somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সৈয়দ শামসুল হক বললেন ভারত বিভাগ একটা ঐতিহাসিক শোকের ঘটনা

১৭ ই এপ্রিল, ২০০৮ সকাল ৯:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভারত বিভাগ একটা ঐতিহাসিক শোকের ঘটনা। সাতচল্লিশে ভারত স্বাধীন হয়নি, দ্বিখন্ডিত হয়েছে। কালের পরে কাল যাবে কিন্তু একসময়ে এই শোক আমরা উদযাপন করবো, স্বাধীনতা নয়। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক যখন উপরোক্ত কথাগুলো উচ্চারণ করলেন, মনে হলো পরিষ্কার দৃষ্টিভংগীর এমন সাহসী উচ্চারণ সময়োত্তীর্ণ এক সময়ের স্ফুরণ, যা ভবিতব্যের নকশা উদ্ভাসিত করে। বাংলাদেশের সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্রদের মধ্যে তিনি প্রথম পূর্ণকালিন পেশা হিসাবে সাহিত্যকে বেছে নিয়েছিলেন। সাহিত্য সংশ্লিষ্ট আরো অনেক বিষয়ে নতুন যুগের সূচনাকারী। এদেশের লেখকদের মধ্যে প্রথম টাইপরাইটার ব্যবহার করেছেন। লেখার জন্য ল্যাপটপও ব্যবহার করেছেন সবার আগে। বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছিলেন মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে। সৈয়দ হকের বাসায় এই সাক্ষাতকারটি নেয়া হয়েছিল সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের এক ছুটির দিনে। আমরা জলেশ্বরীর কিংবদন্তীর একদম সাম্প্রতিক সাহিত্য ভাবনার জগতে হারিয়ে গেলাম। প্রশ্ন আমাদের শুরু করতে হয়নি, শুরুটা তিনিই করে দিয়েছিলেন।

সৈয়দ হকঃ সাক্ষাতকারটি কিসের জন্য?

কৌশিকঃ জর্জিয়া থেকে প্রকাশিত প্রিয় বাংলা নামের একটা ম্যাগাজিনের জন্য।

সৈয়দ হকঃ আছে সাথে?

কৌশিকঃ ওটার অনলাইন ম্যাগাজিন দেখাতে পারি। (আমার সাথে আনা ইন্টারনেট কানেকশনসহ ল্যাপটপের দিকে ইংগিত করি)।

সৈয়দ হকঃ না, ঠিক আছে, দেখাতে হবে না, অনলাইন ভার্সন যেহেতু আছে আমি দেখে নিতে পারবো।

কৌশিকঃ আপনার সমগ্র স্বত্বা নিয়ে একটা সাক্ষাৎকার প্রকাশ করতে চেয়েছে পত্রিকাটি। ইন্টারনেটে যারা লেখালেখি করে, ব্লগিং করে সেসব আলোচনায় আপনিও ঢুকে পড়েন। আমরা এমন একটা প্রজন্মের প্রতিনিধি যাদের সাথে প্রাজ্ঞ সাহিত্যিকদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ইন্টারনেটে আপনার সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনাকারীরা অনেকেই ভেবেছে আপনাকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করবে। আমার ধারণা ছিল আমাদের বরেণ্য সাহিত্যিকেরা বোধহয় ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত নন। অথচ আপনি বললেন যে পত্রিকাটি অনলাইনে দেখে নেবেন, তার মানে আপনি ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন।

সৈয়দ হকঃ হ্যা করিতো! যখন দরকার হয়, যেটুকু দরকার হয়।

শরৎঃ এই সম্পৃক্ততাকে বোধহয় বেশি জায়গা দেন না?

সৈয়দ হকঃ আসলে যতটুকু দরকার হয়। যেমন মেইল চেক করা, লেখা পাঠানো, কোন তথ্য দরকার হলে ইন্টারনেট সার্ফ করি, বই কেনার দরকার হলে এমাজনে যাই। মানে যতটুকু দরকার ততটুকুই। নট হোল দ্যা টাইম ইন ইন্টারনেট। তবে লেখালেখি আমি ল্যাপটপে করি। সেটা আজকে থেকে নয়। আমি কম্পিউটারে লিখি ১৯৮৯ থেকে। এবং আই ওয়াজ দ্যা ফার্স্ট রাইটার ইন দিস কান্ট্রি টু রাইট ইন দ্যা মেশিন। আই এ্যাম রাইটিং মাই স্টাফ ইন টাইপরাইটার ফ্রম ১৯৭২।

কৌশিকঃ অনেকে বলেন কম্পিউটারে লিখলে কালি কলমের সাথে যে আত্মিক সম্পর্কটা থাকতো তা অনেকটাই যান্ত্রিক হয়ে যায়।

সৈয়দ হকঃ না এরকম নয়। এটা হচ্ছে অভ্যাসের ব্যাপার। একসময়ে মানুষ মৌখিকভাবে লিখতো। তখন লেখাই ছিল না। মুখে মুখেই থাকতো সৃষ্টি। এখনও গ্রামে আছে। তারপরে লোকে খাগের কলম কালিতে চুবিয়ে লিখতো, তারপরে এলো ফাউন্টেন পেন, তারপরে এলো বল পয়েন্ট। এক এক যুগে এক একটা বিষয় এসেছে। এখন যদি কেউ বলে খাগের কলমে লেখাই ভাল ছিল, ফাউন্টেন পেনই ভাল ছিল, সেটা কেমন হবে? টাইপরাইটারে লিখেছি বহুদিন। মুনীর চৌধুরী যখন বাংলা কিবোর্ডটা ডেভলপ করেন সেই ১৯৭০ সালে, ইস্ট জার্মানী থেকে দশটা মেসিন তৈরি করে এনেছিলেন। এবং ওই দশটা মেসিন মুনীর ভাই দশজনকে দিয়েছিলেন পরীক্ষা করার জন্য। তিনি আমাকেও একটা দিয়েছিলেন। ঐটা আমি ছ’মাস ব্যবহার করেছিলাম। ১৯৭২ তে আমি আমার প্রথম টাইপরাইটার কিনি। ৭৬ এ দ্বিতীয়টি। ৮০ তে তৃতীয় বাংলা টাইপরাইটার কিনি। তারপরে ৮৫ তে আমার একটা হার্টএটাক হয়। ৮৮ তে বাইপাস সার্জারী হয়। ডাক্তার আমাকে তখন টাইপরাইটারে কাজ করতে নিষেধ করেন। এটা স্নায়ুতে চাপ তবে সেটা নিয়ে খুশি ছিলাম না। তারপর আমাদের এখানে সবেমাত্র কম্পিউটার আসতে শুরু করেছে, মোস্তফা জব্বার তখন আমাকে একটা মেসিন দিল, সেটা ল্যাপটপ ছিলো না। ১৯৮৯ সালের ঘটনা, সেটা একটা বিরাট যন্ত্র ছিল।

১৯৯২ তে আমি আমার প্রথম ল্যাপটপটা কিনি। তারপর আমার চার পাঁচটা ল্যাপটপ ব্যবহার করা হয়েছে। ভালো, তাই বলে সব লেখা ল্যাপটপে লিখি না। কবিতা বেশির ভাগ আমার হাতে লেখা। এরপর ফাইনাল ড্রাফ্ট আমি কম্পিউটারে করি।

কৌশিকঃ ল্যাপটপের সাথে আপনার ইন্টারনেটের কানেকশন আছে?

সৈয়দ হকঃ ডায়ালআপ ব্যবাহার করি। আর বিদেশে গেলে আমার ছেলের যে কানেকশন আছে সেটা ব্যবহার করি।

কৌশিকঃ আপনার ওয়েব সাইটে দেখলাম আপনার কিছু কবিতা, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি দেয়া আছে। এটাও সম্ভবত নতুন, দেশের বরেন্য লেখকদের নিজস্ব ওয়েব পাওয়া যায় না। পাঠকদের সাথে যোগাযোগ অনেক ভালো হয়। আপনার সম্মন্ধে জানার জন্য হন্যে হয়ে বই খুঁজেছি। বিভিন্ন বইয়ের দোকানে দেখলাম কোথাও একত্রে আপনার সব বইগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছিল যে যদি লেখাগুলো ইন্টারনেটে থাকত, সহজেই জানতে পারতো পাঠক, প্রয়োজনে কিনতে পারতো!

সৈয়দ হকঃ কেউ না কেউ এটা করবে। আমার এত ব্যাস্ততা নেই। আমার লেখা পর্যন্তই আমার কাজ। এরপর বাকিটা অন্যের দ্বায়িত্ব।

কৌশিকঃ আপনার শরীরের এখন কি অবস্থা, বাইপাসের পরে?

সৈয়দ হকঃ সে তো ১৯ বছর আগের কথা। এখনো টিকে আছি।

শরৎঃ খুব তীব্রভাবে জীবিত আছেন, টিকে থাকা কি শুধু বলা যায়?

সৈয়দ হকঃ তীব্র আর কি, বরাবরের মতই আছি, তবে হ্যা আগের তুলনায় অনেক সতর্ক হয়ে থাকতে হয়। একটা সময়ে যখন একেবারেই কোনকিছুই পরোয়া না করে চলা যেত দিনরাত, এখন কিছুটা তা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে।

শরৎঃ সাম্প্রতিক কোন বই খুব নাড়া দিয়েছে এমন ঘটনা কি ঘটেছে?

সৈয়দ হকঃ পড়ে যাই তো। খুব নাড়া দেবার মত বই কি পৃথিবীতে খুব বেশি সৃষ্টি হয়? ইদানিং খুব কম বই নাড়া দেয়। নাড়া খাবার বয়সও তো পার হয়ে গেছে। একটা সময় ছিল, হয়ত কোন বই খুব ভালো লাগলো, পড়ে ফেললাম। এখন সেরকম হয় না। তাছাড়া নিজে লিখিতো। এখন আমার চারপাশে যারা লিখছেন দেশে বিদেশে, তাদের আমার আয়ত্বের বাইরে বলে মনে হয় না। আয়ত্বের বাইরে বলতে আমার চেয়ে একেবারে অন্যকিছু বা বড়কিছু এমনটা মনে হয় না। ফলে হয়েছে কি যে, নাড়া খাবার ব্যাপারটা আর থাকে না। এটার জন্য সমান সমান হবার একটা ব্যাপার কাজ করে।

শরৎঃ একটা বোধগত নির্বাণের জায়গায় কি আছেন?

সৈয়দ হকঃ এটা আমি এখন দেখি যে তেমন কিছু উঠে আসছে না। নতুন নিশ্চয়ই কিছু আছে, কিন্তু এটার এমন শক্তি নয় যেটা আমাকে স্তম্ভিত করবে। কারণ এই শক্তির সাথে আমি পরিচিত। এখন দেখা যাচ্ছে অনেকেই লিখে যাচ্ছেন কিন্তু আলাদা বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অধিকাংশ লেখক এক রকম।

শরৎঃ কিভাবে?

সৈয়দ হকঃ একই রকম, সমাজে যেরকম মধ্যম লোকই বেশি। উচ্চ প্রতিভার লোকজন যেমন কম। আর নির্বোধ লোক সবচেয়ে বেশি। সাহিত্যও তাই। অধিকাংশ লেখাই নির্বোধ। অধিকংশ লেখাই সাধারণ কেবল একদুইজন অন্যরকম। এটা জীবনের সব ক্ষেত্রেই। সাহিত্যের সব লেখাই যদি উচ্চমানের হতো তবে জগতে সুস্থ্যভাবে বাঁচা কঠিন হতো। তবে মধ্যম সাড়ির লেখারও দরকার আছে। এটা পাঠকদের সচল রাখে। কারণ লোকজনও তো বেশীরভাগ মধ্যমমানের। একটা উচ্চমানের বই পড়তে হলে পাঠককেও তো উচ্চমানে উঠতে হবে। সাধারণ মানুষ সাধারণ মানের লেখাই পছন্দ করে। এজন্য সচারচর দেখা যায় জনপ্রিয় লেখক প্রায়শই ভাল লেখক নয়। কারণ তাকে সাধারণ মানেরই থাকতে হয়।

ইশরাতঃ পাঠকরা উঠতি বয়সে রহস্যউপন্যাস, চটুল বই পড়ছে। একটা সময়ে রোমান্টিক লেখায় ঝুকছে। কিন্তু আমাদের সাহিত্যিকরা তাদের রচনার মাধ্যমে কি এই পাঠকদের মান বাড়াতে পারছে?

সৈয়দ হকঃ এটা সাহিত্যিকের দায়িত্ব নয়। এটা পাঠকের দায়িত্ব। আমি পারছি কি পারছি না সেটা বড় কথা নয়, আমি যতটুকু দিচ্ছি ততটুকু নিতে পারছে কিনা, সেটা হচ্ছে বিষয়। পাঠক তৈরী হচ্ছে কি হচ্ছে না। পাঠক এমন নয় যে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকবে এবং আমি গিয়ে তাদের স্পুনফিড করবো। তার দাত থাকতে হবে।

শরৎঃ এই সহজ পাচ্যতার যে প্রবৃত্তি, এ বিষয়টাকে আপনি কি মনে করেন?

সৈয়দ হকঃ এটা সবসময় হয়েছে, সবকালে, সারাবিশ্বের চিত্রও একই। সাহিত্য শুধু নয়, যে কোন শিল্পেই দুটো জিনিস আছে, একটা হচ্ছে বিনোদন দেয়া, আরেকটা হচ্ছে ভাবিত করা। একটা যদি পরিসংখ্যান দেয়া যায় তবে হয়তো দেখা যাবে যে সত্তর, আশি, নব্বই ভাগই এমন বিনোদনমূলক সাহিত্য। বাকী দশভাগ হচ্ছে এমন যা মানুষকে চিন্তার জায়গা তৈরী করে দেয়। যা একজনের জীবনকে প্রভাবিত করে, মূল্যবান মনে হয়।

কৌশিকঃ আপনি বলছেন জনপ্রিয় লেখা অনেকটাই হচ্ছে সাধারণ মানের, কিন্তু অনেকসময়ে দেখা গেছে উচ্চমার্গের লেখাও জনপ্রিয় হয়েছে। যেমন আপনারও কিছু লেখাও হয়েছে।

সৈয়দ হকঃ হয়, সেটা একটা ব্যতিক্রম।

কৌশিকঃ যেমন আপনার অনেক লেখা ছোটবেলা পড়েছি। কিন্তু এখনও সে লেখাগুলোর মধ্যে নতুন নতুন মাত্রা পাই। সমাজের প্রতিনিয়ত সংঘর্ষমূখরতায় সেগুলো অনুভব করি। এমন উপন্যাসগুলো জনপ্রিয় হয়েছে, এমনকি প্রগতিশীল পরিবারে সেগুলো বাচ্চাদের পড়ার জন্যও বলা হয়!

সৈয়দ হকঃ হ্যা, ব্যতিক্রম তো আছেই। আমরা যখন কথা বলি তার একটা অসুবিধা হচ্ছে আমরা সাধারণ প্রেক্ষিতটাকে সামনে নিয়ে কথা বলি। তবে জনপ্রিয়তার তাৎক্ষনিক মাপকাঠি একটা শিল্পেই বোঝা যায় সেটা হচ্ছে নাটক। শ্রেষ্ঠ নাটক অভিনীত হয়েছে কিন্তু তার সময়ে এটা শ্রেষ্ঠ বলে প্রমানিত হয়নি এমন কখনো ঘটেনি। শেক্সপিয়ার তার সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় নাট্যকার ছিলেন। কারণ নাটক হচ্ছে সরাসরি উপস্থাপনা দর্শকের সামনে। দর্শকের অনভূতি সরাসরি জানা যায়। এবং এটা হচ্ছে খেলার মত, গোল দিলে সকলেই উল্লাস করে, জানে। নাটক হচ্ছে ব্যতিক্রম, অন্যগুলোর ব্যাপারে বলা যায় না। নাটকে যারা দেখছে তারা কিন্তু তখনি বুঝতে পারে এটা একটা শ্রেষ্ঠ উপস্থাপনা কিনা। কিন্তু একটা উপন্যাস বা কবিতা পড়ে চট করে বুঝতে নাও পারে যে এটা একটা মহৎ সৃষ্টি।

কৌশিকঃ আপনি কি মঞ্চ ও টিভি উভয় মাধ্যমের নাটকের কথা বলছেন? নাকি শুধু মঞ্চের কথাই বলছেন?

সৈয়দ হকঃ না না, এটা মঞ্চের নাটকের বিষয়ে বললাম।

কৌশিকঃ লেডি উপন্যাস নিয়ে আপনার নাটকটা মঞ্চে আসতে পারছে না।

সৈয়দ হকঃ এর সবই তৈরী ছিল, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা মঞ্চে উপস্থাপন করা যায় নি। ২২শে ফ্রেব্রুয়ারী নাটকটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু করা সম্ভব হয়নি!

কৌশিকঃ নতুন আর কি নাটক লিখছেন?

সৈয়দ হকঃ লিখেছি তো। বাংলার মাটি বাংলার জল মহরতে গিয়েছে।

কৌশিকঃ টিভি নাটকে আপনার উপস্থিতি নেই!

সৈয়দ হকঃ টিভির জন্য নাটক করতে আমি উৎসাহ পাই না। আমি এখন পর্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। আমি এত কষ্ট করে একটা কিছু নির্মাণ করবো আর এখানে ঘরে বসে একমিনিট দেখেই চট করে বলে ফেলবে ভাল লাগছে না, বন্ধ করে দেই, সেটা আমার সহ্য হয় না।

কৌশিকঃ কিন্তু আপনি তো একসময়ে টিভিতে যুক্তও ছিলেন?

সৈয়দ হকঃ হ্যা সেটা অন্য বিষয়, আমি অনুষ্ঠান উপস্থাপক হিসাবে একসময়ে কাজ করেছি টিভিতে।

কৌশিকঃ সিনেমার জন্য স্ক্রিপ্ট লিখেছেন!

সৈয়দ হকঃ হ্যা একসময়ে কাজ করেছি, কিন্তু সত্তরের পরে আর সিনেমার জন্য কাজ করিনি। এখন শুধু লেখা। কবিতা, নাটক, উপন্যাস সব লিখছি।

শরৎঃ আপনি প্রায়ই বলে থাকেন, সব্যসাচী উপাধীটা আপনার পছন্দের নয়? আপনি বলে থাকেন মূলত আপনি একজন কবি!

সৈয়দ হকঃ না না, আমি সব্যসাচী উপাধি পছন্দ করছি না, তা বলি নি। কেউ যখন অংশত কোন পরিচয়ে পরিচিত করতে চায় তখন আমি কবি পছন্দ করি। কারণ যিনি কবিতা লেখেন তার কাছে অন্য কিছু তারই অন্তর্ভূক্ত। সব্যসাচীর বিষয়ে আমার আপত্তি নেই। তবে আমি তো বলেছি, আমাকে কিছুই বলার দরকার নেই।

শরৎঃ হুমায়ুন আজাদ একবার বলেছিলেন, বহুমাত্রিক যেসমস্ত লেখক আছেন তাদের ক্ষেত্রে যেটা সমস্যা হয় তা হচ্ছে পাঠক খেই হারিয়ে ফেলে। তাদের মূল্যায়ন অনেক সীমায়িত হয়ে পড়ে! কিন্তু যারা একটা বিষয় লিখছেন, কবিতা বা নাটক তাদের ক্ষেত্রে পাঠকের একটা সহজবোধ্যতা থাকে।

সৈয়দ হকঃ এগুলো নিয়ে আমার কোন সমস্যা নাই। কে কি বললো তা নিয়ে আমি তিলমাত্র চিন্তিত নই। আমার চিন্তা হচ্ছে লেখা হচ্ছে বা হচ্ছে না, কি লেখা হচ্ছে, এসব। লেখা আর লেখা।

কৌশিকঃ সারাজীবন আপনি লেখালেখি করেই বোধহয় জীবিকা নির্বাহ করছেন। বর্তমান প্রজন্মের কেউ বোধহয় এই সাহস করবে না!

সৈয়দ হকঃ কিন্তু এখন তো সুযোগ আরো বেশী।

শরৎঃ কিন্তু আপনি যখন শুরু করেছিলেন তখন একাগ্রচিত্তে এবং ভয় না পেয়েই আপনি লেখালেখি নিয়েই থাকবেন মনস্থ করছিলেন?

সৈয়দ হকঃ আসলে হয়েছে কি, সে সময়ের এই সিদ্ধান্তটাকে হয়তো একটা স্টুপিড সিদ্ধান্ত বলা হতে পারে, কিন্তু আমি তখন যে পুরো মননিবেশ করেছি তা কোন আদর্শ বা লক্ষ্য নিয়ে নয়, আমার স্রেফ আর কিছু করতে ইচ্ছে করে নি। মনে হয়েছে লেখালেখি আমার কাজ। এবং তখন আমার মনে হলো যে লেখাটা একটা চব্বিশ ঘন্টার কাজ। আর পাঁচদশটা কাজ করে, সাংবাদিকতা করে, অধ্যাপনা করে পুরো লেখায় মননিবেশ করা যায় না। আমি লেখালেখি করেই জীবন কাটিয়েছি, কোন অসুবিধা হয়নি।

কৌশিকঃ কিন্তু ঐসময়ের আপনার সমসাময়িকদের থেকে আপনি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী!

সৈয়দ হকঃ হ্যা, কেউ ভেবেছে অধ্যাপনা করবে। তারা হয়েছে। আবার লেখালেখি করেছে। কেউ ভেবেছে সে সাংবাদিকতা করবে আর লিখবে। এদুটো হচ্ছে লেখালেখির জন্য জনপ্রিয় পেশা। আমি সেভাবে দেখিনি। আমার মনে হয়েছে লেখালেখিতে যে সময় দেয়া দরকার সেটা দিয়ে আর কিছু করা যায় না।

কৌশিকঃ আপনি একজন পেশাজীবি লেখক। লেখার বাইরে আর কি কি করেন? ঘরসংসার আর সামাজিকতার? সেগুলোর মধ্যে কোন আলাদা ধরণ আছে?

সৈয়দ হকঃ আমার কাজ হচ্ছে লেখা, আর অবসর সময়ে ছবি আঁকার চেষ্টা করি।

কৌশিকঃ এছাড়া বোধহয় প্রচুর ভ্রমণ করেন। রাতদুপুরে আড্ডা দিয়ে বাড়ী ফেরা! হুট করে দূরে কোথায় চলে যেতেন। এখনও কি সেরকম কিছু করেন?

সৈয়দ হকঃ এখনও করি। এমনিই ঘুরে বেড়াই। এইতো দুয়েকদিনের মধ্যে কুস্টিয়া যাব। পথে কোথাও থামবো, দেখবো। অনেক কিছু দেখার আছে।

কৌশিকঃ কি দেখেন?

সৈয়দ হকঃ একটা সজীবতা দেখি। চারদিকে মানুষগুলো চলছে, ফিরছে, ঘুরছে, ক্ষেতে কাজ করছে, আমি দেখছি। কত রকম দেখার জিনিস আছে।

কৌশিকঃ আপনাকে তো অনেকেই চেনে, মানে টিভির বদৌলতে আপনার চেহারা অনেকের কাছেই পরিচিত হবার কথা!

সৈয়দ হকঃ হ্যা, তা ঠিক। একবার হয়েছে কি, আমার এক ইংরেজী লেখক বন্ধু জেরেমীকে আমন্ত্রন করে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলাম। আমি তাকে আমার দেশটা দেখে যেতে বলেছিলাম, কেমন আমার দেশ। সে ঘুরতে এসেছিল। জেরেমীকে নিয়ে বেড়িয়েছি, বরিশাল যাব। গৌরনদীর পরে একটা ফেরিঘাট আছে। সেখানে যখন অপেক্ষা করছিলাম ফেরির জন্য, অনেকে এসে সালাম দিল, চিনে ফেললো। হোটেলে খেতে ঢুকেছি। খাবার পরে হোটেলওয়ালা পয়সা নেবে না। পরে জেরেমী তার একটা প্রতিবেদনে লিখেছিল, যে দেশের সাক্ষরতার হার এত কম, সেদেশের লেখককে মানুষ এত সম্মান করে, হোটেলে খেলে পয়সা নেয় না, এটা একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা। মানুষ জানে বা না জানলেও অনুমান করতে পারে। কিছু মানুষকে দেখলে বোঝা যায়, আর সাধারণ মানুষ এটা ভাল বুঝতে পারে। অনেকেই এমন হয় জিজ্ঞেস করে, কোথায় আপনাকে দেখেছি। হয় কি অনেককে দেখলেই বোঝা যায় যে এ সরকারি চাকুরি করে, দেখলেই মনে হয় দোকানদারী করে, বা শ্রমিক। আপনি যে কাজ করেন তা আপনার শরীরেও একটা আলাদা গঠন দেবে। হয়তো আমার হাতে বই আছে, জিজ্ঞেস করে, কি করেন, আমি বলি, এই আছি, লেখাপড়া নিয়েই আছি। মনে করে আমি শিক্ষক। এখন অনেকেই মনে করে অবসরপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তা।

কৌশিকঃ অনেক জেলাই আপনি ঘুরেছেন। প্রত্যন্ত গ্রামে কি যান?

সৈয়দ হকঃ গিয়েছি। সেসব কথা তো আমার বইগুলোতে ঘুরে ফিরে এসেছে। বাংলাদেশে প্রায় চারশো সাড়ে চারশো গ্রাম জনপথে আমি গিয়েছি। বড় কোন শহরই তো বাদ নাই। একটা সময়ে সিক্সটি ফাইভ, সিক্স থেকে সেভেনটিটু পর্যন্ত ভ্রমণটা ব্যপক করেছি। তারপরে এই এইটিজ থেকে এখন পর্যন্ত আবার ঘুরে বেড়াচ্ছি। পনেরদিনের মধ্যে অন্ততপক্ষে পুরো তিনচারদিন বাইরে থাকা হয়। আমার স্ত্রী অনেকদিন লন্ডনে ছিল, এখন দেশে চলে এসেছে। সময় পেলেই দুজন বেড়িয়ে পড়ি। পশ্চিমবঙ্গেও প্রচুর ঘুরেছি, যেমন মুর্শিদাবাদ জেলা, গতবছর ঘুরেছি, এবারও যাবো, মুর্শিদাবাদ ছাড়িয়ে বীরভূমে!

কৌশিকঃ জায়াগা ঘুরে দেখাই কি উদ্দেশ্য?

সৈয়দ হকঃ মাটি তো একই। আসলে মানুষগুলো দেখা। জীব্নযাপন দেখা। তারা তো একটা সময় পর্যন্ত অন্তত আমার বাল্যকাল পর্যন্ত একই দেশই ছিল।

কৌশিকঃ ওখানের সাহিত্যিকদের সাথে কি দেখা হবে?

সৈয়দ হকঃ সাহিত্যিক তো সবাই কম বেশী পরিচিত আছে। তাদের সাথে তো যোগাযোগ হয়ই। তবে মানুষ দেখাই উদ্দেশ্য। সাহিত্য সম্মেলনগুলোতে যখন যাই তখন তো সবার সাথে দেখা হয়েই যায়। আমার দেশই তো ছিল, আমার তখন তেরো বছর যখন আলাদা হয়ে গেল।

কৌশিকঃ দেশ বিভাগের সময় একদিন আপনার শৈশবের এক বন্ধুর বাড়ীতে গিয়ে দেখলেন ওরা চলে গেছে!

সৈয়দ হকঃ সে দুঃখবোধ তো আছেই। কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ হচ্ছে দেশটার বিভক্তি। এটার কোন দরকার ছিল না। ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার কোন কারণ ছিল না। কারণ যেটা সেটা হচ্ছে এটা বাইরে থেকে তৈরী করা।

কৌশিকঃ মানে এধরণের ভাগাভাগির একটা বোধ নির্মাণ করা হয়েছে?

সৈয়দ হকঃ এমনিতে শুনতে এটা তেমনই লাগে, কিন্তু বিষয়টা এত পজিটিভ নয়। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত, বিভক্তি একটা ঐতিহাসিক শোক। আমি এই বিভক্তির একজন প্রত্যক্ষদর্শী। প্রত্যেকটা মানুষের একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা থাকে, আমার জীবনের সেটা হচ্ছে ভারত বিভাগ। ইটস নট দ্যা ইনডেপেন্ডেস অফ ইন্ডিয়া, এটা হচ্ছে পার্টশন অফ ইন্ডিয়া, আমি সেভাবে দেখি। উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে আরো আছে, যেমন বাহান্নো সালের ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্টের সরকার, আটান্নতে আইয়ুব খার সামরিক শাসন, ৬২ থেকে মানুষ কিভাবে এই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হচ্ছে, সেভেন্টি ওয়ান, এসব হচ্ছে একটা মানুষের জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ৭৫ এর বঙ্গবন্ধুর হত্যা, আবার এরপরে সামরিক শাসন, স্বৈরশাসন এসেছে, এ সবই হচ্ছে উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

কৌশিকঃ আপনি ভারত বিভাগকে ঐতিহাসিক শোক বললেন, কিন্তু আমাদের দেশে বেশীরভাগ মানুষতো বিষয়টাকে এভাবে দেখে না। আপনার কি মনে হয় ভবিষ্যত প্রজন্ম এটা অনুধাবন করতে পারবে?

সৈয়দ হকঃ না না, এটা তো আর এখন তেমন করে কেউ দেখে না। এটা দেখার কথাও না। এটা এখন জাতির স্তম্ভ হয়ে গেছে। যারা এই বিষয়টা খতিয়ে দেখে তারা কেবল বুঝতে পারবে, কেন এমন হলো। যেমন কোন রাজনীতিক জানবেন আসল বিষয়টা কি ছিল। সিপাহী বিপ্লবের কথাই ধরুন, সাধারণ মানুষ এ সন্বন্ধে কতটুকু জানে, কিন্তু যারা বিশেষ পড়াশুনা করে তারা এর মর্ম বুঝবে। এটা হয়ও না। এটা ভেতরে জীবন, যেমন আমার জীবনের সাথে আছে।

কৌশিকঃ ব্রাত্য রাইসুর সাথে এক সাক্ষাতকারে আপনি বলেছেন, আমাদের সাহিত্য শিশুতোষ সাহিত্য, এটার একটা মানে পৌছুতে এখনও ত্রিশ চল্লিশ পঞ্চাশ বছর লেগে যাবে।

সৈয়দ হকঃ আসলে সময় বেধে দেয়া তো যায় না, তবে আমাদের সচেতন হওয়া দরকার।

কৌশিকঃ বর্তমানে একটা প্রজন্ম রয়েছে যারা বাংলা ইংরেজী উচ্চারণের মত বলে, ভাষা অহেতুক বিদেশী শব্দে অচেনা করে ফেলছে। গানেও এখন এর ব্যবহার। আপনারা পঞ্চাশের দশকে বাংলা সাহিত্যকে উর্দুআরবীকরণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আজকের সাহিত্য তৈরী করেছেন। আজকের এই ইংরেজী সংমিশ্রন অনেকেই মনে করে অপভাষা, অপশিল্প, এর বিরুদ্ধ কোন আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন কি?

সৈয়দ হকঃ আমি এ বিষয়টা নিয়ে খুব চিন্তিত নই। এটা সামান্য একটা প্রবাহমানতা। আমি মনে করি না এটা এমন কোন সংকটের জন্ম দিয়েছে যে তা নিয়ে আমার ভাববার দরকার হবে। তবে আমি যেটা সংকট হিসাবে দেখি সেটা হচ্ছে এই যে আমরা মাতৃভাষা মাতৃভাষা বলে এত চ্যাচালাম, সেই ভাষা সম্পর্কেই সচেতন নই। মনযোগটা সেখানে দেয়া উচিত। আমার ভাল লাগে যখন দেখি অন্যভাষার লোকেরা বাংলার প্রতি যতœবান, বাংলায় একটা বই পড়ে!

কৌশিকঃ আপনি পার্বত্য চট্টগ্রামে একবার এক পাহাড়ী যুবককে দেখেছিলেন আপনার একটা বই পড়তে। দেখে আপনার ভীষন ভাল লেগেছিল।

সৈয়দ হকঃ হ্যা আমি তাকে বুঝতে দেই নি।

কৌশিকঃ অনেকেই বলে, এই আদিবাসিদের ভাষা বাংলার আধিপত্যে হারিয়ে যেতে বসেছে?

সৈয়দ হকঃ বাংলাও তো অন্য ভাষার আধিপত্যে পড়েছে, ভাষা সাম্রাজ্যবাদ আছে না! ইন্টারনেটে কোন ভাষার দখল? আজকে ইংরেজী ফ্রেঞ্চ, জার্মান ভাষাকেও কাবু করে ফেলেছে। এটা অন্য বিষয়, ছোট ভাষা, বড় ভাষা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেই ভাষা আমি আমার জীবন যাপনের জন্য কতটুকু ব্যবহার করতে পারছি। সেই সুযোগটা তাদের আছে কিনা। সেটা তাদের থাকতে হবে। সুযোগ নেই বলেই তারা বাংলা ভাষার কাছে আসছে। আমরা ইংরেজী তারিখ ব্যবহার করি, বাংলা কেন করি না? বাংলা তারা ব্যবহার করে যাদের এই মাসের সাথে কৃষিকাজের যোগ রয়েছে। তার কাছে শ্রাবন মাসে যে বর্ষা হয় সেটা জানা। আর আমি যখন জুলাই মাস বলি, তখন আমি জানি না এটা বর্ষার মাস নাকি শরৎ এর মাস। কারণ আমার জীবন যাপনের সাথে বাংলা ক্যালেন্ডারের যোগ নেই, ইংরেজীটার আছে। কাজেই ভাষা মরে যাচ্ছে বিষয় সেটা নয়, বরঞ্চ আমাদেরকে দিতে হবে তাদের এমন জীবন যেন তারা তাদের নিজেদের জীবনের সাথে মানানসই ভাষাকে লালন ও ব্যবহার করতে পারে, যদি তারা সেটা মনে করে। আমাদের দেশের ডাক্তাররা যখন ইংল্যান্ডে গিয়ে কাজ করে তখন সে ইংরেজীতে কথা বলছে না! আবার সে যখন দেশে আসে তখন সে তো বাংলাতেই কথা বলছেন। আদিবাসিদের এই সুবিধাটা থাকা দরকার, সে যখন তার জায়গায় যাবে তখন সে যেন তার ভাষায় কাজ করতে পারে। সে যদি চায় সে অন্য কোথাও গিয়ে কাজ করবে, চট্টগ্রাম, শেরপুর, মানিকগঞ্জ যেখানে সে সুবিধা মনে করবে।

শরৎঃ সেই ক্ষমতায়নের সুযোগ কি আদিবাসীরা পায়?

সৈয়দ হকঃ সেটা অন্য বিষয়। এটা বলছি না। বিষয় হচ্ছে ভাষা নিয়ে, সে তার কাজ পাচ্ছে কিনা, সেটা দেখা, তার ভাষা কাবু করে দিচ্ছে সেটা নয়, তাকে কি আমরা সেই সুযোগ দিচ্ছি?

শরৎঃ সেটাই তো প্রমান করছে রাষ্ট্র সেভাবে জায়গা দিচ্ছে না?

সৈয়দ হকঃ আমি সেটা অস্বীকার করি না। সেজন্য তাদের সুবিধা দেয়া হচ্ছে কিনা সেটা হতে হবে আমাদের অনুসন্ধানের জায়গা।

কৌশিকঃ আপনার বাহাত্তর বছর হয়েছে। দীর্ঘ একটা সময় কাটিয়েছেন। এর মধ্যে আপনার অত্যন্ত ঘনিষ্টজন কবি শামসুর রহমান মারা গেছেন, তার মৃত্যুতে শূণ্য বোধ করেন?

সৈয়দ হকঃ শামসুর রহমান আমার অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ট জন ছিলেন। কবি হিশেব যতটুকু শূণ্যতা বোধ করি তার চেয়ে বেশি করি ব্যক্তিগত একজন ঘনিষ্টজনের হারিয়ে যাওয়াতে।

শরৎঃ আপনি কি মৃত্যুকে ভয় পান?

সৈয়দ হকঃ না, একদমই না।

শরৎঃ মৃত্যুকে কিভাবে দেখেন।

সৈয়দ হকঃ সেটা আমার লেখাতে আছে। আমি যেকোন মুহুর্তের জন্য তৈরী। এই মুহূর্তে হলেও আমি তৈরী। কারণ যেটা নিয়ে চিন্তা করে কিছু করা যাবে না, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তিত হবার কিছু দেখি না। বরঞ্চ আমি ভীত হবো হাইজ্যাকারে ছুরিতে।

কৌশিকঃ এমন একটা সময় কি ছিল যখন ভয় পেতেন?

সৈয়দ হকঃ আমার এমন ভয় ছিল না। আমি সাহসী নই, তবে ভয় আমি পাই না। আমার মধ্যে কোন শূণ্যতার ভয় নেই। আমার কাছে শূণ্যতা বলে কিছু নেই। আমার সবসময় কিছু না কিছু অবলম্বন আছে। অনেকে আছে একটা জায়গায় অপেক্ষা করছে কয়েকঘন্টা ভীষণ বিরক্ত হয়ে। আমার তেমন হয় না। আমি দেখেছি ঐ ঘন্টাখানি কত সময়, আমার কত কিছু ভাবনা করার আছে। আমি চিন্তা করি। চারপাশে কত মানুষ আছে, কথা নয় কেবল দেখলেই সময় কেটে যায়। একটা মানুষের মুখ বিবর্ণ কেন, আরেকজনের উজ্জ্বল কেন সেসব দেখার বিষয়। এয়ারপোর্টে দুঘন্টা ডিলে হলো, লোকজন অস্থির হয়ে ওঠে। আমার মজাই লাগে। দুঘন্টা লেটে দশজনের মানুষের মধ্যে দশধরণের প্রতিক্রিয়া দেখি। কেউ ভীষণ বিচলিত, কেউ সমালোচনামুখর।

কৌশিকঃ অপেক্ষার এমন কোন প্রহর কি বিরক্ত লেগেছে জীবনে?

সৈয়দ হকঃ না কখনই না। আমার সবসময় একটা অবলম্বন ছিল। কবিতা লেখার জন্য আমি তেমন সময় ব্যয় করতে পেরেছি।

কৌশিকঃ বিশেষ করে সেই সময়টাতে যখন বিয়ে করেননি, সে সময়ের অপেক্ষাগুলো?

সৈয়দ হকঃ না না কখনই এমন বিরক্ত লাগে নি। আমার মনে হয়েছে অনেক কাজ করা যায়। একজন লেখককে চারপাঁচঘন্টা লেখার জন্য দিনে কমপক্ষে তিনচারঘন্টা পড়া উচিত। এই যে আমার লাইব্রেরীতে এখনও হাজারখানেক বই রয়ে গেছে যা আমি পড়তে পারিনি। তারপরে অনেক রকম লেখা নিয়ে আমি ভাবি। অনেক রকম বিষয়। কাজেই কিছু না কিছু ভাবনা আমার সাথে থাকতোই অপেক্ষার প্রহরগুলো অতিবাহিত করার জন্য। তারপরে আমার একটা পারিবারিক দায়িত্ব আছে। আমি আমার পরিবারে বড় সন্তান। নানারকম কাজ করতে হয়। সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। অনেকে আসে উপদেশের জন্য, অনেকে অনেক রকম সমস্যা নিয়ে আসে সেগুলো আমাকে ভাবায়। দেশ আছে, রাজনীতি আছে। বন্ধুবান্ধব আছে, সময় কোথায়? একটা জীবনে একটা মানুষ কত কাজ করতে পারে।

শরৎঃ একজন লেখক তার লেখক স্বত্বা জেগে ওঠার পরে একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত? সে যখন লিখতে বসে তার আগে পর্যন্ত সে চারিপাশ থেকে সবকিছু উপভোগ করে, সংগ্রহ করে, তারপরে তারমত করে রূপ দেয়ার চেষ্টা করে?

সৈয়দ হকঃ শুনতে ভালই তো শোনাচ্ছে। চারদিক থেকে সংগ্রহ করে একা বসে লিখছে বিচ্ছিন্নদ্বীপে, হ্যা তাই তো। লেখার কাজটা তো খুব নিঃসঙ্গের কাজ, বোরিং কাজ। দ্বীপ কিনা জানি না তবে এটা বেশ লোনলি জব। এটা নাটক নয়, যে সবাইকে নিয়ে একসংগে মহড়া দিয়ে তৈরি করে ফেললাম। বা এটা গান নয় যে তবলচি আছে, সারেঙ্গিওয়ালা আছে, রেকর্ডিস্ট আছে। এটা আসলেই নিঃসঙ্গতার কাজ। তারপরে প্রচুর সময় দিতে হয়, দুমিনিটেই কিছু লিখে ফেলা যায় না। পুরোটুকু সময় দিতে হয়। এমন সময় লিখেছি সবাই যখন আড্ডা দিচ্ছে, বেড়াচ্ছে।

শরৎঃ তবে এটা একটা দীর্ঘ আনন্দদায়ক বিষয়ও বটে!

সৈয়দ হকঃ হ্যা তাতো বটেই। আমার কথা তো লেখাতেই থাকে। এই সাক্ষাতাকার দিয়ে কি হয়। এখনও বেঁচে আছি বলে লোকজন আসে। কিন্তু মানুষ জানবে ঐ লেখা দিয়ে। মাইকেলের জীবন সন্বন্ধে আমরা কতটুকু জানি? কিন্তু তার লেখাগুলো আছে আমাদের কাছে। আজকে শামসুর রহমান একবছর হয় মারা গেছেন, এখনই তার কবিতা পড়া কমে গেছে। একসময় এই লেখাও থাকবে না। রবীন্দ্রনাথের ক’টা কবিতা আমরা পড়ি। দশটা কবিতার নামও মানুষ উল্লেখ করতে পারবে না। বিশটার বেশী গান শোনে না। জীবনানন্দের ঐ বনলতা সেনই রয়েছে বেঁচে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০০৮ সকাল ১১:৩৬
১০টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×