গ্যাস অমূল্য সম্পদ। আমাদের নিত্যদিনের রান্না-বান্না থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প কারখানা এবং যানবাহন চালানোর ক্ষেত্রে গ্যাসের অবদান অপরিসীম। কিন্তু কতদিন আমরা এই গ্যাস ব্যবহার করতে পারব? গবেষণা কিন্তু ভয়ের কথাই জানাচ্ছে আমাদের।
বর্তমানে বাংলেদেশে প্রতিবছর প্রায় ১ টি সি এফ গ্যাস ব্যবহার করে। সরকারি তথ্যমতে বাংলাদেশের জন্য আহরণযোগ্য গ্যাসের মজুদ রয়েছে প্রায় ১৬.৫৯ ট্রিলিয়ন ঘন ফুট বা ১৬.৫৯ টি সি এফ গ্যাস (২০১২ এর হিসাব অনুযায়ী) অথবা ২৬৪.৬ বিলিয়ন কিউবিক মিটার (২০১৪ এর হিসাব অনুযায়ী)। কোনও কোন সূত্রমতে এর পরিমাণ মাত্র ১৪.১৬ টি সি এফ। প্রতিদিন ২৭০০থেকে ৩০০ বিলিয়ন ঘনফুটের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ২.২৮ বিলিয়ন ঘনফুট এবং এর চাহিদা বছরে ১০% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে ২৩ টি গ্যাসফিল্ড এর অধীনে ৮০ টি গ্যাসকূপ উৎপাদনে নিয়োজিত আছে, যার মধ্যে ১৫ টি রাষ্ট্রয়ত্ব এবং বাকিগুলো আন্তর্জাতিক বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো উৎপাদন করে চলেছে। আন্তর্জাতিক কোম্পানি গুলোর মধ্যে শেভরন এবং কনোকোফিলিপস উল্লেখযোগ্য। দেশীয় কোম্পানিগুলোর মধ্যে তিতাস গ্যাস কোম্পানির হাতে আছে ৬.৩৬ টি সি এফ গ্যাস ( পেট্রোবাংলার সূত্রমতে) । ২০০৬ সালে পেট্রোবাংলা গ্যাস সেক্টর মাস্টার প্ল্যান হাতে নিয়েছিলো যা থেকে ভবিষ্যৎবানী করা হয় ২০১৬ সালে গ্যাস উৎপাদন সর্বোর্চ্চ পর্যায়ে পৌঁছবে এবং তারপরে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে। সর্বশেষ ২০১২ এর হিসাবে বলা হয়েছিলো গ্যাস আমরা আরও ১৮ বছর ব্যবহার করতে পারব (সে সময়ের হিসাবে), অর্থাৎ ২০৩০ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ আর ১৫ বছর। অপর একটি সূত্রমতে ২০২২ সাল পর্যন্ত বর্তমান মজুদ চলবে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই- ইলাহি চৌধুরীও বলে দিয়েছেন যে সামনে কঠিন দিন আসছে, ১৫ বছর পর দেশের গ্যাস একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যাবে ( প্রথম আলো, ২৭ অক্টোবর, পৃষ্ঠা ১২) ।
সুতরাং, এটা স্পষ্ট অদূর ভবিষ্যতে আমরা তীব্র গ্যাস সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছি। এর সাথে জ্বালানি নিয়ে আমাদের সরকার তথা রাষ্ট্রনায়কদের খামখেয়ালীপনা এবং চরম অদূরদর্শিতা সঙ্কটকে আরও তীব্র করার পথে নিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সাংবাদিক তুষার আব্দুল্লাহ একটি রিপোর্ট লিখেছেন যা থেকে জানা যায় যে, ২০০৫ সালে যখন মিয়ানমারের গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত নিতে পরিকল্পনা নেওয়া হয়, তখন বাংলাদেশের কাছে ত্রিদেশীয় পাইপলাইনে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব আসে। ভারতে জ্বালানি চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের উপকূলবর্তী গ্যাসফিল্ড থেকে পশ্চিমবঙ্গে গ্যাস নেওয়ার জন্য ২৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। ওই পাইপলাইন ভারতের ত্রিপুরা ভূখ- থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে রাজশাহী সীমান্ত দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকবে। এই প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের প্রতিবছর বিভিন্ন ফি বাবদ ২০ কোটি ডলার পাওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পটি ২০০৯ সালে চালু হওয়ার কথা ছিল। বলা হয়েছিল বাংলাদেশ প্রয়োজনে এই পাইপলাইন থেকে গ্যাস নিজ জাতীয় গ্রীডে নিতে পারবে।
কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সেই সময়ে তিনটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। শর্ত তিনটি হচ্ছে―এক. নেপাল ও ভুটান থেকে বাংলাদেশ জলবিদ্যুৎ আমদানির জন্য চুক্তিবদ্ধ হলে ভারত প্রয়োজনীয় ট্রানজিট সুবিধা দেবে। দুই. নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্ভাব্য স্থলবাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংযোগ সড়ক প্রদান করবে। তিন. বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বর্তমান বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস করার লক্ষ্যে ভারত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এই তিন শর্ত ভারত মেনে নেয়নি। আবার ভারত যেহেতু ত্রিপক্ষীয় আলোচনার চেয়ে ত্রিপক্ষীয় সংলাপে গুরুত্ব দেয় তাই মিয়ানমার থেকে আসা সেই পাইপলাইনে বাংলাদেশ আর যুক্ত হতে পারেনি। যদিও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট ও বিদ্যুৎ আমদানিসহ অনেক বিষয়ে সমঝোতা ও চুক্তি হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ গ্যাসের সম্ভাবনাময় উৎস থেকে বঞ্চিত থেকে গেল।
বাংলাদেশের জন্য আঞ্চলিক গ্যাস পাইপলাইন থেকে গ্যাসপ্রাপ্তির আরেকটি সম্ভাবনা হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল পাকিস্তান, তুর্কমেনিয়া গ্যাস পাইপলাইন। এই গ্যাস পাইপলাইনের দৈর্ঘ ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটারের বেশি। শুরু হচ্ছে তুর্কমেনিয়ার পূর্ব দিকে, যেখানে রয়েছে বৃহত্তম গ্যাস উত্তোলন ক্ষেত্র ও পৌঁছবে পাক-ভারত সীমান্তে ফাজিলকা নামের সীমান্তে। ভারতের যে জ্বালানি ক্ষুধা, তাতে তারা সেই পাইপলাইনের দিকে হাত বাড়িয়ে রেখেছিল অনেক আগ থেকেই। তাই তারা সেখান থেকে গ্যাস পাবে। কিন্তু বাংলাদেশ এই পাইপলাইনের বিষয়ে দৃষ্টি দেয়নি। ফলে এখন আর সম্ভাবনা নেই সেখান থেকে গ্যাস পাওয়ার।
তবে এখন আরেকটি সম্ভাবনা রয়েছে সামনে। ইরানের গ্যাসক্ষেত্র থেকে একটি পাইপলাইন পাকিস্তান হয়ে ভারত পর্যন্ত আসছে। ইরানের ভূখণ্ডে ইতিমধ্যে ৯০০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। প্রতিদিনই এই পাইপলাইন দিয়ে ইরান ২ কোটি ১৫ লাখ কিউবিক মিটার গ্যাস রপ্তানি করবে। এই গ্যাস পাইপলাইন বাংলাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত করা সম্ভব। পাকিস্তান ও ভারতের সঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতার মোড়কে বাংলাদেশ এই সুবিধাটি নিতে পারে। এক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা এখন থেকেই জোরদার করা প্রয়োজন। সুদূর ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বলা যায়, এটি আগামী কয়েক দশকের জন্য গ্যাস নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সুবর্ণ সুযোগ। এবার হেলা করলে বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে বিপদে পড়তে হবে।
প্রাথমিক জ্বালানি গ্যাসের অভাবে বাংলাদেশ এই মুহূর্তে তার প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) তার অনেক বিদ্যুৎ ইউনিটকে সচল রাখতে পারছে না গ্যাস ঘাটতির জন্য। সার কারখানা বন্ধ রেখে চালু রাখা হচ্ছে বিদ্যুৎ ইউনিট। শিল্প কারখানায় দীর্ঘদিন গ্যাস সংযোগ বন্ধ ছিল। আবার উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের পরিকল্পনা করেছে সেখানেও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু যেখানে প্রতিদিন গড়ে যে সাড়ে সাত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে এর প্রায় আশিভাগই আসছে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে।
দেশে এই মুহূর্তে প্রতিবছর গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে এক ট্রিলিয়ন ঘনফুট। প্রমাণিত মজুদ ১৪.১৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। কেবল এই পরিসংখ্যান অনুসরণ করলেই বলা যায়, প্রাথমিক জ্বালানি গ্যাস দ্রুতই ফুরিয়ে যাচ্ছে। আগামী ১৫ বছর পর গ্যাস শূন্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যে উপায়ে এই মুহূর্তে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে, অর্থাৎ বিবিয়ানা, তিতাস গ্যাসফিল্ডের মতো ৩-৪টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে সক্ষমতার চেয়ে বেশি গ্যাস তোলা হচ্ছে, এতে যেকোনো সময় বিপর্যয়ের ঝুঁকি থেকে যায়।
পাইপলাইনের বাইরে নিজস্ব উৎস থেকে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে সমুদ্র থেকে। স্থলভাগে গ্যাসপ্রাপ্তির নানা উল্লাস শোনা গিয়েছিল সাম্প্রতিককালে। পরে দেখা গেছে যতটা গর্জন আসলে গ্যাস তার তুলনায় ছিটেফোঁটা। এখন সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান করবে কে? দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে শক্তিশালী করার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সমুদ্র থেকে গ্যাস উত্তোলনের কারিগরি শক্তি তার নেই, হওয়ার সম্ভাবনাও কল্পনাপ্রসূত। অতএব বিদেশি কোম্পানির কাছেই যেতে হবে। সমঝোতা চুক্তি হয়েছে কিন্তু তারপর আর অগ্রগতি নেই। অথচ সবার জানা একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের পর থেকে উত্তোলনে দশ বছর প্রয়োজন হয়। তাই সমুদ্রের গ্যাস অনুসন্ধান বিষয়ে গড়িমসি করার সুযোগ নেই।
জ্বালানি নিরাপত্তার আরেক উৎস কয়লা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতার দোলাচলে বাংলাদেশ প্রায় এক দশক ধরে। ২০০৫ সালেই বলা হয়েছিল ২০০৮ সালের পর স্থাপিত সব বিদ্যুৎ কেন্দ্র হবে কয়লাভিত্তিক। কিন্তু ফুলবাড়ি কয়লাক্ষেত্র কোন উপায়ে উত্তোলিত হবে এ নিয়ে কোনো সরকারই সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি। ২০১০ সালের এনার্জি মাস্টারপ্ল্যানে বলা হয়েছিল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার উৎসের ৫০ ভাগ স্থানীয়, বাকি ৫০ ভাগ মেটানো হবে আমদানি থেকে। এখন ২০১৫ সালের এনার্জি মাস্টারপ্ল্যানে বলা হচ্ছে ১০০ ভাগেরই উৎস হবে আমদানি করা কয়লা। অর্থাৎ নিজেদের কয়লা অব্যবহৃত থেকেই যাচ্ছে। জ্বালানি নিরাপত্তার বিকল্প আরেকটি উৎস হিসেবে চিন্তা করা হচ্ছে লিকুয়িড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি)। প্রতি এক হাজার ঘনফুট এলএনজির আমদানি মূল্য দাঁড়াবে ১২ মার্কিন ডলার। এই দরে গ্যাস এনে বিদ্যুৎ উৎপাদন বা শিল্প উৎপাদন কতটা বাজার সহায়ক হবে?
এমনিতেই এখন দেশের অনেক জায়াগায় গ্যাস পৌঁছায়নি। যেসব জায়াগায় গ্যাস পৌঁছেছে সেসব জায়গাতেও অনেক সময় গ্যাসের সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। দেশের শিল্প-কারখানার অনেকগুলোই গ্যাসের অভাবে ঠিকমতো চলতে পারছে না। জ্বালানি নিরাপত্তায় দেশের অবস্থান অত্যন্ত নাজুক। আবার অন্যদিকে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার ৭০ – ৮০ শতাংশই উৎপাদন হচ্ছে গ্যাস থেকে। এটা ঠিক যে গ্যাসের মতো জ্বালানি একসময় সব দেশেই ফুরিয়ে যাবে। তবে কথা হচ্ছে আমাদের দেশে এ ব্যাপারটা বেশ তাড়াতাড়ি ঘটবে। সবকিছু থেকে একটা জিনিষ স্পষ্ট যে আমরা মারাত্মক একটি বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে চলেছি।
যদি মনে করেন ১৫ বছর অনেক দূরের ব্যাপার, এখনই চিন্তা করার কোনও দরকার নেই, তাহলে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতে পারেন। সেক্ষেত্রে একটি কথা বলার আছে যে অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ থাকে না।
দেখুন
দেখুন
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:২৩