টানা বৃষ্টির জবরদখলে এবার শরত এল ক্লাসে লেট হওয়া ছাত্রের ভীরুতায়। তবে এসেই নীল খামে সাদা মেঘের পোস্টকার্ড পাঠিয়ে আসবার জানান দিতে দেরী হয়নি। প্রতি বছর আশ্বিনের শুরুর দিনগুলো এলেই আমার মনটা ভারী খুশি হয়ে যায়। সত্যি কথা বলতে কি আমি বোধ হয় সঙ্গোপনে অপেক্ষাও করি এই সময়টার জন্যে। করবার কারণও তো থাকে।
এই দেখইনা, এই সময়টায় কত মজা হয়। আকাশটাকেই দেখ, কী গভীর নীল হয়ে থাকে। সেই ঝর্নার নিচের রঙিন নুড়িগুলোর মত রোদ ঝলমলে নিটোল এক একটা দিন। উঠোনের সিঁড়িটার শেষ ধাপে বসে চারপাশের ঝেঁপে থাকা গাছপালা, তার ওপরের আশ্চর্য নীল আকাশ আর ঝলমলে রোদের দিকে তাকিয়ে মনে হয় চারপাশে অদ্ভুত এক প্রশান্তি আলো আলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। সূর্যের আলোটা পাতাগুলোয় ঠিকরে পড়ে যেন সবজেটে হয়ে ছড়িয়ে যায় এদিক ওদিক । সেই আলো গায়ে মেখে বুলবুলিগুলো ঝাঁকবেধে সজনে গাছটার নিচু ডালটায় বসে সেই সকাল থেকেই শুরু করে বকরবকর...
স্মৃতির ভেলায় ভেসে আসে হিমেভেজা ঘাসেদের ওপর বিছিয়ে থাকা শিউলির চাদর...সেই শিশির আঙ্গুলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ফুল কুড়োতাম আমরা। সেই কোন ভোরবেলায় উঠে কার মালাটা কত বড় হল তাই নিয়ে কি ভীষণ এক হুড়োহুড়ি। একটু বাদেই অমল কাকাদের বাড়ি থেকে শাঁখের পোঁ সহ ধুপের গন্ধ আর ঢাকের ডুম ডুম ভেসে আসত। ওমনি বাতাসটায় কেমন পূজো পূজো ঘ্রাণ হয়ে যেত। ওদের পূজো হলে আমাদের কোন লাভ লোকসান নেই বটে কিন্তু ওদের খুশিটা উচ্ছ্বাসটা আমাদেরও ছুঁয়ে যেতই। সুস্মিতা অনামিকারা পূজোর জামা কাপড় কিনলে মা আমাদেরও একটা করে আটপৌরে জামা করে দিতেন। কি ভালো যে লাগত। বাণী মাসি ধরে নিয়ে গিয়ে কাঁসার রেকাবিতে করে কতরকম মিষ্টি খাওয়াতেন। খাওয়া শেষে দুটো নাড়ু ফ্রকের পকেটে ভরে থুতনি নেড়ে দিয়ে বলতেন, বিকেলে আবার আসিস কিন্তু ! সাথে বোনাস হিসেবে তিন দিনের মাইকে করে হিট সব পূজোর গান শুনতে পাওয়া যেত। অচেনা কি এক গায়ক দরদ দিয়ে বলত, "মাধবী ফুটেছে ওই !" সাথে সাথে গায়িকার সাথে গলা মিলিয়ে আমরাও বলে উঠতাম "হ্যাঁঅ্যা" আর গড়াগড়ি দিয়ে কি হাসি। প্রতিমা দর্শন, গুড়ের জিলাপি, চালতার আচার, হজমি বড়ি সহ পূজোর মেলার সাড়ে সতের মজা তো এন্তার চলত। আর একটা দারুন মজা কি বলতো ? সে হল পূজো সংখ্যা। ওফ, গরমাগরম গল্পগুলো এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলতে কি দারুণই না লাগত। বছরের আর সময়টায় যে এমন হয় না ।
ছেলেবেলার এই দিনগুলো সেইভাবে ফিরে আসেনা কখনও। আসাটা বোধ করি উচিতও নয়। সেই দিন গুলোর মত স্বচ্ছতা কই আর আমাদের মাঝে। সময়ের পলি জমে ঘোলা হয়েছি কত। তার থেকে এই ভাল। এই দূরে দূরে থেকে মনে করা। অপূর্ব মায়ার ঘ্রান মেশানো ছোট বেলার সেই দিনগুলো মেঘের ভাঁজে পুরে বুকের গহীনে লুকিয়ে রাখি। তুলো তুলো মেঘেদের দেখেই তাই দুম করে মনে হয়ে যায় পুরনো দিনের কথা।
আজ ভীষণ মন ভালো দিন।
অনেক অনেকগুলো দিন পরে এই শরতদিনে বাঁচতে ভালো লাগলো আজ। দুপুরে জানলাটার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে বড় ভালো লাগলো আবার। তাকিয়ে দেখলাম জানলার জাফরির ওপারে ইলেকট্রিকের তার...তার ওপারে পুরনো কুৎসিত ঘরবাড়ি...কিন্তু তার ওপারে ? তার ওপারে এক চিলতে ঝলমলে নীল আকাশ। ওই অদ্ভুত গভীর নীলটার দিকে তাকিয়ে এক লহমায় মন ভালো হয়ে গেল । দেখলাম... দেখলাম...দেখলাম দু চোখ ভরে ওই আকাশ। ওই চিলতে আকাশের নীল বেয়ে ভেসে যাওয়া সাদা মেঘের টুকরোটাও কি থেমে আমাকেই দেখল কতক্ষণ ? দেখে কি ভাবতে ভাবতে আনমনে ভেসে চলে গেল যেন। ওই রোদেলা দুপুরটায় ওই টুকরো নীল-সাদা মাখতে মাখতেই আবার বেঁচে উঠতে বড় ভালো লাগলো। আবার ভাবতে ভালো লাগলো আমার জীবনে তুমি আছ। আর তাইতেই বোধ হয় আমার মেঘলা আকাশটা রোদের আলোয় হেসে উঠল ঝলমলিয়ে ।