somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাবাকে জমের মত ভয় পাওয়া শেষ জেনারেশনও সম্ভবত আমরাই...

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ রাত ৮:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কতগুলো ব্যান্ড ভেঙে গেছে। নতুন গান আসবে না। নতুন এলবাম আসবে না। আইয়ুব বাচ্চু মারা গেল। বেজবাবা অসুস্থ। জেমসের বয়সও তো কম হয়নি। মাইকেল জ্যাকসান মারা গেছে বহু দিন। চেস্টার বেনিংটন সুইসাইড করলো চোখের সামনে। নতুন ফানি ভিডিও বানাবে না আর মিস্টার বিন। হিথ লেজারকে আর কোনোদিন জোকার চরিত্রে দেখা যাবে না। শাহরুখ, সালমান, আমির বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। শৈশবের হিরোরা এখন ফানি লাগে। অসুস্থ কন্টেন্টে ভরপুর ফেসবুক আর চালাতে ভালো লাগে না। আব্বু আম্মুর বয়স হয়ে যাচ্ছে। অসুস্থ থাকে। আম্মু আগের মত রান্না করার অবস্থায় নেই। প্রেশার, ডায়াবেটিস, হার্টে সমস্যা। আব্বু রিটায়ার্ড করেছে। অফিসে না গিয়ে সারাদিন বাসায় থাকলেও আর আগের মত ভয় লাগে না। ভাই বোন যার যার মত থাকে। একসাথে হাসি আনন্দ অথবা মারামারি, কোনোটাই হয় না।

আক্ষরিক অর্থেই আমরা এই পৃথিবীর সবচাইতে ভাগ্যবান জেনারেশন। নব্বইয়ের মাঝামাঝি থেকে দুই হাজার পাঁচ- ছয় সাল অব্দি আমরা যারা শৈশব কাটিয়েছি এই বাংলাদেশে তারা কি পাইনি! তিন গোয়েন্দা আর ‘দীপু নাম্বার টু’ পড়া দিয়ে শুরু। কিশোর মুসা রবিন আর জীনার সাথে আমাদের কী ভীষণ বন্ধুত্ব! তারপর একটু বড় হতেই মাসুদ রানার রোমাঞ্চকর জগতে প্রবেশ। সাথে এক হাতে বাংলা সাহিত্য এবং নাট্যজগত অন্যরকম ভালোলাগায় গড়ে দেয়া সেই মানুষটা। হিমু, মিসির আলী, শুভ্র, জহির, মুহিব, অপলা, জরী, তিলু, নীলু থেকে শুরু করে বাকের ভাই, মজিদ, টুনি, তিতলী- কঙ্কা, চৌধুরি খালেকুজ্জামান, চ্যালেঞ্জার, ফারুক, ডাক্তার এজাজ, রিয়াজ, স্বাধীন খসরু, সূবর্ণা মুস্তফা, হুমায়ূন ফরিদী, শাওন। আমরা সবকিছু পড়েছি, দেখেছি, হেসেছি, কেদেছি, ভালোবেসেছি। রোনালদো, রোনালদিনহো, জিদানের শেষটা দেখতে না দেখতেই প্রবেশ করেছি মেসি- রোনালদোর অতিমানবীয় জগতে। বছরের পর বছর ধরে কি দূর্দান্ত প্রতিযোগিতা, হাজার অর্জন, সবকিছু ছাড়িয়ে যাওয়া ম্যাজিক আর মুগ্ধতা। রাতদিন কত আলোচনা সমালোচনা ঝগড়া আর তর্ক।

অতিমানবীয় শচিন টেন্ডুলকারে শ্রেষ্ঠ সময় দেখেছি, শেষটা দেখেছি। অস্ট্রেলিয়ার অপ্রতিরোধ্য টিমের খেলা দেখেছি। লারা, ম্যাকগ্রা, ওয়াসিম আকরাম, মুরালী, শেন ওয়ার্ন,সাঙ্গাকারাকে দেখেছি। তারপর প্রবেশ করেছি বিরাট কোহলির পারফেকশনের জগতে। প্রবেশ করেছি সাকিব-তামিম-মাশরাফির যুগে। একটা নড়বড়ে দলকে চোখের সামনে মাথা উচু করে দাঁড়াতে দেখছি। আমি নিশ্চিতকরে বলতে পারি কোনো একদিন বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিতে নিলেও জয়ের তীব্র আবেগটা থাকবে না। আমাদের সময়েই তো শুরুটা হচ্ছে। জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, বেজবাবা, আর্টসেল, শিরোনামহীন, মাইলসের সবচাইতে সুন্দর সময়ের সাক্ষী আমরা। একের পর এক দূর্দান্ত গানে ভেসে যাওয়া জেনারেশন আমরা। আমরাই একমাত্র যারা বখে যাওয়া শৈশবে না, যৌবনের শেষের ক্লান্তিতেও না, খুব বেশি সহজলভ্য ইন্টারনেট যুগে প্রবেশ করেছি তারুণ্যে উজ্জ্বল সময়ে।

গুগল, ইউটিউব, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম সবকিছু পেয়েছি। স্মার্টফোনে অসাধারণ সব ফিচার পেয়েছি। শাহরুখ- সালমান- আমিরের সময়ের মানুষ আমরা। সিনেমা দেখার ঠিকঠাক বয়সে আমরা হাতের কাছে পাচ্ছি দুনিয়ার সমস্ত সিনেমা কয়েক মিনিটে ডাউনলোড করে দেখার সুযোগ। আইএমডিবি রেটিং খুজে ফরেস্ট গাম্প, বিউটিফুল মাইন্ড, শশাঙ্ক রিডেম্পশান, ইন্টারস্টেলার দেখে মুগ্ধ হওয়ার সৌভাগ্য। আমাদের সময়ে সিনেমা বানাচ্ছে ক্রিস্টোফার নোলান নামের একজন মানুষ। আমরা সিনেমা শেষ করে তব্দা খেয়ে বসে থাকছি। শৈশবের সব সুপার হিরো নিয়ে পর্দায় এসেছে জাস্টিস লীগ আর এভেঞ্জার্স ইনফিনিটি ওয়্যার।

আমরা কি ভীষণ ভাগ্যবান একটা জেনারেশন। আমাদের গর্ব করার কত কিছু আছে। নস্টালজিক হওয়ার কত স্মৃতি আছে। আবেগে ভেসে যাওয়া কত মুহূর্ত আছে। মুগ্ধতায় ডুবে যাওয়া কত সৃষ্টি আছে। মায়ের হাতের সুস্বাদু খাবার খাওয়া শেষ জেনারেশন বোধহয় আমরা। বাবাকে জমের মত ভয় পাওয়া শেষ জেনারেশনও সম্ভবত আমরাই। নাম না জানা অসংখ্য সুস্বাদু পিঠেপুলি আর কয়টা শীতের সকালে খাওয়া হবে কে জানে!

কটকটি আর হাওয়ায় মিঠাই পাওয়া যেত ভাঙ্গারি জিনিসপত্রের বিনিময়ে।পাপড় ভাজা কতই না সস্তা ছিল।চার আনার চকলেটগুলো এখন রুপকথার মত।দাদী নানীর ভৌতিক গল্পগুলো কতই না ভয় পেতাম।হয়ত এখন আর ভয় নেই...

টিভিতে আলিফ লায়লা, সিন্দাবাদ, রবিনহুড, গডজিলা শুরুর মিউজিক বাজলে আমাদের বুকের রক্ত যেভাবে ছলকে উঠতো সেই তীব্র আনন্দ আজকের নারুটো আর ড্রাগন বল জি দেখা বাচ্চারা কোনোদিনও বুঝবে না। শুক্রবার নামের আবেগটা শেষ আমরাই বোধহয় অনুভব করেছি।

আমরা যেমন ভাগ্যবান ঠিক, সাথে সাথে আমাদের দূর্ভাগ্যও কি কম? ভাবতে গেলে আর ভাবনা চালিয়ে যাওয়া যায় না। তিন গোয়েন্দা তো শেষ হয়েই গেছে একরকম, মাসুদ রানা এখন কে লিখে তার ঠিক নেই। সেই স্বাদ পাওয়া যায় না। কাজীদা নব্বই বছর পার করে ফেলেছে, আর কদ্দিন? হুমায়ূন আহমেদ চলে গেছেন। সব বই পড়া শেষ, সব নাটক দেখা শেষ। ভাবতে গেলে কেমন লাগে! প্রথম আলোর সাথে সোমবারে আলপিন দেয় না। বৃষ্টি হলে কাগজের নৌকা ভাসাই না বহুকাল।

এখন আর আগের মত খোলা মাঠগুলো নেই। যেখানে সবাই ১-২ টাকা দিয়ে মোট ১৫ টাকা হলে এরোপ্লেন টেনিস বলটা কেনা হত। কেউ বল হারিয়ে ফেললে সবাই টাকা দাবি করত। কাগজের বল দিয়েও এখন আর কেউ ক্রিকেট খেলে না। কাদায় ফুটবল খেলা হয় না বহুবছর। মার্বেল মনে হয় আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম খেলেই নি। বরফ পানি, গোল্লাছুট, কাবাডি খেলাগুলোও ঐতিহ্য হারিয়েছে। কলাগাছের ভেলা তো আর দেখা যায় না। লাটিম ঘোরানো বা ঘুড়ি উড়ানো ছিল আবেগের এক নাম। ঈদের আগের রাতে চাঁদ দেখার পর সবাই চিল্লায়ে এখন আর বলা হয় না..
"এক দুই সাড়ে তিন
কালকে হইল ঈদের দিন।"

আর অল্প কয়টা বছর। তারপর কোনোদিন ফুটবল মাঠে পায়ের ছোয়া পড়বে না মেসি-রোনালদোর। এই দুই অতিমানবের পায়ে সৃষ্টি হবেনা কোনো জাদুকরী মুহুর্ত। আর একটা বিশ্বকাপ। তারপর সাকিব, তামিম, মাশরাফিও কি বাংলাদেশের হয়ে মাঠে নামবে? ভাঙা পা নিয়ে দৌড়াতে গিয়ে কেউ আর পড়ে যাবে না, ভাঙা আঙুল নিয়ে কেউ দশ ওভার বল করবে না, হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে কেউ ব্যাটিংয়ে নেমে যাবে না। লিখতে গিয়ে এই মুহুর্তে আমার চোখে পানি চলে আসছে। পারফেক্ট মুশফিকের সাথে বিপদের বন্ধু মাহমুদুল্লাহ। এই পাঁচজন ছাড়া বাংলাদেশ মাঠে নেমেছে সেটা আমরা কিভাবে সহ্য করবো? কিভাবে!

আমরা একদিন হাজার হাজার স্মৃতি নিয়ে বুড়ো হয়ে যাবো। ভালো লাগা আর খারাপ লাগা দুই ধরনের স্মৃতির ওজনে ভারী হয়ে থাকবে আমাদের বয়সের বোঝা। কোনো এক ক্লান্ত সন্ধ্যার আলো আধারীতে বেলকনির বেতের চেয়ারে বসে আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাববো..
‘জীবনটা আসলে খারাপ ছিলো না!’
১০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত যেসব বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে…

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:০৭




মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত যেসব বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে…
১. প্রথমে বলেছেন মৃতদের পেটে কাটাছেড়ার ডাহা মিথ্যা। পরে স্বীকার করেছেন দাগ থাকে।
২. আশ্রমে বৃদ্ধদের চিকিৎসা দেয়া হয় না। কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) পক্ষ নিলে আল্লাহ হেদায়াত প্রদান করেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:৪২



সূরা: ৩৯ যুমার, ২৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৩। আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম হাদিস, যা সুসমঞ্জস্য, পুন: পুন: আবৃত। এতে যারা তাদের রবকে ভয় করে তাদের শরির রোমাঞ্চিত হয়।অত:পর তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগটা তো ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে গেলো :(

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৫৭



আমি আমার ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে। ব্লগটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ প্রথম আলো ব্লগ আমায় লেখালেখিতে মনোযোগী হতে শিখিয়েছে । সে এক যুগ আগের কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

লুঙ্গিসুট

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



ছোটবেলায় হরেক রঙের খেলা খেলেছি। লাটিম,চেঙ্গু পান্টি, ঘুড়ি,মার্বেল,আরো কত কি। আমার মতো আপনারাও খেলেছেন এগুলো।রোদ ঝড় বৃষ্টি কোনো বাধাই মানতাম না। আগে খেলা তারপর সব কিছু।
ছোটবেলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:২৫

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

ছবি কৃতজ্ঞতা: অন্তর্জাল।

একবার শাইখুল হাদিস মুফতি তাকি উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হল, জীবনের সারকথা কী? উত্তরে তিনি এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×