অবশেষে বাবা আমার অফিসের শেষ কর্মদিবস শেষ করে বাসায় আসলেন। সেই চিরচেনা, প্রশান্তিময়, হাসিমাখা ,একজন বিজয়ী মানুষের মুখ।
কিন্তু আমাদের সবার মন খারাপ। খুব খারাপ, খুব বেশী খারাপ।বাবা যে আমাদের জন্য একেবারে কিছুই করলেন না। এতো বছর চাকুরি করে একেবারে শূণ্য হাতে বাবা ঘরে ফিরলেন।
ছোট বোন বললো-
বাবা, তোমার কি কোনো সন্চয় নেই? এখন আমাদের চলবে কেমন করে?
আরে তোদেরতো কিছুই বলিনি। যদি হেরে যাই। সেই ভয়ে আগে কিছু বলিনি। তাই মনে করলাম, যেদিন সত্যিকারের বিজয়ীর বেশে বাড়ী ফিরবো, সেদিনই তোদের আমার সব সন্চয় দেখাবো। আজ আমার বিজয়ের দিন। আজ আমার বড় আনন্দের দিন। আমার চেহারায় দেখতে পাচ্ছিস না, কি বিজয়ীর হাসি আমার মুখে লেগে আছে। আজকে আমি দিগবিজয়ী আলেকজান্ডার।তোদের বাবা আলেকজান্ডার।
সুদীর্ঘ চাকুরিজীবনের বিশাল সন্চয় দেখাবার জন্য আমাদের নিয়ে পরদিন বাবা বেড়িয়ে পড়লেন।
বাবা'র পরনে একটা ভালো শার্ট নেই। মুজা খুঁজতে গিয়ে দেখলাম মুজার কয়েকজায়গায় ফুটো হয়ে গেছে। এতোদিন এসব খেয়াল করিনি। আজ বাবার সাথে যাবো। তাই সবকিছু মন দিয়ে দেখছি।
বাবা, প্যান্ট পড়লেন দেখলাম-খুব শক্ত করে কোমড়ে একটা গিট্টু দিলেন। কেমন ঢোলাডালা প্যান্ট।
বাবাকে বললাম, বাবা।
একি অবস্থা ! তোমার দেখি একটি ভালো শার্ট নেই, প্যান্ট নেই। মুজার কয়েক জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে।
বাবা বলেন, বড় কোনো সন্চয় করতে হলে যে এরকমই হয়। একটু কৃপণতা না করলে কি এতোবড় সন্চয় করতে পারতাম। চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে। আজকে তোদের আমার সব অর্জন দেখাবো।
এবার, অন্যরকমের এক আনন্দে আমাদের মন ভরে গেলো। যাক, বাবা হয়তো এতোদিন আমাদের কিছু বলেননি। আজকে বাবার অর্জিত সম্পদ দেখবো। দারুন ভালো লাগছে মনে।
অতঃপর নিয়ে গেলেন, ব্যাংকে । হাসিমুখে বাবার এ্যাকাউন্ট দেখালেন। আমার কৌতুহল বাড়তে লাগলো। কিন্তু এ আমি কি দেখলাম।
ব্যালেন্স যে কিছুই নেই , সব শুণ্য।
আমরা খুবই মন খারাপ করে বাড়ী ফিরলাম।
বাবার মুখে কিন্তু সেই আগের মতো বিজয়ীর হাসি।
বাবা, বললেন , দেখলি- সুদীর্ঘ ৩৪ বছরের চাকুরি জীবনে কত বিশাল বড় সন্চয় করেছি।
আমি বললাম- বাবা, ব্যাংকে কিছুই নেই, গ্রামের সেই পুরানো বাড়ি, কোনো গাড়ি নেই। সেই রিকসায় চড়া। তোমার একটা ভালো জামা নেই। তোমার জুতোর রঙ দেখে বুঝা যায়না, এটা একসময় কালো ছিলো। এই হলো তোমার বিশাল সন্চয়। মাথা খারাপ হলো তোমার?আর খালেক চাচাকে দেখো, ঠিক তোমার মতো চাকুরি করলেন।ঢাকা শহরে বাড়ি, দামী গাড়ি। শপিং মলে নিজস্ব দোকান। এখন বলো -কারটা সন্চয়, তোমারটা না কি খালেক চাচার টা? আর ব্যাংকে শুন্য সন্চয় নিয়ে তুমি নিজেকে আলেকজান্ডার ভাবছো, বাবা?
বাবা, বললেন- ৩৪ বছর শুধু বেতনের টাকায় সংসার চালিয়ে কোনো সম্পদের মোহে আর লোভে না পড়ে এই যে এতটুকু পথ পাড়ি দিলাম-নিজের বিবেকের ঘরে এর চেয়ে বড় সন্চয় আর কী হতে পারে?
দারিদ্রের টানাপোড়নে প্রতিনিয়ত জর্জরিত হয়েছি, কিন্তু লোভ আর অসততার সাথে এতটুকু আপোষ করিনি , এর চেয়ে বড় বিজয় আর কি হতে পারে?
তোদেরকে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষায় নিজের পায়ে দাঁড় করাতে শিখেয়েছি, এর চেয়ে বড় সাফল্য আর অর্জন কি হতে পারে?
আর আমি জানি, আমার বেতনের টাকা কতটুকু । সেই হিসাবে কেউ যদি এ টাকা থেকেই গাড়ী , বাড়ি এসব কিছু করে ফেলে, তবে আমি বলবো-
সেটা সন্চয় নারে, সেটা হলো হলো জীবনের সবচেয়ে বড় সংশয় ।
ফেসবুকেও পড়তে পারেন
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ৩:০৬