বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত দেশ ও সংবিধান বিরোধী সবচেয়ে সক্রিয় ছাত্র সংগঠন হচ্ছে মওদুদীবাদী ছাত্রশিবির। স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল মওদুদীবাদী জামাতের ক্যাডারভিত্তিক ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির দলের সদস্য অন্তর্ভুক্তি করে শিশু বয়স থেকেই।
শিবির থেকেই উৎপত্তি হয়েছে হিযবুত তাহরীর, জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)সহ নানা সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের। আন্তর্জাতিক মহলে ছাত্রশিবির পরিচিত সন্ত্রাসী সংগঠন ‘আইসিএস’ নামে। দেশের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়ছে এ সংগঠনের কার্যক্রমে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিশু সংগঠন ফুলকুঁড়ি আসরসহ ফোকাস, রেটিনা প্রভৃতি কোচিং সেন্টার আর উপ-সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সংগঠনে নিয়ে আসছে শিবির।
ছাত্রশিবিরে ভেড়ানোর কৌশল :
ছাত্রশিবিরের একটি বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদেরকে শিশুকাল থেকেই টার্গেট করে ছাত্রশিবির। আর শিশু সংগঠন ‘ফুলকুঁড়ি আসর’ গঠন করা হয়েছে এ উদ্দেশ্য নিয়েই।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ফুলকুঁড়ি আসরে যেসব শিশু যুক্ত হয়, পরবর্তীতে তারা যোগ দেয় ছাত্রশিবিরে। শিবিরের সম্পূর্ণ কার্যক্রম পরিচালিত হয় ক্রমানুযায়ী। প্রথম পর্যায়ে একটি শিশুকে পরিচিত করা হয় ফুলকুঁড়ি আসরের সঙ্গে। ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে উঠলেই তাকে দিয়ে পূরণ করানো হয় ছাত্রশিবিরের সদস্য ফরম। যখন শিশুটি শিবিরে যোগ দেয়, তখন সে নিবন্ধিত হয় সংগঠনের সমর্থক হিসেবে। এরপর ধাপে ধাপে কর্মী, সাথী এবং শেষে সংগঠনের সদস্যপদ লাভ করে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীর বেশ কয়েকটি প্রথম সারির স্কুলে কাজ করে ফুলকুঁড়ি আসর। তারা সবচেয়ে বেশি কাজ করে স্কুলের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাংলাদেশ স্কাউটের মধ্যে। এছাড়া রোভার স্কাউট ও বিএনসিসি কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে সক্রিয় শিবির কর্মীরা। বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে, স্কাউটের শিশুরা জাতীয় স্টেডিয়ামে বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসের প্যারেডে অংশগ্রহণের জন্য মনোনীত না হলে ফুলকুঁড়ি আসরের মাধ্যমে অংশগ্রহণের জন্য দাওয়াত দেয়া হয়।
এক ধরনের কৃতজ্ঞতবোধ থেকে শিশুরা এরপর ফুলকুঁড়ির বিভিন্ন কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে। তখন তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের মওদুদীবাদী বই সরবরাহ করা হয়। সুযোগ বুঝে ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণীতে উঠলে শিবিরের ফরম পূরণ করিয়ে নেয়া হয়। শিশুদের মধ্যে ‘নতুন কিশোর কণ্ঠ’ এবং ‘ইয়ুথ ওয়েব’ নামে দুটি মাসিক সম্পাদনা সরবরাহ করা হয়। যা প্রকাশ করা হয় ছাত্রশিবির থেকে।
স্কুল পর্যায়ে এসব দ্বায়িত্ব পালন করে শিবিরের কেন্দ্রীয় স্কুল কার্যক্রম সম্পাদক মিজানুর সরকার, কেন্দ্রীয় শিক্ষা সম্পাদক মোবারক হোসেইন, কেন্দ্রীয় কলেজ কার্যক্রম সম্পাদক মাসুদুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় মাদ্রাসা কার্যক্রম সম্পাদক হাফেজ শাহিনুর রহমান এবং কেন্দ্রীয় বিতর্ক সম্পাদক মোস্তফা সাকেরুল্লাহ।
সারাদেশে ছাত্রশিবিরের পরিচালিত বেশ কয়েকটি কোচিং সেন্টার রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের দলে ভেড়াতে সহায়তা করে। এর মধ্যে এইচএসসি পাস করা শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ‘ফোকাস’, মেডিকেলে ভর্তির জন্য ‘রেটিনা’ এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির জন্য ‘কনক্রিট’ সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। দেশব্যাপী শতাধিক শাখা রয়েছে এ তিনটি কোচিংয়ের।
দেশের যেসব জেলা বা উপজেলা-থানায় এসব কোচিংয়ের শাখা রয়েছে সেগুলো স্থানীয় ছাত্রশিবির নেতাকর্মীদের দ্বারাই পরিচালিত হয়। এসব কোচিংয়ে শিক্ষকতা এবং অন্যান্য চাকরির মাধ্যমে কর্মীদের থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা দেয় ছাত্রশিবির। বর্তমানে কোচিংগুলোর মূল পরিচালনার দ্বায়িত্বে রয়েছে শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি শাহ মোহাম্মদ মাহফুজুল হক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি বদিউল আলম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি আশরাফুল আলম ইমন এবং কেন্দ্রীয় শিক্ষা সম্পাদক মোবারক হোসেইন।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সকল নেতাকর্মী ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কোচিং সেন্টারগুলোর সঙ্গে। রেটিনা কোচিংয়ের সঙ্গে মেডিকেল কলেজ এবং কনক্রিটের সঙ্গে জড়িত রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবির কর্মীরা। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর প্রায় এক কোটি টাকার মতো আয় হয় দেশব্যাপী কোচিং সেন্টারগুলোর বিভিন্ন শাখা থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের এভাবেই সংগঠনে ভেড়ায় শিবির।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২০০১ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকাকালীন শিক্ষকদের যে নিয়োগ হয়েছে তার বেশিরভাগই ছাত্রশিবিরের কর্মী বা নেতা। বিএনপি ঘরানার ছাত্ররাও নিয়োগে ছিলো অনেক পিছিয়ে। ছাত্রশিবির ব্যাকগ্রাউন্ডে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা এখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের নেতাকর্মীদের মতো কাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিবিরের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং ভালো ফলাফলে এসব শিক্ষকরা সর্বোচ্চ সাহায্য করেন বলেও জানা গেছে।
যেভাবে জন্ম শিবিরের :
বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীশক্তি মওদুদীবাদী জামাতের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির। সংগঠনের প্রথম থেকেই ধর্মের নামে রাজনীতির ভুল চর্চার মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতাবিরোধী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছে সংগঠনটি। ১৯৪৭ সালে বিভ্রান্ত মওলানা মওদুদীর নেতৃত্বে যে জামাত-ই-তালেবার নামক যে ছাত্র সংগঠনের জন্ম হয় পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালে তা ছাত্রসংঘে রূপ নেয়।
তৎকালীন সময়ে জামাত এবং ছাত্রসংঘ প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয় আল-বাদর বাহিনী। এই আল-বাদর বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু ধর্মের নামে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে এ ধরনের সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও দেশ স্বাধীন হলে মওদুদীবাদী জামাত ও ছাত্রসংঘের সদস্যরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়।
এরপর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে ছাত্রসংঘ ১৯৭৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রশিবির নামে পুনরায় যাত্রা শুরু করে। ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মীর কাশেম আলী এবং আগের ছাত্রসংঘের শীর্ষ নেতা কামারুজ্জামান, মুজাহিদ ও আব্দুল জলিল আবু নাসের তারা সবাই আল-বাদরের সক্রিয় কর্মী ছিলো বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ছাত্রশিবিরের বর্তমান সভাপতি দেলাওয়ার হোসেন এবং সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল জব্বারর নামে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমে মদদ দেয়ার অভিযোগ।
বর্তমানেও ছাত্রশিবিরের সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এরা সক্রিয় রয়েছে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়সহ জাহাঙ্গীরনগর ও সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের পতনের আগে মহাজোটের আন্দোলন ঠেকাতে ছাত্রশিবিরের সশস্ত্র তৎপরতাই সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা গেছে।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরও এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রশিবির তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করেনি বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এছাড়াও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরের স্কুল-কলেজগুলোতেও ছাত্রশিবির নিজস্ব নামে অথবা বিভিন্ন সংগঠনের নামে চালিয়ে যাচ্ছে কার্যক্রম।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ছাত্রশিবিরের সরচেয়ে বেশি সক্রিয়তা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মাদ্রাসাগুলোতে বিশেষ করে আলিয়া মাদ্রাসাগুলোতে।
কিরিস বাহিনী :
ছাত্রশিবিরের রয়েছে বিশেষ ক্যাডার বাহিনী। এ বাহিনীকে বলা হয় ‘ক্রিজ (কিরিস) বাহিনী’। বিশেষভাবে অস্ত্র চালানোয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং হাতবোমা বানানো ও ছোড়ায় পারদর্শী এরা প্রায় সকলেই ছাত্রশিবিরের কর্মী, সদস্য অথবা সাথী। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রশিবির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস ও হল দখলের কাজে ক্রিজ বাহিনীকে কাজে লাগায় বলে জানা গেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এ বাহিনীর সদস্যরা অপারেশনের কয়েকদিন আগে থেকেই নির্দিষ্ট ক্যাম্পাসের আশপাশে অবস্থান করে।
গত সপ্তাহজুড়ে দেশব্যাপী পুলিশের সঙ্গে ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষেও পিকেটিং বাহিনীর সঙ্গে ছিল ক্রিজ বাহিনীর উপস্থিতি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিবিরের এক কর্মী জানায়, একমাত্র এ বাহিনীর কারণেই তারা এখনো রাজশাহী ও চট্টগ্রাম এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাব বজায় রেখেছে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



