বাবার সহজ-সাধারণ গভীর মমতামাখা মুখটা মনে পরলেই
আমাদের চৌরাস্তার মোড়ে হাজার বছর ধরে দাড়িয়ে থাকা...
বটগাছটার কথা মনে পরে,
রোদ-বৃষ্টি আর ডাকাতে ঝড় ঝাপটা মাথায় নিয়ে
বটগাছটা যেমন চলমান পথিকের নিরন্তর সঙ্গ দিয়ে চলছে
বাবাও যেন আমাদের ওপর প্রশান্তি আর নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার
এক অদৃশ্য ছায়া হয়ে দাড়িয়ে আছে সেই আবহমান কাল ধরে
শৈশবে, বাবার দুবাহুর মধ্যিখানে ঘুমানোর সময়
বুকের লোমশ জমিনটাকে মনে হতো,
প্রকান্ড একটা সবুজ মাঠের মতো
আমি যেন সেই কতকাল ধরে,
সবুজ মাঠটার একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত
নিরন্তর দোড়াচ্ছি, দোড়াচ্ছি আর দোড়াচ্ছি..............
বাবা আমাকে,
'অ' তে অজগর না শিখিয়ে
'অন্যায় থেকে বিরত ' শেখালেন
'আ' তে আম না শিখিয়ে
'আশা'র সমান বাঁচতে ' শেখালেন ।
আমার নিকট বাবা হয়ে উঠলেন
মহানায়কের মতো, শ্রেষ্ঠতম এক শিক্ষকের মতো
বাবা আমাকে হাত ছেড়ে দিয়ে হাটতে শেখালেন
স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় 'বিস্কুট দৌড়' এ হেরে গিয়ে
কান্না করতে করতে বাড়ি ফিরলেও,
বাবা কখনো আমারচোখের পানি মুছে দেননি
সহজ কৈশোরে বাবা আমাকে কঠিন জীবনের
দীক্ষা দিয়েছিলেন।
প্রতিবার জ্বরের ঘোরে মাঝরাতে, আলো ছায়ার খেলায়
আমি আমার শিয়রের পাশে এক জাদুকর কে দেখতাম
আমার সেই জাদুকর বাবা আমার কপালে হাত রাখলেই
আমি যেন সুস্থ হয়ে উঠতাম, আমি যেন বেঁচে উঠতাম
আমি যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেতাম।
আমার বাবা,
মোমের আলোর মতো পবিত্র
আমার বাবা,
কাক ডাকা ভোরে মুয়াজ্জিনের আযান
আমার বাবা,
সুনীলের ভুবন ডাঙার হাসি
আমাট বাবা,
উথাল-পাতাল বৃষ্টির পর এক ফালি রোদ্দুর
আমার বাবা,
চিরহরিৎ বনে হরিয়ালের ডাক
আমার বাবা,
মিটিমিটি সন্ধ্যায় জোনাকি পোকার গান
আমার বাবা,
নবান্নের উৎসব, হেমন্তের ধানে মুহুর্মুহু ঘ্রাণ
আমার বাবা,
শরতের সকাল জুড়ে একবুক নীলাকাশ
আমার বাবা,
প্রমত্তা পদ্মার উঠোনে আয়েশি মাঝির পাল তোলা নৌকা
আমার বাবা,
আউশ ধানের ক্ষেতে হাওয়ার দোল লাগা
আমার বাবা,
অবিরাম বর্ষায় টিনের চালে ঝুমঝুম বৃষ্টির শব্দ
আমার বাবা,
প্রজাপতির ডানা, শীতের পাতার মর্মর ধ্বনি
আমার বাবা,
শান্ত নদী ধেয়ে চলা একঝাঁক পানকৌড়ি।
আমার বাবা,
দোয়েলের শিস
ছাতিমের ডালে বাবুই-মুনিয়ার ডাক
ঘুমপাড়ানি দুপুরে ঘুঘুর ঠোটে 'ওম' ধ্বনি
আর মধ্যরাত ফুড়ে বিশুদ্ধ জোছনার
বুকের ভিতর হাহাকার করা হাতছানি।
আমার বাবা অনেকটা,
জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো
এস.এম সুলতানের চিত্রকর্মের মতো
আমার বাবা অনেকটা,
গানওয়ালার শ্রেষ্ঠ গানের কথামালার মতো
লেলিহান দুপুরে অনেক দূর থেকে ভেসে আসা
রাখাল বালকের বাঁশির সুরের মতো
আমার বাবা অনেকটা,
বীণার চিকন তারে সুরের মিহিপ্রাণ স্নিগ্ধ আর
রবি ঠাকুরের ছোট গল্পের মতো জীবন্ত।
আমার বাবা যখন হেসে উঠে,
মনে হয় পৃথিবীর সব ময়ূর
পেখম মেলে আনন্দের ঝংকার তুলছে।
আমার বাবা যখন,
ডাহুকের মতো বিষন্ন চোখে তাকায়, মনে হয়
আকাশের সব মেঘমল্লার দল
অভিমান করে জমিনে খসে পড়ছে।
আমার বাবা যেখান থেকে শেষ করেছিলো,
আমি সেখান থেকেই শুরু করেছি।
আমার বাবা ছিলেন,
শিমুলতলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দরিদ্র কেরানীর মতো চাহিদাহীন
আমার বাবা ছিলেন
পোস্ট অফিসের সাদামাটা ডাকপিয়নের মতো অভিমানহীন
কখনো কোন বড় আয়োজনে বাবাকে আমি নতুন পোশাক কিনতে দেখেনি। অথচ
প্রতিটি উৎসবে আমাদের জন্য নতুন জামা কিনবার জন্য
বাবা পৃথিবীর মানচিত্র উপড়ে ফেলতেন।
তবুও আমার বাবা ছিলেন,
কৈশোরে ওড়ানো ঘুড়ির মতো রঙিন
আশ্বিনের ঝিলের মতো স্বচ্ছ
কুয়াশার চাদর ভেদ করা সূর্যের মতো দৃপ্ত আর
দুচালা টিনের চালের নিচে আমাদের নিয়ে জড়োসরো হয়ে
বাস করা পৃথিবীর এক সুখি মানুষ।
আমার বাবা ছিলেন,
অখ্যাত এক 'মানবিক মানবের ' নাম
আমার বাবা, তোমার বাবার মতোই 'মধ্যবিত্তের আদর্শ '
খেটে খাওয়া সংসারের সদা জাগ্রত সৈনিক
প্রতি সকালে জীবন যুদ্ধ জয়ের মন্ত্র কৌশল।
আমার বাবা এখনো আছেন,
আমার সেই আদিম শৈশবের মতো
এখনো বাবা জায়নামাজে দাড়িয়ে উচ্চস্বরে ফাতিহা পাঠ করেন, শুধু রেশমের তুলার মতো বাবার সেই নরম দরাজ
গলাটি বয়সের ভারে ভারী হয়ে উঠেছে।
চাতক পাখির বাসার মতো বাবার সেই তীক্ষ্ণ আখি জোড়ায়,
চামড়ার স্তরে, ঘন কালো চুলে, স্মৃতির কোঠরে
বার্দ্ধক্য এসে হানা দিয়েছে!!
হয়তো বাবা একদিন থাকবেনা,
তবুও বাবা থাকবে
আমারর চিন্তায় চেতনায়, আমার আদর্শে
আমার মমন-মস্তিষ্কের আনাচে কানাচে
বাবা থাকবে,
আমার চোখের পাপড়িতে, কপালের ভাজে
আমার হাতের তালুর বক্ররেখায়
বাবা থাকবে,
আমার ফুসফুস থেকে বের হয়ে আসা প্রতিটি হাসিতেতে
আমার গাল বেয়ে নেমে আসা কান্নার বিন্দু জলে
বাবা থাকবে,
আমার রক্তধারায় প্রবাহমান অভিমানী স্রোতে
আমার হৃদপিন্ডের প্রতিটি ধুকধুকানিতে।
ভালো থাকো বাবা, বেঁচে থাকো বাবা
ভালো থাক পৃথিবীর সকল বাবা।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:২০