লাসে যেমন কথা বলা যায় না, কিবরিয়া স্যারের বেলায় তা উল্টো। পড়া না থাকলে খামাখা বসে থাকার কি মানে, খালি না চিল্লালেই হলো- স্যারের সোজা কথা। তো সেদিনও পড়া শেষে আমাদের ফিসফিসানি চলছে, আর স্যারও যথানিয়মে গালে হাত দিয়ে জানালার বাইরে উদাস- এমন সময় হলো কি, ক্লাসে ছিল কয়েকটা বামপন্থী, আর আল্লামাবুদ জানে আশির দশকে এগুলা স্কুলে থাকতেই কেমনে পাকনা হয়ে যেত, আর জানেনই তো চিরকালের নিয়মে ওরা কারো ভাল দেখতে পারে না, খুব হিংসা ওদের- আমার যে একটু গর্ব হয়েছে বিশ্বশান্তির তত্ত্ব দিয়ে তা ওদের ভাল লাগবে কেন; স্যারকে আমার আবিষ্কার সম্পর্কে জানাল।
স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই এ কথা বলছিস?
জ্বি, বলেছি।
আবার বল, শুনি।
আমি আবার বললাম আমার তত্ত্বখানা: সবাই যদি মুসলমান হয়ে যায়, তাহলে তো আর যুদ্ধ- হানাহানি থাকবে না। কারণ সব হানাহানি তো ধর্ম নিয়াই।
স্যার আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে জানালার বাইরে তাকালেন, কয়েক মুহুর্তের নীরবতা। আমি বসবো কিনা বুঝতে পারছিলাম না, পেছনে আবার ফিসফাস শুরু হয়ে গেছে।
স্যার জানালার বাইরে থেকে চোখ না ফিরিয়েই বললেন: কোন মুসলমান, শিয়া না সুন্নী?
আমার মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল, পেছনের ফিসফিসানিও চুপ। বিশ্বাস করুন, আশির দশকের যে শিশুরা আমরা প্রতিদিন টিভিতে উপসাগরীয় যুদ্ধ নামের বিশেষ পর্বটির জন্য অপেক্ষা করতাম, আর তার পরই আমাদের দুই ভাইয়ের বালিশ যুদ্ধ শুরু হত, আমি ইমাম খোমেনীর সমর্থক, ও সাদ্দামের তাদের কাছে এই প্রশ্নের মানে অনেক। আমরা সবাই জানতাম, খেমেনি খাঁটি, কিন্তু সে শিয়া। আর সাদ্দাম সুন্নী হইলেও আমেরিকার লোক, সৌদি পয়সায় চলে। আমার নিজর পক্ষ ছিল তাই ইরান।
আমি তখনো দাঁড়িয়ে, পেছনে ফিসফিসানি আবার শুরু হয়েছে। যদিও তা হতম্ভবতার শেষের অনিশ্চয়তা মাখানো।
আমি বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম আমার দিকে আদৌ না তাকানো কিবরিয়া স্যারের দিকে। আমার শিশুস্বর্গ ভেঙে দিয়েও দেখো কি আশ্চর্য সহজ আর স্বাভাবিক তিনি। তাকিয়ে আছেন জানালা দিয়ে, যেন আমার সেই শিশুস্বর্গের কোন দাম নেই, যেন কোন অপরাধ তিনি করেননি আমার প্রতি। যেন সব কিছুই আগেই মত স্বাভাবিক।
কি কি যে ঘৃনা হলো বিকারহীন কিবরিয়া স্যারের প্রতি।
তখনো যদি জানতাম স্বর্গচ্যুতির এই মোটে শুরু!
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০০৯ রাত ২:২৬