স্বাধীনতা। যেকোন জাতির জন্য বহুল আকাঙ্ক্ষিত একটি জিনিষ। ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন এবং ২৪ বছরের পাকিস্তানী শাসনের পর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর এসেছিলো আমাদের স্বাধীনতা। যদিও সত্যিকারের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা আজো আসেনি। কিন্তু সেটি ভিন্ন বিতর্ক।
আমরা হয়তো বেশিরভাগই জানিনা আমাদের স্বাধীনতা এসে পড়তে পারত ১৯৪৭ সালেই। ভারত-পাকিস্তান ভাগাভাগি হওয়ার ঠিক আগে 'স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা' সৃষ্টির প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার প্রথম প্রস্তাব উত্থাপন করেন বাংলার অবিসাংবাদিত নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি। ১৯৪৭ সালের ২৬শে এপ্রিল ইংরেজ বড়লাট মাউন্টব্যাটেনের সাথে এক সভায় এই প্রস্তাব তিনি উত্থাপন করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি তার এই পরিকল্পনার পক্ষে সমর্থন সৃষ্টির জন্য মাউন্টব্যাটেনের কাছ থেকে দুমাস সময় চেয়ে নেন। মাউন্টব্যাটেন তাকে জানান যে তিনি দেশ বিভাগের বিরুদ্ধে, তবে ঐক্যবদ্ধ ভারত না হলে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবকেই তিনি অগ্রাধিকার দেবেন। ঐদিনই কায়েদে আজম জিন্নাহর সাথে সাথে মাউন্টব্যাটেনের এক বৈঠক হয়। সে বৈঠকে তিনি জিন্নাহকে জানান সোহরাওয়ার্দি তাকে বলেছেন যে ভারত বা পাকিস্তান কারো সাথে যোগ দেবে না এই শর্তে অবিভক্ত বাংলা থাকা সম্ভব। জিন্নাহ ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব সমর্থন করেন।
সেসময় ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় নির্ধারিত ছিল ১৯৪৮ সালের জুন মাস। কিন্তু পরবর্তীতে মাউন্টব্যাটেন জাতীয়তাবাদী নেতা ভি কে কৃষ্ণমেননকে বলেন ভারত কমনওয়েলথে যোগদান করলে ক্ষমতা হস্তান্তর ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে এগিয়ে আনা যাবে। ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসেও মাউন্টব্যাটেন এবং বাংলার তৎকালীন গভর্নর বারোজের মধ্যে বাংলার ভবিষ্যৎ কি হবে সেটা নিয়ে মতভেদ ছিলো। মে মাসে তাঁদের দুজনের মধ্যে দিল্লীতে দীর্ঘ আলোচনা হয়। মাউন্টব্যাটেন ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবের আলোকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার পক্ষপাতী ছিলেন। গভর্নর বারোজের প্রস্তাব ছিল কোলকাতাকে দুই বাংলার কোনটার অন্তর্ভুক্ত না করে একে স্বাধীন আন্তর্জাতিক বন্দর হিসেবে ঘোষণা করা। মহাত্মা গান্ধী দ্বিতীয়বার নোয়াখালী যাবার পথে '৪৭ সালের ৯ মে কোলকাতায় আসলে তাঁর সাথে অবিভক্ত বাংলার অন্যতম মূল প্রস্তাবক শরৎচন্দ্র বসু আলোচনা করেন। তাঁর পরের দিন মুসলিম লীগ নেতা আবুল হাশিম মহাত্মা গান্ধীর সাথে অবিভক্ত বাংলার প্রস্তাব নিয়ে আলাপ করেন। তিনি বলেন যে অবিভক্ত বাংলা পাকিস্তান ঘেঁষা হবে অথচ বাংলার সংস্কৃতি সমগ্র ভারতীয় সংস্কৃতির একটি অঙ্গ।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা সৃষ্টির জন্য ১৯৪৭ সালের ২০শে মে সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান পার্টির নেতা শরৎচন্দ্র বসুর বাড়িতে নেতা পর্যায়ে একটি ত্রিদলীয় আলোচনা সভা হয়। এ সভায় উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দি, মুহম্মদ আলী, ফজলুর রহমান, প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক আবুল হাশিম, আব্দুল মালেক, অবিভক্ত বাংলার কংগ্রেস পরিষদীয় দলের নেতা কিরণশঙ্কর রায়, সত্যরঞ্জন বক্সী এবং শরৎ বসু। এ সভায় আবুল হাশিম ও শরৎ বসু সবার সাথে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। কিরণশঙ্কর রায় কংগ্রেস পার্টির দলের ঘোষিত নীতির বিরোধিতা করে এই প্রস্তাবের সাথে যুক্ত হন। সোহরাওয়ার্দি ও আবুল হাশিম একইভাবে মুসলিম লীগের ঘোষিত নীতির বিরুদ্ধে কাজ করেন। তবে কমিউনিস্ট পার্টি স্বাধীন অবিভক্ত বাংলার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে।
এরপর ‘৪৭ সালের সালের ২৩ শে মে হিন্দু মহাসভার সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে একটি চিঠি লিখেন। এই চিঠিতে তিনি জিন্নাহর পাকিস্তানের দাবির বিপক্ষে বলেন, ভারত ভাগ হোক আর না হোক বাংলা আর পাঞ্জাবকে ভাগ করতেই হবে। ঐ পত্রে তিনি সার্বভৌম অবিভক্ত বাংলার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি লিখেন যে জিন্নাহর দাবি হল হিন্দু ও মুসলমান দুই স্বতন্ত্র জাতি, তাই মুসলমানদের নিজস্ব বাসভূমি ও রাষ্ট্র চাই। তাহলে বাংলার হিন্দুরাও দাবি করতে পারে তাদেরকে মুসলমান রাষ্ট্রে বাস করতে বাধ্য করা চলবে না। তিনি বলেন যে সার্বভৌম বাংলা কার্যত পাকিস্তানই হবে।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার প্রস্তাবকদের স্বাক্ষরিত চুক্তিপত্রের এক কপি শরৎ বসু মহাত্মা গান্ধীকে পাঠিয়ে তাঁর নির্দেশ কামনা করেন। মহাত্মা গান্ধী পাটনা থেকে লিখেন যে ব্রিটিশ কর্তৃক কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বাইরে কোনও তৃতীয় পক্ষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের সম্ভাবনা নেই। অতএব এরকম কোনও সিদ্ধান্ত এই দুই দলের সম্মতিতে হতে হবে। এ প্রসঙ্গে কংগ্রেসের মূল নেতা নেহরু বলেছিলেন - অবিভক্ত বাংলা যদি ভারত ইউনিয়নের সাথে যোগ দেয় তাহলে কংগ্রেসের আপত্তি নেই। শরৎ বসু জিন্নাহর সাথেও এনিয়ে পত্রালাপ করেন। জিন্নাহ মুসলিম বিধায়কদের পাকিস্তানের পক্ষে ও বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে ভোট দিতে বলেন। মুসলিম লিগ চেয়েছিল বাংলা অবিভক্তভাবে পাকিস্তানের অংশ হবে। কিন্তু এই শর্ত পূরণ হয়নি। ফলে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের বিধায়করা বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ভোট দেয় এবং মুসলিম লীগের বিধায়করা খণ্ডিত পূর্ববঙ্গের পাকিস্তান অন্তর্ভুক্তি গ্রহণ করে নেয়।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার আরেকজন উদ্যোগী ছিলেন কংগ্রেস নেতা যোগেশচন্দ্র গুপ্ত। কিন্তু এঁরা কেউই শেষ পর্যন্ত তাঁদের লক্ষ্যে অবিচল থাকেন নি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি জিন্নাহর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিরণশঙ্কর রায় পূর্ব পাকিস্তান বিধান সভায় কংগ্রেসের দলনেতা হয়েছিলেন। কিন্তু পরে এই পদ ছেড়ে রাতারাতি বিধানচন্দ্র রায়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে যোগ দেন। কেবলমাত্র আবুল হাশিম এবং শরৎচন্দ্র বসু স্বাধীন বাংলার দাবীতে শেষ পর্যন্ত অটল ছিলেন।
( সূত্র : বৃহত্তর বাংলার ইতিহাস পরিচয় - ম. ইনামুল হক)
*********************************
দুর্ভাগ্য বাংলার, বাংলাদেশের। ইতিহাসের এত গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে যাঁদের উপর, যেসব নেতাদের উপর তার ভাগ্য নির্ভর করছিলো তাঁরা তার অখণ্ডতা যেমন ধরে রাখতে পারেননি , তেমনি তাঁরা তাকে স্বাধীন বাংলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতেও দেননি। অন্তত সোহরাওয়ার্দির মতো মুসলিম নেতারা যদি স্বাধীন বাংলার দাবীতে অটল থাকতো তাহলে হয়ত খণ্ডিত বাংলাও স্বাধীন দেশ হিসেবে সেই ১৯৪৭ সালেই আত্মপ্রকাশ করতে পারত। শুধু পারলোনা এদের হীনমন্যতা,সাম্প্রদায়িকতা আর বিশ্বাসঘাতকতার কারণে। এদের কারণে শুধু দেশটাই পিছায়নি, জাতিগতভাবে অনেক বছর পিছিয়ে গিয়েছি আমরা।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:৪৩