শেষ পর্বঃ বাম্পিং বাম
আগের রাতে সামিন আর সাকিবের চাপাচাপিতে একটা গুজরাতি ছিনেমা গলঃধরণ করতে হয়েছিলো। ছিনেমার পাচঁ মিনিটের মধ্যে হতচ্ছাড়া দুইটা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর অনিদ্রা রোগী আমাকে ফার্মগেটের ফকিরগুলোর মত বড় পর্দায় অখাদ্য গিলতে গিলতেই রাত কাবার করে দিতে হয়েছিলো, সুতরাং রাতে খুব ভাল একটা ঘুম হয়নি। ইচ্ছা ছিলো সুবাহ সাদিকের সময় পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হবার, কিন্তু এই প্রথমবারের মত সাকিবের মত আমিও ঘুম থেকে উঠতে দেরী করায় বের হতে হতে সুরয তার পশ্চিমমুখী যাত্রায় আমদের থেকে বেশ এগিয়ে।
সামিনের কাছ থেকে তাড়াহুড়ো করে বিদায় নিয়ে দুই চাকাসহ আমরা আবার রাস্তায়। সুরযকে পাশে রেখে সিলেট বাইপাস দিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করলাম দেশের দক্ষিণ দিকে।
লোকে বলে, ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়- কিন্তু যাদের মাথাভর্তি চুল তাদের ক্ষেত্রে কথাটা কতখানি সত্য? আমাদের বাহনের শক্তি-নির্দেশক সূচক শুন্যের কাছাকাছি। আগের রাতেই আমরা চিন্তা করেছিলাম বাহন-বেচারাকে ভাল করে কিছু দানাপানি দিবো, কিন্তু সময় করে হওয়া ওঠেনি(সামিনের রুমে আমরাই নিজেদের শক্তি বর্ধন করতে ব্যস্ত ছিলাম কিনা)। সুতরাং দায়িত্বশীল বাহকের মত ঠিক করলাম নিজেদের পেটপূর্তির আগে ষাঁড়টাকে সকালের নাস্তা করিয়ে জীবসেবা করবো।
ঈশ্বরবিবর্জিত দেশ- মাইলের পর মাইল পার হওয়ার পরও এই অবলা পশুর মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার মত কোনো জায়গা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। আর কিছুক্ষণ পর হয়ত আমাদের তিন প্রাণীর স্থান অদল-বদল করতে হবে- দেড়শত কিলোগ্রাম ওজনের ষাঁড়টিকে আমাদেরই কাঁধে নিতে হবে। কতদূর পরযন্ত নিতে হবে এই প্রশ্নের মুখে এই লোহার দলাকে কাঁধে নিতে হবে এই চিন্তাতেই জীবপ্রেম নামক বিলাসি ধারণাটি আমাদের মন থেকে কর্পুরের মত উবে গেলো। আমাদের এই দুর্দশা দেখে দেবী বিবেসিয়া তার গুদামে মজুদ সকল পিপের ছিপি খুলে দিলেন। ষাঁড়টিকে আকন্ঠ গিলিয়ে আমরা আমাদের শুন্য ভাঁড়ার ভর্তি করার জন্য সরাইখানার খোঁজ করতে লাগলাম।
অন্নপুর্ণার কৃপায় আমাদের পেটপূঁজা বেশ সন্তোষজনক ছিলো। কিন্তু পেটপূর্তির পর ধূঁমায়মান চায়ের সাথে নাইট্রোজেন-অক্সিজেন আর কার্বণ মিশ্রিত বায়বীয় পদার্থ সেবনের পর নবাগত অতিথি পাকস্থলী নামক কারখানাতে যে সম্ভাব্য দাঙ্গা (riot)-এর জানান দিচ্ছিল তা আটকে রাখা সুনামির পানি সমুদ্রপৃষ্ঠ উচ্চতায় আটকে রাখার মতই অসম্ভব হয়ে পড়ছিল, এই মুহূর্তে আমাদের জন্য যেটা সবচেয়ে বেশী প্রয়োজনীয় ছিল তা হল সুনামির এই জ্বলোচ্ছাসকে নিরাপদ পথে প্রবাহিত করা। শাস্ত্রে আছে- সাহায্যপ্রার্থীর নির্দিষ্ট কোনো সৃষ্টিকর্তা থাকেনা, সৃষ্টিকর্তা যখন যে রূপে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন সেই হাত ধরেই বিপদমুক্তির আশা করে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আমরা একটা মসজিদ খুঁজে পেলাম, সেখানে ভারমুক্তির জায়গা পেয়ে পালা করে নিজেদের পাকস্থলীর বিদ্রোহ দমন করে আমরা আবার রাজপথে।
আমাদের দক্ষিণ যাত্রার অর্ধেকটাই ফিরতি পথ, নতুন কিছু দেখার নেই। তার পরও রাস্তা মেপে মেপে কিছুদূর পরপর চা পানের বিরতি ছিল কিছুটা ধরাবাঁধা। আসলে আমাদেরকে নিয়ে তো চিন্তা ছিল না, আমাদেরকে বহনকারী ভারবাহী পশুটির বিশ্রামের জন্যই বিরতিগুলো নেয়া। কিন্তু পরিচিত কেউ এটা শুনলেই বাঁকা হাসি হেসে বলবে “জানি তো”। কিন্তু এটা আমাদের সৎ জবানবন্দী(honest confession), আমরা শেকল ধূঁমপায়ীদের মত ঘনঘন তামাক সেবন করি না, পরিচিতরা মানুক আর নাই বা মানুক, ধুঁমপানের বিষয়ে আমরা বেশ সচেতন।
সরাইল, বাহ্মণবাড়িয়া। পরিচিত রাস্তা এখানেই শেষ। তিন রাস্তার এই মোড়ে রেদ্যু আমাদেরকে যে কোনো একটি রাস্তা বেছে নেবার আহ্বান জানান- ডানে ঢাকা দিয়ে অতিরিক্ত ১৫০ কি.মি. ঘুরে, আরেকটি হল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভেতর দিয়ে কাঁটারাস্তা(shortcut)। যদিও অতিরিক্ত ১৫০ কি.মি. আমাদের জন্য এমন আহামরি কোনো দূরত্ব না, চোখের পলকে পার হয়ে যেতাম, তবুও আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাস্তা ধরার- এতে সময়ও বাঁচবে আর একটা নতুন জায়গাও দেখা হবে,কলা বেঁচতে বেঁচতে রথ দেখা আর কি। তখনও জানতাম না আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডী লেখা হবে এখনেই।
বাংলাদেশের অন্য যে কোনো মফস্বলের সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তেমন কোনো পার্থক্য নেই- কিছু সরকারি ইমারত, বাজার, রিক্সা-ভ্যান জাতীয় যানের ছড়াছড়ি আর কিছু বায়বীয় পদার্থ চালিত তিন চাকার বাহন। এসব যান-বাহনের উপর খবরদারি করে রাজপথ বিমুখ ফেরারী কিছু চার চাকার দানব। বাহনগুলোকে পাশ কাটিয়ে মফস্বলের সরু রাস্তা দিয়ে ৪০ কি.মি. বেগে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিলো যেন আরব্য রজনীর কোনো এক শহরের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি- রাস্তার দু’পাশে রকমারি পন্যের পসার, সবজির ডালি নিয়ে কিছু ব্যবসায়ী ভীড় করছে এক জায়গায়, কোথাও দেখাচ্ছে বাঁদর নাঁচ, ছোট ছোট ছেলেরা ছন্নছাড়ার মত এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছে, আর চা-পানের দোকানগুলোতে ভীড় জমিয়েছে বিশ্রামরত কিছু আড্ডাবাজ। কিছুক্ষণের জন্য ছোটবেলায় দেখা এ্যারাবিয়ান নাইটস-এ হারিয়ে গিয়েছিলাম, সংবিৎ ফিরলো যখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম ষন্ডপৃষ্ঠ থেকে দুই ফূট উপরে। ভাগ্যিশ ষাঁড়টাকে একহাতে ধরে রেখেছিলাম, নাহলে মুহূর্তেই পপাত চ এবং পরে মমাত চ। এই ক্ষণিকের আকাশ ভ্রমণ প্রথমে কিছুতেই আমার বোধগম্য হচ্ছিলোনা, পুরো ব্যাপারটা বোধোদয় হল কিছু মুহুরমুহ ঝাঁকুনির পর- সওজ বাহনে আরোহণকারী যাত্রীদের একঘেয়েমি কাটানোর জন্য রাস্তার মাঝে মাঝে বিনোদনের ব্যবস্থা করে রেখেছে। গত তিনদিনের টানা ভ্রমণের ধকল আমার পশ্চাৎদেশ তখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি, তাই এই নতুন আপদের আবির্ভাবে খুব স্বাভাবিকভাবেই আমি কিছুতা বিরক্ত হই। প্রথম প্রতিক্রিয়াটা চালকের অধিকার- তাই কিছুক্ষন সাকিবের উপর শব্দের অগ্নি বর্ষণ করি। কিন্তু হতচ্ছাড়া কানে বাহ্যিক শব্দ নিরোধক তার ঢুকিয়ে রাখায় অগ্নিগুলো দিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কোনো কাজে আসলোনা। হয়ত অন্য কোনোভাবে আমার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার চেষ্টা করতাম, কিন্তু ততক্ষণে আমার দেহের ২০৬ টি অস্থি বিক্রিয়ারত ইলেট্রনের মত একে অপরের সাথে ঠোকাঠুকি শুরু করে দিয়েছে। সামনে ঝুকে উঁকি দিয়ে দেখি আমরা কত গতিতে চলছি, গতি স্বাভাবিক গতির অর্ধেক। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সামনে বিস্তীর্ণ সড়কের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠি- কুমিরের পিঠের মত মসৃণ সড়ক, কিছু পথ দূরে দূরে থাকা কালো গর্তগুলো দেখতে কুমিরের হাঁ-এর মত, যেন এখনই আমাদের গিলে পেটে চালান করে দিবে। কুমিরের গ্রাস থেকে রক্ষা করার জন্য সওজ গর্তগুলোর পাশ দিয়ে বিকল্প কাঁচা রাস্তা তৈরী করে রেখেছে নিঃস্বার্থ উদ্ধারকর্তার মত। গরম মাখনের উপরে ছুরি চালানোর মত করে আমাদের যাত্রা অব্যাহত থাকে, গর্তগুলো পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় সওজ-কে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ।
কোনো একজনের কাছে শুনেছিলাম “Nothing goes unpaid”, দুনিয়ার সব কৃতকর্মের ফল নাকি আখিরাতের আগে দুনিয়াতেই একবার পাওয়া যায়। কথাটা যে কতবড় সত্য তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম বাহ্মণবাড়িয়া এসে। আমি বলছিনা যে আমি বড় বড় সব পাপ ইতিমধ্যেই করে ফেলেছি, যা করেছি তা নিতান্তই ক্ষুদ্র ধরণের। কিন্তু এই ক্ষুদ্র পাপগুলো সমষ্টিগতভাবে যে কত বড় শাস্তি দিতে পারে তা বোঝার ইচ্ছা যদি কারো থাকে তাহলে আমি তাকে এই বেহেশতী রাস্তায় যে কোনো জাতের দু’পেয়ে জানোয়ারের পিঠে গৌন বাহক(second seater) হবার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। অভিশপ্ত এই রাস্তায় আধা ঘন্টা যাওয়ার পর আমার পশ্চাৎদ্দেশ ডাক্তার আসিবার পর রোগীটি মারা গেলো অবস্থায় পৌঁছে গেছে। এক রকমভাবে সাকিবের হাতে-পায়ে ধরেই ওকে রাজি করালাম পাশের চায়ের দোকানে যাত্রাবিরতি নেয়ার।
প্রায় টলতে টলতেই চায়ের দোকানে ঢুকলাম। দু’কাপ চায়ের কথা বলে তামাক দিয়ে শরীরের মৃতপ্রায় স্নায়ুগুলোকে জাগ্রত করতে করতে আলোচনা করতে লাগলাম পরবর্তী করণীয় নিয়ে- এভাবেই যাবো নাকি যেতে যেতে রাস্তার যতটুকু ভাল অবস্থা আছে তাও নষ্ট করে দিয়ে যাবো। দোকানদার মামার কাছে পরামর্শ চাইলে তিনি আরেকটা বিকল্প রাস্তার সন্ধান দেন। শুনে প্রথমে কিছুটা ভয় পেয়ে যাই- আরেকটা কাটারাস্তা? এতক্ষণ রাস্তা নামের যা জায়গা দিয়ে আসলাম এটাও তাই ছিলো, সময় বাঁচাতে গিয়ে(সত্যিই সময় বাঁচানোর জন্য, ১৫০ কি.মি. যাওয়াটা এমন কঠিন কোনো কাজ না) আরেকটু হলে আমরাই মারা যেতাম। রাস্তার পাশের সাইনবোর্ডগুলো সত্যি কথাই বলে- সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশী। কিন্তু মামা অভয় দেন,তিনি যে রাস্তার কথা বলছেন তা গ্রামের ভিতর দিয়ে যেয়ে সরাসরি কুমিল্লা শহরে যেয়ে মিশেছে। রাস্তাটি সরু কিন্তু গ্রামের রাস্তা হওয়ার কারণে এতক্ষণ পার করে আসা বড় রাস্তার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত- সেখনে কোনো ভ্রমণ উত্তেজক খানা-খন্দ নেই, নেই ভ্যান-রিক্সা,গাড়ির বান্ধব সান্নিধ্য, বাস-ট্রাকের পাখির গানতুল্য মধুর ভেঁপু। শুনে আমাদের রোমাঞ্চপ্রিয় স্বভাব চনমনিয়ে উঠলো, ঠিক আছে এবার একটু গ্রামগুলোর ভিতর দিয়ে যাওয়া যাক। চা শেষ করে নতুন উদ্যমে আমরা যাত্রা শুরু করলাম।
ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমরা কুমিল্লা পৌছে গেলাম। রাস্তাটাকে সত্যিই ছোট কাটারাস্তা বলা চলে। গ্রামের মাঝখান দিয়ে এঁকেবঁকে গিয়ে সুন্দরবনের শাখানদীর মত যেয়ে কুমিল্লার বড় রাস্তায় যেয়ে মিলেছে। রাস্তার শেষ মাথায় কুমিল্লা বাস টার্মিনাল। কুমিল্লা পৌছে যোগাযোগ করলাম ইব্রাহিমের সাথে, ওর কাছে দিক নির্দেশনা নিয়ে দাড়ালাম কুমিল্লা জেলা স্কুলের সামনে। ইব্রাহিম এসে আমাদের নিয়ে গেলো গায়ক আসিফ আকবরের রেস্টুরেন্টে, সেখানে খাওয়া শেষ করে ওর বাসায় যেয়ে শরীর থেকে রাস্তার দান করা বালিগুলো ধুয়ে সোজা নর্দমায় পাঠিয়ে দিলাম। এরপর আরাম করে কিছুক্ষণ গড়িয়ে নিয়ে বিকালে বের হলাম কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশ্যে।
পরিকল্পনা ছিল ক্যান্টনমেন্টের বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারার। কিন্তু রেদ্যু আমাদের জন্য অন্য পরিকল্পনা করে রেখেছিল, সেখানে যেয়ে কাউকেই পেলাম না। সারাদিনের অমানুষিক ভ্রমণের পর এরকম পরিস্থিতি বিকালের ঠান্ডা আবহাওয়াতেও যে কি রকম প্রভাব ফেলতে পারে তা আমাদের পরবর্তী কাজে প্রমাণ পাওয়া গেলো। এক ক্যাফেতে ইব্রাহিমের সাথে ঠান্ডা লাচ্ছি খেয়ে রওনা দিলাম চট্টগ্রামের উদ্দ্যেশে।
কুমিল্লা-চট্টগ্রাম দূরত্ব ১২৬ কি.মি., এটা সরকারি হিসাব। সরকারি হিসাবের উপর আমার আস্থা ২ দিন আগেই শেষ হয়ে গেছে। আমাদের হিসেবে দূরত্বটা দাঁড়ায় ১৩৫-১৪০ এর মধ্যে। ১০-১৫ কি,মি. নিয়ে মাথাব্যাথা অনেকের কাছে অদ্ভুত ঠেকতে পারে,একদিনের সাড়ে তিনশ কি.মি. এর যাত্রা যখন পৌণে চারশতে যেয়ে পৌছায় তখন অতিরিক্ত রাস্তাটুকু যত কমই হোক না কেন তা বেশ তাৎপর্জপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এই পৌণে দু’শ কি.মি. এর বর্ণনা দেয়ার সাধ্য আমার নেই। কারণ- এক, আকাশ থেকে সূরযকে বিতাড়িত করা হয়েছে, আর দুই, পশ্চাৎদ্দেশের ব্যাথাটা আক্ষরিক অর্থেই pain in the ass এ পরিণত হয়েছে। যেটুকু মনে পরে তা হল হিষ্টিরিয়া রোগীর মত পুরো রাস্তা গান গেতে গেতে যাওয়া,বাস, ট্রাক আর গাড়িগুলোকে অহেতুক ত্যক্ত করা, মাঝে মাঝে আসন থেকে উঠে পিছে ফেলে আসা বাহনগুলোকে পৃষ্ঠদেশ দেখানো, আর যাত্রাপথের তিনটি বিরতি। ষোলশহরে ইব্রাহিমের মামার বাসায় যখন পৌছাই তখন রাত প্রায় নয়টা। ইব্রাহিমের মামা-মামির বর্ণনাতীত আতিথেয়তায় পেট পুরে রাতের খাবার খেয়ে দুঃস্বপ্নে রাজপথের বাহনগুলোর তাড়া খেতে খেতে রাত পার করে দিলাম।
আবহাওয়া সকাল থেকেই স্যাতস্যাতে। ইব্রাহিমের মামার বাসা থেকে বের হবার কিছুক্ষণ পর থেকেই ঝিরঝির বৃষ্টি আমাদের সামনের রাস্তা পরিষ্কার করে দিচ্ছিল…এবং সে সাথে আমাদেরকেও। পিচ্ছিল রাস্তার জন্য খুব সাবধানে চালাতে হচ্ছিল। ঘন্টা তিন পর কুমিল্লা পার হয়ে এক জায়গায় দাড়াতে হল কুকুর-বিড়াল বৃষ্টির কারণে। তারপর আবারো ঝিরঝির বৃষ্টিকে সঙ্গী করে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা। রাস্তায় এক জায়গায় থেমে আমরা আমাদের যাত্রার ১৪০০ কি.মি. পূর্তি উদযাপন করলাম তামাক আর ইংরেজদের জাতীয় পানীয় পান করে। ঢাকার যত কাছে আসছিলাম আমার পায়ে একটু একটু চিনচিনে ব্যাথা শুরু হচ্ছিল। দুপুরে কাঁচপুর ব্রীজ পার করে আবার বিরতি. বিরতির পর ফাঁকা রাস্তা পেয়েই সাকিব ষাঁড়টিকে আবার উড়াতে শুরু করলো। এই উড্ডয়মান গতি অব্যাহত থাকত যদি না রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লরিগুলোর ফাঁক থেকে হুট করে বেরিয়ে আসা মানুষগুলোকে আমাদের ষাঁড়ের গুঁতোয় উড়িয়ে দেয়া থেকে বাঁচানোর জন্য দক্ষিণ থেকে আসা ট্রাকের ধাক্কা থেকে বেঁচে না যেতাম। এই পুরো যাত্রায় এই প্রথমবারের মত ডিমোস ও ফোবোস আমাদেরকে একটু নাড়া-চাড়া দিতে সক্ষম হলো- সিদ্ধান্ত বদল করার প্রথম ধাপ। যাত্রাবাড়ীর জ্যামকে কাঁচকলা দেখিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌছে গেলাম গুলশান-২, পথদন্ড জ্বলজ্বল করে বলছে ১৪৮৭ কি.মি.। ষাঁড় থেকে নেমে টের পেলাম আমার ডান পা কোমায় চলে গেছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী যাত্রা করা আমার পক্ষে আর সম্ভব হয়ে উঠবেনা। বন্ধু হাসানকে সাথে নিয়ে নান আর গ্রিল খেয়ে আমরা আমাদের দেশভ্রমণ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ করলাম। শুধু বাকি ছিলো ঘরে ফিরে যাওয়া, সে গল্প এখানে না করলেও চলবে।
(সমাপ্ত)