-খালি যাবা?
- বিড়িটা শেষ কইরা লই মামা।
-তাড়াতাড়ি করো।
আফসার হাতের তালু দিয়ে কপালের ঘামটুক মুছে নিলো। আজকে আসম্ভব গরম। এখন অবশ্য একটু বাতাস দিচ্ছে। বিল্ডিং এর ছায়ায় গিয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো ও। হাত ঘুরিয়ে আড়াইশো টাকা দামের ঘড়িটার দিকে তাকালো, এখন পর্যন্ত ঠিকঠাক সময় জানান দিয়ে যাচ্ছে ওটা। ২ টা বেজে গেছে প্রায়। নীলা বোধহয় রেডি হয়ে গেছে এতোক্ষনে। নীলার কথা মনে পড়তেই ওর নাকের তিলটা ভেসে উঠলো আফসারের চোখে। অতি মায়াবতী এই মেয়েটার কথা মনে করে বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠলো ব্যাথায়। নীলা, আফসারের ওয়ান এন্ড ওয়ানলি স্ত্রী। ২ বছর হলো বিয়ে করেছে তারা। তার আগে আড়াই বছরের সম্পর্ক। এখনো আফসারের মনে পরে প্রথম দিনের কথা।
ভার্সিটির বাস থেকে নেমে দৌড় দেওয়ার সময় লাল ছাতার মেয়েটার সাথে সজোরে ধাক্কা। তারপর কিছু ঠাহর করার আগেই ঠাস শব্দে চড় পড়ে গালটা লাল হয়ে গেলো।
- মেয়ে দেখলে মাথা ঠিক থাকেনা? ইতর কোথাকার!
গালে হাত বুলাতে বুলাতে আফসার মুগ্ধ হয়ে দেখলো পরীর মতো এক দেবী নাক ফুলিয়ে তাকে সমানে ঝেড়েই চলেছে।
- যত্তসব থার্ডক্লাশ পোলাপান।
তবে আফসার নিশ্চুপ। কিছু বলতে মনে নেই তার। হাজার হোক তৃতীয় বারের মতো এই প্রথম কারো প্রেমে পড়েছে সে, যে কিনা প্রথমবারের মতো তাকে স্পর্শ করেছে।
খোঁজ খবর নিয়ে দেখা গেলো মেয়ে তার ডিপার্টমেন্টেই এক ইয়ার নিচে পড়ে। ততোদিনে চড় খেয়ে পাগল আফসারের রাতের ঘুম আর দিনের আড্ডা সপ্তম আশমানে ধাবিত হয়েছে। তার এহেন শোচনীয় অবস্থায় বন্ধুরা দয়াপরবশ হয়ে নীলাবতীকে হাজির করলো তার সামনে।
- সরি মানে...ভাইয়া মানে...। আমার আসলে ওভাবে...
- নাহ, ঠিক আছে, তুমি তো আর বুঝে করোনাই।
- জ্বি ভাইয়া।
- আর শোনো, মাফ টাফ চাওয়ার দরকার নাই।
- জ্বি...
- তোমার ক্লাশ শেষ কখন? চলো তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিই।
- কি??
- না মানে কোন নোটস দরকার হলে আমাকে বলো।
- জ্বি ভাইয়া, আসি, স্লামালিকুম।
পুরোনো স্মৃতি গুলো বুকের ব্যাথাটা আরেকটু বাড়িয়ে তুললো।
- মামা আহেন। কই যাইবেন?
- সেনবাগ চলো।
রিকশার হুডটা নামিয়ে আবার চিন্তায় ডুব দিলো ও।
দীর্ঘ পাঁচ মাস নীলার পিছনে ঘুরতে হয়েছে তাকে। অবশেষে রাজকন্যার সায় মেলে। তারপর সে কি প্রেম! সুখ সাগরে ভালোবাসার ভেলা ভাসিয়ে স্বপ্নে মগ্ন দুইজন। তবে সে সব আবেগের অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে বিয়ের পর। বিশেষ করে নীলার চাকুরিতে জয়েন করার পর। ব্যক্তিগতভাবে আফসারের ইচ্ছা ছিলোনা নীলা চাকরি করুক। কিন্তু শিক্ষিত কোনো মেয়ের ক্ষেত্রে ঘরে বসে থাকাটা বড় অপমানজনক। বিশেষ করে দারিদ্র্যই যখন সংসারের মূল প্রভাবক, তখন এসব ব্যাপারে এতোটা মাথা ঘামালে চলেনা। তাই সপ্তাহের পর সপ্তাহ রাগারাগি আর কথা কাটাকাটির পর নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নীলাকে চাকরি করতে দিতে রাজি হয়েছিল। তার মনে হতে থাকে এটাই তার জীবনের সব চেয়ে বড় ভুল।
একটা সিগারেট ধরালো আফসার। এখন তার যে আর্থিক অবস্থা- টাকা দিয়ে বিষপানটা বিলাসিতায় বলা চলে। কিন্তু ছাড়তে পারেনা, অভ্যাস। মধ্যবিত্ত পরিবারে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন পারস্পারিক সুসম্পর্ক। কিন্তু ভালোবাসার ধার ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছে। দুরত্ব ক্রমেই বাড়ছিলো। অশান্তিটা আরো বাড়লো যখন নীলার কলিগ আপনের আনাগোনা ঘটলো বাসায়। একে তো নীলার সাথে দুরত্ব, তার উপর আপনের সাথে ইণ্টিমেসি, হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরছিলো আফসার। তাই দুইয়ে দুয়ে চার মেলাতে সময় নেয়নি সে।
প্রচন্ড রাগে মুখ তেতো হয়ে গেলো। সিগ্রেটটা ছুঁড়ে ফেললো আফসার, বিষাদ ঠেকছে। নাহ, ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি সে। বিশ্বাসঘাতকের জায়গা নেই এ দুনিয়ায়। তিলে তিলে হারানোর চেয়ে চিরতরে প্রেমিকাকে বিদায় জানানোর কষ্ট অনেক কম। হ্যাঁ, নীলাকে খুন করবে ও। নীলার জন্যে ভালোবাসার যেটুক অবশিষ্ট আছে, তা নিঃশেষ হবার আগেই আফসার কাজটা করতে চায়।
রিকশা ভাড়াটা মিটিয়ে বাসায় ঢুকলো। আজকে নীলাকে নিয়ে বাইরে যাবার কথা।
- নীলা তুমি রেডি?
- সেই কক্ষণ থেকে বসে আছি।
- চলো বেরোই।
- এই ভরদুপুরে হঠাত বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছো কেন বলতো? ছুটির দিনে কোথায় ঘুমুবো একটু...
- সারপ্রাইজ আছে একটা।
- হুমমম... চলেন মহামান্য, দেখি কি সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে আমার জন্যে।
নামের সাথে মিল রেখে নীলা আজ নীল শাড়ি পরেছে। কপালের নীল টিপটাও ঠিকঠাক মানিয়েছে। আফসার যতবার নীলার দিকে তাকাচ্ছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর। এই সুন্দরকে আর দেখবেনা সে। নীলার হাতের উপর হাতটা রাখলো। একান্ত এই সময়টুকুর খুব দরকার ছিলো, শেষ স্মৃতিটাই তার সারাজীবনের বেঁচে থাকার অবলম্বন হতে চলেছে। ভালোবাসাহীনতার চার দেওয়াল থেকে মুক্ত আরেকটা দিন - আগের মতোই স্বপ্নভর্তি নীলার চোখ, আফসার মিস করবে দিনগুলো।
গল্পের শেষ দৃশ্যপট। চারদিকে কাশফুল, কি নির্জন, কি সুন্দর বাতাস আজকে!
- উফফ, কি সুন্দর এইদিকটা। এই- আমরা এতদিন এখনে আসিনি কেন?
- তোমাকে খুব ভালোবাসি নীলা।
- একি? তুমি কাঁদছো নাকি?
- সরি নীলা, ক্ষমা কোরো
.
.
.
.
নীলার গলায় চাপ বাড়তে থাকে। চোখ ভর্তি অবিশ্বাস নিয়ে সে তাকিয়ে আছে আফসারের দিকে।হাওয়ায় নাচছে কাশফুলগুলো, নীলার চুল উড়ছে দিক-বিদিক। কিন্তু সেই হাওয়া তার জন্যে নয়।