ক্যাবিনের দরজায় টোকার শব্দে সম্বিত ফিরে পেল নীহারিকা; তার অতীত-আর্তি তে বাধা পড়ল, একরকম বিরক্তির গলা নিয়েই আগন্তুকের পরিচয় জিজ্ঞেস করল। “আমি এই ক্যাবিনের গ-৩ এর যাত্রী”, অপর পাশ থেকে ভেসে আসল। নীহারিকা সবে মাত্র বোধ করল ট্রেন তার চলমান অক্ষাংশ থেকে ক্ষণিকের বিশ্রাম নিতে সেই কবে এসে নিরাশবাগিচা ষ্টেশনে থেমেছে। দরজা খুলতেই এক কিশোরীর আবির্ভাব দৃষ্টিগোচর করল নীহারিকা। শালুকরঙা সিল্কের কাপড়ের উপর কাশের নিখুঁত কারুকার্য যেন মেয়েটির ঠিকরে পড়া লাবণ্যের পরিপূরক। চোখের মলিন চাহনি কেন জানি কিশোরী টির অন্তরাধিষ্ঠিত আত্নার সম্মুখ কোঠর ডিঙ্গিয়ে সেই আত্নাকে পরিভ্রমন করার ইচ্ছে জাগাল নীহারিকার মনে, সচরাচর এমন হয় না! নিজের প্রতি নিজেই অবাক হল সে। পরক্ষণেই নিজেকে দমিয়ে নিল।
কিশোরীঃ ম্লান বদন লুকিয়ে যতটুকু সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে হাই, আমি সিহা। [করমর্দনের হাত বাড়িয়ে] আপনি?
নিহারিকাঃ কিশোরীর ম্লান বদন এবং তার বর্তমানের সাথে সামঞ্জস্যের পরোক্ষ দূরত্ব নির্ণয় করে আমি নীহারিকা। পরিচিত হতে পেরে আনন্দিত আমি [এক ফালি মৃদু হাসি হেসে], অন্তত গল্প করার মত কাউকে পাওয়া গেল!
সিহাঃ হাঁসির বৃথা চেষ্টা করে নাইস টু মিট ইউ।
একদা নীহারিকা তার মেঝ খালা তূর্ণার সাথে পশ্চিমাঞ্চল এর মাত্রিনগরে গিয়েছিল তৎকালীন সাফারি পার্কে; ঘুরতে ঘুরতে একটি সাদা ভালুকের আলয়ে এসে ভালুক ছানা টি কে আদর করতে লাগল; পরিদর্শন-কর্মী চাচ্চুর কাছে বায়না ধরল যাওয়ার সময় ছানাটি তাকে দিতে হবে। তখন বোধ করি তার বয়স ৩ বছর ৬ মাস কি পৌনে চার বছর হবে। বেলাশেষে গোধূলির আলো যখন পার্কের কার্যদিবসের সমাপ্তির শিঙ্গা ফুকাল তখন বেশ প্রফুল্ল মনে ভালুক ছানা টিকে নিতে যাবে তখনই দৌড়ে পালাল ছানাটি। কাঁদতে যাবে ঠিক তখনই মেঝ খালার প্রিয় পরিচিত ব্যাঙ্গকীর্তি তার ক্রন্দন-অভিমুখী মুখকে হাসাতে বাধ্য করল, কিন্তু সে নিজে ই জিনিসটা খেয়াল করল, এই হাঁসিটা যেন খুব অন্যরকম লাগছে তার কাছে, শিশুসুলভ মন থেকে কান্নার মৃদু চাপ উঁকি দিয়েও আবার চুপিসারে ডুব দিয়ে হারিয়ে গেল। আবার স্বাভাবিক ভাবে হাঁসতেও পারলনা , ঠিক এমনই এক ধরণের অভিব্যাক্তি লক্ষ্য করল সিহার মুখে।
সিহা জানালার বাইরে নিথরপ্রায় অর্কের দিকে তাকিয়ে অঝোরে চোখের পানি ফেলল; পরক্ষণেই নীহারিকার উপস্থিতি অনুধাবন করে নিজেকে সামলিয়ে নিল। নীহারিকার কাছে মুহূর্তখানেক আগে সিহার ম্লান বদন এবং অভিনীত অবয়বের সামঞ্জস্যের দূরত্বের নিহিত কারণ পরিষ্কার হয়ে গেল। সুপ্ত একটি তীর যেন হঠাৎ জেগে উঠলো; সজোরে এসে বিঁধল নীহারিকার মনে। “না, শক্ত হও নীহারিকা, নিজে কে নিজে বলল, তুমি ভেঙ্গে পড়তে পার না”। অতীত অভিজ্ঞতার আরোপে সিহার আসন্ন পরিস্থিতি ঠাহর করে সিহা কে মন হাল্কা করতে বলল। সিহা কর্ণপাত না করে ই, “ ওর সাথে অনেক দিন দেখা হবে না সেটার জন্য কাঁদছি না আমি!” নিতান্ত ই কোন শ্রেষ্ঠতর কারণ না থাকলে কেউ এইরূপ পাহাড়ক্রন্দন তথা ঝর্ণার ন্যায় অঝোরে কাঁদে না। নীহারিকা কে অনেক অবাক করল সিহার কথাটি, কি এমন কারণ থাকতে পারে যা সিহার অঝোর কান্নার নিহিত সচরাচর কারণ গভীর ভালোবাসার অনুভুতি থেকেও শ্রেষ্ঠতর? অবশেষে জিজ্ঞেস করে বসল সে সিহাকে, “অন্য কি এমন কারণ, জানতে পারি কি?”
সিহাঃ অবশ্যই! তাহলে শুনুন। সিহা যৎসামান্য বিরতি নিল; অর্ধ যুগ আগে অর্কের কণ্ঠে বিশ্রুত অপূর্ণাঙ্গ তথাপি অকল্পিত আত্মকথাগুলো মিহি করে নিতেই এই বিরতি। অতঃপর নীহারিকা কে বিদিত পূর্বক কর্তৃকারকের ভূমিকায় সিহা গোড়াপত্তন করল.........
অর্কঃ আচ্ছা সিহা, বলতে পারিস তরুশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্তেও আমরা কিছু উদ্ভিদকে আগাছা কেন বলি? না সূচক মাথা নাড়াল সিহা। মাত্রিবৃক্ষের পদতলে একটি নবজাতক তৃণ তাঁর পরম ছায়ায় বড় হয়ে উঠার আগেই বাগের মালিক যখন নিদারুণ দর্পে মাতৃস্নেহের বন্ধন কর্তন করে ঠিক তখনই শাবক[!] চারাটি তৃণমূল উৎপাটিত হয়ে আগাছার পরিচিতি বহন করা শুরু করে।
সিহাঃ বেশ! তা এখন হঠাৎ এই প্রসঙ্গের হেতু জানতে পারি কি?
অর্কঃ সিহা, আমি একটি আগাছা। তোদের মত মাতৃছায় বেড়ে উঠার সৌভাগ্য আমার কাছ থেকে বিধাতা আপন হাতে অপসৃত করে দিয়েছিল জীবনের প্রাথমিক লগ্নে।
সিহাঃ মানে...
অর্কঃ আজ বড্ড ইচ্ছে করছে বিধাতার সম্মুখীন হতে। নিজেকে অনেক হীনবল মনে হয় বিধাতার সৃষ্ট সকল সৃষ্টির কাছে তথাপি স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার সম্মুখীন হতে আজ অনেক বলীয়ান মনে হচ্ছে নিজেকে। একটু বিরতি নিল অর্ক।
সিহা নির্বাক হয়ে রইল। প্রথমত অর্কের কথা গুলো মেকি শুনাল তার কাছে; কিন্তু যামিনীর চাঁদের গায়ে যে ক’ফোঁটা কলঙ্ক বিদ্যমান, তা গগনের কালো মেঘের আড়ালে নস্যি হয়ে যায়। অর্কের কথামালা কে মেকি শুনালেও তার ভাষা প্রকাশের মুখাবয়ব সিহাকে নিশ্চিত করল অর্কের কথায় এতটুকুন ভুল থাকতে পারে না। ঐ অদূরে কাশফুল বিস্তৃত তুলাপুস্কুরনি জমিদারবাড়ির পরিত্যক্ত ধানক্ষেত গুলো দেখা যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে দু’জন কাশফুল দের প্রায় কাছাকাছি এসে পরিত্যক্ত ধানক্ষেত গুলোর পাশেই উঁচু বেড়িযুক্ত আয়তাকার পুকুর পাড়ে এসে বসল। এদিকটা অপেক্ষাকৃত নির্জন। বায়ু প্রবাহ হচ্ছিল দক্ষিন-পূর্ব কোণ থেকে; অর্করা বসেছিল সমীরণের বিপরীত মুখী হয়ে। সিহা এবার জিগ্যেস করে বসল অর্ককে, “অর্ক, তুই কি বলতে চাচ্ছিস, আনটি...”
অর্কঃ থেকেও নেই।
সিহাঃ যেমন?
অর্কঃ ছাত্রজীবন যখন প্রাথমিক এর দোরগোড়ায় মাত্র, আমার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে। বিচ্ছেদের পর থেকে মায়ের অন্যত্র বিয়ে হওয়ার মাঝে যে সময় টা ছিল তখন আমি নানাবাড়ি তে মায়ের সাথে থাকতাম। কিন্তু সেই দ্বীপ টুকুও মৃদু হয়ে এলো একদিন, আমার দাদি এসে আমাকে নিয়ে গেল জোর করে এই বলে, “তোর মা ক’দিন পরেই আসবে”। মা-বাবা কে আর কোনোদিন একসাথে দেখতে না পারা যে তাঁদের বিচ্ছেদের সর্বোপরি পরিনাম হবে তা তখন বুঝি নি রে [ক্রন্দনমুখী হয়ে আসছিল অর্কের গলা, এই প্রথম সিহা অর্ককে ক্রন্দনমুখী দেখল]। কি জানি বিধাতা কি ছলে মাকে না দেখার বিষয়টা চাপিয়ে রেখেছিল আমার কাছ থেকে। পরিস্থিতির অনেকটা অনুকূলে চলে আসলাম; বাবা আমাকে ভর্তি করিয়ে দিল একটি বেসরকারী বিদ্যালয়ে। আমার দেখাশোনা করত আমার দাদি আর ছোট ফুপু। আচ্ছা, তোর কি কখনও এমন টা অনুভব হয়েছিল যে তুই একটা জিনিস অনেক চাস কিন্তু কিছু একটা অবিদিত কারণে তুই আপনা থেকেই ঐ জিনিসটা তোর প্রতিকূলে ভেবে নিজেকে বর্তমানের সাথেই সম্পৃক্ত করে নিস? সিহার উত্তরের অপেক্ষা না করেই , আমার মা নেই, আমি মায়ের কাছে যাব এই অনুভূতিটা অনেক কড়া হচ্ছিল দিনের পর দিন কিন্তু কেন জানি দাদি-ফুপুর সাথেই নিজেকে মানিয়ে নিলাম। কিন্তু, বিধি বাম; বিধাতা আমার উপর দ্বিতীয় আঘাত টি হানল। বাবা বিয়ে করল আবার। কথা চালিয়ে যেতে পারলনা অর্ক। কি জানি, সুপ্ত তীর টা হঠাৎ করে আবার বাণ মারল বোধহয় অর্কের বক্ষপ্রদেশে!
এক মুহূর্ত বাকরুদ্ধ থেকে অর্ক আবার শুরু করল Jean Piaget নামক একজন খ্যাতনামা সাইকোলজিস্ট বলেছিলেন যে একটি মানুষ তার জন্মের ৭ বছর থেকে ১১ বছর পর্যন্ত Concrete Operational Stage এর মাধ্যমে আত্নক্রমবিকাশ করে। সে বিমূর্ত এবং প্রকল্পিত ধারণার সঙ্গে লড়াই করে থাকে কেননা সে সবে যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে শেখে কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভাবে তার মত অন্য কেউ চিন্তা করেনা যার ফলশ্রুতিতে নিজের চিন্তাকে অস্পষ্ট মনে করে। এ সময়টাতে একটি বিশেষ্যের স্থিরতা একটি বাচ্চার ক্রমবিকাশে সুবিপুল প্রভাব ফেলে, Concrete Operational Stage যত পূর্ণতা পায় তত বাচ্চাটি ন্যায়িক যুক্তির মাধ্যমে নিজেকে পরিবেষ্টিত করা সবকিছুকে নিয়েই বাঁচতে শিখে। সিহা, আমার পরিবেষ্টিত সমাজও আমার মায়ের অস্তিত্ব সাময়িক মুহূর্ত কতকের জন্য লুকিয়ে রেখেছিল আমার কাছ থেকে।
“এই, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, বাসায় যাবিনা?” আর্দ্র এবং আনমনা কন্ঠে অর্ক সিহাকে জিগ্যেস করে। সিহা তখন অন্য একটি কাল্পনিক তত্সত্ত্বেও এক মহান সত্যের জগতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। যে জগতে সে কাল্পনিক সামগ্রী দিয়ে আবিষ্কার করতে চেষ্টা করছে অর্কের বৃত্তান্তের প্রতিটি অনু-পরমাণুরাজি কে। “কিরে?” হালকা কনুইয়ের গুঁতো দিল অর্ক এবার। অকস্মাৎ বাধায় চমকে উঠে “হুহ” শব্দ করল সিহা। “ক-কিছু বললি?”
“হু, বলছিলাম সন্ধ্যা তো হয়ে এলো, বাসায় ফিরবি না?”
“কিন্তু, আমার যে জানার স্পৃহা আরও বেড়ে গেছে অর্ক!” অনেকটা আবেগচিত্তে কথাগুলো বলল সিহা অর্ককে।
“অন্য আরেকদিন বলব নে! ”
একটা ব্যাপার লক্ষ্য করল সিহা, অর্ক তার জীবন বৃত্তান্ত বিবৃত করার সময় খুব কমই কাঁদল! অনেক ভাবাল এটা তাকে। সে নিজেকে প্রশ্ন করল, “অর্ক কি তাহলে বানানো গল্প বলছে আমার কাছে? কিন্তু কেন?” কিন্তু আবার এটাও লক্ষ্য করল যে যদিও অর্কের মুখে বাঁধভাঙ্গা কান্নার কোন আভাস নেই, তার মুখাবয়ব বলছে অন্য কথা। পরস্পরকেন্দ্রিক চিন্তা দু’টি তার কাছে অর্কের গল্প বলার ভাষা কে অসঙ্গতিপূর্ণ করে তুলছে। অবশেষে নিজেই তার উত্তর খুঁজে পেল সে, সদ্য কাটা গায়ে একাধিক বার আঁচড় কাটলে নতুন আঁচড়ের রক্তবিন্দু পুরাতন রক্তবিন্দু কে প্রতিস্থাপিত করতে ব্যর্থ হয়, বৈ কি! তেমনি, অর্কের দুঃখভার জীবনের গল্প তার নিজের কাছে নতুন কিছু নয়, সে এসবের সাথে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়েছে, অনাক্রম্য হয়ে গিয়েছে তার অনুভুতির দল।
“আচ্ছা ঠিক আছে, আজ রাতে বলিস! ” সিহা উত্তর দিল।
“আজ রাতে? কিভাবে? আমার কাছে তো মোবাইল নেই!”
“আরে গর্দভ, আমি তোর আপুর বাসায় আসব আজকে, নুপুর বলছিল নুপুরের কাছে সেবা প্রকাশনির নতুন কিছু বই আছে, ওগুলো আনতে যাব, তখন বলিস।”
প্রিয় পাঠক, বলে রাখা ভালো যে অর্ক তখন তার দূর-সম্পর্কের এক বোনের বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করত, বিভিন্ন চরাই উতরাই পার হয়ে তার বোনের বাড়িতে প্রত্যাবর্তনের গল্প এই নোট চলাকালীন কিছু খন্ডে পাবেন। নুপুর হচ্ছে অর্কের বোনের মেয়ে, সমবয়সীই বলা যেতে পারে।
“ওহ, আচ্ছা ঠিক আছে ” বলে হাটা শুরু করল অর্ক, পাশাপাশি হাঁটছে সিহা। জমিদারবাড়ি পার হয়ে যখন গ্রামের প্রধান মেঠোপথে উঠল ততক্ষনে নবরত্নগ্রামের গির্জা থেকে ৭ টা ঘণ্টা একে একে বেজে উঠল। গোধুলির আলো পশ্চিমের আকাশে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছিল; সময় গড়াচ্ছিল, সেই সাথে কমছিল একজোড়া কপোতের গন্তব্ব্যের দূরত্ব।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১১:৩৫