সিনেমা দেখতে দেখতে; হঠাৎ কখনও কারো অভিনয়ে ডুবে যাই;
তারপর Youtube বা KMPlayer একবার Pause করে সেই অভিনেতা/অভিনেত্রীকে Google এ সার্চ দিয়ে খুঁজতে থাকি।
আজও এমনটা হল...সেই গল্পটাই লিখে রাখছি।
----
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় তার "প্রতিদ্বন্দ্বী" ছবিটি তৈরি করেন, সেটা মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭০ সালে।
ছবিতে সিদ্ধার্থ (ধৃতিমান চট্রোপ্যাধায়) সদ্য গ্র্যাজুয়েট; সে চাকরীর খোঁজে কলকাতার পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। চাকরিজীবী ছোটবোন, বিপ্লবী ছোটভাই আর বিধবা মাকে নিয়ে তার জীবন-যাপন।
এক রাতে বাড়ী ফেরার পথে কেয়া (জয়শ্রী রায়) সিদ্ধার্থ কে একা একা হাটতে দেখে বলে, “এই যে, শুনুন, এই দিকে, একটু শুনবেন”।
সিদ্ধার্থ এগিয়ে যায় কেয়ার বাড়ীর দিকে তারপর সে বলে, “কি ব্যাপার?”
কেয়াঃ আপনি ফিউজ সারাতে জানেন?
...হ্যা, এভাবেই সিদ্ধার্থ আর কেয়ার পরিচয় হয়।
জানা যায়, সিদ্ধার্থ ডাক্তারি বিদ্যা দুই বছর পড়েছিল কিন্তু বাবা মারা যাবার কারণে আর পড়তে পারেনি। এক রাতে সিদ্ধার্থ আর কেয়া বাসে চেপে রাতের কলকাতা শহর দেখতে বের হয়; টাটা ষ্টীলের ভবনের ছাদে উঠে শহর দেখার প্রস্তাব দেয় সিদ্ধার্থ। সেদিন তারা রেস্টুরেন্টে যায়... আর তাদের গল্পও সামনে এগিয়ে যায়...।
জানা যায়, কেয়ার বাবা ইনকাম ট্যাক্স বিভাগে বদলীর চাকরী করে, দিল্লি থেকে সে কলকাতায় এসেছে মাত্র তিন মাস আগে। কেয়ার ৭বছর বয়সেই তার মা মারা গেছে, সে বড় হয়েছে ছোটমাসির কাছে।
সিদ্ধার্থ আর কেয়া একদিন টাটা ষ্টীলের ভবনের ছাদে উঠে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, গঙ্গার পাড়, আর ময়দানে হাজারো মানুষের কোলাহল দেখে; কথা বলতে বলতে কেয়া সিদ্ধার্থকে আপনি থেকে তুমি বলে। সিদ্ধার্থ কলকাতার বাইরে চাকরী নিয়ে চলে যাবার বিষয় সামনে এলে, কেয়া বলে, “তুমি যদি চলে যাও, আমিও থাকবো না।“
জানা যায়, কেয়ার ছোটমাসিকে তার বাবা বিয়ে করছে; মাসিকে মা বলে ডাকতে সে পাড়বে না; এজন্য সে দিল্লি চলে যাবে।
এদিকে সিদ্ধার্থ সারাজীবন কলকাতা শহরে থাকলেও সে একটা চাকরীর জন্য কলকাতার বাইরে চলে যায়। সে একটি হোটেলে উঠে; তারপর কেয়াকে চিঠি লিখতে শুরু করে...।
হ্যা, গল্প/ছবি এখানেই শেষ। এবার ছবি Pause করে কেয়া (জয়শ্রী রায়) কে Google এ সার্চ দিয়ে কি পেলাম সেটা জানা যাক।
----
জয়শ্রী রায় ১৯৬৮ সালে মিস ক্যালকাটা উপাধি লাভ করেন। তিনি সত্যজিত রায়ের "প্রতিদ্বন্দ্বী" সিনেমার মধ্যমে চলচ্চিত্রে আসেন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পরিচালক আলমগীর কবির ১৯৭৫ সালে তার “সূর্য কন্যা” ছবির জন্য জয়শ্রী রায়কে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন।
এবার একটু আলমগীর কবির সম্পর্কে জানা যাক।
আলমগীর কবির (১৯৩৮–১৯৮৯) স্বনামধন্য চলচ্চিত্র পরিচালক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তার ৩টি চলচ্চিত্র ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের "বাংলাদেশের সেরা ১০টি চলচ্চিত্র" তালিকায় স্থান পেয়েছে।
তিনি ১৯৫২ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক; ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি নেন।
তারপর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ইংল্যান্ড যান। সেই সময়ে তিনি ইংগনমার বার্গম্যানের "সেভেনথ সিল" সম্পর্কে জানতে পারেন। চলচ্চিত্রটি তিনি বেশ কয়েকবার দেখেন এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতি আকৃষ্ট হন।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধের সময়ে, তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি বিভাগে প্রধান হিসেবে যোগ দেন।
তিনি ১৯৭৩ সালে তার প্রথম চলচ্চিত্র "ধীরে বহে মেঘনা" নির্মাণ করেন। এরপর ১৯৭৫ সালে নির্মাণ করেন তাঁর দ্বিতীয় চলচ্চিত্র "সূর্য কন্যা"। চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৭৭ সালে নির্মাণ করেন তাঁর তৃতীয় চলচ্চিত্র "সীমানা পেরিয়ে"। ১৯৭৯ সালে নির্মাণ করেন চতুর্থ চলচ্চিত্র "রূপালী সৈকতে"। ১৯৮২ সালে নির্মাণ করেন পঞ্চম চলচ্চিত্র "মোহনা"। ১৯৮২ সালের মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে "মোহনা" চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ডিপ্লোমা অফ মেরিট লাভ করেন।
এবার মূল বিষয়ঃ
জয়শ্রী রায় ১৯৭৫ সালে "সূর্য কন্যা" ছবির জন্য কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। ছবির কাজ শেষে তিনি আলমগীর কবিরকে বিয়ে করে "জয়শ্রী রায়" থেকে "জয়শ্রী কবির" হয়ে যান।
জয়শ্রী রায় বাংলাদেশ থেকে যান আর "সূর্য কন্যা" - (১৯৭৫), "সীমানা পেরিয়ে" - (১৯৭৭), "রূপালী সৈকতে" - (১৯৭৯) আর "মোহনা" - (১৯৮২) এই ৪টি ছবি আলমগীর কবিরের পরিচালনায় আর জয়শ্রী রায়ের অভিনয়ে নির্মিত হয়।
আশির দশকের মধ্যভাগে আলমগীর কবিরের সঙ্গে তার বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়, জয়শ্রী রায় প্রায় একযুগ এদেশের চলচ্চিত্রে অভিনয় করে কলকাতায় চলে যান।
এদিকে আলমগীর কবির একটি চলচ্চিত্র বিষয়ক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বগুড়া থেকে ঢাকা ফিরে আসার পথে ২০ জানুয়ারি, ১৯৮৯ সালে নগরবাড়ি ফেরিঘাটে এক দুর্ঘটনায় মারা যান।
অন্যদিকে জয়শ্রী রায় নব্বইয়ের দশকে একমাত্র সন্তান লেনিন সৌরভ কবিরকে নিয়ে চলে যান লন্ডনে। তিনি এখন লন্ডনের সিটি কলেজে ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষাদান করছেন।
শেষ কথাঃ
মানুষের জীবনটা কত অদ্ভুত!
কলকাতার ছবি দেখতে গিয়ে খুঁজে পেলাম জয়শ্রী রায়কে; যে কিনা এক যুগ এই ঢাকা শহরেই বসবাস করেছেন!
আজ ভাবছি; কলকাতা, ঢাকা আর লন্ডন... ৩টা শহর আর ২টা মানুষ কিভাবে অদৃশ্য সুই-সুতায় বাঁধা ছিল সময়ের সাথে...!