“আত্মহত্যা” শব্দটি শুনলে বা কোথাও লেখা দেখলেই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠে । শব্দটির সাথে নিশ্চয় কাউকে আর নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই । প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন জায়গার খবরে আত্মহত্যা নামক এই হৃদয়স্পর্শী খবরের দেখা মিলে । যৌতূকের টাকার জন্য শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার সইতে না পেরে আত্মহত্যা, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা, সম্ভ্রম হারিয়ে আত্মহত্যা, সংসারের অশান্তির কারনে আত্মহত্যা, সঙ্গীর প্রতারণার কারনে আত্মহত্যা আরও কত কি । সর্বশেষ যে খবরটি নিয়ে আলোচনা হল তা হল অরিত্রি অধিকারী আর ইদানীং ডাক্তার আকাশ ।
আমার নিজের জীবনের আত্মহত্যা বিষয়টির সাথে সর্বপ্রথম পরিচয় হয় স্কুল শেষ করে যখন সবেমাত্র কলেজে উঠলাম । আমার খুব প্রিয় এক বান্ধবী আমাদেরকে ছেড়ে চলে যায় ওপারে, আত্মহত্যা করে ।
ওর নাম ছিল হ্যাপি । দেখতে খুব সুন্দর, গায়ের রঙ ফর্সা, হাইট কম কিন্তু অনেক বড় বড় আর ঘন চুল ছিল ওর। যখন খোঁপা করতো তখন আগের দিনের নায়িকাদের মতো অনেক বড় একটা খোঁপা হত । ওর মা মারা গিয়েছিলো এক বছর আগে, ভাই বোনদের মধ্যে ও ছিল সবার ছোট । বোনদের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল আর ছিল একটি অবিবাহিত ভাই ও বাবা । মা মারা যাওয়ার পর বোনরা ওইভাবে আসা যাওয়া করতোনা তাই ও খুব একা হয়ে পরেছিল । বাবা চাচ্ছিল আরেকটি বিয়ে করতে কিন্তু বোনরা যেহেতু বিবাহিত ও আরও কিছু পারিবারিক সমস্যা এই নিয়ে ছিল ওর মানসিক অশান্তি । আর এসব নিয়ে পাড়া প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজনরাও ওকে কথা শোনাতো । এমনিতেই কিছুদিন আগে মা হারিয়েছে, বাবা বোন ভাই থাকতেও তাদেরকে কাছে পায়নি তার উপর এসব অশান্তি সব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত সে নিয়েছিল আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত ।
গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করে ও ।
সকালবেলা কলেজে যাওয়ার পরেই স্যার এর কাছে শুনলাম ওর মৃত্যুর কথা । আমার বান্ধবীদের অনেকে গিয়েছিলো ওর মরদেহ দেখতে কিন্তু আমার যাওয়ার সাহস হয়নি । যে বান্ধবীর সাথে দুইদিন আগেও তিন বান্ধবী মিলে রিকশায় যেতে যেতে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিলাম আর সে কিনা করেছে আত্মহত্যা ? এ যে পুরোই অবিশ্বাস্য আমার কাছে, আর ওর জীবনে এমন কি ছিল, এত হাসি খুশী মেয়েটা ভেতরে কি এমন কষ্ট আর মানসিক যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছিল যে বেঁচে থাকা ওর কাছে এত কঠিন মনে হয়েছিল যে মৃত্যুর পথই বেঁছে নিতে হল ।
যারা ওকে দেখতে গিয়েছিলো তাদের মুখে শুনেছি ওর বীভৎস চেহারার বর্ণনা । এত বড় বড় চুলগুলো সব পুড়ে এক জায়গায় জরো হয়ে গিয়েছিলো, আই ব্রো গুলোও ছিলনা একটাও, এত ফর্সা মেয়েটির মুখ হয়ে গিয়েছিলো কালো কুচকুচে । ওর একটি ছবি ছিল আমার কাছে। আমি প্রায়ই এক দৃষ্টিকে ওর মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম ।
মানুষ আত্মহত্যা কেন করে ? মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে বিবেচনা করলে এখানে অনেকগুলো বিষয় আসবে তবে আমি যেহেতু কোন মনোবিজ্ঞানী নই আমি এক কথায় বলতে পারি জীবনের বিভিন্ন সমস্যার কারনে যখন বেঁচে থাকার চেয়ে মরে গিয়ে বেঁচে যাওয়াকেই বেশী সহজ বলে মনে হয় তখনই আমরা আত্মহত্যা করি, করি নিজেকে হত্যা ।
জীবনে দুঃখ কষ্ট থাকবেই । থাকবে ব্যর্থতা, হতাশা, অশান্তি, অপমান আর বিভিন্ন ধরনের মানসিক যন্ত্রণা । এ সকল মানসিক যন্ত্রণা, অশান্তির মধ্যে বেঁচে থাকা, টিকে থাকা আসলেই ভীষণ কঠিন । কখনো আপনার জীবনে বেঁচে থাকার কোন অবলম্বনই থাকবেনা, মানসিক যন্ত্রণা গুলো এত বেশী ভারী মনে হবে যে আর চলতেই পারবেন না। এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে বেঁচে থাকাটাকে অর্থহীন মনে হবে, এই অসহ্য যন্ত্রণার জীবন বয়ে বেড়ানো থেকে মরে যাওয়াটাই অনেক ভালো এমনটি মনে হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয় । অনেক চেষ্টা করার পরেও মনে হবে আর পারছেন না, মনে হবে মরে গেলেই শান্তি । জীবনের এই ধরনের মানসিক অবস্থার মধ্যেই আগে পরে কোন কিছু না ভেবে আমরা আত্মহত্যার মত একটি জঘন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি ।
আত্মহত্যা করে কষ্ট ও যন্ত্রণার জীবন থেকে নিজেকে মুক্তি দেওয়া অনেক সহজ কিন্তু জীবনের বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা, মানসিক কষ্ট, যন্ত্রণা মেনে নিয়ে, যুদ্ধ করতে করতে জীবন কাটানো অনেক কঠিন । আপনার জন্য বেঁচে থাকা অনেক কঠিন কিন্তু আপনার আসে পাশেই আপনার মত কিংবা আপনার চেয়ে বেশী মানসিক যন্ত্রণা সৈহ্য করে যুদ্ধ করে সাহসিকতার সাথে জীবন কাটাচ্ছে এমন মানুষও থাকতে পারে তা হয়তো আপনার অজানা । তাদের কথা কেউ জানেনা কারন তারা আত্মহত্যা করেনি । আপনার আর তার মধ্যে পার্থক্য একটাই, আপনি হেরে গিয়ে একজন লুজার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন আর তিনি যুদ্ধ করে সাহসীর মত বেঁচে থেকে বিজয়ী হওয়ার পথ বেছে নিয়েছেন । আত্মহত্যা করে আপনার এ জীবনে মুক্তি মিলবে কিন্তু পরকালে মিলবে সাঁজা আর তার আল্লাহ এর উপর ভরসা করে আল্লাহকে বিশ্বাস করে আল্লাহর পথ অনুসরন করে এ জীবনে ধৈর্য্য ধরে মিলবে ধৈর্য্যের পুরস্কার আর পরকালে শান্তি ।
একটি কথা মনে রাখবেন আমাদের জীবনে দুঃখ কষ্ট বিপদ এগুলো আল্লাহর তরফ থেকে এক ধরনের পরীক্ষা । বিপদের সময়ে আমরা আল্লাহকে ডাকি কিনা, ধৈর্য রাখি কিনা, তার উপর ভরসা রাখি কিনা সেই পরীক্ষা । আর সেই পরীক্ষায় যিনি পাশ করবেন তার জন্য আল্লাহ অবশ্যই পুরস্কার স্বরূপ এমন কিছু রেখেছেন তা আমরা আল্লাহর বান্দা কল্পনাও করতে পারবোনা । শুধু দরকার সাহস আর ধৈর্য্যের সাথে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করা আর বেশী বেশী সাহায্যের জন্য আল্লাহকে স্মরণ করা । তবেই মিলবে মুক্তি আর শান্তি। আত্মহত্যা কোন মুক্তি নয় বরং এটি এই ক্ষণস্থায়ী এক জীবন থেকে মুক্তি নিয়ে এক চিরস্থায়ী অভিশপ্ত জীবনে বন্দিত্ব ।
যারা আমার এই লেখাটি পড়ছেন আমি তাদেরকে পরামর্শ দিব নিচের লেখাগুলোও পড়তে ।
আত্মহত্যা কোন সমাধান নয়, বরং একটি সমস্যা
আত্মহত্যার ভয়ংকর পরিণতি
ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মহত্যা একটি মহাপাপ
আল্লাহ তার সেই বান্দাকেই বেশী পরীক্ষা করেন যাকে তিনি বেশী ভালোবাসেন । জীবনে বেশী সুখ পেয়ে আমরা আল্লাহ কে ভুলে যাই তখন আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর সাথে আমাদের নৈকট্য তৈরি করার জন্য তার সাথে তার প্রিয় বান্দার সম্পর্ক আরও গাড় করার জন্য তাকে সমস্যা দেন, বিপদ দেন যেন তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমরা বেশী বেশী আল্লাহকে ডাকি এবং এর মাধ্যমে যেন আল্লাহর সেই বান্দার সাথে তার সম্পর্ক আর গাড় হয় । তাই জীবনে সমস্যা ও বিপদ এক ধরনের আশীর্বাদ । জীবনে বিপদ আপদ সমস্যা আপনাকে আল্লাহর একজন খাঁটি ও প্রিয় বান্দায় পরিনত করবে যদি আপনি আল্লাহর উপর ভরসা রাখেন বিশ্বাস রাখেন ধৈর্য্যধারন করেন আর বেশী বেশী আল্লাহকে ডাকেন ।
জীবন দিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে হয়তো এ জীবনের কষ্টগুলো থেকে আপনার মুক্তি মিলবে কিন্তু পরকালে মুক্তি কিভাবে পাবেন ? এ জীবন তো ক্ষণস্থায়ী কিন্তু সেই জীবন তো চিরকালের ।
এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে একটু, না একটু না অনেক অনেক বেশী কষ্ট সৈহ্য করে লড়াই করে সাহসীর মত বেঁচে পরকালের শান্তি চান নাকি নাকি লুজার এর মতো জীবনটা দিয়ে দিবেন। এ জীবনে মুক্তি চান নাকি পরকালে মুক্তি ? ভেবে দেখুন প্লিজ ।
মা দশ মাস গর্ভে ধারন করে বাবা বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থায় টাকা উপার্জন করে দুইজনে অনেক ভালোবেসে যে জীবনকে আগলে রেখেছেন সেই জীবন আপনি এক সেকেন্ডে চাইলেই পারেন শেষ করে দিতে, কিন্তু সেই জঘন্য কাজটি করার আগে আপনার বাবা মা এর মুখটা একবার হলেও কল্পনা করবেন, আপনার নিজের যদি সন্তান থাকে তাদের কথা ভাববেন, পরিবারের অন্যান্য সদস্য যারা আপনাকে ভালোবাসে তাদের কথা ভাববেন আর এমন যদি হয় আপনার কেউ নেই ভালোবাসার তাহলে অন্তত নিজের কথাই ভাবুন যে আত্মহত্যা করার পরে মৃত্যুর পরে আপনার কি অবস্থা হবে ।
আত্মহত্যা যারা করে তারা লুজার আর যারা যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে তারাই সত্যিকারের ওইনার ।
(কিছুদিন আগে যখন অরিত্রি অধিকারীর আত্মহত্যা নিয়ে খুব লেখালেখি হচ্ছিলো তখন লেখাটি অর্ধেক লিখেছিলাম এখন ইদানীং আবার সেই ডাক্তার আকাশের আত্মহত্যা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা লেখালেখি আরও কত কি । কয়দিন পর সব লেখা শেষ কিন্তু যে পরিবার তাঁর আপন জন হারিয়েছে তাদের দুঃখ কি আদৌ শেষ হবে ? তাই আমাদের কারও জীবনে যদি কখনো এমন অবস্থা তৈরি হয় আমরা যেন আর কিছু না হলেও অন্তত আত্মহত্যার পথ বেছে না নেই )
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১৯ রাত ১০:০৩