somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কবি নজরুল কে নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা , যা পড়ে আপনি কাঁদবেন ( "যদি " লিখেছেন সুনীল গঙ্গোপধ্যায় )

১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




আমি সদ্য যে বইটি পড়লাম সেটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের । নাম " আমার জীবনানন্দ আবিষ্কার ও অন্যান্য " । বইটি লেখকের স্মৃতিচারণ মূলক বই ।এই বইয়ের একটা অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কে নিয়ে । অধ্যায়টার নাম তিনি দিয়েছেন "যদি" । লেখাটি পড়ে আমিও বেশ আহত হলাম ।শুধু এই অধ্যায়টা লেখকের সত্যি কোন স্মৃতি নয় , লেখকের কল্পনা । তাই লেখক এর নাম দিয়েছেন যদি , অর্থাৎ যদি এমন হতো । লেখাটি ব্লগের সবার সাথে শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলুম না । ।বাকশক্তি হারানোর পর কবি নজরুল অনেক বছর কোমায় ছিলেন ।লেখক কল্পনা করছেন অনেক বছর পর হাসপাতালের বেডে যখন কবি নজরুল জেগে উঠেন তখন ও তার সব কিছু স্মরণ ছিল ও কথা বলতে পারতেন । তখন অনেকের মত সুনিল ও ছিলেন তার বেডের কাছে । কিন্তু ততদিনে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে , হিন্দু মুসলিমের জন্য আলাদা দেশ হয়ে গেছে ।কিন্তু বাংলা সাহিত্তের প্রানের কবি নজরুল এসবের কিছুই জানেন না , তিনি এখন রিপ ভ্যান উইংকেল ।সুনীল কল্পনা করছেন কবি নজরুলের সাথে তার কথা হচ্ছে। যাই হোক লেখাটা শেয়ার করছি -

দে গরুর গা ধুইয়ে ।

আমি একেবারে সর্বাঙ্গে চমকে উঠলাম ।প্রচণ্ড হুংকার দিয়ে কবি গা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে বসে স্বাভাবিক চোখ মেলে তাকালেন । তারপর বিরক্তি মেশানো গলায় বললেন, “ এ কি – এত মালা টালা দিয়ে এমন জবজরং করে সাজিয়েছ কেন আমায় ?কালীঘাটে নিয়ে গিয়ে আমায় বলি দিবে নাকি ? এত বেলা হল, চা – টাও দেয়নি, খিদে পেয়ে গেছে ।কালী কুল দে মা, নুন দিয়ে খাই ।ওরে , চা – টা দিবি নাকি ?

আমার তখন আনন্দবিস্ময়ে চুড়ান্ত অবস্থা ।
বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম এইমাত্র জ্ঞান ফিরে সুস্থ হয়ে উঠলেন, আমারই চোখের সামনে।তার চোখে মুখে আগেকার সেই বিখ্যাত তেজ ও উজ্জ্বলতা।সারা দেশের লোককে এ সুসংবাদ আমিই প্রথম জানাব, এই আনন্দে আমারই তখন উন্মাদ হয়ে যাবার মতন অবস্থা ।

কবির জ্ঞান ফিরে আসবার পর প্রথম ইন্টারভিউ ছাপাবার কৃতিত্বও আমার ।

কবি এখন হাসিমুখে গলা থেকে ফুলের মালাগুলো খুলে ফেলছেন এবং গুনগুন করে গান করছেন – “বাগিচার বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিসনে আজি দোল” । সেই ভরাট প্রাণবন্ত কণ্ঠশ্বর।আমি পকেট থেকে খাতা – পেন্সিল বার করছিলুম, তিনি আমাকে এই প্রথম লক্ষ করে ধমকে বললেন , “এই ছোঁড়া, তুমি এখানে কি করছ ? অ্যাঁ ?

আমি থতমত খেয়ে বললুম, “ কিছু না , মানে , আপনার একটা অটোগ্রাফ নিতে এসেছি , আর যদি দু” লাইন কবিতা লিখে দেন”।
“এখন হবে না , যাও ভাগো । অটোগ্রাফ দিতে দিতে হাত ব্যাথা হয়ে গেল, আবার কবিতা ...... হবে না, অটোগ্রাফ নেবে তো মেয়েরা, তোমার কি দরকার হে ? এখন সময় নেই” ।

আমি তবু চুপ করে বসে রইলুম।নজরুল আপন মনেই বললেন, “ ইস , এত দেরি হয়ে গেল ।নেপেনকে নিয়ে পন্ডিচেরি যাবার কথা ছিল, শ্রী অরবিন্দের সাথে দেখা করব -

আমি ভয়ে ভয়ে বললুম, “নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের কথা বলছেন ?
“হ্যাঁ । চেন নাকি” ?

“ আজ্ঞে চিনি , তিনি আর বেঁচে নেই । শ্রীঅরবিন্দও -

“অ্যাঁ, নৃপেন বেঁচে নেই ? কি বলো? কবে মরল? আমি তখন কোথায় ছিলাম”?

কবির গলায় অসহায় আর্তনাদ ফুটে উঠলো ।মানুষকে দুঃখের খবর শুনাবার অভ্যাস আমারও নেই । আমিও খানিকটা অসহায় বোধ করতে লাগলুম ।তবু মৃদুস্বরে বললুম, “ আপনি একটানা অনেকদিন ঘুমিয়ে ছিলেন , অনেকদিন , এর মধ্যে অনেক কিছু বদলে গেছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে –

“ হয়েছে? গেছে সাহেব ব্যাটারা? কারার ওই লৌহকপাট ভেঙ্গেছে? সত্যি ? তা হলে তো ফুর্তি করতে হয় একটু আজ ।পন্ডিচেরি থাক , তা হলে আজ অচিন্ত্য আর প্রেমেন কে ডেকে একবার ঢাকা ঘুরে আসি । ওখানে বুদ্ধদেব আছে -

আমি বললাম , “ বুদ্ধদেব ঢাকা ছেড়েছেন বহুদিন । তা ছাড়া পাকিস্তান -

“পাকিস্থান ? ইকবালের সেই পাকিস্থান ? হাঃ – হাঃ – হাঃ – হাঃ- ! জিন্না – গান্ধীজীর ঝগড়া আজও মেটেনি” ?
“ঝগড়া মিটেছে কিনা জানিনা , তবে ওঁরা কেউই আর ইহলোকে নেই” ।

“নেই ? তবে পাকিস্তান কি জন্য ?

“পাকিস্তান ওঁরা বেঁচে থাকতেই হয়ে গেছে ।পূর্ব বাংলা পশ্চিমে পাঞ্জাব আর সিন্ধু নিয়ে পাকিস্তান হয়েছে অনেক দিন আগে । গত বছর ওদের সাথে আমাদের যুদ্ধও হয়ে গেল”।

“ যুদ্ধ হয়ে গেল মানে ? পূর্ব বাংলার সাথে পশ্চিম বাংলা যুদ্ধ করবে ? চালাকি পেয়েছ ? তুমি কে হে ছোকরা ? সত্যি করে বল তো, ব্রিটিশের স্পাই নও তো ?

আমি বিষণ্ণ হেসে বললুম , “ পূর্ব বাংলার সঙ্গে আমাদের হাতাহাতি যুদ্ধ হয়নি বটে , কিন্তু এটা এখন একটা আলাদা দেশ । ওখানকার সঙ্গে এখানকার যাতায়াত বন্ধ । এখানকার বই ওরা পড়তে পায়না , ওদের বই ও আমরা পাই না”।

“এরা আর ওরা ? তুমি এখান থেকে ভাগো তো । যত সব মিথ্যে কথা শোনাতে এসেছ । আমি আজকের ট্রেনেই ঢাকা যাব , দেখি কে আমায় আটকায় ! আমি , জসিমুদ্দিন, গোলাম মুস্তাফা , প্রেমেন , শৈলজাকে সঙ্গে নিয়ে যাব , ওখান থেকে অজিত , পরিমল , মোহিতলালকে সঙ্গে নিয়ে ফিরব , দেখি কে কি করে। তুমি এখন সরে পড়” । আমি বললুম, “ আপনি আমার উপর অকারণে রাগ করছেন , কিন্তু কথাগুলো সত্যি । আপনি যে ট্রেনে চাপবেন , সে – রকম সরাসরি কোনও ট্রেনই চলে না আজকাল আর। ওদেশের সঙ্গে আমাদের দেশের যোগাযোগ সত্যিই একেবারে বন্ধ । আর যাদের নাম করছেন , তাঁরা অনেকেই দেশ বদলেছেন । অবশ্য আপনি যদি যেতে চান তাহলে দুই সরকারের মধ্যে লেখালেখি করে আপনার জন্য একটা কোন বন্দোবস্ত ......” ।
কবি এবার খানিকটা হতাশ চোখে তাকালেন । দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন , “ এতদিন সত্যিই ঘুমিয়ে ছিলুম ।তুমি শুধু আমায় খারাপ খবর শোনাচ্ছ । ভালো খবর কিছু নেই” ?
আমি চিন্তিত ভাবে বললুম , “ ভালো খবর ? হ্যাঁ , মানে , এইতো দুর্গাপুরে বিরাট ইস্পাত কারখানা হয়েছে , কলকাতায় অনেক বড় বড় বাড়ি উঠেছে –
তাকিয়ে দেখি কবি আবার অবসন্নভাবে হেলান দিয়ে কিসব বিড়বিড় করতে – করতে হাত দিয়ে ফুলগুলো ছিঁড়ছেন ।





পাদটীকাঃএই লেখাটি যখন সুনীল লেখেন (১৯৬৬) তখন তিনি ও জানতেন না (জানার কথা ও না) বেশ কিছু বছর পর যখন কবি পুরোপুরি নির্বাক তখন বাঙ্গালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ মানুষটি কবিকে পূর্ব বাংলা তথা বাঙ্গালির একমাত্র স্বাধীন আবাসভূমি বাংলাদেশে নিয়ে আসবেন আর সেই দেশের জাতীয় কবি করবেন । বাংলা ও বাঙ্গালির জয় হোক ।







সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:০৯
২১টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×