somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভাদাইম্যার ভ্রমণকাহিনী

১১ ই নভেম্বর, ২০১১ সকাল ১১:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দ্বিতীয় পর্বঃ মামা এখ খাফ চা দেউক্কা

ঐতিহাসিক মে দিবস, সারাবিশ্বব্যাপী ছুটি। ব্যাপারটা ঠিক ওভাবে মাথায় ছিলোনা। এই কথাটির একটা তাৎপরয আছে, সেটা নাহয় সময় মত বলা যাবে। সকালে তাড়াহুড়ো করে ঘুম থেকে উঠলাম ঢাকা শহরের যানজট এড়িয়ে এখান থেকে বের হবার জন্য। ঢাকা থেকে বের হওয়ার জন্য আমাদের হাতে দুইটা রাস্তা ছিলো;একটি পরিচিত পথ- সায়েদাবাদ দিয়ে, এবং আরেকটি পরীক্ষামূলক- টঙ্গি দিয়ে ঘোড়াশাল হয়ে মহাসড়ক। কোনো রকম চিন্তা না করেই আমরা দ্বিতীয় রাস্তাটি দিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম- আজকে সব রাস্তাই নতুন।

এবারের গন্তব্য হলো বিলাতি শহর শ্রীহট্ট(আশা করি কেন এই বিশেষণ ব্যবহার করলাম সবার তা জানা)। “থ্যাঙ্কস টু বিজ্ঞানের অগ্রগতি”, ঢাকা-শ্রীহট্ট দূরত্ব আগের রাতে ইন্টারনেটে দেখে নিয়েছিলাম। কাগজে-কলমে ঢাকা থেকে শ্রীহট্টের দূরত্ব ১৯৭ কি.মি.। আগের দিন আমরা ২৪৬ কি.মি. পার করেছি, তার তুলনায় এটা কিছুই না। কারণ আসল কষ্টটা হয় শেষ ৫০ কি.মি.-তে এসে। আর এখানে তো ৫০ কি.মি. আগেই পৌছে যাবো, সুতরাং কষ্টটা আর হবেনা। সে সময় অন্তত তাই ভেবেছিলাম।

নিকুঞ্জ থেকে বের হলাম সকাল সাড়ে ছয়টায়। এই দফায় আমার মাথায়ও শিরনাস্ত্র, আর পীঠে তূণ এবং কাঁধ থেকে আড়াআড়িভাবে ঝুলছে আলোকচিত্র শিকারের জন্য রশ্মি নিক্ষেপণ অস্ত্র। শুধু বাহনটা আরেকটু উন্নত গোত্রের হলে নিজেকে মধ্য যুগের কোন বিখ্যাত নাইটের সাথে তুলনা করা যেত। বাহন নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই, কারণ বাংলাদেশে লভ্য যে কোন ভারবাহী দু’পেয়ে পশুর মধ্যে দূরপাল্লা ভ্রমণের জন্য এই বন্য ষাঁড়গুলো যে সর্বোত্তম আজ এই ব্যাপারে আমার আর কোন সন্দেহ নেই। সুতরাং নাইট নাই বা ভাবলাম, নিজেদেরকে রাক্ষসের কবল থেকে রাজকন্যা উদ্ধারকারী রাজপুত্র আর কোটালপুত্র(আমি কোটালপুত্র হতে চাই, কারণ ঠাকুরমার ঝুলি বলে যে রাজকন্যা শেষ পরযন্ত কোটালপুত্রের গলায় মালা দেয়) ভাবতে তো কোন সমস্যা নেই। এই ভ্রমণে কোন রাজকন্যা নেই, তাই নিজেদেরকে কোন এক গ্রীক মহাকাব্যের দুই মহানায়ক ভেবে আমাদের পরবর্তী যাত্রা শুরু করলাম।

টঙ্গী-ঘোড়াশাল বাইপাসটি প্রস্থে বেশ ছোট। অন্য পাশ থেকে কোন ট্রাক এলে রাস্তা থেকে নিচে নেমে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। তবুও আমরা আমাদের বাহনকে ৮৫ কি.মি. বেগে চালাতে পিছপা হইনি। মাঝে মাঝে দু-একটা ট্রাক এলে গতিটাকে আরেকটু ত্বরানিত্ব করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলাম। এখন পরযন্ত বলার মত কোন ঘটনা ঘটেনি। ঘোড়াশাল বাস-স্ট্যান্ডে এক হোটেলে পুরনো দিনের হিন্দি গান উপভোগ করতে করতে ভরপেট খানা খেয়ে ঢাকা-শ্রীহট্ট মহাসড়কে উঠে আসলাম।

আগে দেখিনি- এই প্রথম আসলাম, দেখলাম এবং মুগ্ধ হলাম- ভেনিট স কোড লেপোর লেপোস । ঢাকা-শ্রীহট্ট মহাসড়ক বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর মহাসড়ক। বিশাল এক অজগরের মত একে-বেঁকে রাস্তাটি চলে গেছে ভৈরব, নরসিন্দী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভিতর দিয়ে। রাস্তার দু’পাশে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, আর উপরে নীল সাগরের পৃষ্ঠদেশে রুপকথার কাল্পনিক জীবগুলো সাদা চাদর গায়ে দিয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। শিরনাস্ত্রের ফাঁক দিয়ে হালকা ভেজা বাতাস কানের কাছে শির শির করে কিছু বলার চেষ্টা করছে। আমি প্যানথেয়িস্ট না, আমি কাঠ-খোট্টা ধরণের সাধারণ মানুষ, প্রকৃতির ভাষা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু প্রকৃতির তীব্র আহবান কে কবে অগ্রাহ্য করতে পেরেছে? তাই নির্ধারিত দূরত্ব পার করার আগেই রাস্তার পাশে অখ্যাত এক হোটেলে মাঝারি ধরণের বিরতি।

দশ মিনিট পর ভৈরব পৌছালাম। ভৈরবের চার রাস্তার মোড়ের স্মৃতিস্তম্ভের পাশে পরপর চারটি শিকার সম্পন্ন করে(আহারের তেমন ইচ্ছে ছিলোনা। শুধুমাত্র ভৈরবে পদার্পণ এর প্রমান হিসেবে শিকারগুলো করা হয়েছে) ব্রহ্মপুত্র নদীতে থামলাম সেতুর উপর দাঁড়িয়ে তামাকের সাথে নদীর দৃশ্যাবলী উপভোগ করার জন্য। পশ্চিম তিব্বত থেকে আগত এই নদী দীর্ঘ ৩০০০ কি.মি. যাত্রা করে ভারতের অরুনাচল প্রদেশ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বঙ্গপোসাগরে গিয়ে পড়েছে। নদীর উপরে দাঁড়িয়ে থাকার সময় ব্রহ্মপুত্র বাতাসকে বার্তাবাহক করে আমাকে কথাটা বলেনি, বাসায় এসে উইকিপিডিয়া ঘেঁটে এসব তথ্য বের করেছি। তবে নদীর মাঝখানের চর যে আমাকে অনেকক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দুইতীরের ঠিক মাঝামাঝি বেশ কিছুখানি জায়গা দখল করে রেখেছে চরটা। উঁচু উঁচু ঘাস আর মাঝারি ধরণের গাছের আড়লে ছোট ছোট বাড়িগুলো প্রায় দেখাই যায়না। চশমাটাকে একটু ঘষে পরিষ্কার করে গাছগুলোর উচ্চতা আর ছায়া মেপে পরিমিতির অংক কষলে সেগুলোর ফাঁক গলে সুরযের রশ্মি যেখানে পড়েছে বলে মনে হয় সেখানেই জমিদারের বাড়ির পাশে বিপিনের বাড়ির মত ছোট্ট কুঁড়েগুলো দেখা যায়। অন্য চরগুলোর মত এটাও চরশিকারীদের আগ্রাসনের শিকার হয়নি বলেই হয়ত এটি এখনও আশ্রয়হীন মানুষদের জন্য মাথাগোঁজার একটু ঠাঁই করে রেখেছে।

কিছুক্ষণ পরই উদোম রাস্তা থেকে ছায়াঘেরা রাস্তায় এসে পড়লাম। দুইদিকের বাহনগুলোকে একে অপরকে আপন করে নেওয়ার সুযোগ দিতেই হয়ত রাস্তাটা একটু সংকুচিত হয়ে এসেছে। শত মাইল বিস্তৃত এই সড়কের উদ্দেশ্য হয়ত ভাল, কিন্তু সহজ-সরল এই প্রবীণা একটিবারের জন্যও ভাবেনি যে নৈকট্যের আধিক্য কত বড় সর্বনাশা হতে পারে। এই প্রবীণার সরল উদ্দেশ্যকে ভেংচি কেটে ভুল প্রমাণ করার জন্যই হয়ত অপর পাশ থেকে আসা বিরাটাকার চারপেয়ে দানবটি আমাদেরকে এই যৌবনর্ধ প্রবীনার সাথে এক করে দেওয়ার জন্য ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। আজকে আমার এই লেখা পড়ার পরিবর্তে আমার পরিচিতরা হয়ত আমাদের জন্য লেখা মৃত্যু-সংবাদ পড়তেন যদিও তাতে আমাদের নাম লেখা থাকতোনা, কারণ যেখানে এই সর্বনাশা কর্মটি হতে যাচ্ছিলো সেখানে কিছু হলে আমাদেরকে কেউ হাসপাতালে নিয়ে যাবে এমন আদমসন্তান আশে-পাশে ছিলোনা।ধন্যি চালক সাকিব! মুহূর্তের মধ্যে বাহনটাকে পাশ কাটিয়ে আযরাইলের মরণথাবা এড়িয়ে এলো। কেউ কাউকে বলিনি, কিন্তু আমরা দুইজনই জানি আমরা দুইজনই একই কথা ভাবছিলাম- আমাদের মা-বাবার কোনো পুণ্যের জন্যই আজকে বেঁচে গেছি।

সিলেট ১১৯ কি.মি.। তার মানে আমরা মাত্র ৭৮ কি.মি. পার করে এসেছি। কিন্তু আমার হিসাব তা বলেনা। যাই হোক, হাইওয়ে ইন নামক এক হোটেলে বসে আমরা গলা ভিজালাম। অন্য অনেক কিছু দিয়ে ভেজানোর ইচ্ছা ছিলো, কিন্তু আপাতত জুস দিয়েই মন ভরাতে হল। আবার রওনা দিতেই এতক্ষণ ধরে যা খুঁজছিলাম তা পেয়ে গেলাম- পাশ দিয়ে একটা এলিয়েন(ALLION) পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দুষ্টু মেয়ের মত মুখঝামটা দিয়ে গেলো। দুইজনই নড়ে-চড়ে বসলাম। গতিটাকে শতকের ঘর পার করে সেই ভিনগ্রহী এলিয়েনকে পিছে ফেলে আসলাম অন্তত এক মাইল-ভাবলাম, আর মনে হয় পারবেনা। আমাদেরকে কিঞ্চিত সঠিক প্রমাণ করার জন্যই একটু পরে আরেকটি বাহন(এবার একটা PREMIO) আমাদের ছাড়িয়ে সামনে চলে গেলো। এই নারী আগেরজনের মত এত সহজে ছাড় দিলোনা- ইঁদুর-বিড়াল খেলা চললো অনেকক্ষণ। নব বিবাহিতা বধূ যেমন তার নাগরের কাছে সহজে ধরা দিতে চায়না, কিন্তু একটা মুহূর্তে নিজে থেকে হার শিকার করে নেয়, ঠিক সেভাবেই অপর বাহনটি আমাদের জন্য রাস্তা ছেড়ে দেয়। যতক্ষণে আমরা এই রথযুদ্ধ শেষ করেছে ততক্ষণে আমরা পার করে এসেছি ৩০কি.মি.। আরেকটি তামাক সেবনের বিরতি।

সৃষ্টির শুরু থেকে পরিস্থিতির কাছে মানুষের অভিযোগ- যখন যেভাবে চায় সেভাবে কোনো কিছু পায় না, যখন যেভাবে আমরা আশা করি তা ঠিক সেভাবেই পূরণ হয় খুব কম। প্রথমেই বলেছিলাম যে আজকে দূরত্ব আগের দিনের চেয়ে কম, কষ্টটাও কম হওয়ার কথা। কিন্তু যাত্রার দুই-তৃতীয়াংশের বেশী শেষ হয়ে যাওয়ার পর বিদ্রোহী অঙ্গ শরীরের অন্যান্য অঙ্গের সাথে জোট বেঁধে আরও কিছুক্ষণ আমাদের বাহনের পিঠে সওয়ার থাকতে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে লাগল। সরকারি হিসেব মতে শ্রীহট্ট আর বিশ কি.মি.। দাঁতে দাঁত চিপে, কানে সংগীত প্রেরণকারী তার যুক্ত করে ইন্দ্রিয়গুলোকে শান্ত করতে থাকলাম, ভাবলাম চলে তো এসেছি। কিন্তু বিশ কি.মি. অতিক্রম করার পরও যখন তিন রাস্তার মোড়ে এসে শুনলাম আমাদের গন্তব্য বটেশ্বর সেনানিবাস আরো মাইলখানেক দূরে তখন শরীরটাকে আর ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছিলোনা।

সেই মোড় থেকে কোনদিক যেতে হবে তা একজন সিলেটিকে জিজ্ঞেস করলে জবাবে তিনি কি বললেন তা উদ্ধার করা বড়ই দুরুহ ব্যাপার হয়ে দাড়ালো আমাদের জন্য। শেষ ভরসা মানুষের আদিম ভাষা। তর্জনী দিয়ে আমাদেরকে দিক নির্দেশনা দেওয়ার পর আমরা আর কোন কিছু জানার অভিপ্রায় স্থগিত রেখে সেই দিকে রওনা দিলাম। আমাদের নির্দেশিত পথটি শহরের ভেতর দিয়ে। নানান জনের তর্জনীর ইশারায় আমরা অনেক দূর পরযন্ত অগ্রসর হলাম। এবার একজন ভদ্রলোককে(তার মানে এই না যে বাকিরা অভদ্র ছিলো) পেয়ে ওই জায়গা থেকে সেনানিবাসের দুরত্ব জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন তা আর মাত্র ২কি.মি.। অনেকক্ষণ পর আমাদের মুখে হাসি ফুঁটলো।

আমাদের দেশটা তুলনামুলকভাবে ছোট বলেই হয়ত মানুষ কোন দূরত্বকে বড় মনে করেনা। কাউকে কোন গন্তব্য জিজ্ঞেস করলে সোজা উত্তর দিয়ে দেন, “এইতো সামনে”। দুই কি.মি. দুরত্ব যখন ৮ কি.মি.-তে যেয়েও শেষ হলনা, তখন রাগে-দুঃখে আমার দুই নয়ন জোয়ারের সময় উপচে পড়া তীর। আর যাবোনা ঠিক করে বাহনটাকে থামিয়ে মেজাজটাকে শান্ত করার জন্য নিকোটিনের সাহায্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলাম। বাহনের পথদন্ডটির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ঢাকা থেকে মোটামুটি ২৫০ কি.মি. চলে এসেছি। গালাগালি করে সওজ(সড়ক ও জনপদ)-এর পিন্ডি চটকানোর পর কিছুটা ঠান্ডা হলাম। এরপর একটু এগিয়ে দেখি সবুজ সাইনবোর্ডে লেখা ‘সামনে সেনানিবাস’। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সামিনের রুম।

সামিনের রুমে যখন ঢুকি তখন আমাদের মুখ লাল, গালের দু’পাশ দিয়ে টপটপ করে ঘাম ঝরছে, কিন্তু গরবে মুখ উজ্জ্বল, যেনো এইমাত্র আমরাও মুসা ইব্রাহিমের মত এভারেস্ট জয় করে এসেছি। হাত-মুখ ধুয়ে সামিনের সাথে আহার করতে বসলাম।আহার শেষে সামিন আমাদেরকে বিশ্রাম নিতে বললে অত্যন্ত গর্বের সাথে তা নাকচ করে দিয়ে চলমান চিত্র দেখতে বসে গেলাম।

সেদিন আর তেমন কিছু করিনি। বিকালে বের হলাম অন্য বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। রাতে ঠিক করলাম আমি, সাকিব, সামিন আর নিহাব শ্রীহট্ট শহরে রাত্রিকালিন খাবার খাবো। সাকিব আর সামিনের বাহনগুলো নিয়ে চারজন বের হলাম। রাতে যে কোনো শহরের রুপ দিনের তুলনায় ভিন্ন হয়। কিন্তু অপরিচিত জায়গায় আমি সবসময়ই সে রুপ দেখা থেকে বঞ্চিত হই। আমি সামিনের পিছে চড়েছিলাম, তাই কিছুটা হলেও এই শহর সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি। শহরের যে রেস্তোরায় খাবার জন্য বেরিয়েছি পৌছে দেখি তা বন্ধ। তারপর অন্য রেস্তোরার খোঁজ করতে যেয়ে মনে পড়লো আজকে সব রেস্তোরারই একই অবস্থা- মে দিবস। শেষে রওনা দিলাম সিলেট মেডিকেল কলেজে। সেখানে অধ্যয়নরত আসিফ নিয়ে গেলো ওদের ক্যান্টিনে। সেখানে গরম খিচুড়ী আর ঝাল গরুর মাংস দিয়ে খেয়ে ঢেঁকুর তুলে পাঁচজন মিলে পাশের চায়ের দোকানটা ধোঁয়া ধোঁয়া করে দিলাম।

দশটার দিকে সামিনের রুমে ফেরৎ আসার জন্য রওনা দিলাম। আসার সময় শহরের মধ্যে দিয়ে এসেছি তাই সামিন বললো যাওয়ার সময় আরেকটা রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাবে। সামিন যে রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো সেটা ছিলো শহরের বাহির দিয়ে সরাসরি জাফলং যাওয়ার জন্য। ফাঁকা রাস্তা, দোপেয়ে পশু বাহনকারীদের জন্য স্বপ্নের রাস্তা। বাহনগুলোর ফলক শতক ছুঁই ছুঁই করতে আমরা পৌছে গেলাম শাহ পরাণ সেতুতে। মাঝ সেতুতে বাহন থামিয়ে নদীর মুক্ত বাতাসের সাথে কার্বণযুক্ত ধোঁয়া পোড়াতে পোড়াতে গল্প করলাম বেশ কিছুক্ষণ।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠলাম অনেক বেলা করে। উঠে দেখি সামিন আমাদের জন্য সকালের নাস্তা আনিয়ে রেখেছে। মুখ ধুয়ে খেয়ে উঠতে উঠতে দেখি সুরয হালকা বেঁকে তার আলো ছড়াচ্ছে। ঠিক করলাম জাফলং যাব। তৈরী হয়ে চলে গেলাম সামিনের দফতরে। সেখানে চা খেয়ে বটেশ্বর সেনানিবাস একটু ঘুরলাম। এর মধ্যে আমাদের ষাঁড়টাকে একটু যত্ন-আত্তির জন্য পাঠানো হল। ষাঁড়টাকে হাতে পাওয়ার পরই জাফলং রওনা হবার ইচ্ছা ছিলো, কিন্তু সামিনের জোরাজুরিতে ভরপেটে আবার দুপুরের খাবার খেতে হল। খেয়ে দু’জন মিলে বের হলাম জাফলং এর উদ্দেশ্যে।

সেনানিবাস থেকে নাক বরাবর সোজা গেলেই জাফলং। পথ নির্দেশনা দেওয়ার সময় সামিন বলে দিয়েছিলো হাতের বামে চা-বাগান পড়বে। হাতের অস্ত্রটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম জাফলং-এ যেয়ে শিকার করার জন্য। বটেশ্বর থেকে জাফলং ৪০ কি.মি.। রাস্তার দু’পাশে অসংখ্য গাছ আর ক্ষেত। মাঝে মাঝে দুই-একটা বাজার পার করে যেতে হয়। সামিনের হিসেব মতে কিছুক্ষণ পর চা-বাগান হলেও হাতের বামে কখনো তাকানো হয়নি। রাস্তা দিয়ে সোজা তাকালে জাফলং-এর টিলাগুলো আবছা দেখা যায়। রাতের মোহনীয় বারবণিতার মত টিলাগুলো তাদের বক্ষের একদিক উন্মোচিত করে রেখেছে সবাইকে অন্যদিক দেখনোর আশা দিয়ে। যত কাছে যাই টিলাগুলোকে তত বেশী মোহনীয় মনে হয়। টিলাগুলোর উপর থেকে আছড়ে পড়া ঝরণাগুলোকে দূর থেকে দেখে এক রকম নেশা লাগে, আমাদের গতি আপনা-আপনি বাড়তে থাকে। টিলাগুলোর উপরে ভাসমান মেঘগুলোকে মনে হয় বারবণিতার ফেলে দেয়া আচঁল।

জাফলং-এর আগে পড়ে তামাবিল জিরো পয়েন্ট। সেখানে থেমে আমাদের কীর্তির প্রমাণ হিসেবে কতগুলো চিত্র শিকার করি। তারপর চা খেতে খেতে সীমানার ওপারে ডাউকী শহর পরযবেক্ষণ করে আবার জাফলং এর রাস্তায় উঠি।

সবসময় দেখে এসেছি যত কিছু ভালো সবই আগে অন্যের নিয়ে যায়। আমাদের জন্য রেখে যায় অবশিষ্টগুলো। খুবই হতাশ হলাম যখন শুনলাম এতক্ষণ যে টিলাগুলো আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো সবই ভারতে পড়েছে। কেন, একটু আমাদের জন্য রাখলে কি ক্ষতি হত? আমার সত্যিকার অর্থে যারপরনাই অভিমান হল।

শেষ পরযন্ত জাফলং পৌছালাম। ডাউকী নদীর পানির নিচে এতলা বড় বড় পাথর। নদীর এপাশ থেকে ওপারের শহরের প্রাণচাঞ্চল্য দেখা যায়। নদীর তীরে পরযটকদের বিনোদনের জন্য নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। অনেকটা অভিমান করেই নৌকায় উঠলাম না। ওপারের টিলাগুলো শেষবারের মত দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেরৎ আসার জন্য রওনা দিলাম।

০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×